তালেবান যুগ: কোন পথে আফগানিস্তান

0

আবসার মাহফুজ

দখলদার বিশ্বপরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মদদপুষ্ট তাবেদার সরকারগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ২০ বছর লড়াইয়ের পর আফগানিস্তানে আবারো তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি চমকপ্রদ, সন্দেহ নেই। আফগানিস্তান পুনরায় তালেবান যুগে প্রবেশের পর এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক অঙ্কে নানা পরিবর্তন এসেছে। স্বার্থগত কারণে তালেবানবিরোধী অনেক দেশ তাদের সার্থে সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। তাদেরকে স্বার্থের গুটি হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টাও করছে কিছু দেশ। পঞ্জশিরে তালেবানের বিরুদ্ধে সিংহের গর্জনও শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সেখানে ব্যাপক রক্তপাতও হয়েছে। কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে কিছু মন্ত্রী নিয়োগ দিলেও তালেবানরা এখনো সরকার গঠন করতে পারেনি। সরকারের ধরন কি হবে তাও ঠিক করতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ বিরোধও প্রকট আকার ধারণ করেছে, যা আগে ছিল না। তাছাড়া নারীশিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের কিছু বিতর্কিত পদক্ষেপ ইতোমধ্যে আফগান জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেছে। সংগতকারণে সামনে আরো নতুন দৃশ্য দেখা যাবে। এসব বিবেচনায় আফগানিস্তানে শান্তি কতটুকু ফিরে আসবে বা আদৌ ফিরে আসবে কি না, তা দেখার বিষয়।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের হামলার পর আল কায়দা নির্মূলে দুই দশক আগে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটোবাহিনীর অভিযানে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন হয়েছিল। তালেবানের পতনের পর দেশটিতে ক্ষমতাসীন হয় মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন পুতুল সরকার। তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দমন অভিযান চালাতে থাকে। আফগানিস্তানে হাজার হাজার মার্কিন সেনার উপস্থিতির পাশাপাশি উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে বিপুল অর্থ ব্যয়ে গড়ে তোলা হয় মার্কিন বশংবদ আফগান সরকারি সামরিক বাহিনী। একইসঙ্গে আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো জোটের সামরিক ঘাটি স্থাপন করা হয়। কিন্তু এতোকিছুর পরও দমন করা যায়নি তালেবানদের। তালেবানরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোসেনাদের বিরুদ্ধে নেমে পড়ে এক রক্তাক্ত যুদ্ধে। গত দুই দশকের লড়াইয়ে তাদের জানমালের বিপুল ক্ষতি হলেও তারা হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০০-এর বেশি সেনা। আহত করেছে কয়েক হাজার। আফগান সেনাও মারা গেছে কয়েক হাজার। উভয়পক্ষের হামলায় নিহত হয়েছে হাজার হাজার আফগান নাগরিক। উদ্বাস্তু হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। সাম্প্রতিক দিনগুলোতেও কয়েক লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। এই লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র ৮৩ বিলিয়ন ডলার (কোনো কোনো হিসাবে এক ট্রিলিয়ন ডলার) খরচ করেছে। এতো বিপুল অর্থ খরচ ও সেনা ক্ষয়ের উদ্দেশ্য ছিল তালেবানবিরোধী লড়াইয়ে জেতা। কিন্তু শেষপর্যন্ত আশা পূরণের সম্ভাবনা না দেখে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও তার পথই অনুসরণ করেন। প্রসঙ্গত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সসম্মানে আফগানিস্তান ত্যাগের জন্যে তালেবানদের সাথে একটি গোপন চুক্তিও করেছে। যদিও বছরকয়েক ধরে মার্কিন মধ্যস্থতায় আফগান সরকারের সঙ্গে তালেবানের আলোচনা চলে আসছে। বছরদুয়েক আগে কাতারের রাজধানী দোহায় আনুষ্ঠানিকভাবে অনুষ্ঠিত হয় ‘ঐতিহাসিক শান্তি আলোচনা’। আর সে আলোচনার শুরুতেই ইসলামী শাসনের বিষয়টি তুলেছেন তালেবান নেতারা। তালেবানের উপনেতা মোল্লা আবদুল গনি বরদার বলেছিলেন, ‘আমরা আফগানিস্তানকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে চাই। এবং এটা নিশ্চিতভাবেই হতে হবে ইসলামিক ব্যবস্থার অধীনে। যেখানে এর সব নাগরিক নিজেদের আদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাবে।’ সে সময় আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে তখনকার আফগান সরকার ও তালেবান উভয়পক্ষের প্রতি জোর আবেদন রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও বলেছিলেন, ‘আপনাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থা কি হবে, তা আপনাদেরকেই তৈরি করতে হবে। সেটা ঠিক করতে হবে খোলা মন নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যম্যই।’ শেষপর্যন্ত একটি চুক্তি হয়েছে বটে, তবে তা একটি গোপন চুক্তি। তাও আবার তৎকালিন আফগান সরকারের সাথে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। আর সে চুক্তির সারমর্ম হচ্ছে, মার্কিন সেনা ও সেদেশের নাগরিকদের নিরাপদে প্রস্থান। জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর আফগানিস্তান থেকে সৈন্য ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী দেশটি আফগানিস্তান থেকে তাদের বিপুলসংখ্যক সৈন্য সরিয়ে নেয়। তবে তাদের ধারণা ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সৈন্য সরে যাওয়ার পর আফগান সরকার দেশটি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেও অন্তত ছয় মাস টিকে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে এ আভাসের চেয়েও কম সময়ের মধ্যে তালেবানরা পুরো আফগানিস্তান পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। এর কারণ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ার পথ খুঁজতে থাকলে আফগান বাহিনীর মনোবল পুরোপুরি ভেঙে যায়, বিপরীতে চাঙ্গা হয়ে ওঠে তালেবান যোদ্ধারা। তবে তালেবান যে এতো দ্রুত পুরো আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ সবার ধারণারও বাইরে। অনেকে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এটি তালেবানদের বিজয়, যুক্তরাষ্ট্রের চরম পরাজয়। এই ঘটনা ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েতনাম থেকে মার্কিনীদের লজ্জাজনক বিদায়ের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। উত্তর ভিয়েতনামের বিপ্লবীদের কাছে পরাজিত হয়ে সায়গনের ছাদ থেকে হেলিকপ্টারে করে পালিয়েছিল মার্কিনিরা। আসলে কি তাই? যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি না হলে কি তালেবানরা আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে নিতে পারতো? কখনো না। বরং কাবুলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তালেবান পাহারায় মার্কিন নাগরিকগণকে নিরাপদে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে দেখা গেছে। সত্যিটা হচ্ছে, আফগানিস্তান থেকে খনিজসম্পদসহ সব সম্পদ লুটের পর মার্কিনীরা যখন হিসেব করে দেখেছে নেয়ার মতো আর কিছু নেই, তখনই তারা আফগানিস্তান ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন তারা দেশটিতে অস্ত্রবাণিজ্য করবে। আর এ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে আফগানিস্তানের নানা গোত্রকে মুখোমুখি দাঁড় করাবে। তালেবানকে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচণা দেবে। ইতোমধ্যেই মার্কিনীদের নতুন মিশন শুরু হয়ে গেছে। তালেবানরা প্রথমে নারীশিক্ষাসহ নানা বিষয়ে যেসব ঘোষণা দিয়েছিল, সে অবস্থান থেকে তারা ক্রমশ সরে যাচ্ছে। শরিয়া আইনের নামে নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে।

তালেবানরা আফগানিস্তানকে ‘ইসলামি আমিরাত’ ঘোষণা করে ‘শরিয়তি’ শাসন কায়েমের যে ঘোষণা দিয়েছে, তাতে আফগান জনগণের আপত্তি না থাকলেও ইতোমধ্যেই ইসলামের নামে গৃহীত তাদের নানা পদক্ষেপ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিশেষত নারীশিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান, নারীর চলাফেরা, পুরুষদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করা সহ নানাবিষয়ে যেসব ফতোয়া জারি করা হয়েছে, সেসব বিষয়ে চরম বিতর্ক দেখা দিয়েছে। অনেক ইসলামি পন্ডিতজন তালেবানের এসব কর্মকান্ডকে ইসলামি শরিয়তের সাথে সাংঘর্ষিক বলে মত দিয়েছেন। তাদের মতে, ইসলামে যেখানে নর ও নারী উভয়ের জন্যে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ ঘোষণা করা হয়েছে এবং জ্ঞান অর্জনের জন্যে প্রয়োজনে সুদূর চিন দেশেও যেতে বলেছে, সেখানে তালেবানরা নারীশিক্ষাকে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে। তারা (তালেবানরা) বলছে, সন্তান ধারন ও লালন-পালনই নারীর একমাত্র কাজ। নারীর কর্ম নিয়ে তালেবানের দৃষ্টিভঙ্গিও ইসলামসম্মত নয় বলছেন অনেক আলেম। বিরুদ্ধপক্ষের লোকজনকে বিচার ছাড়াই বেছে বেছে হত্যাসহ আরো অনেক বিষয়ও তালেবানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ইসলামি শরিয়তি শাসনের নামে তালেবানের কিছু বিতর্কিত কর্মকান্ড ইসলাম সম্পর্কে যেমন সাধারণ মানুষের কাছে ভুল বার্তা দিচ্ছে, অন্যদিকে তালেবানকে সভ্যদুনিয়া থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। মুসলিমবিশে^র বিভিন্ন দেশও তালেবানের বিতর্কিত কর্মকান্ডের সমালোচনা করে তা থেকে সরে আসার আহবান জানিয়েছে। এ বিষয়ে তালেবানের বোধোদয় দরকার। তাদের মনে রাখা দরকার, প্রকৃত ইসলামি শরিয়াভিত্তিক শাসনের ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকার সুযোগ নেই। কারণ ইসলাম সবার মানবাধিকার রক্ষাকারী ও নিরপেক্ষভাবে সবপক্ষের যুক্তিসঙ্গত অধিকারের রক্ষাকবচ। কিন্তু শরিয়তের নামে যখন কোন গোষ্ঠীমত চাপিয়ে দিয়ে ফায়দা লুঠার অপচেষ্টা করা হয়, তখন তা বিপদ ডেকে আনে। তালেবানরা এ সত্য যতো তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততোই তাদের জন্য এবং আফগান জনগণের জন্যে মঙ্গলকর হবে।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের পর থেকেই দেশটি পরাশক্তিগুলোর একটি ‘প্রক্সি ওয়ার’-এর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তৃণমূলে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা তালেবান তরুণটি নিজেও হয়তো জানেন না তাঁরা কারও ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন কিনা। যদিও তাঁদের কাছে এটা দ্বীন প্রতিষ্ঠার লড়াই, কিন্তু তাদের নেতৃত্ব এবং পরাশক্তিগুলোর কাছে স্বার্থের লড়াই। আফগানিস্তানের দীর্ঘ সময় ধরে চলা ভূরাজনৈতিক দাবা খেলাটির একটি পর্যায় এখন দেখা যাচ্ছে এবং খেলাটি নিশ্চিতভাবেই এখানেই শেষ হচ্ছে না। তবে এককভাবে ক্ষমতায় না থেকে নানা দল-মতের গোষ্ঠীগুলোকে সঙ্গে রাখতে পারলে আফগানিস্তানে একটা স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার পথ অনেকটাই মসৃণ হয়ে যাবে।

লেখক: বিশিষ্ট সিনিয়র সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •