পবিত্র ক্বোরআনের বিশুদ্ধতম অনুবাদ কানযুল ঈমান
আল্লামা কাযী মুহাম্মদ মুঈন উদ্দীন আশরাফী
জ্ঞান-গবেষণার জগতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো সঠিক, যথার্থ ও বিশুদ্ধ অনুবাদ। কারণ, অনুবাদক যদি বক্তার- ভাষা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বুঝতে সফলভাবে সক্ষম না হন, তাহলে তাঁর পক্ষে সঠিক অনুবাদ কখনো সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে মুতারজ্জম বা অনুবাদককে বেশ কিছু বিষয়ে যথাযথ প্রয়োজনীয় জ্ঞান অবশ্যই থাকতে হবে। ১. ভাষা জ্ঞান, ২. বক্তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, ৩. বক্তব্যের প্রায়োগিক ক্ষেত্র, ৪. বক্তব্যের সাথে সম্পর্কীয় যাবতীয় বিষয় সমূহের জ্ঞান ইত্যাদি।
ভাষাজ্ঞান বলতে শুধুমাত্র আভিধানিক অর্থ নয়। বরং প্রত্যেক ভাষার মৌলিকত্ব, পরিভাষা, প্রায়োগিক ক্ষেত্র অনুযায়ী সঠিক অর্থে শব্দের ব্যবহার; যথার্থ শব্দচয়ন, বক্তব্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ইত্যাদি। এতো হলো সাধারণ অনুবাদ ভাষান্তর এর কথা।
পবিত্র ক্বোরআন মহান আল্লাহর কালাম। আরবী ভাষায় বর্ণিত। আরবী ভাষা পৃথিবীর প্রাচীনতম মৌলিক ভাষা। অনেকের মতে অন্য সব ভাষার মূল আরবী ভাষা। সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে আরবী ভাষার স্থান সব ভাষার সর্বোচ্চ। তারপরও শুধু ভাষা জ্ঞান দিয়ে পবিত্র ক্বোরআনের মর্ম উপলব্ধি করা অসম্ভব। বরং সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকতে হবে। কিছু বিষয় ভাষা জ্ঞানের ব্যুৎপত্তি দ্বারা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। যেমন- আমরা সম্ভোধনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি পার্থক্যে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করি। যেমন- বড়জন ও সম্মানিত ব্যক্তির ক্ষেত্রে- ‘আপনি’, সমবয়স্ক বা সাধারণ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ‘তুমি’ এবং অতি ঘনিষ্ঠ ও ছোটদের ক্ষেত্রে ‘তুই’। কিন্তু অন্যসব ভাষায় এ ধরনের পৃথক পৃথক শব্দ নেই। আরবীতে ‘‘انت ’’ (আন্তা) ‘‘ك’’ (কাফ) যেমন ‘‘انّك’’ (ইন্নাকা)। ইংরেজীতে ণড়ঁ। অতঃপর আরবী বা ইংরেজীতে সম্বোধিত ব্যক্তি কোন স্থরের তা কিন্তু ভাষা নির্ণয় করতে পারবে না। এটা সম্পূর্ণরূপে অনুবাদকের দায়িত্ব। অর্থাৎ অনুবাদক এর জানা থাকতে হবে সম্বোধনের শব্দদ্বয় যে বা যাদেরকে সম্বোধন করা হচ্ছে- সে বা তারা কোন স্থরের।
যেমন ধরুন আরবী ভাষী একজন বক্তা আমাদের বাংলাদেশে কোন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে সভাপতি বা প্রধান অতিথিকে সম্বোধন করলেন انت (আনতা) বা انك (ইন্নাকা) শব্দ দিয়ে। আর দোভাষী বা অনুবাদক অর্থ করলেন, তুমি বা তুই। তাহলে অবস্থা কি হবে, বুঝতে কারো কষ্ট হবার কথা নয়। অথচ শব্দের অনুবাদ ভুল হয়নি। মারাত্মক ভুলটি হয়েছে- সম্বোধিত ব্যক্তির মর্যাদা অনুযায়ী শব্দচয়নের ক্ষেত্রে। উপস্থিত সুস্থজ্ঞান সম্পন্নরা বলবে- এ ব্যক্তি দোভাষীর দায়িত্ব পালন করার ন্যূনতম যোগ্যতা রাখে না। আর সম্বোধিত ব্যক্তির পদমর্যাদার বিষয়ে উদাসীন ব্যক্তি বলবে- ভুল কি হয়েছে। দোভাষী তো- ‘দ্বিতীয় পুরুষের’ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অর্থই করেছে। দোভাষী তো انت (আনতা) বা انك (ইন্নাকা) এর অর্থ প্রথম পুরুষ বা তৃতীয় পুরুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অর্থ করেন। কিন্তু জ্ঞানীজন এ বক্তব্যকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারবেন না।
পবিত্র ক্বোরআনের অনুবাদের ক্ষেত্রটি যে অনেক বেশী স্পর্শকাতর। একটু এদিক-সেদিক হলেই ‘ঈমানের’ মত অমূল্য সম্পদটি বিনষ্ট হবার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান। সেটি সার্বক্ষণিক বিবেচনায় রেখে অতীব সতর্কতার সাথে তরজমা করতে হবে। অন্যথায় যা হবার তা হবে। পবিত্র ক্বোরআন অনেক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। দুটি অনুবাদকে তুলনামূলকভাবে যাচাই করলে- অনেক পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে উপরোল্লিখিত কারণে। সুতরাং সঠিক ও বিশুদ্ধ অনুবাদ-ই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন বিষয়।
পাক-ভারত উপমহাদেশে – ফারসী, উর্দু ও বাংলায় পবিত্র ক্বোরআনের অনেক অনুবাদ হয়েছে। এমনকি ক্বোরআন এর উপর ঈমান আনেননি- এমন ব্যক্তিও পবিত্র ক্বোরআনের অনুবাদ করেছে বাংলা ভাষায়। এ অনুবাদটির ভাষাই তাঁর ধর্ম পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট। এসব অনুবাদের মধ্যে অনেক ধরনের ভিন্নতা বিদ্যমান। কারণ, অনুবাদকের আক্বীদা-বিশ্বাস, ধ্যান-ধারনা, দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই তাঁর অনুবাদে ফুটে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। যতই যোগ্যতা ও নিরপেক্ষতার বুলি আওড়াক না, অনুবাদই বলে দেবে তার আক্বীদা-বিশ্বাসের আসল পরিচয়। অতএব, পবিত্র ক্বোরআনের তরজমা পাঠে আগ্রহী মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলব- বাংলায় অনুদিত কোন অনুবাদটি বেচে নেবেন- তা একজন দক্ষ সুন্নী আলেমের নিকট জেনে নেবেন। মনে রাখবেন আপনি পবিত্র ক্বোরআনের তরজমা না জানলে আপনার ঈমান-আমলের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু বিকৃত ও ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা সম্বলিত অনুবাদ এবং তা বিশ্বাস করার ফলে আপনার ‘ঈমান ধ্বংসের মুখোমুখি হবার আশংকা রয়েছে।
আলোচ্য বিষয়টি খোলাসা করার লক্ষ্যে আমি শুধুমাত্র একটি আয়াতের অনুবাদ- দুটি অনুবাদ গ্রন্থ থেকে পাঠক সমাজের নিকট পেশ করছি। –
لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ [সূরা ফাতাহ্: আয়াত-২, পারা- ২৬]
আলোচ্য আয়াতের তরজমা করেছেন- মৌং মাহমুদুল হাসান দেউবন্দী এবং মৌং শাব্বির আহমদ ওসমানী-
تا كه معاف كرے تجه كو الله جو ا ۤگے هو چےر تيرے گناه اور جو پىنچھے رهے
অর্থাৎ- যাতে আল্লাহ্ আনপাকে আপনার পূর্বের পাপ এবং পরের গুনাহ্ মাফ করেন। [পৃষ্ঠা- ৬৬২, মদীনা প্রেস, বাজনুর, ইউ, পি, ইন্ডিয়া কর্তৃক মুদ্রিত, ১৯২৩ ইংরেজী]
প্রায় একই অনুবাদ করেছেন- শাহ্ রফীউদ্দীন ও মৌং আশরাফ আলী থানবী। এ দু’জন কর্তৃক অনুদিত তরজমা- পৃষ্ঠা: ৫৭৬, তাজ কোম্পানী লি. ক্বোরআন মনযিল, লাহোর কর্তৃক মুদ্রিত।
উপরোক্ত অনুবাদ পাঠ করে একজন সহজ-সরল সাধারণ পাঠক- নিশ্চয়ই একটি বিষয় বিশ্বাস করবে- যে, নবী করীম সায়্যিদুল মা’সুমীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পূর্বাপর পাপরাশি রয়েছে- যা ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। গুনাহ্ বা পাপ তাঁর থেকে সংঘটিত না হলে- ক্ষমা করে দেয়ার কি মানে। অপর দিকে উম্মতের পাপরাজি অন্তকরনে তাওবা এবং পূণ্য আমলের দ্বারা মাফ হয়ে যায়। তাহলে নবী আর উম্মতের মধ্যে পার্থক্য কোথায় রইল। সবচেয়ে বড় কথা হলো- প্রত্যেক মুসলমান-এর এ আক্বীদা-বিশ্বাস পোষণ করতেই হবে- যে, সকল নবী রসূল আলায়হিমুস্ সালাম নিষ্পাপ। একদিকে আয়াতের অনুবাদ দ্বারা ‘‘নবীর পূর্বপার পাপরাজি মাফ হবার’’ বিষয় মুসলমানদের সামনে আনা হয়েছে। অপরদিকে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- আক্বীদা-বিশ্বাস-হচ্ছে-শুধু আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নয় বরং সকল নবী-রসূল পিষ্পাপ। এ দু’য়ের স্পষ্ট গরমিলে সহজ সরল মুসলমানগণ বিভ্রান্ত হবে নিশ্চিত ভাবে। সাধারণ সুমলমানগণ ইসলামের মূল বিষয় ‘‘আক্বীদা’’ সম্পর্কে অনেকটাই অনবহিত। তখন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে পবিত্র ক্বোরআনের এ ধরনের অনুবাদকে মহান আল্লাহর বাণী হিসেবে- নবী-রাসূলগণ এমনকি নবীকুল শিরোমণি সায়্যিদুল মা’সুমীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকেও যে গুনাহ্ সংঘটিত হয়েছে- এ বিশ্বাসই পোষণ করবে। এ ধরণের অনুবাদ কি মুসলমানদেরকে হেদায়াতের আলোকে আলোকিত করবে: নাকি গোমরাহীর দিকে ঠেলে দেবে।
এ সমস্যার সমাধান নির্ভরযোগ্য তাফসীরকারগণ অনেক আগে থেকেই বর্ণনা করে আসছেন। কিন্তু, অনুবাদক তো সেগুলোর আলোকে অনুবাদ কাজ-সম্পন্ন করেননি। যার ফলে পবিত্র ক্বোরআনের এ অনুবাদ ও ইসলামী আক্বীদার মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
আবার আল্লাহ্-রাসূলের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত এমন সকল অনুবাদকও আছেন যাঁর অনুবাদ ও ইসলামী আক্বীদা বিশ্বাসের মধ্যে অনন্য সামঞ্জস্য বিদ্যমান। এ ধরনের উপরোক্ত আয়াতের একটি অনুবাদ পাঠক সমাজের নিকট পেশ করছি।
تا كه الله تمهارے سبب سے گناه بخشے تمهارے اگلو كے اور تمهارے پچهلوں كے-
অর্থাৎ যাতে আল্লাহ্ আপনার কারণে আপনার পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের ক্ষমা করেন।
[কানযুল ঈমান: পৃষ্ঠা- ৭৩৯, তাজ কোম্পানী লি. লাহোর, কারাচী।]
এ অনুবাদ অনুবাদকের নিজস্ব মন গড়া নয়- বরং আরবী ব্যাকরণ ও নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থ সমূহের আলোকে কৃত।
উল্লেখ্য যে, ইসলামী আক্বিদা এবং ক্বোরআন-সুন্নাহর মধ্যে কোন বৈপরীত্য থাকতেই পারে না। কারণ, ইসলামী আক্বীদার মূল উৎস হলো- পবিত্র ক্বোরআন এবং সুন্নাহ্।
শেষোক্ত অনুবাদ কে করেছেন? যিনি সহ¯্রাধিক গ্রন্থের লিখক; যিনি বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী, যাঁর সফল বিচরণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রে, যাঁর ‘‘তরজমা-এ ক্বোরআন’’ বাতিলদের ভিত্ উপড়ে ফেলেছে; যাঁর কলমের সামনে কলম চালানোর সাহস তাঁর সময়ে কারো ছিল না, যিনি পাক-ভারত উপমহাদেশ পেরিয়ে আরব বিশ্বের বিজ্ঞ আলেমদের নিকট অসাধারণ গ্রহণযোগ্যতা লাভে ধন্য হয়েছেন- তিনি হলেন আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রযা খান ফাযেলে বেরেলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
এভাবে ইতোপূর্বে বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত পবিত্র ক্বোরআনের অনুবাদগুলোর সাথে আ’লা হযরত কর্তৃক অনুদিত ‘‘কান্যুল ঈমান ফী তারজামাতীল ক্বোরআন’’ এর তুলনামূলক পর্যালোচনা পূর্বক শতাধিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায়- পবিত্র ক্বোরআনের বিশুদ্ধতম অনুবাদ হলো- কান্যুল ঈমান।
লেখক: শায়খুল হাদীস, সোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।