যুগজিজ্ঞাসার জবাবে আলা হযরত

0
যুগজিজ্ঞাসার জবাবে আলা হযরত (রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি)
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ আল মাসুম
[আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি প্রণীত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত কিছু বিষয়ের কুরআন-হাদীসের আলোকে প্রামাণ্য সমাধান বর্ণিত হলো]
রাসূলুল্লাহর মর্যাদা
এমন কোন নিয়ামত, দৌলত ও সম্মান নেই যা মহান আল্লাহ তা‘আলা আপন হাবীব রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতিরেকে অন্য কাউকে দিয়েছেন। বস্তুত ইহ-পরজগতে যাকে যা কিছুই দান করা হয়েছে বা হবে, তার সবই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমেই, তাঁর কারণেই এবং তাঁরই দস্ত মুবারকে প্রদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إنما أنا قاسم والله يعطي
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা হলেন দাতা আর আমি বন্টনকারী। আর উম্মতের সকল কথা, কর্ম ও আমল প্রতিদিন দুইবার রাসূলে পাক এর নিকট উপস্থাপন করা হয়। মিলাদ শরীফের মজলিস রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিকির। আর হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিকির আল্লাহ তা‘আলার যিকির এবং আল্লাহর যিকিরকে শরীয়তের বিনা কারণে নিষেধ করা শয়তানের কাজ। বস্তুত হেদায়ত তো নবীয়ে করীম কে মান্য করার মধ্যেই নিহিত, যে তাঁকে মানবে না তার হেদায়ত নেই এবং যখন হেদায়তই নেই তখন ঈমান কোথায়? ইরশাদ হচ্ছে-
مَنْ یُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ اَطَاعَ اللّٰهَۚ-
অর্থাৎ যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহার্য আসবাবপত্র তাবাররুকও আল্লাহ পাকের নিদর্শনসমূহের মধ্যে উত্তম নিদর্শন। এই সম্মানিত তাবাররুকের সম্মান করা মুমিন মুসলমানের উপর ফরয। ইরশাদ হচ্ছে-
وَ مَنْ یُّعَظِّمْ شَعَآىٕرَ اللّٰهِ فَاِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে সম্মান করবে, তবে এটা অন্তরগুলোর পরহেযগারীর লক্ষণ। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহার্য আসবাবপত্র দেখা মাত্রই পরিপূর্ণ আদব ও সম্মান সহকারে রাসূলে পাকের কল্পনা করুন এবং অধিকহারে দুরূদ ও সালাম পাঠ করুন।
শরীয়ত, তরীকত, হাক্বীক্বত ও মা’রিফাতের রহস্য
শরীয়ত হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী এবং তরিকত হলো হুযুরের কর্ম আর হাকীকত হলো নবীজির অবস্থা এবং মা’রিফাত হলো প্রিয় নবীর অতুলনীয় জ্ঞান। শরীয়ত ঐ পথ, যার শেষ প্রান্তে হলো আল্লাহ এবং যার মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা পর্যন্ত পৌঁছা যায় আর তা ব্যতীত মানুষ যদি অন্য পথের পথিক হয় তা আল্লাহর পথ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। আর যার বাহ্যিক শরীয়তের অলঙ্কার দ্বারা সজ্জিত নয় (অর্থাৎ যে বাহ্যিকভাবে শরীয়তের বিধানাবলী অনুসরণ করে না) সে বাতেনেও আল্লাহ তা‘আলার সাথে এখলাস রাখে না। ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনে কারো উপর শরীয়তের বিধান লংঘন করার কারণে শরীয়তের নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ না হওয়াতে খুশি হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, একদিন ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবেই, যাতে শিং বিশিষ্ট ছাগল থেকে শিং বিহীন ছাগলের হিসাব নেয়া হবে।
নবী – অলীর অলৌকিক ক্ষমতা
জগতে আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম এবং আউলিয়ায়ে কেরামের ক্ষমতা দুনিয়াবী জীবনে (অর্থাৎ শারীরিক জীবন) এবং ওফাতের পরও আল্লাহর দান ক্রমে অব্যাহত থাকে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের ফয়য অব্যাহত থাকবে। তাঁরা হলেন আল্লাহর রহমতের নিদর্শন। দ্বীন-দুনিয়া, অন্তিম মুহুর্ত, হাশর ও কবর সর্বাবস্থায় তাঁরা তাঁদের মুরীদদের সাহায্য করে থাকেন। তাঁরা তাঁদের মহব্বতে নাম নেয়া ব্যক্তিদের আপন করে নেন এবং তার প্রতি দয়ার দৃষ্টি রাখেন। বস্তুত আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জীবদ্দশায় তাঁদের নিকট যাওয়া এবং ওফাতের পর তাঁদের কবর যিয়ারতে যাওয়া উভয়ই সমান। যেমন- ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির নূরানী মাযার যিয়ারতে গমন করতেন এবং ফয়জ অর্জন করতেন। আর বরকতপূর্ণ সত্ত্বা কিংবা বিশেষ জিনিসের দিকে যেই বস্তুর সম্পর্ক করা হয়, তাতে বরকত এসে যায়।
হাদীসে রাসূল অস্বীকারকারীর হুকুম
যে ব্যক্তি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করবে, সে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করলো। আর যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করলো, সে কুরআন মাজীদকে অস্বীকার করলো। বস্তুত যে ক্বোরআনে মজীদের অস্বীকারকারী, সে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহকে অস্বীকারকারী।
ইবাদত বর্জন কারী শয়তানের বন্ধু
যার জ্ঞান ও হিম্মত নিরাপদ ও অবশিষ্ট আছে, জেনে শুনে নামায বা রোযা (শারীরিক ফরয ইবাদত) বর্জন করলো, কখনোই সে আল্লাহর ওলী নয় (বরং) শয়তানের ওলী (অর্থাৎ শয়তানের বন্ধু)। কোন ব্যক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে না, যেখানে পৌঁছলে তার জন্য নামায রোযা ইত্যাদি শরীয়তের আহকাম রহিত হয়ে যাবে। যতক্ষণ জ্ঞান অবশিষ্ট থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর উপর শরীয়তের বিধানাবলী বর্তাবেই।
জ্বিনের ভবিষ্যত সম্পর্কিত জ্ঞান বিশ্বাস করা কুফরী
জ্বিনেরা গায়েব সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ, তাদের থেকে ভবিষ্যতের কথা জিজ্ঞাসা করা বোকামি এবং শরীয়ত মতে হারাম। আর তাদের গায়েবর জ্ঞান হওয়ার প্রতি বিশ্বাস রাখাও কুফর। আর জ্বিনের সাথে কথা বলার আকাক্সক্ষা এবং সাহচর্যের আশা মূলত কল্যাণকর নয়, এর একেবারে নি¤œ ক্ষতিকর দিক হলো যে, মানুষ অহঙ্কারী হয়ে যায়। বস্তুত অহংকার করা করা হারাম। কেননা, এটা আল্লাহর চাদর। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: ‘‘সম্মান হচ্ছে- আল্লাহর পরনের কাপড়; আর অহংকার হচ্ছে- আল্লাহর চাদর। যে ব্যক্তি এটা নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করে আমি তাকে শাস্তি দেই।”
ঈসালে সাওয়াবের নিয়তে খাবার তৈরী করে দান করা
মৃত মুসলমানের নামে খাবার তৈরী করে ঈসালে সাওয়াবের নিয়তে দান করা বৈধ ও পছন্দনীয় কাজ। আর ফাতেহার মাধ্যমে ঈসালে সাওয়াব করা খুবই পছন্দনীয় এবং উভয়টির সমন্বয় হওয়া আরো বেশি মঙ্গল জনক। প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এটা অধিক উত্তম যে, কোন ভালো কাজ করে সেটার সাওয়াব পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী জীবিত ও মৃতদের (অর্থাৎ হযরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে ক্বিয়ামত পর্যন্ত আগত) সকল মুমিন নর-নারীর উদ্দেশে হাদিয়া প্রেরণ করা (অথাৎ সাওয়াব প্রেরণ করা)। যার সাওয়াব সবার নিকট পৌছবে এবং যে ঈসালে সাওয়াব করেছে, সেও তাদের সম পরিমাণ সাওয়াব পাবে। ঈসালে সাওয়াব যেমনিভাবে আযাবকে আটকায় বা আযাব উঠিয়ে নেয়াতে আল্লাহ পাকের আদেশে কাজ দেয়, তেমনিভাবে মর্যাদা বৃদ্ধি এবং নেকী বৃদ্ধিতেও কাজ দেয়। পিতামাতার পক্ষ থেকে মৃত্যুর পর কুরবানী করা কুরবানীকারী এবং তার পিতামাতার জন্যও মহা প্রতিদানের মাধ্যম। ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম (ইন্তেকালের) সাতদিন পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে খাবার পরিবেশন করতেন। হযরত সৈয়্যিদুনা সাদ বিন উবাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আম্মাজান ইন্তেকাল করার পর তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আমার অনুপস্থিতিতে মা-জননী ইন্তেকাল করেছেন। আমি যদি তাঁর পক্ষ থেকে কিছু সদকা করি তবে কি তাঁর কাছে এটার কোন উপকার পৌঁছবে? নবীজি ইরশাদ করলেন, হ্যাঁ। তিনি আরজ করলেন, তবে আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমার বাগান তাঁর পক্ষ থেকে সদকা করলাম।
আর বছরের যে কোন দিন যেকোনো সময় ঈসালে সাওয়াব করা বৈধ। তবে ঈসালে সওয়াবের জন্য কোনো মুহূর্ত ও সময় নির্ধারণ করাতে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন অসুবিধা নেই। সময় নির্ধারণ করাটা দু’ধরনের। যথা- ক.শরয়ী ভাবে: শরীয়ত কর্তৃক কোন কাজের সময় নির্ধারণ করা। যেমন কুরবানী ও হজ্ব ইত্যাদি। খ. শরীয়তের পক্ষ থেকে কোন সময় নির্দিষ্ট নেই, কিন্তু মানুষ নিজেদের সুবিধার্থে কিংবা কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে কোন সময় নির্দিষ্ট করা। যেমন মসজিদে নামাজে জামাতের সময় নির্ধারণ করা ইত্যাদি। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, এবং বুযুর্গানে দ্বীন কর্তৃক এক্ষেত্রে সময় নির্ধারণের ব্যাপারে বর্ণনা রয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমের কবর যিয়ারতের জন্য বছরের শেষ সময়কে নির্দিষ্ট করেছিলেন। নবীজি মসজিদে কুবায় শনিবারে তশরীফ নিতেন। হযরত সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ধর্মীয় পরামর্শের জন্য সকাল ও সন্ধ্যার সময় নির্ধারণ করেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ওয়াজ ও আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার কে নির্ধারণ করেছেন। আর আলেমগণ পাঠ শুরু করার জন্য বুধবারকে নির্ধারণ করেছেন।
আর প্রতিটি বস্তু বা বিষয়ের মূল হচ্ছে মুবাহ। যতক্ষণ না শরীয়ত কর্তৃক কোন প্রতিবন্ধকতা না আসে। আর ঈসালে সাওয়াব বৈধ পূণ্যময় কাজ, তার ধরন ভিন্ন হতে পারে। তা নামাজের মাধ্যমে, খাবার পরিবেশন কিংবা সদকা প্রভৃতির মাধ্যমে করা যাবে। কোন একটি বৈধ কাজ অবৈধ বলার অধিকার শরীয়ত কাউকে দেয়নি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُحَرِّمُوْا طَیِّبٰتِ مَاۤ اَحَلَّ اللّٰهُ لَكُمْ
وَ لَا تَعْتَدُوْاؕ-اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ الْمُعْتَدِیْنَ
অর্থাৎ হে ঈমানদারগণ! যে সব বস্তুকে মহান আল্লাহ তোমাদের জন্যে হালাল করেছেন, সেগুলোকে তোমরা হারাম করোনা, আর সীমাঅতিক্রম করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্গনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
জানাযার নামাযে অংশ গ্রহণের প্রতিদান
হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কারো মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর মৃত ব্যক্তি পরিবার- পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করলো, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য এক কিরাত সাওয়াব লিখে দিবেন। অতঃপর যদি জানাজার সাথে গমন করে, তবে আল্লাহ তায়ালা দুই কিরাত সাওয়াব লিখে দিবেন। এরপর যদি জানাযার নামায আদায় করে তবে তিন ক্বীরাত, আর যদি দাফনের সময় উপস্থিত থাকে তবে চার ক্বীরাত সাওয়াব লিখে দেবেন। আর প্রত্যেক ক্বিরাত উহুদ পর্বত সমতূল্য।
জানাযায় গমনকালে নাত পাঠ
এ প্রসঙ্গে ইমামে আহলে সুন্নাত রাহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, জানাযার সাথে গমন কালে উচ্চস্বরে কালেমা তৈয়বা, বা কালেমা শাহাদাত, কিংবা হামদ-নাত প্রভৃতি পাঠ করা জায়েয।
কবরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ
আলা হযরত রাহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কবরের দৈর্ঘ্য মৃত ব্যক্তির কাঁধ থেকে কিছুটা দীর্ঘ হবে এবং প্রস্থে মৃত ব্যক্তির কাঁধের সমপরিমাণ হবে। আর গভীরতা কমপক্ষে অর্ধ কাঁধের সম পরিমাণ হবে। উত্তম হচ্ছে গভীরতাও কাঁধ সমপরিমাণ হওয়া। (কেননা, যদি শরীর ফেটে ছড়িয়ে পড়ে, তবে দুর্গন্ধ ছড়ানো থেকে পরিত্রাণ পাবে। আর গভীর হওয়ার কারণে মাংস ভক্ষণকারী নিশাচর প্রাণী হতে নিরাপদ থাকবে।) আর মধ্যম পন্থা হলো, বক্ষ পর্যন্ত হওয়া। এটা দ্বারা উদ্দেশ্য লাহাদ কিংবা সিন্দুকের অনুরূপ হাওয়া, এটা নয় যে, যেখান থেকে কবর খনন শুরু করেছে সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত এ পরিমাণ হবে।
মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার ধরন
আলা হযরত রাহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন, মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখার সহজ পদ্ধতি হলো, (মৃত ব্যক্তিকে কবরে নামানোর সময় নিম্মোক্ত দোয়া
بِسْمِ اللهِ وَعَلی مِلَّةِ رَسُوْلِ اللهِ
পাঠ করে) মৃত ব্যক্তির পিঠের নিচে নরম মাটি কিংবা বালিময় বালিশের মতো তৈরি করে হাত কে তার পার্শ্ব থেকে পৃথক করে রাখবে। যে ক্ষেত্রে এরকম করাটা কষ্টকর হয়, সে ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিকে চিত করে শোয়ানোর পর মুখকে কেবলামুখী করে দেবে। বর্তমানে এটাই বেশী করা হয়। যদি মুখ কেবলামুখী না থাকে এবং এমন শক্ত হয়ে যায় যে- ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না, তবে ওই অবস্থায় ছেড়ে দেবে, বেশী কষ্ট দেবে না। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির জানাযার নামাযে অংশগ্রহণ করেছেন। অতঃপর বলেন, হে আলী! মৃত ব্যক্তিকে কেবলামুখী করে দাও এবং সকলে
بسم اللہ وعلی ملة رسول اللہ
বলো। তাকে ডান পাশে রাখো,তাকে উপুড় করে রেখো না, বরং চিৎ করে রাখো।
কবরে আহাদনামা রাখা
আ’লা হযরত রহমতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, ইমাম ফকীহ ইবনে আজীল রাহমতুল্লাহি আলাইহি দোয়ায়ে আহাদনামা সম্পর্কে বলেন, যখন এই আহাদনামা লিখে কবরে মৃত ব্যক্তির সাথে রেখে দেয়া হয়, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে মুনকার-নকীরের সাওয়াল-জাওয়াব সহজকরণ ও কবরের আযাব থেকে নিরাপত্তা দান করেন।
আমীরুল মুমেনীন হযরত সৈয়্যদুনা আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের (অর্থাৎ ফরজ-সুন্নত ইত্যাদি) পর আহাদ নামা পাঠ করে, ফেরেশতারা তা লিখে সীলমোহর মেরে কেয়ামত দিবসের জন্য সংরক্ষণ করে। যখন আল্লাহ তায়ালা ঐ বান্দাকে কবর থেকে উত্তোলন করবেন, ফেরেশতারা ওই দলিল (আহাদ নামা) সঙ্গে নেবেন এবং আহব্বান করা হবে, আহাদ সম্পন্ন ব্যক্তিরা (আহাদ নামা পাঠকারীরা) কোথায়? তাদেরকে আহাদ নামা দেওয়া হবে। ইমাম তিরমিযি রহমতুল্লাহি আলাইহি এটা বর্ণনা করে বলেন, ইমাম তাউস রহমতুল্লাহি আলাইহির ওসীয়ৎ অনুযায়ী এই আহাদনামা তাঁর কাফনে লেখা হয়েছিল। যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত দোয়া মৃত ব্যক্তির কাফনে লিখবে, আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত তার থেকে কবরের আজাব তুলে নিবেন।
اللہم إنی أسٸلک یا عالم السر یا عظیم الخطر یا خالق البشر یا موقع الظفر یا معروف الاثر یا ذا الطول والمن یا کاشف الضر والمحن یا الہ الاولین والاخرین فرج عنی ہمومی واکشف عنی غمومی وصل اللہم علی سیدنا محمد وسلم
যে ব্যক্তি নিম্নোক্ত দোয়া কোন কিছুতে লিখে মৃত ব্যক্তির বুকের ওপর কাফনের কাপড়ের নিচে রাখবে, তবে কবরের আযাব হবে না এবং মুনকার-নাকীরেও দৃষ্টিগোচর হবে না।
لا الہ الا اللہ واللہ اکبر لا الہ الا اللہ وحدہ لا شریک لہ لا الہ الا اللہ لہ الملک ولہ الحمد لا الہ الا اللہ ولا حول ولا قوة الا باللہ العلی العظیم
কবরের উপর আগর বাতি জ্বালানো
ইমাম আলা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, কবরের উপর আগর বাতি জ্বালাবে না। এটা আদবের পরিপন্থী এবং দুষণীয় কাজ। (এর দ্বারা মৃত ব্যক্তির কষ্ট হয়।) তবে হ্যাঁ, যিয়ারতকারীদের (উপস্থিত লোকদের) সুগন্ধি অনুভব হওয়ার জন্য (যদি লাগাতে চায়) কবরের নিকটস্থ খালি জায়গা থাকলে, সেখানে লাগাবে, যেহেতু সুগন্ধি ছড়ানো পছন্দনীয়। কবরের উপর প্রদ্বীপ কিংবা জ্বলন্ত মোমবাতি প্রভৃতি রাখবে না। কেননা, এগুলো আগুন। আর আগুন কবরের উপর রাখার ফলে মৃত ব্যক্তির কষ্ট হয়। যদি যিয়ারতকারী বা পথচারীর নিকট চার্জ লাইট কিংবা টর্চ লাইট বিশিষ্ট মোবাইল সেট না থাকে, রাস্তায় সরকারী লাইটও না থাকে কিংবা বন্ধ থাকে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত্রে রাস্তায় চলাফেরা কিংবা কুরআনুল করিম তেলাওয়াত করতে আলোর প্রয়োজন হয় তবে কবরের এক পার্শ্বে খালি স্থানে মোমবাতি কিংবা প্রদীপ রাখতে পারবে, শর্ত হচ্ছে খালি স্থানটি যেন এমন না হয় যে, যেখানে পূর্বে কবর ছিল এখন বিলীন হয়ে গিয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে মুসলিম শরীফের একটি হাদিস শরীফ বর্ণনা করেন, হযরত আমর বিন বছর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু মৃত্যু শয্যায় শায়িত অবস্থায় আপন সন্তানদের এ মর্মে ওসীয়ত করেন যে, যখন আমি মৃত্যু বরণ করবো, তখন যেন আমার সাথে কোন বিলাপকারী না যায়, কোন আগুন না যায়।
মাযার যিয়ারত
মুসলমানদের কবর যিয়ারত করা সুন্নত আর আউলিয়ায়ে কেরাম, শোহাদায়ে এজামের দরবারে হাজেরী দেয়া সৌভাগ্যের বিষয়, তাঁদের প্রতি ইসালে সাওয়াব করা মানদুব তথা পছন্দনীয় ও পূন্যময় কাজ। জুমার দিন ফজরের নামাযের পর কবর যিয়ারত করা উত্তম। রাত্রিবেলা কবরস্থানে একাকী যাওয়া অনুচিত। হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
کنت نَهَيْتُکُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُوْرِ فَزُوْرُوْهَا
فَإِنَّهَا تُذَکِّرُکُمُ الْمَوْتَ.
অর্থাৎ আমি তোমাদেরকে ইতিপূর্বে করব যিয়ারতে নিষেধ করেছিলাম। (এখন আমি তোমাদের অনুমতি দিচ্ছি যে,) তাদের যিয়ারত করো। কেননা, করব যিয়ারত দুনিয়া বিমুখ করে এবং পরকালের স্মরণ এনে দেয় ।
রাতে আয়না দেখা
এ প্রসঙ্গে আলা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, রাতে আয়না দেখায় কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। জনসাধারণের ধারনা যে, এতে মুখে ছুলী (ঋৎবপশষবং) হয়ে যায় এবং এরও কোন প্রমাণ না শরীয়তে আছে, না চিকিৎসা বিজ্ঞানে আছে, না কোন গবেষণায়।
হালাল পন্থার উর্পাজন কখন হারাম হয়?
ইমাম আহমদ রেযা খান রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, বলেন: কাজের তিন ধরনের অবস্থা। (১) ধীর, (২) মধ্যম, (৩) খুব দ্রুত। চাকুরি করার সময় যদি অন্ততঃ মধ্যম পন্থায়ও না করে, বরং কেবল অলসতা সহকারে কাজ করে, তাহলে সে গুনাহ্গার। আর তার পক্ষে পূর্ণ পারিশ্রমিক গ্রহণ করা হারাম। সে যতটুকু কাজ করেছে, সেই কাজের পরিমাণ পারিশ্রমিক নিতে পারবে। বাড়তি পারিশ্রমিক যার সাথে চাকরীর শর্তবদ্ধ হয়েছে তাকে ফেরৎ দেবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হোক অথবা প্রাইভেট হোক, কর্মচারী ডিউটিতে আসার ক্ষেত্রে যদি প্রচলিত নিয়মের বাইরে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করে কিংবা নির্দ্দিষ্ট সময়ের আগে চলে যায় অথবা অনুপস্থিত থাকে, তাহলে সে চুক্তির ইচ্ছাকৃতভাবে বিরুদ্ধাচরণ করে গুনাহ্ করল । আর এমতাবস্থায় সে যদি পূর্ণ বেতন গ্রহণ করে, তাহলে আরো বেশি গুনাহ্গার হবে এবং জাহান্নামের আগুনের হকদার হবে। তিনি আরো বলেন: যেসব জায়েয দায়িত্ব তার উপর নির্ধারিত ছিল সেগুলোর ব্যতিক্রম করা হারাম এবং চুক্তিবদ্ধ সময়ে নিজের কাজ করাও হারাম। তাছাড়া অপূর্ণ কাজ করে পূর্ণ কাজের বেতন নেওয়াও হারাম।
শয়তানের প্রতারণা
এ প্রসঙ্গে আলা হযরত রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, অভিশপ্ত ইবলিস মানুষকে নেকীর ধোঁকায় গুনাহ করিয়ে থাকে আর মধুর বাহানা দিয়ে বিষ পান করায়। ইলমে দ্বীন ব্যতীত ইবাদত ও রিয়াযতকারীকে শয়তান আঙ্গুলের উপর নাচায়, মুখে লাগাম, নাকে দড়ি দিয়ে যেদিকে ইচ্ছা টেনে থাকে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হচ্ছে- তারা এ ধারণায় রয়েছে যে, ‘তারা সৎকর্ম করছে। মানুষ শয়তানকে দূরে মনে করে, অথচ শয়তান তার খুবই নিকটে। যার নিকট শয়তানের কুমন্ত্রণা গোপন থাকে, সেই মানুষের উপর মন্দ ও ভালতে সন্দেহ হয়ে যায় এবং শয়তান তাকে কল্যাণ থেকে মন্দের দিকে নিয়ে যায় আর এই বিষয়ে আমলসম্পন্ন আলেমগণই অবহিত হতে পারে।
পিতা-মাতার আনুগত্য ও সংশোধন
ইমামে আহলে সুন্নাত রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, জায়িয ব্যাপারে পিতা-মাতার আনুগত্য ফরয যদিও তারা (অর্থাৎ পিতামাতা) স্বয়ং কবীরা গুনাহ সম্পাদনকারী হয়। মাতা-পিতা যদি গুনাহ করে তবে তাদেরকে নম্র ও আদব সহকারে আবেদন করুন, যদি মেনে নেয় তবে ভাল; অন্যথায় কঠোরতা করতে পারবে না বরং অনুপস্থিতিতে তাদের জন্য দোয়া করুন। ইরশাদ হচ্ছে-
رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
অর্থাৎ “হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছে। আর সন্তান মা-বাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাআলা তাঁদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। [সূরা বানি ইসরাঈল : ২৪]
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মৃত্যুর পর যখন কোনো বান্দার মর্যাদা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন সে বলে- হে আমার প্রতিপালক! আমি তো এতো মর্যাদার আমল করিনি, কীভাবে এ আমল এলো? তখন বলা হবে- তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় এ মর্যাদা তুমি পেয়েছ।’ [আদাবুল মুফরাদ] আর পিতা-মাতার দায়িত্ব সন্তানদের পবিত্র উপার্জন থেকে খাওয়ানো, কেননা অপবিত্র সম্পদ অপবিত্র অভ্যাস গড়ে তুলে। [ফতোয়ায়ে রযবীয়া, ২১/১৫৭; ২৪/৪৫৩]

লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা, রাঙ্গুনিয়া
খতিব-রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ মসজিদ, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •