ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তানের অধিকার
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম
মানবজীবনের প্রতিটি বিষয়ে ইসলামের দিকনির্দেশনা রয়েছে। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার কর্তব্যের ব্যাপারেও ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পন করেছেন। সন্তান হলো পিতা-মাতার কাছে আল্লাহ প্রদত্ত আমানত। এ আমানত সম্পর্কে মাতা-পিতাকে সজাগ ও দায়িত্ববান হতে হবে। সন্তানদের বাহ্যিক প্রয়োজন পূরণের সঙ্গে সঙ্গে আত্মিক খোরাকের প্রতিও নজর রাখতে হবে। কেননা, এর গুরুত্ব প্রথমোক্তটির চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। দৈহিক চাহিদাকে পরিতৃপ্তি দিতে পারে কেবল আত্মা। পক্ষান্তরে দৈহিক চাহিদার অপূর্ণতা সত্ত্বেও আত্মা পারে সুখী হতে। ইসলাম তাই শিশুর উভয় চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচাও, যার ইন্দন হবে মানুষ ও পাথর। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাদেরকে আদব শিক্ষা দাও এবং ইলম শিখাও। পিতা-মাতার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হবে যদি সন্তানকে আদর্শবান রূপে গড়ে না তুলতে পারে। পিতা-মাতার উপর সন্তানদের যে হকগুলো রয়েছে তা আলোচনা করার প্রয়াস পেলম।
১. কানে আযান দেয়া
সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেয়া এবং বাম কানে একামত দেয়া, তা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। এটি পিতা-মাতার উপর এজন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যে, শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের আওয়াজ পৌঁছে দেয়া এবং ওত পেতে থাকা শয়তান যেন তার কোন ক্ষতি করতে না পারে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবূ রাফে রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কানে আযান দিতে দেখেছি।
২. সুন্দর নাম রাখা
বাচ্চার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। নাম অর্থবহ হওয়া নামের সৌন্দর্য। কেননা, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন।
৩. আক্বিকা করা
ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় হলো সন্তানের আকীকা করা। এ প্রসঙ্গে হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সকল নবজাতক তার আক্বিকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে।সন্তান ছেলে হলে দুটি ছাগল আর মেয়ে হলে একটি ছাগল দ্বারা আক্বীক্বা করবে।
৪. সদকা করা
ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সপ্তম দিবসে চুল কাটা এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকা করা সুন্নাত। নবীজি হযরত ফাতেমা বতুল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে ইরশাদ করেন, হে ফাতেমা ! তাঁর (হাসানের) মাথা মুন্ডন কর এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকা কর।
৫. খাতনা করা
ছেলেদের খাতনা করানো একটি অন্যতম সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমাম হাসান এবং হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার সপ্তম দিবসে খাতনা করিয়েছেন।
৬. তাওহীদ ও রিসালত শিক্ষা দেয়া
শিশু যখন কথা বলা আরম্ভ করবে তখন থেকেই আল্লাহর একাত্ববাদ ও নবীর রিসালত শিক্ষা দিতে হবে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বলেন, হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখাতে চাই। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, আল্লাহও তোমার হেফাযত করবেন। যখন কোন কিছু চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সহযোগিতা চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে।
৭. কুরআন মাজিদের শিক্ষা
ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দেয়া ফরয। ইরশাদ হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়। অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের সন্তানকে কুরআন শরীফ নাজেরা পড়ায়, তার আগের ও পরের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। আর যে সন্তানকে হাফেজ বানাবে, তাকে হাশরের ময়দানে পূর্নিমার চাঁদের মত উজ্জল করে উঠানো হবে, এবং তার মাতা-পিতার মর্যাদাওÍ বৃদ্ধি পাবে।
৮. নামায শিক্ষা দেয়া
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের নামাযের নির্দেশ দাও সাত বছর বয়সে। আর দশ বছর বয়সে নামাযের জন্য মৃদু প্রহার কর এবং শোয়ার স্থানে ভিন্নতা আনো।
৯. আদর-স্নেহ ও ভালবাসা দেয়া
সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসা প্রিয়নবীর সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে অন্যের প্রতি রহম করে না আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না।
১০. দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া
সন্তানকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া ফরজ । কারণ দ্বীনি ইলম না জানা থাকলে সে বিভ্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে। এ প্রসঙ্গে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন , প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয।
১১. সক্ষম করে তোলা
সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদ্বিয়ল্লাহু আনহু বলেন, নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন, তোমাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম।
১২. বিবাহ দেয়া এবং তালাকপ্রাপ্তা কন্যাকে আশ্রয় দান
সন্তান বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাকে বিবাহ দেয়া পিতার দায়িত্ব। সন্তান যখন যৌবনে পদার্পন করে তখন তার চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন ঘটে, তখন সে নতুন কিছুর সন্ধানে উন্মুখ হয়। সে যেকোন সময় বিপদগামী হতে পারে। তাই পিতার একান্ত উচিৎ উপযুক্ত পাত্র/পাত্রী নির্বাচন করে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করা। হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই পিতার দায়িত্ব হচ্ছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে। কোন কারণে কন্যা যদি স্বামী কর্তৃক পরিত্যাক্তা হয় কিংবা অসহায় হয়ে পড়ে, তখন পিতা সেই ভাগ্যাহতা কন্যাকে সাদরে গ্রহণ করে আশ্রয় ও ভরণপোষণের ব্যবস্থা করবে।
১৩. সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা
রাসূলল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে ইরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তাদের মাঝে ইনসাফ করো।
১৭. ইসলাম বিবর্জিত কাজ থেকে বিরত রাখা
ইসলাম অনুমোদন করে না এমন কাজ থেকে তাদেরকে বিরত না রাখলে এই সন্তানগনই কিয়ামাত দিবসে পিতা-মাতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ইরশাদ হচ্ছে, হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।
১৯. দোয়া করা
পিতা-মাতা সন্তানদের জন্য দোয়া করতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহর নেক বান্দা তারাই যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন, যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন।
পরিশেষে বলা যায়, পিতা-মাতা হলেন সন্তানের প্রথম অভিভাবক, প্রথম শিক্ষক। আর পরিবার তার প্রথম বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয় থেকে সে যা শিখবে, সেটার ওপর নির্ভর করবে তার ভবিষ্যত সুন্দর হওয়া না হওয়া। তাই এক্ষেত্রে পিতা-মাতাকে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে। পিতা-মাতার অবহেলায় অধিকাংশ সন্তান অকালে ঝরে পড়ে। অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায় তাদের জীবনবৃক্ষ। সন্তানের সুন্দর জীবন গঠনে তাই মা-বাবার সচেতনতা ও আন্তরিকতার বিকল্প নেই। সন্তানকে রক্ষা করার উপায় হলো, তার মাঝে বুদ্ধির উন্মেষ লক্ষ্য করা মাত্র উত্তমরূপে তাকে পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান করতে শুরু করবে। প্রতিপালনের প্রাথমিক অবস্থায় যদি শিশুর প্রতি অযত্নও অনাদর দেখানো হয়, তবে প্রায় ক্ষেত্রেই সে অসৎ স্বভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। শিশুর কোনো সুন্দর আচরণ বা প্রশংসনীয় কাজ চোখে পড়লে, তার প্রশংসা করতে হবে। তাকে খুশি করার মতো কিছু পুরস্কার দিতে হবে। মানুষের সামনে করতে হবে তার প্রশংসা। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে সে কিছু করলে প্রথমবারের মতো তা উপেক্ষা করতে হবে। গোপন রাখতে হবে; অন্যের সামনে প্রকাশ করা যাবে না। বিশেষত বাচ্চাটিই যখন চাইবে সেটিকে গোপন রাখতে। অন্যের কাছ থেকে আড়াল করতে। যদি দ্বিতীয়বার এ কাজের পুর্নাবৃত্তি করে, তবে তাকে গোপনেই শাসাতে হবে। বলে দিতে হবে, এমন কাজ তুমি দ্বিতীয়বার করা থেকে বিরত থাকবে। অন্যথায় মানুষের সামনে তোমাকে লজ্জা দেয়া হবে। তাকে শাসন করার সময় কখনো অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। এতে করে তার পক্ষে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার শোনা এবং মন্দ বিশেষণ হজম করা সহনীয় হয়ে উঠবে। পক্ষন্তরে তাকে খারাপে অভ্যস্ত করা হলে, তাকে পশুর ন্যায় অবহেলা করা হলে, সে হবে হতভাগ্য ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর এর দায় বর্তাবে তার কর্তা ও অভিভাবকের ওপর। বস্তুত সন্তান দা¤পত্য জীবনের কাঙ্খিত ফসল। তাই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভের জন্য তাদেরকে যথাযথভাবে গড়ে তোলা বাবা-মার দায়িত্ব। যাতে সৎ সন্তান হিসাবে তারা পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও তাদের জন্য আমল জারী থাকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩টি আমল বন্ধ হয় না-১. সদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দোয়া করে।আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে তাঁর নির্দেশ মতো সন্তান মানুষ করার তাওফীক দান করুন। আমিন! বিহুরমাতি সৈয়্যদিল মুরসালিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা, রাঙ্গুনিয়া
খতিব-রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।