আল্লাহ্-রসূল বিরোধীরাই চির লাঞ্চিত
অধ্যক্ষ হাফেজ কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
اَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمْ عَذَابًا شَدِیْدًاؕ- اِنَّهُمْ سَآءَ مَا كَانُوْا یَعْمَلُوْنَ (۱۵) اِتَّخَذُوْۤا اَیْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوْا عَنْ سَبِیْلِ اللّٰهِ فَلَهُمْ عَذَابٌ مُّهِیْنٌ (۱۶) لَنْ تُغْنِیَ عَنْهُمْ اَمْوَالُهُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُهُمْ مِّنَ اللّٰهِ شَیْــٴًـاؕ- اُولٰٓىٕكَ اَصْحٰبُ النَّارِؕ-هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ (۱۷) یَوْمَ یَبْعَثُهُمُ اللّٰهُ جَمِیْعًا فَیَحْلِفُوْنَ لَهٗ كَمَا یَحْلِفُوْنَ لَكُمْ وَیَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ عَلٰى شَیْءٍؕ- اَلَاۤ اِنَّهُمْ هُمُ الْكٰذِبُوْنَ (۱۸) اِسْتَحْوَذَ عَلَیْهِمُ الشَّیْطٰنُ فَاَنْسٰىهُمْ ذِكْرَ اللّٰهِؕ- اُولٰٓىٕكَ حِزْبُ الشَّیْطٰنِؕ- اَلَاۤ اِنَّ حِزْبَ الشَّیْطٰنِ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ (۱۹) اِنَّ الَّذِیْنَ یُحَآدُّوْنَ اللّٰهَ وَرَسُوْلَهٗۤ اُولٰٓىٕكَ فِی الْاَذَلِّیْنَ (۲۰)
আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমা: (মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন) আল্লাহ্ তাদের জন্য কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন। নিশ্চয় তারা যা করে খুবই মন্দ। তারা নিজেদের শপথসমূহকে ঢাল স্বরূপ গ্রহণ করে নিয়েছে। অতঃপর তারা আল্লাহর পথে (মানুষকে) বাধা প্রদান করেছে। সুতরাং তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্চনাদায়ক শাস্তি। তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি আল্লাহর আযাব থেকে মোটেও তাদের বাঁচাতে পারবে না। তারা আগুনের অধিবাসী। তথায় তারা স্থায়ীভাবে থাকবে। যেদিন আল্লাহ্ তাদের সকলকে পুনরুত্থিত করবেন। তখন তাঁর (অর্থাৎ আল্লাহর) সম্মুখেও তারা তেমনই শপথ করবে, যেমন তোমাদের সামনে শপথ করেছে এবং তারা একথা মনে করছে যে, তারা কিছু করেছে। সাবধান, নিশ্চয় তারাই তো মিথ্যাবাদী, শয়তান তাদের উপর বিজয়ী হয়েছে। সুতরাং সে তাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে আল্লাহর স্মরণ। তারা শয়তানের দল। সাবধান, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত। নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরন করে তারা সর্বাধিক লাঞ্চিতদের অন্তর্ভূক্ত। [সূরা আল-মুজাদালাহ্, আয়াত-১৫-২০]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
اَعَدَّ اللّٰهُ لَهُمْ عَذَابًا شَدِیْدًاؕ الخ…
মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী ‘আল্লাহ্ তাদের অর্থাৎ মুনাফিকদের জন্য কঠোর শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন।’
এর ব্যাখ্যায় মুফাস্সেরিনে কেরাম উল্লেখ করেছেন, উদ্ধৃত আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মুনাফিক্বদেরকে কঠোর শাস্তির ভয় প্রদর্শন করেছেন। যারা দিনের বেলায় প্রকাশ্যে মু’মিনগণের সঙ্গে মেলামেশা ও সামাজিকতা রক্ষা করে। আর গোপনে অপ্রকাশ্যে কাফের-মুশরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রাখে অথচ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কাফের মুশরিক বেদ্বীনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা হারাম ও কুফরী। (নাউযুবিল্লাহ্)
কুরআনে করীমের পূর্ণাঙ্গ সূরা ‘আল-মুনাফিক্বুন’ এবং ‘আল-বাক্বারা’র প্রারম্ভিক وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَّقُوْلُوْ اَمَنَّا بِالله الخـ.. হতে পরপর তের আয়াত অবতীর্ণ করণসহ আরো বিভিন্ন সূরা আয়াত অবতীর্ণ করে আল্লাহ্ জগৎবাসীর সামনে মুনাফিকদের প্রকৃত ও পরিপূর্ণ স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছেন। যাতে মু’মিনগণ তাদের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন হয়। এরা ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ঘরের শত্রু স্বরূপ। প্রকাশ্য কাফের-মুশরিক, ইহুদীগণের চেয়ে বেশী ক্ষতিকর ও ভয়ঙ্কর।
তাই আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহ্ যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, লালনকর্তা, সর্বচাহিদার সংস্থানকর্তা, বিচারকর্তা ও প্রতিফল দাতা, তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করেছেন কঠিন শাস্তির। এটা এক প্রকারের تهديد তথা ভীতি প্রদর্শন। যাতে তারা এদের ঈমান-আক্বীদা পরিপন্থী ও আখেরাত বিধ্বংসী পাপাচার থেকে তাওবা করে বিরত থাকে।
ইসলাম পরকাল বিশ্বাস নির্ভর জীবন ব্যবস্থা, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন চরম ও পরম সহনশীল। জাগতিক জীবনে বান্দার হাতে ইচ্ছানুযায়ী কর্ম সাধনার সুযোগ ও ইখতেয়ার সোপর্দ করা হয়েছে। প্রতিদান-ফলাফল আখেরাতে প্রদত্ত হবে। পাপী-তাপী, অপরাধীদের তৎক্ষণাৎ পাকড়াও ও করা হয় না বরং অবকাশ দেয়া হয়। যাতে তারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহ্-রসূলের আনুগত্যে ফিরে আসে এ প্রত্যাশায়। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে বান্দা এতেই গোমরাহ্ ও পথভ্রষ্ট হয়।
لَنْ تُغْنِیَ عَنْهُمْ اَمْوَالُهُمْ وَ لَاۤ اَوْلَادُهُمْ…
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্সেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন মুনাফিকদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি তাদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে মোটেও রক্ষা করতে পারবে না। যাদের ভরসায় তারা জাগতিক জীবনে আল্লাহ্-রসূলের উপর ঈমান আনয়ন ও আনুগত্য করা থেকে বিরত রয়েছে।
উল্লেখ থাকে যে, যেসব বিষয় মানবকুলকে আল্লাহ্-রসূলের স্মরণ ও আনুগত্য হতে বিভ্রান্ত-বিমুখ করে তন্মধ্যে সর্ববৃহৎ দু’টি বস্তু-ধন সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি। তাই কুরআনে করীমের বিভিন্ন সূরায় অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন কাফির-মুশরিক, মুনাফিকদেরকে সম্পদ ও সন্তানের বিষয় উল্লেখ করে ভয় প্রদর্শন করেছেন। যার ভরসায় ও অহংকারে তারাও আল্লাহ্-রসূল আখেরাতের উপর ঈমান আনয়ন করেন বরং ঈমান-ইসলামের প্রচার-প্রসারের প্রতিরোধে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। সম্পদ-সন্তানের অহংকারে মত্ত হয়ে নিরীহ্ মুমিন-মুসলিমের উপর জুলুম-জ্বালাতনের স্টীম রোলার চালিয়েছে ধনবল ও জনবলে বলীয়ান হয়ে এসব সম্পদ কিংবা সন্তানাদি তাদেরকে পার্থিব বা পারলৌকিক জীবনের কোন অবস্থায় কোনরূপ আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। যেমন, রক্ষা করতে পারেনি অভিশপ্ত ফেরআউন, কারুন, হামান, নমরূদকে আল্লাহর আযাব-গযব থেকে। বাঁচতে পারেনি আল্লাহর সাজা-শাস্তি হতে আরবের অভিশপ্ত আবূ জাহেল, আবূ লাহাব কিংবা মুনাফিক্বরা। স্মর্তব্য যে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতির মহব্বত সর্বাবস্থায় নিন্দনীয় ও বর্জনীয় নয়, বরং এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকা কোন কোন অবস্থায় কেবল জায়েজই নয় ওয়াজিবও হয়ে যায়। সম্পদ আর সন্তানাদি যদি ঈমান-ইসলামের প্রচার-প্রসারের বড় অবলম্বনে পরিণত হয় আল্লাহ্-রসূলের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের নিশ্চিত ওয়াসিলায় গণ্য হয় এবং দিকরজনী, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় মানব কল্যাণে ও সমাজ উন্নয়নে ব্যয় হয়, তবে তা মহান আল্লাহর বড় নেয়ামত। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, অর্থ-বিত্তের অধিকারীরাই একমাত্র হজ্ব-যাকাতের ন্যায় ফরয ইবাদত আদায়ের সৌভাগ্য অর্জনে ধন্য হয়। আর্তের সেবায় আত্মনিয়োগ আর ক্ষুধার্তের মুখে অন্নের সংস্থান এর সুযোগ সম্পদশালীরাই লাভ করে থাকে। তাই সম্পদ আর সন্তানাদি মুমিনের জন্য পার্থিব-পারলৌকিক উভয় জীবনে কল্যাণকর। [তাফসীর-ই কুরতুবী ও নুরুল ইরফান]
اِنَّ الَّذِیْنَ یُحَآدُّوْنَ اللّٰهَ وَرَسُوْلَهٗۤ …
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্সেরিনে কেরামে উল্লেখ করেছেন যে, ইজ্জত আর লাঞ্চনার মালিক একমাত্র আল্লাহ। وتعز من تشاء وتذل তাই ইজ্জত লাভের এবং من تشاء লাঞ্চনা থেকে মুক্তির মানদন্ড হলো আল্লাহ্-রসূলের উপর ঈমান ও সামগ্রিক জীবনে আনুগত্য। এর কোন বিকল্প নেই। পক্ষান্তরে এর বিপরীতে যারা আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয় রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে পার্থিব জীবনের সর্বক্ষেত্রে তারাই চির লাঞ্চিত, অপদস্থ। মহান আল্লাহ্ সকলকে আমল করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: অধ্যক্ষ-কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর এফ ব্লক, ঢাকা।