হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর অনুগ্রহের সূর্য

0
শানে রিসালত
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর অনুগ্রহের সূর্য
হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্ররাজির সূর্য, আর সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম ওই নুবূয়তের সূর্য থেকে আলো গ্রহণ করেন; এ প্রসঙ্গে আল্লামা বূ-সীরী আলায়হির রাহমাহ্ বলেছেন-
فَاِنَّه شَمْسٌ فَضْلٍ هُمْ كَوَاكِبُهَا يُظْهِرْنَ اَنْوارَهَا لِنَّاسِ فِى الظُّلَمِ
অর্থাৎ: হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর অনুগ্রহের সূর্য, আর সমস্ত সম্মানিত নবী আলায়হিমুস্ সালাম হলেন নুবূয়তের ওই সূর্য থেকে আলো গ্রহণকারী নক্ষত্ররাজি, তাঁদের নসীহত ও হিদায়তের আলো অন্ধকারের সময় প্রদর্শন করে থাকেন।
হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর অনুগ্রহ ও খোদাপ্রদত্ত পূর্ণতার সূর্য আর নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম হলেন ওই সূর্যের চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজি। যেভাবে চন্দ্র সূর্য অদৃশ্য হলে সেটা থেকে নূর আহরণ করে অন্ধকার রাতে আলো ছড়ায়, তেমনি সম্মানিত নবীগণ হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর রূহ মুবারকের নূর থেকে নূর সংগ্রহ করে, পূর্ববর্তী নিজ নিজ যুগে, আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে হিদায়তের নূর বিচ্ছুরিত করতেন; আর যখন হুযূর-ই আকরাম বিশ্বে তাশরীফ আনলেন, তখন যেভাবে চন্দ্র সূর্যোদয়ের পর গোপন হয়ে যায়, তেমনি সমস্ত নবী নূরে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এ বিলীন হয়ে ওই নূরের দিকে রুজূ করেছেন।
আল্লামা ক্বাস্তলানী ‘মাওয়াহিব-ই লাদুনিয়া’য় হুযূর-ই আকরামের নামগুলোর মধ্যে ‘শামস’ (সূর্য)-ও উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন-
وَاَمَّا الشَّمْسُ يُسَمّٰى بِهَا صَّلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِكَثْرَةِ نَفْعِه وَعُلُوِّ رِفْعَتِه وَظُهُوْر ِ شَرِيْعِتِه  وَجَلَالَةِ قَدْرِه وَعَظْمِ مَنْزِلَتِه لِاَنَّه يُحَاطُ بِكَمَالِه حَتّٰى لَا يَسَعَ الرَّبِىُّ اَنْ يَنْظُرْ اِلَيْهِ مِلْأَ عَيْنِه  اِجْلَالًا لَه كَمَا اَنَّ الشَّمْسَ فِى الرُّتْبَةِ اَرْفَعُ مِنْ اَنْوَاعِ الْكَوَاكِبِ
لِاَنَّهَا فِى السَّمَاءِ الرَّابِعَةِ وَالْاِنْتِفَاعِ بِهَا اَكْثَرَ مِنْ غَيْرِهَا كَمَا لَايَخْفٰى وَاَيْضًا لَمَّا كَانَ مَسَائُرُ الْكَوَاكِبِ يُسْتّمَدُّ مِنْ نُوْرِهَا نَاسَبَ تَسْمِتَه صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِهَا لَاَنَّ اَنْوَارَ الْاَنْبِيَاءِ اِسْتَمَدَّ مِنْ نُوْرِه عَلَيْهِ السَّلاَمَ انْتَهٰى-
অর্থ: তিনি বলেন- ‘সূর্য’ হুযূর-ই আকরামের নাম এভাবে যে, উচুঁ মর্যাদা, শরীয়তের প্রসার মর্যাদার মহত্ব ও পদবীর বড়ত্বে হুযূর-ই আকরামের স্থান এমনই যে, তাঁর পূর্ণতাকে আয়ত্বে আনা সম্ভব নয়। এমনকি দ্রষ্টা দর্শনকারী তার চোখ ভরে হুযূর-ই আকরামের মহব্বত ও সৌন্দর্যের দর্শন করতে পারে না। যেভাবে সূর্য সেটার মর্যাদায় সবার উপরে, চতুর্থ আসমান থেকে আলোর বিকিরণ করে, আর তা থেকে যে পরিমাণ উপকার পাওয়া যায়, ওই পরিমাণ চন্দ্র ও নক্ষত্রগুলো থেকে পাওয়া যায় না। অনুরূপ, হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র সত্তা এমন মহিমায় রয়েছে যে, সমস্ত নবী আলায়হিমুস্ সালাম নক্ষত্ররাজির ন্যায় ওই পূর্ণতার সূর্য থেকে আলো গ্রহণ করছে। এ কারণে হুযূর-ই আকরামের নাম শামস বা সূর্য হলেও তা একেবারে প্রযোজ্য। তখন হুযূর-ই আকরামের যেমন নাম তেমন কাজ হবে। কবি বলেন-
سب نبى نور هيں ليكن هے تفاوت اتنا
نير نور هم تم سارے نبى تاروں هيں
অর্থ: সমস্ত নবীও নূর, তবে পার্থক্য এতটুকুই যে, হে আল্লাহর রসূল। আপনি হলেন নূরের সূর্য, আর সমস্ত নবী হলেন তারকাপুঞ্জ। এখন প্রশ্ন জাগছে- সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম হুযূর-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নূর-ই পাক থেকে কিভাবে নূর ও ফয়য হাসিল করেছেন? এ জবাবে আল্লামা খরপুতী আলায়হির রাহমাহ্ এক দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছেন। সেটার সারসংক্ষেপ হচ্ছে- সমস্ত সম্মানিত নবী হুযূর-ই আকরামের আবির্ভাবের পূর্বে নিজ নিজ গুণ ও ফযীলত প্রদর্শন করতে থাকেন; কিন্তু যা কিছু তাঁদের থেকে প্রকাশ পেয়েছে সবই আমাদের হুযূর পুরনূরের নূরে পাকের কল্যাণ ধারার বহিঃপ্রকাশ ছিলো; তাও এভাবে যে, হুযূর-ই আকরামের নূর মুবারক বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। আর সর্বপ্রথম নূর-ই মুহাম্মদীর যেই ধারা প্রকাশ পেয়েছিলো তা হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিলো, যখন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে যমীনে নিজের খলীফা প্রতিনিধি বানিয়ে সব কিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং তিনি ফেরেশতাদের উপর ওই ইলমে ইলাহী প্রকাশ করে ছিলেন। এভাবে সমস্ত মানবের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। তাদের বংশ পরম্পরা চলতে চলতে হুযূর-ই আকরামের পবিত্র যমানা আসলো;
তারপর যখনই হুযূর-ই আকরামের সূর্যের ন্যায় হয়ে প্রকাশ পেলেন, তখন তাঁর নূরের সামনে সমস্ত নূর বিলীন হয়ে গেলো। সমস্ত নবী-রসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার রিসালতের ঝান্ডার নিচে এসে গেলেন। মোটকথা যে নবী-ই ‘কোন গূণ বা বৈশিষ্ট্য লাভ করেছেন, তা হুযূর-ই আকরাম পেয়েছেন। هرچه خو باں بمه دارند توتنها دارى (অন্য নবী-রসূলগণ যত গুণ বা বৈশিষ্ট্য পেয়েছেন, সবই হুযূর-ই আকরাম একাই পেয়েছেন। যেমন হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে সমস্ত ফেরেশতা সাজদাহ্ করেছিলেন। তাও হুযূর-ই আকরামের নূরের কারণে ছিলো, যা কপাল শরীফে আলোকিত ছিলো, হযরত ইদ্রীস আলায়হিস্ সালামকে আল্লাহ্ তা‘আলা উঁচু স্থানে নিয়ে গেছেন, কিন্তু আমাদের হুযূরকে মি’রাজে এমন উঁচু মর্যাদার স্থানে নিয়ে গেছে, যেখানে অন্য কেউ পৌঁছতে পারেনি। হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম তাঁর অনুসারীগণ সহকারে মহা প্লাবন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, আর আমাদের হুযূর-ই আকরামের উম্মতগণকে আসমানী আযাব থেকে নিরাপদে রেখেছেন। হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে নমরূদের অগ্নিকুন্ড থেকে নাজাত দিয়েছেন, আর আমাদের হুযূর-ই আকরামকে যুদ্ধের আগুন থেকে সব সময়ের জন্য নিরাপদ করে দিয়েছেন; মি’রাজে তাঁকে আগুনের সমুদ্র নিরাপদে পার করিয়ে নিয়ে গেছেন। হযরত ইব্রাহীম ‘খলীলুল্লাহ্’ ছিলেন, আর আমাদের হুযূর-ই আকরাম ‘হাবীবুল্লাহ্’ ছিলেন। হযরত ইব্রাহীমকে বোত ভাঙ্গার ফযীলত দিয়েছেন, আর মক্কা বিজয়ের দিন ৩৬০ মূর্তি থেকে কা’বা মু‘আয্যমাহ্কে পবিত্র করার মর্যাদা দিয়েছেন। হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম-এর জন্য তাঁর মু’জুযিা স্বরূপ কাঠের লাঠিকে সাপ বানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আর আমাদের হুযূর-ই আকরামের জন্য লাঠি ছাড়াই এমন খাস মু’জুযিা দেওয়া হয়েছিলো। যেমন আবূ জাহেল যখন হুযূর-ই আকরামকে পাথর দ্বারা শহীদ করতে গিয়েছিলো, তখন সে হুযূর-ই আকরামের উভয় স্কন্ধ মুবারকের উপরিভাগে দু’টি বিরাটকার অজগর দেখে ভয়ে পালিয়ে তার দলের নিকট এসে আশ্রয় নিয়েছিলো। হযরত মুসা আলায়হিস্ সালামকে ‘ইয়াদে বায়দ্বা’ (শুভ্র হস্তের মু’জিযা) দেওয়া হয়েছিলো। আর আমাদের হুযূর-ই আনওয়ারকে ওই নূর দান করা হয়েছে, যা অন্ধকার রাতে চমকিত হতো। এমনকি পূর্ণিমার চাঁদকে হুযূর-ই আকরামের নূরানী চেহারা-ই আকদাসের মোকাবেলায় ফ্যাকাশে মনে হতো। হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামকে সমুদ্র দ্বিখন্ডিত করে শুক্নো রাস্তা করে দেওয়ার মু’জিযা দেওয়া হয়েছিলো, আর আমাদের হুযূর-ই আকরামকে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার মতো এমন মু’জিযা প্রদান করা হয়েছিলো যে, হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর ক্ষমতা প্রয়োগ ছিলো যমীনে, কিন্তু আমার হুযূর-ই আকরামের ক্ষমতা আসমানের উপর প্রয়োগ করিয়ে দেখানো হয়েছে। হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম সহ সমস্ত নবীর দো‘আ আল্লাহর দরবারে কবূল হতো, আর আমাদের নবী-ই আকরামকে এত প্রশস্ত গ্রহণযোগ্যতা দান করা হয়েছে যে, তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম পাথরের উপর লাঠি শরীফ দ্বারা আঘাত করলে তা থেকে পানির ফোয়ারা জারী হয়ে গিয়েছিলো, আর আমাদের নবী-ই আকরাম-এর আঙ্গুল মুবারকগুলো থেকে পানির ফোয়ারা প্রবাহিত হয়েছিলো। হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম তূর পর্বতে আরোহণ করে আল্লাহর সাথে সরাসারি কথা বলেছেন, আর মি’রাজ শরীফে আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূর-ই