মহিয়সী মহিলা সাহাবী হযরত সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব

0
মহিলা বিভাগ
মহিয়সী মহিলা সাহাবী
হযরত সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব
ফাতেমা তুত্ তাহেরা অপি
হযরত সাফিয়াহ্ বিনতে আব্দুল মুত্তালিব হলেন ইতিহাসের প্রসিদ্ধ এক বীরাঙ্গনা নারী-সাহাবী, যিনি রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ফুফু এবং হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়ামের মাতা। তিনি তৎকালীন ইসলামি আরব সমাজের একজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তাঁর বহু প্রশংসিত কবিতা ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে।
নাম ও বংশ পরিচয়
নাম সাফিয়া, পিতার নাম আবদুল মুত্তালিব, মাতার নাম হালাহ বিনতে উহাইব বিন আবদে মুনাফ। এ সূত্রে তিনি হযরত হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সহোদর বোন এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ফুফু ছিলেন। তিনি রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জন্মের বছর ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারে হাশেম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন।
ইসলাম গ্রহণ
ইবনুল আসির বলেছেন, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফুদের মধ্যে একমাত্র হযরত সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবনে সা’দ বলেছেন, তিনি ৬২২ খ্রি. তাঁর স্বামী হযরত আওয়ামের সাথে মদিনায় হিজরত করেন। এক সূত্রে জানা যায়, মক্কায় প্রথম ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি একজন। তিনি তাঁর স্বামী হযরত আওয়াম ও পুত্র হযরত যুবায়র একসাথে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর কুরাইশদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নুবূয়তের ৫ম বছরে সপরিবারে হাবশায় হিজরত করেন।
যুদ্ধে অংশগ্রহণ
হযরত সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধের সময় নারী ও শিশুদেরকে প্রসিদ্ধ কবি হাস্সান ইবনে সাবিতের দুর্গে নিরাপত্তার জন্য রেখে যান। এ দুর্গকে ‘উতুম দুর্গ’ বলা হতো। নিরাপত্তায় থাকা নারীদের মধ্যে হযরত সাফিয়াও ছিলেন। তিনি ছিলেন দুঃসাহসী। খন্দক যুদ্ধের সময় তিনি এক ইহুদীকে দুর্গের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে দেখেন। তখন তিনি নিরাপত্তার স্বার্থে কৌশলের সাথে তাকে হত্যা করেন। হযরত উরওয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর বীরত্ব সম্পর্কে বলেন, হযরত সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সেই অকুতোভয় নারী যে একজন পুরুষ শত্রুকে হত্যা করে তার কর্তিত মাথা কিল্লার সাথে ঝুলিয়ে দেন। ফলে শত্রুরা ভীত হয়ে পড়ে।
উহুদের যুদ্ধে তাঁর অবদান বেশি। যখন মুসলিম সৈন্যরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পালাচ্ছিলেন, তখন তিনি তাঁদেরকে একত্র করার চেষ্টা করেন। এ যুদ্ধে তাঁর সহোদর ভাই হযরত হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নির্মভাবে শহীদ হন। নবী-ই আকরামের সাথে তিনি মদিনা মুনাওয়ারাহ্ হতে প্রায় ১৬/১৭ শত মাইল দূরে সংঘটিত তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সেখানে ২০ জন নারীর নেতৃত্ব দেন। তিনি পারদর্শিতার সাথে প্রতিটি পদক্ষেপ ও কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর সাঁড়াশি অভিযান ইহুদীদের বেসামাল করে ফেলেছিলো।
বিবাহিত জীবন
হযরত সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা প্রথমে হারিস ইবনে হারবকে বিবাহ্ করেন। সাফি ইবনে হারিস তাদের সন্তান। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন হযরত আওয়াম ইবনে খুয়াইলিদ। তাঁদের সন্তানরা হলেন হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম, সাইয়িব, আব্দুল কাবা। তাঁর স্বামী আওয়াম ইবনে খুয়াইলিদ ছিলেন উম্মুল মু’মিনিন হযরত খাদিজাতুল কোবরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার সহোদয় ভাই। তিনি তাঁর সন্তান যুবাইরকে প্রহার করতেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন, ‘‘আমি তাকে এ জন্যেই প্রহার করি; যাতে সে মেধাবী ও যুদ্ধের ময়দানে একজন সাহসী রণবীর হয়। হযরত সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার জীবন-জীবিকার জন্য রসূল-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম খায়বার বিজয়ের পর সেখানে উৎপাদিত ফসল হতে বার্ষিক ৪০ ওয়াসাক্ব শস্য নির্ধারণ করে দেন।
কাব্য প্রতিভা
হযরত সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব কুরাইশ গোত্রে হাশেমী শাখার একজন মহিলা কবি ও সুভাষিণী ছিলেন। তিনি আরবী ভাষায় বেশ পারদর্শী ছিলেন। তিনি অবাধ গতিতে কবিতার শ্লোক বলতেন। সে সব শ্লোক হতো চমৎকার ভাব বিশিষ্ট, প্রাঞ্জল ও সাবলীল, সত্য ও সঠিক আবেগ-অনুভূতি সম্পন্ন এবং চমৎকার বীরত্ব ও সাহসিকতায় পরিপূর্ণ। বর্ণিত আছে, তিনি তার ছোট্ট শিশু সন্তান যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে কোলে নিয়ে শ্লোক শোনাতেন।
হযরত সাফিয়ার কতিপয় শোক কথন
হযরত সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তৎকালিন প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। অনেকে তাঁকে কুরাইশ বংশের খানসা উপাধি দিয়েছেন। [আল-ইসাবা-৪/৩৪৯] পিতা আবদুল মুত্তালিবের ইন্তেকালের পর স্বীয় বোনদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে স্বরচিত শোকগাথাঁ পাঠ করেন, যা বহু গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। [নিসা মিন আমরিন নুবুওয়াহ-৪১৯] রসূল-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর তিনি একটি শোকগাথাঁ রচনা করেন। তা হল- ‘‘হে আমার চক্ষু! অশ্রু বর্ষণ ও রাত্রি জাগরণের ব্যাপারে বদান্যতা দেখাও। একজন সর্বোত্তম মৃত, হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির জন্যে বিলাপ কর।
প্রচন্ড দুঃখ-বেদনা সহকারে মুহাম্মদ আল-মুসতাফার স্মরণে বিলাপ কর। যে দুঃখ-বেদনা অন্তরে মিলে মিশে একাকার হয়ে তাকে ঠেস দিয়ে বসানো রোগগ্রস্ত ব্যক্তির মত করে দিয়েছে।
আমার জীবনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, যখন তাঁর সেই নির্ধারিত মৃত্যু এসে যায়,
যা এখন একটি মহা সম্মানিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে।
তিনি ছিলেন মানুষের প্রতি কোমল,
দয়ালু ও সর্বোত্তম পথ প্রদর্শক। জীবন ও মৃত্যু সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ তাঁর প্রতি সদয় থাকুন এবং সেই চিরন্তন দিনে আল্লাহ্ তাঁকে দান করুন জান্নাত।’
[সিয়ারু আলান আন-নুবালা, ২/২৭১, হায়াতুস্ সাহাবা-৩/৩৪৭-৩৪৮] উহুদ যুদ্ধে হযরত হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাতের পর তাঁর স্মরণে একটি কবিতা রচনা করেন। তা হল-
‘‘আর আপনার উপর এমন একটি দিন এসেছে,
যে দিনের সূর্য অন্ধকার হয়ে গেছে, অথচ তা ছিলো আলোকোজ্জ্বল। [আল ইসাবা-৪/৩৪৯]
ইন্তেকাল ও দাফন
হযরত সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ফারুকে আ’যম হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাসনামলে ২০ হিজরীতে ৭৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে জান্নাতুল বাক্বিতে হযরত মুগিরা ইবনে শু’বার বাড়ির আঙ্গিনায় অজুখানার পাশে দাফন করা হয়।
হযরত সাফিয়া বিনতে আবদুল মুত্তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কোনো সাধারণ নারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন মহিলা সাহাবি, যাঁর সাহসিকতা, বীরত্ব, কাব্য-প্রতিভা সবকিছুই অতুলনীয়। তাঁর জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত বর্তমান নারী সমাজের জন্য শিক্ষণীয়। তাঁর যুদ্ধে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে অসামান্য সাহসিকতা কাফের-ইহুদীদের পরাজিত করেছে। আজ বিশ্বের ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা আছে। মহান রাব্বুল আলামিন, তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলায় সাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে জান্নাতের উচ্চ মক্বাম নসীব করুন। এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করুন। আমিন।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •