অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব-ভালবাসা রাখা সর্বাবস্থায় হারাম নিষিদ্ধ

0
অমুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব-ভালবাসা রাখা সর্বাবস্থায় হারাম নিষিদ্ধ
অধ্যক্ষ হাফেজ কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
كَتَبَ اللّٰهُ لَاَغْلِبَنَّ اَنَا وَ رُسُلِیْؕ- اِنَّ اللّٰهَ قَوِیٌّ عَزِیْزٌ (۲۱) لَا تَجِدُ قَوْمًا یُّؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ یُوَآدُّوْنَ مَنْ حَآدَّ اللّٰهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ لَوْ كَانُوْۤا اٰبَآءَهُمْ اَوْاَبْنَآءَهُمْ اَوْاِخْوَانَهُمْ اَوْعَشِیْرَتَهُمْؕ- اُولٰٓىٕكَ كَتَبَ فِیْ قُلُوْبِهِمُ الْاِیْمَانَ وَاَیَّدَهُمْ بِرُوْحٍ مِّنْهُؕ – وَیُدْخِلُهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاؕ-رَضِیَ اللّٰهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُؕ- اُولٰٓىٕكَ حِزْبُ اللّٰهِؕ-اَلَاۤ اِنَّ حِزْبَ اللّٰهِ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ۠ (۲۲)
আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমা: আল্লাহ্ তা‘আলা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন যে, নিশ্চয় আমি (অর্থাৎ আল্লাহ্) বিজয়ী হবো এবং আমার রাসূলগণ, অবশ্যই আল্লাহ্ শক্তিধর, মহা সম্মানিত। আপনি পাবেন না ওই সব লোককে, যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে আল্লাহ্ ও পরকালের উপর এমনি যে, তারা বন্ধুত্ব রাখে তাদের সাথে, যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, যদিও তারা (অর্থাৎ বিরুদ্ধাচরণ কারীরা) তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা নিকটাত্মীয় লোক হয়। এরা হচ্ছে ওই সব লোক, যাদের অন্তরসমূহে আল্লাহ্ ঈমান অঙ্কিত করে দিয়েছেন এবং তাঁর নিকট থেকে ‘রূহ’ দ্বারা তাঁদের সাহায্য করেছেন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করবেন, যার তলদেশে নহরসমূহ প্রবহমান, যেথায় তারা স্থায়ী হবে। মহান আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এরাই আল্লাহর দল। মনে রেখ! আল্লাহর দলই সফলকাম। [সূরা মুজাদালাহ্, আয়াত-২১ ও ২২]

আনুষঙ্গিক আলোচনা
لَا تَجِدُ قَوْمًا یُّؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ ؕ الخ…
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্সেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন- বক্ষমান আয়াতে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মুমিনগণের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছেন বিশ্ববাসীর সম্মুখে। যাঁদের অন্তরজগতে আল্লাহ্-রাসূলের প্রতি ঈমান, দূঢ় আস্থা-বিশ্বাস, প্রেম-প্রীতি, ভক্তি-শ্রদ্ধা স্থান লাভ করে স্থায়ীভাবে, সেখানে আল্লাহ্-রসূলের বিদ্বেষী ও বিরুদ্ধবাদী কাফির-মুশরিকদের প্রতি কোনরূপ বন্ধুত্ব ভালবাসা কিংবা সমর্থন সম্মানবোধ স্থান পেতে পারে না কোন অবস্থায় কোন উদ্দেশ্যে। যদিও বেঈমানরা তাদের পিতা, ভাই কিংবা আত্মীয়-স্বজন হোক না কেন। আল্লাহ্-রাসূলের সাথে অকৃত্রিম প্রেম-প্রীতি ভালবাসা ও ঈমানী বন্ধনের কারণে তারা অমুসলিম আত্মীয়-স্বজনের সাথে সকল প্রকার জাগতিক ও আন্তরিক বন্ধন ও সম্পর্ক ছিন্ন করেদিন।

ইসলামের ইতিহাসের সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠতম মুমিন সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের মহিমান্বিত জীবনালেখ্যই যেন আলোচ্য আয়াতের বাস্তব তাফসীর। সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ উবায়দাহ্ ইবনুল র্জারাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উহুদ যুদ্ধে স্বীয় পিতা জাররাহ্কে হত্যা করেছিলেন। আমীরুল মুমেনীন সাইয়্যেদুনা আবূ বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বদর যুদ্ধের দিন আপন পুত্র আবদুর রহমানকে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য আহ্বান করেছিলেন। অবশ্য রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে ঐ মোকাবেলার জন্য অনুমতি দেননি। পরবর্তীতে হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবূ বকর ঈমান আনয়ন করে সাহাবীয়ে রাসূলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। আমীরুল মুমেনীন হযরত ওমর ফারূকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বদর যুদ্ধে স্বীয় মামা আস ইবনে হিসাম ইবনে মুগীরাকে হত্যা করেছিলেন। সাইয়্যেদুনা মুসআব ইবনে উমায়র বদর যুদ্ধে আপন ভাই আবদুল্লাহ্ ইবনে উমায়রকে হত্যা করেছিলেন এবং আমীরুল মুমেনীন সাইয়্যেদুনা মাওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, সাইয়্যেদুশ শুহাদা হামযাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত আবূ উবায়দাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কাফির সর্দার ওতবা, শায়বাহ ও ওয়ালীদ ইবনে ওতবাকে বদর যুদ্ধে কতল করেছিলেন। এরা সবাই তাঁদের নিকটাত্মীয় ছিল। আল্লাহ্-রাসূল ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কারণে তারা তাদেরকে হত্যা করেছিলেন। [তাফসীরে খাযায়েনুল ইরফান, তাফসীরে রুহুল বয়ান ও নঈমী শরীফ]
উদ্ধৃত আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে ইসলামী আইন শাস্ত্রবিশারদ ফক্বীহগণ এ বিধান রেখেছেন যে, তাদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব রাখা কোন মুসলমানের পক্ষে জায়েয হতে পারে না। তবে হ্যাঁ, জাগতিক কর্মকান্ডের প্রয়োজনে সহযোগিতা কিংবা প্রয়োজন মাফিক সাহচর্য ভিন্ন কথা, যার মধ্যে ফিসক তথা পাপ শক্তি বিজানু বিদ্যমান আছে, একমাত্র তার অন্তরেই কোন ফাসিক ও পাপাসক্তের প্রতি বন্ধুত্ব ও ভালবাসা থাকতে পারে। তাই রাসূলে আকরাম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে এভাবে দোয়া করতেন- اللهم لاتجعل لفاجر على يدًا অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাকে কোন পাপাসক্ত ব্যক্তির কাছে ঋণী করো না, তার কোন অনুগ্রহ যেন আমার উপর না থাকে। কেননা, সম্ভ্রান্ত মানুষ স্বভাবগত গুণের কারণে অনুগ্রহকারীর প্রতি বন্ধুত্ব ও ভালবাসা রাখতে বাধ্য হয়। কাজেই ফাসিকদের অনুগ্রহ কবুল করা তাদের প্রতি মহব্বতের সেতু। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই সেতু নির্মাণ থেকেও আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। [তাফসীরে কুরতুবী শরীফ]
কাফির-মুশরিক, অমুসলিমদের সাথে
সম্পর্ক স্থাপনের বিধান
কুরআনে করীমের আয়াত ও হাদীসে রাসূলের রেওয়ায়তের আলোকে ইয়াহুদী নাছারা, কাফির, মুশরিকসহ সকল অমুসলিম-বিধর্মীদের সাথে মুসলমানের موالات তথা আন্তরিক বন্ধুত্ব-ভালবাসা স্থাপন করা সর্বাবস্থায় হারাম-কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর এটা যৌক্তিকভাবে সম্ভবপরও নয় কারণ, মুমিনের মূল সম্পদ হচ্ছে আল্লাহ্ ও তাঁর প্রিয়তম রাসূলের সাথে মহব্বত-ভালবাসা, কাফির-মুশরিকসহ অমুসলিমরা হলো আল্লাহ্-রাসূলের শত্রু। যার অন্তরে কারও প্রতি সত্যিকার মহব্বত-বন্ধুত্ব আছে তার শত্রুর প্রতিও মহব্বত ও বন্ধুত্ব রাখা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভবপর নয়। এ কারণেই কুরআনে করীমের অনেক আয়াতে কাফিরদের সাথে বন্ধুত্বের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত বিধি-বিধান ব্যক্ত হয়েছে এবং যে মুসলমান কাফির-মুশরিকদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব রাখে তাকে কাফেরদেরই দলভুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে কুরআন করীমে। যেমন সূরা আলে- ইমরানে এরশাদ হয়েছে-
لَا یَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُوْنَ الْكٰفِرِیْنَ اَوْلِیَآءَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِیْنَۚ-وَ مَنْ یَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَلَیْسَ مِنَ اللّٰهِ فِیْ شَیْءٍ اِلَّاۤ اَنْ تَتَّقُوْا مِنْهُمْ تُقٰىةًؕ-
অর্থাৎ মুমিনগণ যেন অন্য মুমিন ব্যতীত কোন কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে (অর্থাৎ কাফির মুশরিককে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে) আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশংকা কর। (তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে।) [সূরা আল-ই ইমরান, আয়াত-২৭] یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوْا بِطَانَةً مِّنْ دُوْنِكُمْ لَا یَاْلُوْنَكُمْ خَبَالًاؕ-وَدُّوْا مَا عَنِتُّمْۚ-قَدْ بَدَتِ الْبَغْضَآءُ مِنْ اَفْوَاهِهِمْ ﭕ وَ مَا تُخْفِیْ صُدُوْرُهُمْ اَكْبَرُؕ-
অর্থাৎ- হে মুমিনগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তোমাদের অমঙ্গল সাধনে ত্রুটি করে না। তোমরা কষ্টে থাক, তাতেই তাদের আনন্দ শত্রুতাপ্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই প্রকাশ পেয়েছে। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে আছে তা আরো অনেক গুণ বেশী জঘন্য। [সূরা আল-ই ইমরান, আয়াত-১১৮] يَا اَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَتَّخِذُوا الْیَهُوْدَ وَ النَّصٰرٰۤى اَوْلِیَآءَ بَعْضُهُمْ اَوْلِیَآءُ بَعْضٍؕ-
অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, অবশ্য সে তাদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা মায়েদা, আয়াত-৫১] উপরিউক্ত আয়াতসমূহের মর্মবাণীর আলোকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, ইহুদী-নাছারা, কাফির-মুশরিকসহ সকল অমুসলিমের সাথে মুমিন-মুসলিমের আন্তরিক বন্ধুত্ব-ভালবাসা স্থাপন সর্বাবস্থায় হারাম, কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ্ আমাদেরকে হেফাজত করুন।
তবে معاشرات ومعاملات তথা সামাজিক সদাচার ও সৌহার্দমূলক সম্পর্ক রাখা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, ইজারা, চাকুরী, শিল্প ও কারিগরী ক্ষেত্রে সম্পর্ক স্থাপন করা সব অমুসলমানের সাথে জায়েয। তবে এতে যদি মুসলমানদের ক্ষতি হয়, তবে জায়েয নয়। রাসূলে আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদীন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম এবং অন্যান্য সাহাবীগণ কর্তৃক গৃহীত কর্মপন্থা-এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। ফিক্বহ্শাস্ত্র বিশারদগণ এ কারণেই যুদ্ধরত কাফিরদের হাতে সামরিক অস্ত্র-শস্ত্র বিক্রয় করা নিষিদ্ধ করেছেন। এমনিভাবে বাহ্যিক সচ্চরিত্রতা ও সৌহার্দ্যমূলক ব্যবহার করা সব ধর্মাবলম্বীদের সাথে জায়েয রয়েছে। যেহেতু আল্লাহ্ কুরআনে করীমে এরশাদ করেছেন-حسنا وقولوا للناس অর্থাৎ সর্ব মানুষের সাথে সুন্দর ও সদ্ব্যবহার করো। তবে এর উদ্দেশ্য অতিথির আতিথেয়তা অথবা অমুসলমানকে ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে অবহিত করা অথবা তাদের অনিষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করা হতে হবে।
লেখক: অধ্যক্ষ-কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর এফ ব্লক, ঢাকা।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •