আল্লাহর মারেফাত লাভই বান্দার জন্য বড় সাফল্য

0

আল্লাহর মারেফাত লাভই বান্দার জন্য বড় সাফল্য

অধ্যক্ষ হাফেজ কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
سَبَّحَ لِلّٰهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيْمُ -لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ -هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ – هُوَ الَّذِيْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنْزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ -لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِلَى اللهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ –

আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমা: (মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন) আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে যা কিছু নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে রয়েছে এবং তিনিই শক্তিধর, ও প্রজ্ঞাময়। তারই জন্য নভোমন্ডল ও ভূমল্ডলের রাজত্ব। তিনি জীবন দান করেন আর মৃত্যু ঘটান এবং তিনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশমান, তিনিই গোপন এবং তিনিই সব বিষয়ে সম্যক অবগত। তিনিই (সেই স্বত্ত্বা) যিনি নভোমন্ডল ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অত:পর আরশের উপর ইস্তিওয়া করেছেন। (যেমনই তাঁর জন্য শোভা পায়) তিনি জানেন যা ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা ভূমি থেকে নির্গত হয় । আর যা আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয় এবং যা তাতে আরোহণ করে। আর তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাক এবং তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখেন। তাঁরই জন্য নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব এবং আল্লাহরই প্রতি সকল কর্মের প্রতাবর্তন।(সুরা আল-হাদীদ, ১-৫ নং আয়াত)

আনুষঙ্গিক আলোচনা
مسبّحات সূরা সমূহ। মুফাচ্ছেরীনে কেরাম বর্ণনা করেছেন কুরআনে কারীমের যেসব সুরা سَبَّحَ কিংবা يُسَبِّحُ দ্বারা শুরু করা হয়েছে হাদিসে নববী শরিফে এসব সুরাকে مسبّحات তথা তাসবীহ যুক্ত সূরা বলে অভিহিত করা হয়েছে। এসব সূরার মধ্যে প্রথম হলো, সুরা আল-হাদীদ, দ্বিতীয়- সূরা আল-হাশর, তৃতীয় সূরা আস-ছফ, চতুর্থ-জুমআহ এবং পঞ্চম- সূরা আত-তাগাবুন। সাহাবীয়ে রাসূল সাইয়্যেদুনা হযরত ইরবায বিন সারিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসূলে আকরাম নূরে মুজাসসাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রাতে ঘুমানোর পূর্বে এসব সূরা তেলাওয়াত করতেন। (আবু দাউদ, তিরমিজী ও নাসায়ী শরীফ)
উল্লেখ্য যে, ‘তাসবীহ’ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যথা প্রথমত: তাসবীহে এতেক্বাদী তথা বিশ^াস বা আকীদাগত তাসবীহ আর তা হলো মহান আল্লাহ রাববুল আলামীনকে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসুন্দর-আশোভন ও আপত্তিকর সকল বৈশিষ্ট্য থেকে পূত-পবিত্র-নিস্কলুষ বলে বিশ^াস বা আক্বিদা পোষণ করা। দ্বিতীয়ত: তাসবীহ ক্বাওলী তথা-মৌখিকভাবে মহান আল্লাহর পবিত্রতম স্বত্ত্বা ও গুনাবলীকে সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি হতে পূত-পবিত্র বলে ঘোষণা করা। আলোচ্য সুরার শুরুতে উল্লেখিত তাসবীহ দ্বারা তাসবীহে ক্বাওলীকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে বিদ্যমান সকল প্রাণী ও প্রাণহীন বস্তু মহান আল্লাহর পবিত্রতা পরিশুদ্ধি বর্ণনা করে। তৃতীয়ত: তাসবীহে ক্বাহরী তথা বাধ্যগতভাবে মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও গুনগান বর্ণনা করা। (তাফসীরে নুরুল ইরফান)

هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ الخ এর বিশেষ ফজিলত ও বিশদ ব্যাখ্যা
সাহাবীয়ে রাসুল সাইয়্যেদুনা হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া (রা.)-এর রেওয়ায়তে রাসূলে কারীম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, مسبّحات তথা তাসবীহ যুক্ত সূরা সমূহের মধ্যে একটি আয়াত এমন আছে যা হাজার আয়াত থেকে শ্রেষ্ঠ। ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর তাফসীরে ইবনে কাছীরে উল্লেখ করেছেন, সেই শ্রেষ্ঠ আয়াতটি হচ্ছে সুরা আল-হাদীদ এর নি¤েœাক্ত আয়াত
هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
মুফাসিসরকুল সরদার সাইয়্যেদুনা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেন কোন সময় অন্তরে মহান আল্লাহ ও ইসলাম সম্পর্কে শয়তানি কুমন্ত্রণা দেখা দিলে هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ আয়াতখানা পাঠ করো, শয়তানী প্ররোচনা দূরীভুত হয়ে যাবে। (তাফসীরে মাযহারী ও ইবনে কাছীর)
উদ্ধৃত আয়াতের তাফসীর এবং আউয়াল, আখের, যাহের এবং বাতেন-এর ব্যাখ্যায় মুফাসেসরীনে কেরাম অনেক অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এসব অভিমতের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই সবগুলোরই অবকাশ আছে। ‘আউয়াল’ শব্দের অর্থ তো প্রায় নির্দিষ্ট, অর্থাৎ অস্তিত্বের দিক দিয়ে সকল সৃষ্টজগতের অগ্রে ও আদি। কারণ, তিনি ব্যতীত সবকিছু তাঁরই সৃজিত। তাই তিনি সবার আদি। কোন কোন তাফসীরকারকের মতে আখের এর অর্থ এই যে, সবকিছু বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও তিনি বিদ্যমান থাকবেন। যেমন, كل شئ هالك الا وجهه আয়াতে এর সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। বিলীনতা দুই প্রকার। প্রথমত: যা কার্যত: বিলীন হয়ে যায়। যেমন, কেয়ামতের সময় সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত: যা কার্যত বিলীন হয় না, কিন্তু সত্ত্বাগত বিলীন হওয়ার আশংকা থেকে মুক্ত নয়। এরূপ বস্তুকে বিদ্যমান অবস্থায়ও ধ্বংসশীল বলা যায়। এর উদাহরণ জান্নাত ও জাহান্নাম এবং এগুলোতে প্রবশেকারী ভাল-মন্দ মানুষ। তাদের অস্তিত্ত্ব বিলীন হবে না। কিন্তু বিলীন হওয়ায় আশংকা থেকে মুক্তও হবে না। একমাত্র আল্লাহর সত্ত্বাই এমন যে, পূর্বেও বিলীন ছিল না এবং ভবিষ্যতেও কখনো বিলীন হবে না, তাই তিনি সবার অন্ত।
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, মহান আল্লাহর মারেফত সবার শেষে হয়। এই দিক দিয়ে তিনি আখের তথা অন্ত। মানুষ জ্ঞান ও মারেফাতে ক্রমোন্নতি লাভ করতে থাকে। কিন্তু মানুষের অর্জিত এসব স্তর আল্লাহর পথের বিভিন্ন মনযিল বৈ নয়। এর চুড়ান্ত ও শেষে সীমা হচ্ছে আল্লাহর মারেফাত। (তাফসীরে রুহুল মায়ানী)
‘যাহের’ বলে সেই সত্ত্বা বোঝানো হয়েছে, যেসব বস্তু অপেক্ষাকৃত অধিক প্রকাশমান। প্রকাশমান হওয়া অস্তিত্বের একটি শাখা। অতএব আল্লাহর অস্তিত্ব যখন সবার উপরে ও অগ্রে তখন তাঁর আত্মপ্রকাশ ও সবার উপর হবে। জগতে তাঁর চাইতে অধিক কোন বস্তু প্রকাশমান নয়। তাঁর প্রজ্ঞা ও শক্তি-সামর্থ্যের উজ্জ্বল নিদর্শন বিশ্বের প্রতিটি কণায় কণায় দেদীপ্যমান।
আবার মহান আল্লাহ দলীলাদি দ্বারা এমনি যাহের বা প্রকাশ্য-সকল স্তরের মানব ও অণু-পরামানু পর্যন্ত তাঁকে চিনে, জানে ও মান্য করে। কিন্তু তাঁর মহান সত্ত্বা এবং এর প্রকৃত স্বরূপ এমনি গোপন যে, বিবেক বুদ্ধি সে পর্যন্ত পৌছতে পারে না, তাই তিনি বাতেন বা অপ্রকাশ্য। উল্লেখ্য যে, জান্নাতে মহান আল্লাহ রাববুল আলামীনের দীদার হবে। কিন্তু ‘ইদরাক’ তথা দৃষ্টির সীমায় আয়ত্ব করা সম্ভব হবে না। কেননা, তিনি অপ্রকাশ্য সত্ত্বা তথা বাতেন। এক কথায় তাঁর জ¦ালওয়া বা জ্যোতি প্রকাশ্য আর মহান সত্ত্বা অপ্রকাশ্য। (নুরুল ইরফান শরীফ)
শায়খে মুহাক্কিক আলাল ইতলাক আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি মাদারেজুন্নবুওয়াত” কিতাবের ভুমিকায় বলেছেন, আলোচ্য আয়াতের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তথা আউয়াল, আখের, যাহের, বাতেন এবং সব বিষয়ে সম্যক অবগত। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের শানেও এগুলো প্রযোজ্য। কারণ, তিনি সৃষ্টিতে সর্বপ্রথম আর আত্ম প্রকাশে সর্বশেষ। নুরে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সবার নিকট প্রকাশ্য আর হাকীকতে মুহাম্মদীয়াহ পর্যন্ত কোন মানবের বিবেক বুদ্ধি পৌছতে পারে না। তিনি প্রত্যেক মুমিন ও কাফেরকে চিনেন-জানেন।(নুরুল ইরফান শরীফ)

লেখক: অধ্যক্ষ-কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর এফ ব্লক, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •