প্রকৃত মুমিন মাযার যিয়ারত প্রত্যাশী
অধ্যক্ষ মাওলানা নুরুন্নবী রহমানী
প্রত্যেক প্রাণীই মরনশীল। আল্লাহর নবী রাসুলগণ সহ ওলীগণ নির্দিষ্ট সময় আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যূর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। আমাদের পেয়ারা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সব মাখলুকের প্রাণ, তিনিও ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে এ ধরা পৃষ্ঠে শুভাগমন করে ৬৩ বছর ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করে ১১ই হিজরী ১২ই রবিউল আউয়াল ৬৩২ খ্রীষ্টাব্দে ৮জুন সোমবার ওফাত লাভ করেন। তিনি মক্কা শরীফে শুভ বেলাদত লাভ করে মদিনা শরীফে ওফাত বরণ করেন। তাঁর নূরানী শরীর মোবারকে যে মাটিগুলো লেগে আছে, তার মর্যাদা আরশ আযীমের চাইতেও অনেকগূণ বেশী মর্যাদাবান। তামাম জাহান আজ তাঁর কাছে ঋণী। হুজুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যে পবিত্র ভূমিতে (মদিনা শরীফে) তাশরীফ রাখছেন সেটা রওজা আত্বহার নামে অভিহিত। তাঁর পাক রওজা যিয়ারত করে যে কোন মুমিন মুসলমান হন চির ধন্য। সেই সৌভাগ্যশীল মুমিন মুসলিমের জন্য পেয়ারা নবীর সুপারিশ অবধারিত। সত্যিই তিনি হবেন জান্নাতী।
মানুষ মারা গেলে তাকে যে মাটিতে দাফন করা হয় তা স্বাভাবিক ভাবে গোর বা কবর নামে অভিহিত। যা ইসলামী আকাইদগত ভাবে আলমে বরযখ নামে পরিচিত। তবে সকল মানুষের দাফন স্থলকে কবর বলা আদব নয়; বরং বিশেষ বিশেষ মুমিন-মুসলমানের দাফন স্থানকে সৌজন্যতার খাতিরে মাযার বলা হয়। কেউ বা সমাধিও বলে থাকে। তবে ওলীগণের কবরকে স্বাভাবিক ভাবে আমরা মাযার বলে থাকি। কিন্তু আল্লাহর নবী-রাসূলগণের কবরকে ঈমান আক্বিদা ও আদবের স্বার্থে আমরা রওজা মোবারক বলে থাকি। এটাই চির সিদ্ধ কথা।
আখিরাতের প্রথম স্টেশন কবর থেকেই শান্তি-মুক্তি কিংবা আযাবের কার্যক্রম শুরু হয়। কবর জগতে যেসব সাধারণ মুসলমান আছেন তাদের নাজাতের জন্য আমরা কবর যিয়ারত করি। আবার নবী-ওলীদের মাযার যেয়ারত করে তাদের শান-মান বৃদ্ধির জন্য আমরা দোয়া-মুনাজাত করি। এতে কবরবাসীদের যেমন উপকার, তেমনি তাঁদের দোয়া লাভ করে আমরাও হই ধন্য। উল্লেখ্য কবরবাসীর দোয়া-কবুল। পবিত্র কোরআন করীমের সূরায়ে ত্বাকাছুরে কবর যিয়ারতের বিষয়ে সবিশেষ উল্লেখ রয়েছে।
হাদীস শরীফেও কবর যিয়ারতের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন: “আমি তোমাদেরকে ইতিপূর্বে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে তোমরা কবর যিয়ারত করতে থাক, কেননা এতে তোমাদের মনে আখিরাতের চিন্তা-ভাবনা সঞ্চিত হবে।”
আমাদের নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাঁর মাতা-পিতার কবর যিয়ারত করেছেন, এমনকি তিনি প্রতি বছর শোহাদায়ে ওহুদের কবর যিয়ারত করেছেন। বিগত দেড় হাজার বছর ধরে মক্কা-মদিনা শরীফের মেহমানবৃন্দ হারামাইন শরীফাইনের কবরসমূহ যিয়রত করে আসছেন। এ ধারা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। বাতিলপন্থীদের কোন চক্রান্ত কখনো সফল হবে না; বরং মুমিন-মুসলিমগণ যিয়ারত নামক ইবাদত পালন করে লাভবান হবেন এটাই চিরন্তন সত্য।
যিয়ারত নামক এ ইবাদত পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অসংখ্য সাহাবী কর্তৃক পালন করার বিবরণ হাদীস শরীফে এসেছে। আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মি’রাজের রাতে হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম এর পরামর্শে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম এর জন্মস্থান বেতেলহামে দু’রাকাত নামাজ সহ যিয়ারত কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। সুতরাং যিয়ারত নামক ঐ আত্মিক ইবাদত প্রত্যেক সুষ্ঠু আকি¦দা সম্পন্ন মুমিন-মুসলমানগণ প্রাণভরে পালন করে থাকেন। আমাদের পূর্ব মুরুব্বিগণও কবর-মাজার ও রওজা যিয়ারত করে এসেছেন। ওফাত প্রাপ্তদের রূহানী ফুয়ুযাত হাসিলের মাধ্যমে দো’জাহানের সমৃদ্ধি অর্জন করেন। এমর্মে আমাদের আকাবিরের যিয়ারতের ধারাবাহিকতার ফিরিস্তি আমাদের মনে প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। আমাদের মহান ইমাম ইমামে আ’যম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হি নবীজি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লা-এর রওজা মোবারক যিয়ারত করেছেন জীবনে ৫৫ বার। ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলায়হি কোন জটিল মাসআলায় আটকে গেলে সুদুর ফিলিস্তিন থেকে ইরাকের কুফা নগরীতে অবস্থিত ইমাম আযম রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর মাযার শরীফ যিয়ারত করে তাঁর উসিলা দিয়ে দোয়া ও মুনাজাত করতেন, এতে তাঁর জটিল মাসআলা ‘হল’ (সমাধান) হয়ে যেত। এভাবে এ জগতে মুমিন-মুসলিমগণ নবী-ওলীগণের মাযার-রওজা যিয়ারত করে বিশ্ব মুসলিমকে একটি মহতি ইবাদতের পথ প্রশস্ত করেছেন। এহেন ইবাদত করে লাখো-কোটি মুসলিম উপকৃত হয়েছেন বলে অগণিত প্রমাণ রয়েছে।
প্রিয় পাঠককুল, একটু ভেবে দেখুন- যিয়ারত পাগল বান্দাগণ সারা বিশ্বের বিভিন্ন নবী-ওলীর মাযার প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন। ইরাকের বাগদাদ শরীফে অবস্থিত হযরত বড় পীর সৈয়দ মুহিউদ্দিন আব্দুল ক্বাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর মাযার, এশিয়ার উজবিকিস্তানে অবস্থিত ত্বরিক্বতের মহান পীর হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশ্ বন্দী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, ভারতের আজমীর শরীফে অবস্থিত খাজা মঈনুদ্দীর চিশতী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও ভারতের সিরহিন্দ শরীফে অবস্থিত হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি সহ বিশ্বের অনেক নবী-ওলীর মাযার যিয়ারত করে যাচ্ছেন। এই যে আমাদের দেশে ইসলাম প্রচারক হযরত শাহ জালাল ইয়ামেনী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত শাহ পরান রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাযার যিয়ারতে দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ মুসলিম ওই সব ওলীর দোয়া অর্জনে ধন্য হচ্ছেন।
বস্তুতঃ মাযার যিয়ারতে রয়েছে এক মহা আকর্ষণীয় শক্তি। প্রত্যেক মুসলমান তার মা-বাবা, দাদা-দাদী, নানা-নানী, পীর-ওস্তাদগণের কবর যিয়ারত করেন। বাংলাদেশের আউলিয়া নগর চট্টগ্রামে হযরত আমানত শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত বদর শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত মীরজান শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত মোহসেন আউলিয়া রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হবিগঞ্জের মুড়ারবন্দ নামক স্থানে ১২০ জন হযরত শাহ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর সাথী আউলিয়া কিরাম শায়িত আছেন। তন্মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমে প্রলম্বিত আছেন হযরত সিপাহ-সালার নাসিরুদ্দিন রহমাতুল্লাহি আলায়হি। তাঁদের মাযার যিয়ারত করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজন দো’জাহানের সমৃদ্ধি হাসিল করেন।
এখনো বিশ্বের অনেক মুমিন-মুসলমান শোহাদায়ে বদর, ওহুদ ও কারবালার যিয়ারত করেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। প্রত্যেক মুমিন-মুসলমান মনে করেন আল্লাহর নবী-রাসুলগণ ইন্তেকাল করলেও তাঁদের মাযারসমূহ আমাদের জীবন ধন্য করার মত এক মস্ত বড় নিয়ামত। মানুষ সুখে-দুঃখে ওলীগণ ও তাঁদের মুরুব্বিদের কবর-মাযার যিয়ারত করে আল্লাহর রহমত, বরকত ও নিয়ামত হাসিল করছেন। বিশেষ করে সমূদ্রের ঝড়-তুফান, টর্ণেডো ও জলোচ্ছাসের মুহূর্তে আমাদের দেশের বেতার-টেলিভিশনগুলোতে ওলী-আউলিয়ার নামের গজলগুলো প্রচারিত হলে মানুষের মনে শ্রদ্ধার ভাব সৃষ্টি হয়। তাঁদের দোয়ার বরকতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি দেন। আমাদের দেশের অনেক মানুষ বিদেশ ভ্রমনের ইচ্ছে করলে, পাসপোর্ট-ভিসা সহজ প্রাপ্তিতে এমনকি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এবং নির্বাচনোত্তর সরকার গঠন করতে বা সকল সফলাতার শুকরিয়া প্রকাশে সিলেটের হযরত শাহ্ জালাল রহমাতুল্লাহি আলায়হি ও তাঁর ভাগিনা হযরত শাহ্ পরান রহমাতুল্লাহি আলায়হি, চট্টগ্রামে হযরত শাহ্ আমানত রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাযার শরীফ যিয়ারতে অংশ নিতে দেখা যায়। এটা কিন্তু একজন সুষ্ঠু আক্বিদাধারী তথা সুন্নি মুসলমানের দৃষ্টিতে অতি উত্তম আমল।
বাংলাদেশের অনেক মাযার শরীফ রয়েছে, ঐসব মাযার গুলোতে সুন্নত তরীকা অনুসরণে সারা বছর অনেক মুমিন-মুসলমান পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, ওজিফা পাঠসহ যাবতীয় নফল ইবাদত করে মোনাজাত ও ফাতেহা পাঠ করে থাকেন, এতে তাদের দো’জাহানের অনেক মুশকিল আসান হয়। আবার বিভিন্ন মাযারের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন বলে জানা যায়। কোন কোন মাযার মামলা-মোকদ্দমায় জয়ী, কোনটা রোগ-শোক থেকে পরিত্রাণ, কোনটা ইলম লাভ ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, কোনটায় আধ্যাত্বিক বিকাশ লাভের জন্য খ্যাতি আছে বলে জানা যায়। বিভিন্ন মাযারে গিয়ে অনেক লোক নানাভাবে উপকৃত হন বলে জানা যায়। পক্ষান্তরে নবী-ওলী বিরোধী চক্র মাযার সমূহের তীব্র সমালোচনা মূখর হতে দেখা যায়। এতে মাযারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল লোকদের মনে খুব ব্যথা পান সমালোচনাকারীদের মূর্খতা ও ভ্রান্ত আক্বীদার জন্য আফসোস হয়। একটি শরীয়তসম্মত বিষয়ের বিরুদ্ধে কথা বলা তাদের ধৃষ্ঠতা বৈ-কিছুই নয়!
ইদানিং মসজিদ-মাযার সংলগ্ন অনেক দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে দ্বীন ইসলামসহ অনেক সমাজ সেবার কার্যক্রম চলছে, যা সত্যিই প্রশংসার্হ।
নবী-ওলীগণ তাঁদের কবর-রওজাতে জীবিত আছেন। তাঁদের মাযার থেকে যিয়ারতকারীদের দেখেন, চেনেন ও জীবিতদের জন্য দোয়া করেন। এমনকি কোন কোন সময় তাঁরা জীবিতদের দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এটা হচ্ছে তাঁদের কারামত। আবহমান কাল থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক মাযার যিয়ারত করে জীবন ধন্য করেন মুসলমানগণ। অনেকে মাযারে খানা-পিনা ও তাবারুকের ব্যবস্থা করে ইসলামি সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন। আউলিয়া কেরামের মাযার যিয়ারতে শারীরিক-মানসিক শান্তি লাভের কথা সর্ব শ্রেনির মানুষের কাছে জানা যায়। পবিত্র কোরআনুল করীমের সূরায়ে ফাতেহার “ইহদিনাস সিরাত¦াল মুস্তাক্বিম’’-এর তাফসিরে নবীগণ-সিদ্দিক্বিন, শোহাদা ও সালেহীন বা আউলিয়ার কথা বলা হয়েছে এবং তাঁদের পথে পরিচালিত করার জন্য সারা বিশ্বের মুসলমানগণ মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছেন। তাই একজন প্রকৃত মুসলিম সদা নবী-ওলীগণের মাযার যিয়ারতে প্রত্যাশী। তাকে কেউ এহেন মহৎ কাজে বাধা দিতে পারে না। তাই কোন পথভ্রষ্ট গোষ্ঠির অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে সদা ইসলামী ত্বরীকা অনুযায়ী নবী-ওলীগণের মাযার শরীফ যিয়ারত করে দো’জাহানের কামিয়াবি হাসিল করব। আল্লাহ আমাদের সকলকে নবী-ওলীগণের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার খাস তওফীক দিন। আমীন, ছুম্মা আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, পাটোয়ার ফাযিল মাদরাসা, লাঙ্গলকোট, কুমিল্লা।