বিসমিল্লাহ্ শরীফের ফযীলত ও বরকত
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُل ُّ اَمْرٍ ذِىْ بَالٍ لاَ يَبْدأَ فِيْهِ بِبِسْمِ اللهِ فَهُوَ اَبْتَرُ [رواه ابوداود والنسائى وابن ماجه ]
অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রত্যেক ভাল কাজ যেটা বিসমিল্লাহ্ দ্বারা শুরু করা হয়না সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। [আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ্]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
উক্ত হাদীস শরীফে বিসমিল্লাহ্ শরীফের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এটি পবিত্র কুরআনের একটি পূর্ণ আয়াত। পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবা ব্যতীত অন্যান্য সকল সূরা বিসমিল্লাহ্ দ্বারা আরম্ভ করতে হবে। কলেমা শরীফ, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) পাঠ করা যেভাবে উত্তম যিকর, তেমনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পাঠ করাও আল্লাহর মাকবুল ও উত্তম যিকর।
[মনোয়ারুল বয়ান, খন্ড-৩, পৃ.-১৩২]
প্রত্যেক ভাল ও বৈধ কাজ বিসমিল্লাহ্ শরীফ দ্বারা শুরু করা মুস্তাহাব কিন্তু অবৈধ নাজায়িয ও হারাম কাজ বিসমিল্লাহ্ শরীফ দ্বারা করা নিষেধ। মদপানের সময়, যিনা-ব্যভিচারের সময়, জুয়া খেলা, চুরি, ডাকাতি করার সময় বিসমিল্লাহ্ পাঠ করা কুফরী। [ফতোয়ায়ে আলমগীরি]
খাবারের সময় বিসমিল্লাহ্ পাঠ করার বরকত
প্রতিটি ভালো কাজে বিসমিল্লাহ্ পাঠে বরকত ও রহমত রয়েছে, বিসমিল্লাহ্ পাঠ ব্যতীত কাজ বরকত শূন্য হয়।
যে খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ্ পড়া হয় এতে শয়তান অংশ নিতে পারে না। বিসমিল্লাহর বরকতে খাবারসমূহ নূর হয়ে পেটে প্রবেশ করে। বিসমিল্লাহ্ পাঠ ব্যতীত খাবার খাওয়ার পরও ক্ষুধা অবশিষ্ট থেকে যায়। [আনোয়ারুল বয়ান, ২য় খন্ড, পৃ. ১৩২]
হাদীস শরীফে রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-
اِذَا اَكَلَ اَحَدَكُمْ نَنْسِىَ اَنْ يُذْكَرَ اللهَ عَلى طَعَامِه فَلْيَقُلْ بِسْمِ اللهِ فِىْ اَوَّلَهُ وَاخِرِه
অর্থ: তোমরা খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ্ পড়া ভুলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্র পড়ে নিবে। বিসমিল্লাহ্ ফী আউয়ালিহি ওয়া আখিরিহি। [তিরমিযী শরীফ, খন্ড-২, পৃ.৭, ইবনে মাযাহ্, পৃ.২৩৫]
বিসমিল্লাহ্ পড়ে সকলে মিলে খাবারের বরকত
এক সাহাবী নবীজির দরবারে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! খাবারের পরও আমার ক্ষিধা অবশিষ্ট থেকে যায়, পরিতৃপ্ত হই না, নবীজি এরশাদ করেন সম্ভবতঃ তুমি একা খেয়ে থাকো, সাহাবী জবাব দিলেন, জী, হ্যাঁ, আমি একা আহার করে থাকি, নূর নবীজি এরশাদ করলেন-
اِجْتَمِعُوْا عَلى طَعَامِكُمْ وَاذْكُرُوْا اِسْمَ اللهِ تَعَالى يُبَارِكُ لَكُمْ فِيْهِ
সকলে এক সাথে খাবার খাও, খাবারে বিসমিল্লাহ্ পাঠ করো, তোমাদের খাবারে বরকত হয়ে যাবে।
[সুনানে ইবনে মাযাহ্, পৃ. ২৩৬, কানযুল উম্মাল, খন্ড-১৫, পৃ. ১০৩]
প্রত্যেক মুসলমান নিজ স্ত্রীর নিকট বিশেষ মুহূর্তে গমনের পূর্বে বিসমিল্লাহ্ শরীফ পাঠ করলে শয়তানের প্রভাব থেকে পবিত্র থাকবে। যে সন্তান জন্ম নেবে সেই নেককার ও পূণ্যবান হবে। [আবু দাউদ শরীফ, খন্ড-২, পৃ. ২৯৩]
মাওয়াহিবে লুদুনীয়া শরীফে উল্লেখ আছে, হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা স্ত্রী সম্ভোগের সময় বিসমিল্লাহ্ শরীফ পড়ে নিলে গোসল না করা পর্যন্ত ফিরিস্তাগণ সওয়াব লিখতে থাকবেন। [আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড-৩, পৃ. ১৩৪]
বাহনে আরোহণের সময় বিসমিল্লাহ্ পড়া
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন তোমরা বাহনে আরোহন করবে, ‘বিসমিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্’ পাঠ করবে, এতে প্রতি কদমে নেকী প্রাপ্ত হবে। [মাওয়াহিবে লুদুনীয়া]
বাহনযোগে যাতায়ত ও ভ্রমণের সময় বিসমিল্লাহ্ শরীফ পাঠ করলে বিভিন্ন বিপদাপদ ও দুর্ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম নৌযানে আরোহণের সময় বিসমিল্লাহ্ পাঠ
বিসমিল্লাহ শরীফ পাঠ করা নবীদের সুন্নাত। হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম জাহাজে আরোহণের সময় দুআ পাঠ করেছিলেন, ‘বিসমিল্লাহি মাজরীহা ওয়া মুরসাহা ইন্না রাব্বী লাগাফুর রাহীম।’ বিসমিরøাহর বরকতে আল্লাহ্ তা‘আলা মহাপ্লাবন থেকে নৌযান রক্ষা করেছেন।
যে ব্যক্তি সামুদ্রিক জাহাজে আরোহণের সময় এ দুআ পাঠ করবে আল্লাহ্ তাকে সমুদ্রে ডুবে যাওয়া ও বিপদ থেকে বাঁচাবে।
[তাফসীরে নাঈমী, খন্ড-১ম, কৃত. হাকিমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহ.]
বিষপানে প্রতিক্রিয়া হলোনা
সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সত্যতা প্রমাণের জন্য প্রিয় রসূলের সাহাবী হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিকট কোন এক ব্যক্তি শর্ত আরোপ করল, আপনি যদি এ বিষ পান করে সুস্থ থাকতে পারেন, আমি ইসলামের সত্যতা স্বীকার করে কলেমা পড়ে মুসলমান হয়ে যাব। হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বিসমিল্লাহ্ শরীফ পড়ে লোকটির কথামতো বিষপান করার পরও কোন প্রতিক্রিয়া হলোনা, সম্পূর্ণরূপে সুস্থ ছিলেন। হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদের এ কারামত দেখে লোকটি ইসলাম কবুল করলেন। [তাফসীর নাঈমী, খন্ড-১ম]
বাদশাহ্ হিরাক্লিয়াসের মাথা ব্যথা দূরীভূত হলো
পবিত্র কুরআন সকল রোগের মহৌষধ। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-
وَ نُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْاٰنِ مَا هُوَ شِفَآءٌ وَّ رَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِیْنَۙ-
অর্থ: এবং আমি ক্বোরআনের মধ্যে অবতীর্ণ করি ওই বস্তু যা ঈমানদারদের জন্য আরোগ্য ও রহমত। [সূরা বনী ই¯্রাঈল: আয়াত-৮২
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত আমিরুল মুমেনীন ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নিকট একদা রোম সা¤্রাজ্যের বাদশাহ্ হিরাক্লিয়াস পত্র লিখলেন, আমিরুল মু’মিনেীন, আমি প্রচন্ড মাথা ব্যথায় ভুগছি আপনি একটু আমার চিকিৎসা করুন, খলিফাতুল মুসলেমীন বাদশাহর কাছে একটি টুপি প্রেরণ করলেন, বাদশাহ্ যখন এ টুপি মাথায় পরিধান করতেন, মাথা ব্যথা চলে যেতো, মাথার টুপি যখন নামিয়ে ফেলতেন, পুনরায় মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যেতো। বাদশাহ্ আশ্চর্য হলেন এ কি রহস্য? এক পর্যায়ে টুপি খুলে দেখলেন, টুপির ভেতরে এক টুকরো কাগজে পবিত্র কুরআনের আয়াত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখা ছিলো, বিসমিল্লাহি শরীফের বরকতে মাথা ব্যথা দূরীভূত হলো, সাহাবায়ে কেরামের কুরআনী চিকিৎসা ইসলামের এক বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক শক্তির গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। [তাফসীরে নাঈমী, খন্ড-১ম, কৃত. হাকিমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহ.]
ইন্তেকালের পূর্বে এক ব্যক্তির ওসীয়ত
ইন্তেকালের পূর্বে এক ব্যক্তি, অসীয়ত করে গেল, যখন আমার ইন্তেকাল হয়ে যাবে তখন আমার সীনা ও কপালের উপর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ লিখে দিবে, এভাবে করা হলো, অতঃপর কোন ব্যক্তি ওই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে স্বপ্নে দেখে তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, মৃত ব্যক্তি জবাব দিলেন যখন আমাকে কবরে রাখা হলো, ফিরিস্তার আগমন হলো, যখন কপালে ‘বিসমিল্লাহ্’ শরীফ লিখা দেখলেন, ফিরিস্তারা বললো, তুমি আযাব থেকে রক্ষা পেয়েছো। [দূররে মুখতার, জানাযা শীর্ষক অধ্যায়, খন্ড-৩, পৃ. ১৮৫]
ঘরের বাইরের দরজার উপর বিসমিল্লাহ্ শরীফ লিখা
হযরত ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় প্রণীত বিশ্ববিখ্যাত তাফসীরে কবীরীতে বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি ঘরের বাইরের দরজার উপর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লিখে রাখবে, ওই ঘর ধ্বংস থেকে রক্ষা পাবে। অর্থাৎ ঐ ঘরে অকল্যাণ ও অনিষ্টতা আসবে না।
[তাফসীরে কবীরি, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড-৩, পৃ. ১৩৮]
বিসমিল্লাহ্র বরকতে ওস্তাদ ও মাতা পিতার ক্ষমা
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে বলে পড়ো, ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ তখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীর পিতামাতার জন্য ক্ষমা লিপিবদ্ধ করা হয়। [দায়লামী, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড-৩, পৃ. ১৩৫]
বিসমিল্লাহ’র ‘বা’ অক্ষরের রহস্য
আলমে আরওয়াহ্ তথা আত্মার জগতে আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টি কুলের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, আমি কি তোমাদের প্রভু নই? প্রত্যেকে জবাব দিলো, ‘‘বালা’’ অর্থাৎ হ্যাঁ, মানুষের মুখ থেকে সর্বপ্রথম ‘বা’ অক্ষর বের হয়েছিলো, পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘আলাও তাঁর বাণী বিসমিল্লাহ্’ ‘বা’ দিয়ে শুরু করেছেন, যেন কুরআনুল করীম তিলাওয়াতের শুরুতেই আল্লাহর সাথে কৃত বান্দার অঙ্গীকারের কথা স্মরণ হয়ে যায়। [তাফসীরে নাঈমী]
হযরত সোলায়মান আলায়হিস্ সালাম কর্তৃক প্রেরিত চিঠিতে বিসমিল্লাহ্ শরীফ
হযরত সোলায়মান আলায়হিস্ সালাম রাণী বিলকিসের নিকট লিখিত চিঠিতে প্রথমে লিখেছিলেন-
اِنَّهٗ مِنْ سُلَیْمٰنَ وَ اِنَّهٗ بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِۙ
অর্থাৎ বিসমিল্লাহ শরীফের বরকতে হযরত সোলায়মান আলায়হিস্ সালাম, হযরত বিলকিসের সাথে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং সমগ্র ইয়ামেন সা¤্রাজ্যে হযরত সোলায়মান আলায়হিস্ সালাম’র নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। [তাফসীরে নঈমী, খন্ড-১ম]
আল কুরআনের সংখ্যাতাত্মিক রহস্য
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ আয়াতে আরবি বর্ণমালার ১৯টি অক্ষর রয়েছে। গোটা কুরআনের সূরা সংখ্যা ১১৪টি। যা ১৯ দিয়ে বিভাজ্য (১৯ী ৬ = ১১৪)। কুরআনে ইসম শব্দটি এসেছে ১৩৩ বার (১৯ী ৭ = ১৩৩)। আল্লাহ্ শব্দটি এসেছে ৫৭ বার (১৯ী ৩= ৫৭) রাহীম শব্দটি এসেছে ১১৪ বার (১৯ী ৬= ১১৪)।
এ অলৌকিকত্ব আল কুরআনের এক বিস্ময়কর মুজিযা। [আল কুরআন- ও সাহেবে কুরআন, পৃ. ১১]
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের প্রতিটি কাজে বিসমিল্লাহ্ শরীফের বরকত দান করুন।
লেখক: অধ্যক্ষ- মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।