আন্ওয়ার আলমে লা-মাক্বানে খোদায়ী ব্যবস্থাপনায় আরোহরণ করে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কথোপকথন করেছেন। হযরত হারূন আলায়হিস্ সালামকে ভাষালাঙ্কারে পূর্ণতা দান করা হয়েছিলো, আর আমাদের হুযূর-ই আকরামকে আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্ত বনী আদম অপেক্ষা বেশী ভাষালাঙ্কার দান করেছেন। হযরত ইয়ূসুফ আলায়হিস্ সালাম-এর চেহারা ও দেহ মুবারকে আলোকময়তা ও শুভ্রতা ছিলো, আর আমাদের হুযূর-ই আকরামের চেহারা ও যাত মুবারকে লাবণ্য সবচেয়ে বেশী রয়েছে। হযরত ইয়ূসুফ আলায়হিস্ সালামকে আল্লাহ্ তা‘আলা স্বপ্ন ব্যাখ্যার জ্ঞান দান করেছেন, আর আমাদের হুযূর-ই আকরামকে পূর্ব ও পরবর্তী সমস্ত সৃষ্টির জ্ঞান (ইলমে মা-কানা ওয়া মা ইয়াকূনু) দান করেছেন। হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালাম-এর হাত মুবারকে লোহা নরম হয়ে যেতো, আর আমার হুযূর-ই আকরামকে তদ্পেক্ষা বেশী আশ্চর্যজনক মু’জিযা দান করা হয়েছে। তিনি কাঠকে লোহার তলোয়ার করেছিলেন। তিনি পাথরের উপর পা মুবারক রাখলে পাথর মোমের মতো গলে গিয়ে ওই নূরানী কদমের নক্শা নিজের বক্ষে স্থায়ীভাবে ধারণ করে নিতো।
হযরত সুলায়মান আলায়হিস্ সালামকে আল্লাহ্ তা‘আলা জিনের সেনা বাহিনীর সর্দার করেছেন আর আমাদের হুযূর-ই আকরামকে ফেরেশতা বাহিনীর নির্দেশদাতা করেছেন। হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম আপন হাত মুবারক মসেহ করে মাতৃগর্ভের অন্ধকে চক্ষুদান করেছেন, কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করেছেন। তিনি আল্লাহ্র নির্দেশে মৃতকে জীবিত করেছেন, আর আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে তদ্পেক্ষা বড় বড় মু’জিযা দান করা হয়েছে। তিনি বের হয়ে পড়া চক্ষুকে সেটার স্থানে স্থাপন করে জ্যোতিপূর্ণ করে দিয়েছেন। হযরত মু‘আয ইবনে আফরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর স্ত্রীর কুষ্ঠরোগ হয়েছিলো। হুযূর-ই আকরাম তাকে সুস্থ করে দিলেন। আর মৃতকে জীবিত করার মু’জিযা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর মু’জিযার চেয়ে বড় ছিলো। তাঁর সংস্পর্শে এসে শুক্নো উস্তুনে হান্নানাহ্ জীবিত হয়ে গিয়েছিলো। হুযূর-ই আকরাকমের বিচ্ছেদে বিবেক সম্পন্নের মতো কান্না করেছিলো! তদুপরি হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দু’মৃত ছেলেকে জীবিত করার ঘটনা তো প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।
মোটকথা হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মু’জিযা ও পূর্ণতার তুলানায় অন্য নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর মু’জিযাদি এক দশমাংশ না, বরং সমুদ্রের তুলনায় এক ফোটা পানির চেয়ে কম। আলহামদুলিল্লাহ্! আল্লাহ্ পাকের মহান দরবারে নবীকুল সরদারের, আমাদেরকে উম্মত করার জন্য অসখ্য শোকরিয়া।

লেখক: মহাপরিচালক- আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •