সৃষ্টিকুলে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী নবী মোস্তফা

0
সৃষ্টিকুলে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী নবী মোস্তফা
মুফতি মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান আল কাদেরী
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বিশে^ অগনিত ও অসংখ্য সৃষ্টি সৃজন করেছেন। সৃষ্টিকুলে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট দান করেছেন একমাত্র মানব জাতিকে। মানব জাতির মাঝে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের সম্মানে আসীন করেছেন নবী ও রাসূলদেরকে। নবী ও রাসূলগণ সহ সৃষ্টিজগতে সর্বাধিক সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে নবীগণের নবী সমগ্র বিশে^র রহমত হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহানবী নিজেই ঘোষণা করেন- সৃষ্টির সূচনা থেকে অন্ত পর্যন্ত আমিই সর্বাধিক সম্মানিত’’। এ সম্মানে ভূষিত করেছেন মহান রব তাঁর প্রিয় হাবিবকে। যার অধিক বর্ণনা রয়েছে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে।
চিরাচরিত নিয়মে সন্তান পিতা-মাতাকে, শিক্ষার্থী শিক্ষাগুরুকে, অনুসারী অনুসৃতকে, ছোটজন বড়জনকে, কর্মচারী কর্মকর্তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকে। এর ব্যত্যয় ঘটলে ধৃষ্ঠতায় পর্যবসিত হয়ে থাকে বিজ্ঞজন সহ সকলের নিকট। এমনকি এর জন্য কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় অনেকাংশে। আবার এ সম্মান পরস্পর প্রদর্শিত না হলে সমাজ হয়ে পড়ে কলুষিত ও পতিত হয় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তাই এ বিষয়টা মনে-প্রাণে সবাই মেনে নিলেও তাদের একাংশ বাদ সেধেছে প্রিয় নবীজির তাযিমের ক্ষেত্রে। দয়াল নবীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কথা আসলে চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায় ওই অংশটির। এমনকি বিদায়াত-শিরিকসহ নানান কথা বলতে থাকে তারা। আল্লাহ তাআলার প্রিয় হাবিবের শানে অশালীন মন্তব্যের পক্ষে কোন তথ্য-উপাত্ত নেই বরং তা সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। আদতে তাদের কাছে কুরআন-সুন্নাহর কোন দলীল-প্রমাণ আছে বলে মনে করার কারণ নেই। মহানবীর প্রতি সম্মান, প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে তারা সর্বদা উন্নাসিকতা প্রকাশ করে যা আদৌ শোভনীয় নয় এবং সুস্থ বিবেক ও ইসলামি দর্শনের সরাসরি পরিপন্থী।
প্রিয় পাঠক! মনে রাখা দরকার- ঈমানের পরে দ্বিতীয় যেই কাজটি অপরিহার্য তা হচ্ছে দয়াল নবীর প্রতি অগাধ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করা। কথাটা দুনিয়ার কারো না স্বয়ং মহান রবের বাণী ও নির্দেশনা। যেমন ইরশাদ হচ্ছে, “যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান আন এবং রাসূলের মহত্ব বর্ণনা ও (তাঁর প্রতি) সম্মান ও অগাধ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করো এবং সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর মহিমা প্রকাশ করো”। (সূরা ফাতাহ)। অর্থাৎ, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ওপর ঈমান এনে মুসলমান হয়ে অন্যান্য আমলের পূর্বে দ্বিতীয় যেটা অনিবার্য, তা হচ্ছে তাঁর রাসূলের প্রতি সীমাহীন সম্মান-মর্যাদা প্রদর্শন। উদ্ধৃত আয়াতে সম্মানের বিধানটা নবীর সাথে সম্পৃক্ত আল্লাহর সাথে নয়, এটাই অধিকাংশ তাফসীরকারকদের অভিমত। মহানবীর প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রকাশের শিক্ষা মহান রব পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে উম্মতকে দিয়েছেন। তাইতো কুরআনের এই শিক্ষা উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষ সাহাবায়ে কেরাম বাস্তবে প্রতিপালন করে অন্যান্যদের জন্য রেখে গেছেন উত্তম আদর্শরূপে।
আগেও বলেছি ছোট বড়জনকে, সন্তান মাতা-পিতাকে এবং একে অন্যকে সম্মান করার প্রথা আবহমান কাল থেকে সমাজে প্রচলিত এবং তা শরিয়তের নির্দেশও বটে। তাই স্বর্ণযুগের আলোকিত শ্রেষ্ঠ মুসলমান সাহাবায়ে কেরাম দয়াল নবীর প্রতি সীমাহীন সম্মান প্রদর্শন করেছেন যা সহীহ হাদিস দ্বারা প্রতিভাত। হাদিস শাস্ত্রের পাকা জহুরি ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রাসংগিক হাদিসটি স্ববিস্তার আলোকপাত করলেও আমি বিস্তার আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষিপ্তরূপে তুলে ধরব সম্মানিত পাঠক সমাজের জন্যে, ফলে নবী বিদ্বেষীদের জোচ্চুরি ও উপাখ্যান উম্মোচিত হবে মেঘহীন সূর্যের আলোর মতো।
হাদিস স¤্রাট ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলায়হি কিতাবুশ শুরুথ এর যুদ্ধ ও সমঝোতা পরিচ্ছেদে মনোজ্ঞ হাদিসটির বর্ণনায় উল্লেখ করেন- ষষ্ট হিজরিতে কাফিরদের কর্তৃক প্রায় দেড় হাজার সাহাবী সহ প্রিয় নবীজি হুদায়বিয়া নামক জায়গায় বাধার সম্মুখীন হলে মুসলমানদের শক্তি-সামর্থ যাচাই কল্পে কাফিরদের তরফ থেকে প্রতিনিধি হয়ে দক্ষ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি উরওয়া বিন মাসউদ ছাকাফী (যিনি পরে সাহাবী হয়েছেন) ছদ্মবেশে সাহাবীদের মাঝে এসে পড়েন। সংগোপনে তিনি সবকিছু গভীর পর্যবেক্ষণ করে পবিত্র মক্কায় গিয়ে কাফিরদের নিকট পেশকৃত প্রতিবেদনের ফলে তাদের আশা ও ইচ্ছা তিরোহিত এবং যুদ্ধের মনোভাবে ভাটা পড়ে যায়।
উরওয়া বিন মাসউদ-এর চিত্তাকর্ষক বক্তব্যটি ছিল এমন- আমি আল্লাহ তায়ালার শপথ করে বলছি যে, নবী-আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন স্বীয় শ্লেষ্মা মোবারক নির্গত করেন তখন সাহাবীদের মাঝে কেউ না কেউ তা হাতে নিয়ে আপন চেহারা ও শরীরে মালিশ করতে থাকেন। নবী সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন কিছুর নির্দেশ করেন, তড়িৎ তা পালনে তাঁরা লেগে পড়েন। তিনি যখন অযু করেন অযুর ব্যবহৃত পানি পাবার জন্য তাঁরা পরস্পর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে থাকেন। যখন তিনি আলাপ করেন তখন তাঁরা স্বীয় স্বরকে নবীজির সম্মুখে নিচু করেন। অগাধ সম্মানের ফলে তাঁর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় না। উরওয়া বিন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আরও বলেন- আমি মহান রবের কসম করে বলছি, হে আমার সম্প্রদায়! মহামান্য রাজা-বাদশার দরবারে প্রতিনিধিরূপে আমি গমন করেছি। এমনকি কায়সার, কিসরা ও নাজাশীর দরবারেও আমার উপস্থিতি হয়েছে, কিন্তু আল্লাহর শপথ এমন কোন সম্রাট বা অধিপতিকে দেখি নি, যার রাজ কর্মকর্তা কিংবা সভাষদগণ তাকে এমন সম্মান ও শ্রদ্ধা করে থাকেন, যেমন মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথী তথা সাহাবীগণ তাঁর প্রতি নিবেদন করে থাকেন।
প্রিয় পাঠক! উদ্ধৃত হাদিসে দেখা যায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি সম্মানিত সাহাবীগণের ভক্তি-শ্রদ্ধার পরাকাষ্ঠা, যা মুসলিম সমাজের জন্যে শিক্ষনীয় কিয়ামত দিবস পর্যন্ত। একে অপরকে সম্মান করার কারণে অনেক কিছু মেনে নেওয়া যায়, যা বাস্তবে পরিলক্ষিত, আর এটাই ভক্তি-শ্রদ্ধার প্রতীক। কিন্তু শ্লেষ্মা যদি অন্যের জামাতেও পতিত হয় অনিচ্ছাকৃতভাবে, সর্বোচ্চ ভালবাসা ও সম্মান হৃদয়ে ধারন করার পরও এটা কেউ মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে না। তা কেউ হজম করবে এমন কাউকে এ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। বলাবাহুল্য প্রিয় নবীজির শ্লেষ্মা মোবারক সাহাবায়ে কেরাম নিজেরাই উৎসাহী হয়ে প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে সাদরে আপন শরীর ও চেহারায় মালিশ করেছেন। এর নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। নবীজি নির্দেশ করেছেন বিধায় তা তাঁরা পালন করেছেন, এমন কথা হাদিসে নেই। বরং হাদিসে রয়েছে নিজ ইচ্ছায় তাঁরা তা করেছেন। এ অদ্ভুত ও বিষ্ময়কর প্রেম-ভালবাসা ও শ্রদ্ধাই হচ্ছে ঈমানের মূল।
আজকে মুসলিম সমাজের বিদ্যমান আবহ দেখে হৃদয়-মন হতাশ হয়ে যায়। যে নবীরপ্রেম ও তাযিম ঈমানের ভবিতব্য বিষয়, এটাকে বিদয়াত বলে প্রতিনিয়ত সরলপ্রাণ মুসলমানকে বিভ্রান্তির ফাঁদে ফেলে ঈমান হননের কাজে লিপ্ত কিছু লোক। স্বসম্মানে দাঁড়িয়ে দয়াল নবীজিকে সালাম দিলে বিদায়াতসহ বিভিন্ন রকমের অর্বাচীন ও উদ্ভট মন্তব্য করতে দ্বিধাবোধ করেনা। তাদের হাতে এ বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহ সমর্থিত কোন তথ্য-উপাত্ত না থাকার পরও দুঃসাহস দেখায় সত্য পথ থেকে প্রেমিক ঈমানদারকে দূরে রাখার নিমিত্তে। অনেকেই ঋজুতায় তাদের প্রতারণায় পা দিয়ে সত্য থেকে ছিটকে পড়ছে এবং পড়ছে, যা খুবই দুঃখজনক।
গুনাহগার উম্মতের তরফ থেকে নবীজির প্রতি একটু-আধটু সম্মান যদি বিদায়াত কিংবা শিরিক হয়ে থাকে, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম যাঁরা অগাধ ও সীমাহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা নবিজির প্রতি প্রত্যেক মুহুর্তে নিবেদন করতেন তাঁদের বেলায় ওদের ফাতওয়ার কী হবে একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা প্রয়োজন। আসলে তা বিদয়াত-শিরিক নয় বরং নিঃসন্দেহে এটাই ঈমান, যা সাহাবায়ে কেরামের আমল থেকে দ্বীপ্তিমান। তাইতো নবিজী ইরশাদ করেছেন, আমি ও আমার সাহাবায়ে কেরাম যেই আক্বিদা-বিশ্বাস ও আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং যারা এটার অধিকারী তারাই একমাত্র-নাজাতপ্রাপ্ত দল তথা জান্নাতী আর অন্যান্যরা জাহান্নামের পথিক।
হযরত সিদ্দিক্বে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুসহ অন্যান্য সাহাবীগণ নামাযেও দয়াল নবীজিকে সম্মান প্রকাশ করেছেন, যার বর্ণনা সহীহ বুখারি সহ অন্যান্য হাদিস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। ইমাম মালেক, ইমাম জাফর সাদেক ও ইমাম মোহাম্মদ বিন মুনকাদির সহ অসংখ্য আইম্মায়ে কেরাম কেবল নবীজির পবিত্র সত্তার প্রতি অগাধ সম্মান প্রকাশ করতেন না, এমনকি হাদিস বলার সময় নবীজির হাদিসের প্রতি এতো বেশি ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন, যার ফলে ওই সময় কারও চেহারার রং পরিবর্তন হতো, কেউ কেউ বসা থেকে শুয়ে পড়তেন, কারও অবস্থা এমন হতো যে মুখ গহ্বর পর্যন্ত শুকিয়ে যেত নবীর তাজিমে। যাদের মাধমে আজকে আমরা দ্বীন পেয়েছি তাঁরা কি কুরআন-সুন্নাহ সঠিকভাবে না বুঝে এমন কাজ করতেন? নিশ্চয়ই না। আর যারা বিরুদ্ধবাদী তারা কুরআন-সুন্নাহ সঠিকভাবে না বুঝেই শরিয়তকে বিকৃত করে দ্বীনকে বুঝতে এবং বুঝবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। ফলে মুসলিম সমাজে নানা অশান্তি বিরাজ করছে। তা থেকে উত্তরণ না ঘটলে ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাবে। এতে কোন সন্দেহ নেই।

লেখক: প্রধান ফকিহ, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •