দরসে কোরআন

0
দরসে কোরআন
হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
یُوْلِجُ الَّیْلَ فِی النَّهَارِ وَ یُوْلِجُ النَّهَارَ فِی الَّیْلِؕ-وَ هُوَ عَلِیْمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ(۶) اٰمِنُوْا بِاللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَاَنْفِقُوْا مِمَّا جَعَلَكُمْ مُّسْتَخْلَفِیْنَ فِیْهِؕ-فَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَ اَنْفَقُوْا لَهُمْ اَجْرٌ كَبِیْرٌ(۷) وَ مَا لَكُمْ لَا تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِۚ-وَ الرَّسُوْلُ یَدْعُوْكُمْ لِتُؤْمِنُوْا بِرَبِّكُمْ وَقَدْ اَخَذَ مِیْثَاقَكُمْ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ(۸) هُوَ الَّذِیْ یُنَزِّلُ عَلٰى عَبْدِهٖۤ اٰیٰتٍۭ بَیِّنٰتٍ لِّیُخْرِجَكُمْ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَى النُّوْرِؕ-وَ اِنَّ اللّٰهَ بِكُمْ لَرَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ(۹) وَ مَا لَكُمْ اَلَّا تُنْفِقُوْا فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ وَ لِلّٰهِ مِیْرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِؕ-لَا یَسْتَوِیْ مِنْكُمْ مَّنْ اَنْفَقَ مِنْ قَبْلِ الْفَتْحِ وَ قٰتَلَؕ-اُولٰٓىٕكَ اَعْظَمُ دَرَجَةً مِّنَ الَّذِیْنَ اَنْفَقُوْا مِنْۢ بَعْدُ وَ قٰتَلُوْاؕ-وَ كُلًّا وَّعَدَ اللّٰهُ الْحُسْنٰىؕ-وَ اللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِیْرٌ۠(۱۰)
তরজমাঃ (মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন) তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) রাত্রিকে (অর্থাৎ অংশ বিশেষকে) প্রবিষ্ট করেন রাতে। এবং তিনি অন্তরের বিষয়াদি সম্পর্কেও সম্যক জ্ঞাত আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উপর ঈমান আনো এবং তাঁরই পথে তার কিছু ব্যয় করো যার মধ্যে তোমাদেরকে অন্যান্যদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। সুতরাং যেসব লোক তোমাদের মধ্য থেকে ঈমান এনেছে এবং তাঁর পথে ব্যয় করেছে তাদের জন্য রয়েছে মহা প্রতিদান। এবং তোমাদের কি হয়েছে যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনছো না? অথচ এ রাসুল তোমাদেরকে আহ্বান করছেন যে, আপন প্রতিপালকের উপর ঈমান আনো এবং নিশ্চয় তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ) যিনি আপন বান্দার উপর সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি অবতীর্ন করেন, যাতে তোমাদেরকে অন্ধকারসমূহ থেকে আলোর দিকে নিয়ে যান। এবং নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর অবশ্য করুনাময় পরম দয়ালু। এবং তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় করছো না? অথচ নভোমন্ডলসমূহ ভূমন্ডলের ‘ওয়ারিছ’ (মালিক) আল্লাহই। তোমাদের মধ্যে সমান নয় ওইসব লোক, যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় ও জিহাদ করেছে, তারা মর্যাদায় ওইসব লোক অপেক্ষা বড়, যারা মক্কা বিজয়ের পরে ব্যয় ও জিহাদ করেছে, এবং তাদের সবার সাথে আল্লাহ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন এবং আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্মগুলো সম্পর্কে অবহিত আছেন। [সুরা আল-হাদীদ, ৬-১০ নং আয়াত]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
الخ وَمَا لَكُمْ أَلَّا تُنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ এর শানে নুযুল ঃ
উপরোক্ত আয়াতের শানে নুযুল বর্ণনায় প্রখ্যাত তাফসীরবেত্তা ইমাম কালবী রহমাতুল্লাহি আলায়হি উল্লেখ করেছেন যে, উদ্ধৃত আয়াতখানা নবি-রাসুলগণের পর মানবকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মুমিন মনীষী সায়্যেদুনা আবু বকর সিদ্দিক’র রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শানে অবতীর্ণ হয়েছে। কেননা, তিনিই হচ্ছেন ঐ ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করেছেন এবং রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বোত্তমভাবে সাহায্য করেছিলেন। (তাফসীরে কাশ্শাফ, খাযায়েনুল ইরফান ও নূরুল ইরফান)
সকল সাহাবায়ে কেরাম জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত
ইসলামের ইতিহাসে সকল সাহাবায়ে কেরাম রা. সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠতম মুসলমান। তাঁরা স্বচক্ষে ইসলামের প্রবর্তক সৃষ্টিকুল সরদার নবিকুল শিরমনি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রত্যক্ষ করে ঈমান এনেছেন ঈমান –ইসলামের মিশনকে রক্ষা ও প্রচার প্রসারে কাফের মুশরিকদের মোকাবেলায় বদর, ওহুদ, খন্দক ও খায়বারে জান-মাল সর্বস্ব উৎসর্গ করে যুদ্ধ করেছেন। দ্বীনের ঝান্ডাকে সমুন্নত করতঃ অনেকে শহিদ আর অনেকে গাজী হিসেবে মর্যাদামন্ডিত হয়েছেন। পরবর্তী মুমিনগন কোন ক্ষেত্রেই তাঁদের সঙ্গে তুলনীয় কিংবা তাঁদের সমমর্যাদা সম্পন্ন হতে পারেন না। কেননা, তাঁরা হলেন রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও পরবর্তীতে আগমনকারী সকল উম্মতের মধ্যকার সেতু বন্ধন স্বরূপ। মা‘সুম (অর্থাৎ নিস্পাপ-নিস্কলুষ) নবির মাহফুজ (অর্থাৎ ত্রুটি-বিচ্চুতি হতে হেফাজতকৃত) শিষ্য। তাঁদের মাধ্যমেই মদিনার প্রকৃত ও পরিপূর্ণ ইসলাম সারা বিশে^ প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁদেরকে বাদ দিয়ে প্রকৃত ঈমান ইসলাম, কুরআন সুন্নাহর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। তাঁরা ঈমান ইসলামের অবিচ্ছেদ্য স্বত্ত্বায় পরিণত হয়েছেন। তাঁদের সমালোচনা মূলত ঈমান ইসলামের অবমাননা। কেননা, তাঁরাই হলেন হক্ব আর বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের মাপকাঠী, সঠিক হেদায়াতের মানদন্ড,ঈমান ইসলামের মূর্ত প্রতীক, কুরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াতে আর হাদিসে রাসুলের অনেক রেওয়ায়াতে তাঁদের স্ববিশেষ মর্যাদা মহিমা আর শ্রেষ্ঠত্ত্বের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যার দুয়েকটি নি¤েœ উদ্ধৃত করা হলো।
সুরা আল বাক্বারাহ’র ১৩৭ নম্বর আয়াতে এরশাদ হয়েছে, فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا অর্থাৎ অতঃপর তারা যদি এভাবে ঈমান আনতো, যেমন তোমরা (অর্থাৎ সাহাবায়ে রাসুল) ঈমান এনেছ, তবেই তো তারা হেদায়াত পেয়ে যেতো।
এ আয়াতের আলোকে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হলো সাহাবা কেরাম হলেন ঈমানের মাপকাঠী। আল্লাহ রাসুলের নিকট গ্রহণযোগ্য ও পছন্দনীয়, ঈমানের নমুনা।
সুরা আল আনফালে’র ৪নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, اولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ অর্থাৎ এরাই (অর্থাৎ সাহাবিরাই) প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য রয়েছে অসংখ্য, অগন্য মর্যাদা তাদের প্রতিপালকের নিকট আর মাগফিরাত এবং সম্মানজনক জীবিকা। মহান আল্লাহর সাহাবিরায় হলেন প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মুমিন। (সুবহানাল্লাহ)
সুরা আল হাদীদ’র ১০ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, وَكُلًّا وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى অর্থাৎ আর মহান আল্লাহ সকলের (সাহাবিয়ে রাসুলের) সাথে জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। অর্থাৎ সকল সাহাবিয়ে রাসুল জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। (আলহামদুলিল্লাহ)
হাদিস শরিফে আল্লাহর হাবিব এরশাদ করেছেন, لاتمسُّ النار من رأنى অর্থাৎ যারা (ঈমান সহকারে) আমি নবিকে দেখেছে জাহান্নামের আগুন তাদেরকে স্পর্শ করবে না। অন্য রেওয়ায়াতে এরশাদ হয়েছে, اصحابى كالنجوم بايهم اقتديتم اهتديتم অর্থাৎ আমি নবির সাহাবীগণ (হেদায়াতের) নক্ষত্রস্বরূপ যে কোন একজনকে তোমরা অনুসরণ করবে হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।
উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত হলো সাহাবায়ে রাসুল উম্মতের হেদায়াতের বড় অবলম্বন, ঈমান আক্বীদার মানদন্ড তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা কিংবা তাঁদেরকে বিতর্কের বিষয় বা আক্রমনের লক্ষ্যস্থল বানানো হারাম, কুফরী ও গোমরাহীর নামান্তর।
পক্ষান্তরে সাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকে কোনো প্রকারের পদস্খলন বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু হয়ে থাকলে তা ছিল خطاء اجتهادى তথা ইজতেহাদি ভুল। যে কারণে সেগুলোকে গুনাহের মধ্যে গণ্য করা যায় না। বরং সহীহ বুখারীর বর্ণনানুযায়ী আল্লাহর নবি এরশাদ করেছেন, المجتهد يخطى ويصيب فان اصاب فله اجران وان اخطى فيه اجر অর্থাৎ মুজতাহিদ বা কুরআন হাদিসের গবেষণাকারী ভুল কিংবা শুদ্ধ দুটিই করতে পারে। যদি তার ইজতেহাদ শুদ্ধ হয় তবে দুটি সাওয়াব পাবে। আর যদি তার ইজতেহাদ ভুল হয় তবে একটি সাওয়াব পাবে। আর যদি বাস্তবে কোনো গুনাহ হয়েই যায়, তবে প্রথমত তা তাদের সারাজীবনের সৎকর্ম, এবং রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলামের সাহায্য ও সেবা মোকাবেলায় মাফের কোঠায় থাকে। দ্বিতীয়তঃ তাঁরা ছিলেন অসাধারণ আল্লাহভীরু সামান্য গুনাহের কারণে তাঁেদর অন্তরাত্ম কেঁপে উঠতো। তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে তাওবা করতেন এবং নিজের উপর গুনাহের শাস্তি প্রয়োগ করতে তৎপর হতেন।
কেউ নিজেকে মসজিদে নববী শরিফের স্তম্ভের সাথে বেধেঁ দিতেন। এবং তাওবা কবুল হওয়ায় নিশ্চিত বিশ^াস অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তদবস্থায়ই দন্ডায়মান থাকতেন। এছাড়া তাঁদের প্রত্যেকের পূন্য এত বেশি ছিল যে, সেগুলো দ্বারা গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে যেতে পারে। সর্বোপরি আল্লাহ তাঁদের মাগফেরাতের ব্যাপক ঘোষণা দিয়েছেন বিভিন্ন আয়াতে। শুধু মাগফিরাতই নয়, رضى الله عنهم ورضوا عنه বলে তাঁর সন্তুষ্টির ও নিশ্চিত আশ^াস দান করেছেন। তাই তাঁদের পরস্পরে যেসব মতবিরোধ ও বাদানুবাদের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর ভিত্তিতে তাঁদের মধ্যে কাউকে মন্দ বলা অথবা দোষারোপ করা নিশ্চতভাবে হারাম। হাদিসে রাসুলের ঘোষণানুযায়ী অভিশপ্ত হওয়ার কারন। (নাউজুবিল্লাহ)
وَلِلَّهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
উদ্ধৃত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় মুফাস্সেরীনে কেরাম বর্ণনা করেছেন আরবি অভিধানে “মীরাছ” উত্তরধীকার সূত্রে প্রাপ্ত মালিকানাকে বলা হয়ে থাকে। এই মালিকানা বাধ্যতামূলক মৃতব্যক্তি ইচ্ছা করুক বা না করুক, ওয়ারিশ ব্যক্তি আপনা আপনি মালিক হয়ে যায়। এখানে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের উপর আল্লাহর সার্বভৌম মালিকানাকে মীরাছ শব্দ দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে। এর রহশ্য এই যে, তোমরা ইচ্ছা কর বা না কর, তোমরা আজ যে যে জিনিসের মালিক বলে গণ্য কর সেগুলো অবশেষে মহান আল্লাহর বিশেষ মালিকানায় চলে যাবে। সবকিছু প্রকৃত ও স্থায়ী মালিক পূর্বেও আল্লাহ ছিলেন, কিন্তু তিনি কৃপাবশতঃ কিছু বস্তুর মালিকানা তোমাদের নামে করে দিয়েছিলেন। এখন তোমাদের সেই বাহ্যিক মালিকানাও অবশিষ্ট থাকবে না। সর্বোত্তমভাবে আল্লাহরই মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তাই এই মুহুর্তে যখন বাহ্যিক মালিকানা তোমাদের হাতে আছে তখন এ থেকে আল্লাহর নামে যা ব্যয় করবে তা পরকালে পেয়ে যাবে। এভাবে যেন আল্লাহর পথে ব্যয়কৃত বস্তুর মালিকানা তোমাদের জন্য চিরস্থায়ী হয়ে যবে। তিরমিযি শরিফের রেওয়ায়াতে আম্মাজান আয়েশা সিদ্দিকা রা. বর্ণনা করেছেন একদিন আমরা একটি ছাগল জবাই করে তার অধিকাংশ গোশত বন্টন করে দিলাম, শুধু একটি হাত নিজেদের জন্য রাখলাম। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, বন্টনের পর এই ছাগলের গোশত কতটুকো আছে? আমি আরজ করলাম শুধু একটি হাত রয়েগেছে। তিনি বললেন গোটা ছাগলই রয়ে গেছে। তোমার ধারণা অনুযায়ী শুধু হাতই রয়ে যায়নি। গোটা ছাগলই আল্লাহর পথে ব্যয় হয়েছে। এটা আল্লাহর কাছে তোমার জন্য থেকে যাবে। যে হাতটি নিজের খাওয়ার জন্য, পরকালে এর জন্য কোন প্রতিদান পাবে না। কেননা এটা এখানেই বিলীন হয়ে যাবে। (তাফসীরে মাযহারী)
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •