নারী শিক্ষা : ইমাম আ’লা হযরতের দৃষ্টিভঙ্গি

0
নারী শিক্ষা : ইমাম আ’লা হযরতের দৃষ্টিভঙ্গি
জোবেদা খানম
হিজরী চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ-এ মিল্লাত, সহস্রাধিক জ্ঞানগর্ভ গবেষণালব্ধ কিতাব ও না’ত রচয়িতা, আরব-আজম নির্বিশেষে বিশ্বের প্রায় অর্ধশতাধিক খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁর জীবনী ও মূল্যবান কর্মের উপর অসংখ্য এম.ফিল, পিএইচ.ডি গবেষণা কর্ম অনুমোদিত। তাঁর অনন্য সাধারণ চিন্তাধারা থেকে ইসলাম ও শিক্ষা দর্শন প্রসঙ্গে উল্লেখ যোগ্য যে মতামতগুলো লক্ষ্যণীয় এর আলোকে বর্তমান সমাজে মুসলিম নারীদের শিক্ষা অর্জন ও ইসলামী ভাবধারার শিক্ষার সমন্বয় এতদুভয় সম্পর্কে নি¤েœাক্ত আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছে।
আল্লাহপাক পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন –
یَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْۙ-وَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍؕ-وَ اللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ(۱۱)
“আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ঈমানদারদের ও তাদেরই, যাদেরকে জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে, মর্যাদা সমুন্নত করবেন। এবং আল্লাহর নিকট তোমাদের কর্মসমূহের খবর আছে” [সুরা মুজাদালাহ ঃ আয়াত ১১, অনুবাদ কানযুল ঈমান] হাদীসে পাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান- “যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের পথে বের হল এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সে ঐ রাস্তাতে আছে সে যেন মূলত আল্লাহর রাস্তাতেই রয়েছে”। (আল- হাদীস)
আ’লা হযরতের শিক্ষা দর্শন
মুসলিমনের-নারী মাত্রই জ্ঞান অর্জন করা ফরজ। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি বর্তমানে যুগের অববাহিকায় জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যম ও পদ্ধতিসমূহ বিভিন্ন ধারায় প্রচলিত রয়েছে। ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বিশাল কর্মময় জীবনের পরিধি পর্যালোচনা করলে ও যুগোপযোগী তাঁর অতুলনীয় সংস্কার কর্মগুলোর মর্ম যথাযথ অনুধাবন ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে শিক্ষাজগতের মান উন্নয়ন, ইসলামী কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে মার্জিত ও সুষ্ঠু শিক্ষা কাঠামো বিনির্মাণ এবং ইসলামী কল্যাণময় জীবনাদর্শ ও চেতনার ভিত্তিতে আলোকিত সমাজ ও জাতি গড়া নিতান্তই সহজ ব্যাপার।
আ’লা হযরতের শিক্ষাদর্শন ও নীতিমালার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে লক্ষ্যণীয় যে, ইসলাম ধর্মের মর্ম অনুধাবন ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই মূলত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এক্ষেত্রে ইলম হাসিল করার জন্য নিয়্যতের পরিশুদ্ধতার মাধ্যমেই কর্মের সুফল অর্জন করা যায়। যে জ্ঞান ব্যক্তিকে মারিফাতে ইলাহী তথা আল্লাহর পরিচয় অর্জন ও রিসালাতের মর্যাদা ও শান-মান অনুধাবন করতে সহযোগিতা করবে এবং ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ধারণের স্বকীয় যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে মানব জীবনকে হক্ব ও হালালের পথে, ইসলামী শরীয়তের অনুগত হিসেবে পরবর্তী জীবন যাপনের করণীয় সাব্যস্ত করার মত করে গড়ে তুলবে তা-ই হল উপযুক্ত শিক্ষা।
ইসলাম ও নারীর মর্যাদা
ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন বিধান। এ জগত সংসারের সার্বিক শৃঙ্খলা বদ্ধ পরিক্রমা যাতে সুন্দর সুচারুরূপে পরিচালিত হতে পারে তাই আল্লাহপাক আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানবজাতি সৃষ্টি করে নর ও নারীর মাঝে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বন্টন করে দিয়েছেন। যুগে যুগে নারী জাতি পারিবারিক অবকাঠামো সুদৃঢ করতে ও সমাজ-সংসার-সন্তানদের লালন-পালন এবং সার্বিক দেখাশোনার মাধ্যমে পুরো জাতির ভিত্তিমূল গড়তে অনবদ্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। এছাড়াও সমাজে চলার পথে নারীরা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবের সাথে নিজ নিজ পারদর্শিতায় জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অবদান রাখছে। ইসলাম নারীদেরকে আইয়্যামে জাহেলিয়্যাতের অন্যায়, অত্যাচার ও লাঞ্ছনার শেকল থেকে মুক্ত করে সমাজে বিভক্তিহীন ভাবে বাঁচার অধিকার দিয়ে তাদের মর্যাদাকে অত্যন্ত সমুন্নত করেছে। ইসলামের প্রারম্ভিক সময়ে আরবে মাত্র সতের জন লোক পড়ালেখা জানতেন, এর মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন নারী। ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিদুষী নারীরা শিক্ষা ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। মহিলা সাহাবীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্ট দিনানুসারে তাঁদের শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি প্রতিনিধি পাঠিয়েও তিনি নারীদের শিক্ষা দিতেন। ফলস্বরূপ অনেক নারী পাণ্ডিত্যের উদয় হয়েছিল, যারা ইসলামের মহান শিক্ষা প্রচারে অংশ গ্রহণ করে ছিলেন।
তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা, নবী দুলালী মা ফাতেমা যাহরা, সাফিয়া, উম্মে সালমা, ফাতিমা বিনতে কায়েস, সৈয়িদানা ফিসা, উম্মে দারদা, আয়শা বিনতে সাদ, জয়নাব বিনতে সালমা, উম্মে আতিয়া, শিমা, সাকিনা, উম্মে হাবিবা, উম্মে শরীক, উম্মে ইউসুফ রদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুন্না আজমা’ঈন প্রমুখ।
ইসলামী দর্শন ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন তখনকার নারীরা, এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও নারীদের অসামান্য অবদান ছিল। খলিফাদের শাসনকালেও নারীরা শিক্ষাদীক্ষা, সাহিত্য, কাব্যচর্চা ও সমাজসেবায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। উম্মুলমু’মিনীন তাঁদের কাছে আগত মহিলাদের ধর্মীয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক প্রভৃতি বিষয়ে নৈতিক শিক্ষা দান করতেন। পৃথিবীর অন্য কোন ধর্মই ইসলামের ন্যায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সমাজে নারীদের অধিকারকে বিশ্লেষিত ও পরিমার্জিত করেনি। তাই অন্য সকল অধিকারের পাশাপাশি উপযুক্ত ও উপকারী জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে শিক্ষিত ও কর্মঠ হিসেবে গড়ে তোলার অধিকারও ইসলাম নারীকে দিয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে নারীদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য ও কল্যাণমুখীতার দিকে খেয়াল রাখতে গিয়ে ইসলামী শরীয়ত নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সবিশেষ কিছু বিধিমালা ও সতর্কতা অবলম্বন করেছে। আর একথা সর্বজন বিদিত যে, উক্ত ইসলামী বিধিনিষেধের আওতায় থেকে পড়ালেখা করে জগতব্যাপী মুসলিম নারীদের জীবন সুসংহত ও কার্যকরী গুণাবলী সম্পন্ন হয়েছে। অপরদিকে পাশ্চাত্য ও বিধর্মী সংস্কৃতির অবলোকনে যেসব অপাংক্তেয় পদ্ধতির অনুপ্রবেশ শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘটেছে, দূরদৃষ্টি দিয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে তার অসারতা ও অপকারিতা প্রমাণিত।
নারী শিক্ষার্জনে আ’লা হযরত’র অভিমত
ইমাম আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র প্রদর্শিত শিক্ষা ব্যবস্থাতে উপরোক্ত বর্ণনা অনুযায়ী নারী শিক্ষাও তদ্রুপ ভাবগাম্ভীর্য বহন করে। বর্তমানে একশ্রেণীর তথাকথিত নারীবাদী জনগোষ্ঠী আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলায়হি কে নারী শিক্ষাবিরোধী বলে সাব্যস্ত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। অথচ ইসলামী শরীয়তের সীমারেখার ভিতরে নারীদের জন্য তাঁদের স্বভাব-প্রকৃতি ও জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের বিষয়াদি, চাহিদার আলোকে, উপকারী ও স্বতন্ত্র সিলেবাস প্রণয়ন করা উচিত বলে ইমাম আহমদ রেযা খান রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মূল্যবান অভিব্যক্তি বিদ্যমান রয়েছে। ইসলাম সহশিক্ষাকে অনুমোদন দেয়না। নারীদের জন্য পৃথক ব্যবস্থায় স্বতন্ত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ পূর্বক সেখানে পর্দাসহকারে যে সকল জ্ঞান ও কর্মমুখী বাস্তব শিক্ষা অর্জন সম্ভব সে সব বিষয়ই ইসলামে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
আমাদের বর্তমান সমাজের মুসলিম নারীদের অবস্থান বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, শিক্ষার্জন যেন সুনির্দিষ্ট ক্লাস ভিত্তিক ঊর্ধগামিতার মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি নারী শিক্ষার ব্যাপারে এমন যুগান্তকারী সমাধানের পথ মুসলিম জাহানকে দেখিয়ে ছিলেন যার ন্যূনতম বা কিয়দাংশ যদি এখনও সমাজের কোন পর্যায়ে বাস্তবায়িত হতে পারে তাহলে মুসলিম নারী জাতি পাবে ইসলামী শিক্ষার আলোকে অনন্য একদিশা। শিক্ষার্থীদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে এবং খোদার যমীনে খোদার মর্জি মোতাবেক জীবন পাথেয় ও আখেরাতের অর্জন যোগাড় করতে এক অনন্য পথ-পদ্ধতি এই শিক্ষা দর্শন।
দ্বীনী ও দুনিয়াবী ইলম অর্জন
ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষার অবলম্বন মূলত ইসলামী শরীয়তের মৌলিক চারটি উৎস তথা- ১. আল-কুরআন, ২. আল-হাদীস, ৩. ইজমা এবং ৪.কিয়াস। এ চারটির বাইরে সবধরণের ইলম অতিরিক্ত। তবে এক্ষেত্রে অন্যান্য পার্থিব জ্ঞানার্জন যদি এই নিয়তে করা হয় যে, তদ্বারা দ্বীন ধর্মের কল্যাণ সাধন করা হবে। তাহলে তা-ও ধর্মীয় জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত হবে অন্যথা নয়। এছাড়াও কল্যাণ অর্জন ও উপকার হাসিল করার দৃষ্টিকোণ থেকেই সলামীশিক্ষা ব্যবস্থার সহায়ক প্রাচীন কিংবা আধুনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক বা তথ্য-উপাত্তের সমাহার, চিকিৎসা বিজ্ঞান-প্রকৌশল, প্রযুক্তিবিদ্যা, ভূগোল, অর্থনীতি, জ্যামিতি, হিসাব বিজ্ঞানসহ যেকোন বৈধ জ্ঞান অর্জন করতে কোন সমস্যা নেই। এমনকি ইংরেজী ভাষা শিক্ষা যা স্বয়ং আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলায়হি ঘৃণা করেছেন কিন্তু কোন জ্ঞানী মুসলমান যদি খ্রিষ্টবাদের অসারতা প্রমাণ করতে ও খ্রিষ্ট মতবাদ খণ্ডনের জন্য সেই ইংরেজী শিক্ষা অর্জন করে তাতে নিঃসন্দেহে সাওয়াবের অধিকারী হবে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেছেন। তবে যেসব জ্ঞান ইহ-পরকালে কোন কাজে আসবেনা অথবা অযৌক্তিক ও সমালোচনা যোগ্য সেসব জ্ঞান অর্জন নিষিদ্ধ।
আ’লা হযরতের শিক্ষা নীতিতে মুসলিম নারীদের সংশ্লিষ্টতা
ইমাম আ’লা হযরতের রেখে যাওয়া দারুল উলূম মানযারুল ইসলামের অনন্য শিক্ষা ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত ও শিক্ষাচিন্তা ধারার পর্যায়ক্রমিক বিশ্লেষণও মূলত নারী শিক্ষা সংশ্লিষ্টতার উজ্জ্বল একেকটি ধাপ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
একজন মায়ের কোলই তাঁর শিশুসন্তানের প্রথম শিক্ষা গ্রহণের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াস্থল
মা নিজেই যদি উপযুক্ত শিক্ষায় প্রশিক্ষিত না হন, তাহলে মুসলিম জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার শিশুরা অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী নরম কাঠ যেমন যেদিকে ফিরানো হয় সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে বাচ্চাদের প্রাথমিক শিক্ষাই তাদের পরবর্তী জীবনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে ভূমিকা রাখবে। এক্ষেত্রেও জীবনে মর্যাদা ও প্রশান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে শিশুর মনে মমত্ববোধ ও ভালবাসার মাধ্যমে যেগুণ গ্রাহীতা গড়ে তোলার প্রতি আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলায়হি অপরিসীম গুরুত্বারোপ করেছেন সেই মহান দায়িত্বের অধিকাংশই একজন মায়ের পালন করতে হয়। মাতৃভাষায় পাঠদান ও ভাষা শিক্ষার সময় তার মাঝে রুচিবোধ ও ইসলামী মন মানসিকতা জাগিয়ে তোলা এবং শারীরিকভাবে কর্মক্ষম ও ছোট ছোট পদক্ষেপে বোধশক্তির সুউজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে শিশুটিকে গড়ে তুলতে নানাবিধ প্রায়োগিক প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়া জানা থাকাটাও একজন মায়ের জন্য নেহায়েতই জরুরী। সন্তানের মুখে আধো আধো বুলি ফুটতেই প্রথমে ‘আল্লাহ আল্লাহ’ তারপর সম্পূর্ণ কলেমা তাইয়্যেবাহ শেখানো থেকে শুরু করে, বোধশক্তি হলে ইসলামী তাহযীব-তমদ্দুনের আদলে সন্তানকে শিষ্টাচারিতা আদব-আখলাক শিক্ষা দেয়া, খানা-পিনা, চলাফেরা, উঠা-বসা, নম্রতা, লজ্জাশীলতা, বড়দের সম্মান, পিতা-মাতা আত্নীয় স্বজন ও শিক্ষকদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করা ইত্যাদি সহ কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা দেয়া এবং ইসলামী আক্বীদা, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সুন্নত সম্পর্কিত জ্ঞান শিক্ষা দেয়া, সাত বছর বয়সে নামাজের মৌখিক তাকীদ দেয়া, ইলমে দ্বীন বিশেষত অজু, গোসল, নামাজ, রোযা ইত্যাদির মাস’আলা শিক্ষা দেয়াসহ সৎসঙ্গ বজায় রেখে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সন্তুষ্টি অর্জনের খাতিরে নিজেকে পুরো জীবন নিবেদিতপ্রাণ রাখা প্রভৃতি ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি কতৃক বর্ণিত সকল মহিমান্বিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষার সাথেই মায়ের তথা নারী শিক্ষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন নারী নিজে ইসলামী শিক্ষায় সুশিক্ষিত না হলে তাঁর মাধ্যমে গড়ে ওঠা পরিবার ও স্বামী-সন্তানাদি কখনোই ইসলামের সুশীতল শিক্ষার পরম সে ছায়া পাবেনা। তা ছাড়া ইসলামের এমন অসংখ্য বিষয়াদি যেমন- উত্তরাধিকার আইন, মহরানা ইত্যাদি বহু এমন জ্ঞান রয়েছে যা নারীর জন্য অর্জন করা একান্ত অপরিহার্য, নয়ত সে একজন মুসলিম নারী হিসেবেও নিজের অধিকার ও অবস্থান সম্পর্কে সম্যক অবগত ও সচেতন হতে পারবেনা।
আমাদের সমাজের দিকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, মুসলিম নারীরা বর্তমানে বৃটিশ কলোনী শাসনের রেখে যাওয়া সেই দুরভিসন্ধিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থারই সংযোজিত-বিয়োজিত ও কিছুটা পরিবর্তিত রূপে স্কুল-কলেজ বা মাদ্রাসা ইত্যাদিতে নিজেদের জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট শিক্ষা সনদ অর্জন শেষে জীবিকা অর্জনের তাগিদে অপারগতা থেকে অথবা অর্জিত শিক্ষাকে সমাজে কাজে লাগাতে গিয়েও নারীরা অনেকেই বিবিধ সেক্টরে কর্মক্ষেত্রেও নিয়োজিত হচ্ছেন। ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র শিক্ষাদর্শন বিবেচনায় বর্তমান প্রেক্ষাপটের দিকে লক্ষ্য করলে নারী সমাজের পরিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন যোগ্য না হলেও অন্ততপক্ষে শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক ও নৈতিক আদর্শগত উৎকর্ষতা বজায় রাখতে নারীদের ব্যাপকহারে পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুনিশ্চিতকরণ ও পার্থিব শিক্ষার পাশাপাশি ইলমে দ্বীন অর্জন করার প্রতিও গুরুত্বারোপ আরও জোরদার করা একান্ত প্রয়োজন। যার জ্বলজ্যান্ত একটি উদাহরণ হল, “মাসলাকে আ’লা হযরত”র উপর ভিত্তি করে শাহেনশাহে সিরিকোট রহমাতুল্লাহি আলায়হি’৫৪ তে এশিয়া বিখ্যাত দ্বীনী শিক্ষার যে মারকায জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন তারই অপর মহিলা শাখা হিসেবে’৯৬ তে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মহিলা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন পীরে বাংগাল হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ্ ম.জি.আ., যা আসলে আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মাধ্যমে আমাদের বাংলাদেশেই আ’লা হযরতের উন্নয়নমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার সুন্দরতম নজির বহন করছে। পরিশেষে পদ্ধতিগুলোর উপযুক্ত বাস্তবায়ন সম্ভবপর হলে মুসলিম নারীদেরকে পাশ্চাত্য ও হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির করাল থাবায় জর্জরিত অবস্থায় আর দিকভ্রষ্ট হতে হবেনা বরং সুনির্দিষ্ট প্রায়োগিক ইসলামী শিক্ষার পরিবেশ ও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবন গঠণ করে কর্মক্ষেত্র, পরিবারসহ সে নারী যে অঙ্গনেই বিচরণ করুক না কেন, পূর্ণপর্দা সহকারে যেকোন প্রতিকূল অবস্থাতেও সে ইসলামী স্বকীয়তার আড়ালে নিজের জীবনকে উম্মুল মু’মিনীন মুসলিম নারী আদর্শের সেই চেতনার আলোকে গড়ে তুলতে পারবে, সর্বোপরি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন প্রতিফলিত হবেই আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র নারী শিক্ষার প্রতি কাক্সিক্ষত সেই শিক্ষা দর্শন ও চিন্তাধারার, যা হল- মারিফাতে ইলাহী অর্জনের মাধ্যমে ইশক্বে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তথা দরবারে রিসালতে নিজেকে বিলীন করে দেয়া, সুনিশ্চিতভাবে অঙ্কিত হবে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণময় এক অধ্যায়, ইনশাআল্লাহ।
তথ্যসূত্র-
১. কানযুল ঈমান খাযাইনুল ইরফান, বঙ্গানুবাদ, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান।
২. আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি: জীবন ও অবদান, অধ্যক্ষ মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি। ২য় সংস্করণ ২৪ সফর ১৪৪২ হিজরি
৩. মারিফে রেযা, করাচি, দারুল উলুম মানযারুল ইসলাম শতবার্ষিকী সংখ্যা, জুলাই-সেপ্ট ২০০১, পৃঃ ২০৮,২০৯
৪. ফতোওয়ায়ে রিজভীয়্যাহ, ১০ম খন্ড, ইমাম আ’লা হযরত (র.)
৫. মালফুযাত ই আ’লা হযরত, শাহজাদা মাওলানা মুস্তফা রেযা বেরলভী (র.), অনুবাদ- মুজিবুর রহমান নেজামী, প্রকাশ- ২০১৩
৬. আ’লা হযরত কি নযরিয়াতে তা’লীম কি সীধা সীধা খুসুসিয়াত, সলিম উল্লাহ জুন্দরান, রিসার্চ জার্নাল পাকিস্তান এডুকেশন ফাউন্ডেশন ইসলামাবাদ, জুলাই ১৯৯৯
৭. প্রফেসর ড.মুহাম্মদ মসউদ আহমদ, ইমাম আহমদ রেযা আউর আলমে ইসলাম, করাচী, ১৯৮৪ সন, পৃঃ ১১৮
৮. ইসলামে নারী শিক্ষা, ড. মোহাম্মদ বাহা উদ্দিন, প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ১৯
৯. ইসলামে নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব, গাজী মো. রুম্মান ওয়াহেদ, ডেইলি-বাংলাদেশ.কম, প্রকাশ ২০১৯
১০. ইমাম আহমদ রেযা খা’র জীবন ও কর্ম, সৈয়্যদ মুহাম্মদ জালাল উদ্দিন, গবেষক, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়।
১১. নারীশিক্ষায় ইসলামের প্রেরণা, মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪
১২.ইমাম আহমদ রেযা খাঁন (র.)-এর প্রতি অপবাদের জবাব, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাসউদ আহমদ, অনুবাদক- কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন, প্রকাশ ২০১৮।
লেখক : বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ মহিলা বিভাগ
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •