ড. সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ্ আল-মারূফ
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, নবীশ্রেষ্ঠ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীতে আগমন করলেন, পরবর্তীতে তাঁর নুবূয়্যতের অভিষেক হলো এবং বিশ্বে নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রবর্তন করে স্বাভাবিক দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলেন। এখন সারা বিশ্বে কোটি কোটি মসজিদে দৈনিক পাঁচবার তথা সারাক্ষণ রাউন্ড দ্য ব্লক মিনারে মিনারে তাঁর নাম উচ্চ আওয়াজে ঘোষিত হয়; এমন একজনের পৃথিবীতে আগমনের দিনটি উদযাপিত হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
আমরা যারা তাঁকে আমাদের নবী মানি; মানাটা যে আমার ঈমানের অর্ধেক রবং পুরোধা, তাঁর জন্মদিন মীলাদকে গৌরবে ঘোষণা করা এটাই তো স্বাভাবিক। একটি মানব সন্তান জন্ম নিলে তার মা-বাবা, ভাই-বোন, নানা-নানী, দাদা-দাদী, আত্মীয় স্বজন কত খুশী হয়; তাহলে যিনি এককভাবে হাজার হাজার বছর ধরে কেয়ামত পর্যন্ত নবী-রাসূল হিসেবে বলবৎ থাকবেন। তাঁর শুভাগমনের বর্ণাঢ্য ও আনন্দঘন করে রাখব এটাই তো স্বাভাবিক।
আর সে জন্যই পৃথিবীর এমন কোন দেশ নাই যেখানে সরকারি অথবা বেসরকারিভাবে মীলাদ দিবস উদযাপন হয় না।
পৃথিবী তো একটি গ্রহমাত্র। দুনিয়া হচ্ছে সকল গ্রহ নক্ষত্রের আধার। কেয়ামতের আগে হবে মহাপ্রলয়। তখন আসমান অর্থাৎ মহাকাশ ও তার গ্রহ-নক্ষত্র, ছায়াপথ, ব্লাকহোল ইত্যাদি এবং সপ্তাকাশ সব হয়ে যাবে ‘ছিজিল্লিল কুতব’ বইয়ের পাতার মত মিলিত।
আখেরাত হচ্ছে এ মহাপ্রলয়ের পর পুনরুত্থান বা ‘কিয়ামত’। যখন আল্লাহ্ তা‘আলা আবার একটি সূর্য বানাবেন যা সবার জন্য সমান উত্তাপ দেবে না। তখন একটি বড় মাঠ হবে বিচারের জন্য। এখানে হিসাব হবে, হাত-পায়ের সাক্ষ্য নেওয়া হবে এবং নেকীবদী মাপা হবে।
এই কিয়ামতের আগে যারা মারা যাবে তারা একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে থাকবে। নামে কবর হলেও তার অবস্থা হবে মৃত ব্যক্তির হাল অনুযায়ী। কেউ তো লম্বা একটা ঘুম দেবেন, কেউ বেহেশতের আঁচ পাবেন, আবার কেউ তো ত্রাহী ত্রাহী চিৎকার দেবেন।
এখন আসা যাক, এ ভূমিকার মূল উদ্দেশ্য। আমাদের নবী না হলে আল্লাহ্ কিছুই সৃষ্টি করতেন না, এ প্রচলিত বাণীটিকে অনেকে মানেন না। তবে পৃথিবীর সকল ওহাবী-সালাফি ইত্যাদি সহীহ হাদীস বলে তারস্বরে চিৎকারকারীরা একটি হাদীসকে সহীহ মানেন। তা হচ্ছে মুসনাদ আবি ইয়া’লা নামক হাদীস সঙ্কলনে আছে- لولاك ما خلقت الدنيا (হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম! আপনি না হলে আমি দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না।’
এখানে বলা হয়নি যে আপনি না হলে আমি পৃথিবী সৃষ্টি করতাম না। পৃথিবীকে আলো-উত্তাপ দিতে তো চন্দ্র-সূর্য প্রয়োজন। হ্যাঁ, শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিজগত মানুষকে এ গ্রহে পাঠিয়েছেন তাই নবীগণকেও এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এটা এ পৃথিবীর সৌভাগ্য। তবে কয়েকজন নবী যে জমিনের কবরে নামায পড়েন আবার ১,২,৩,৪,৫, ৬ ও ৭ম আসমানেও থাকেন এটাও দুনিয়ারই বরযখী অংশ। একজন নবী তো এখন ২য় আসমানে আছেন; তাঁর কবর হবে পৃথিবীতে। কাজেই সেটাও দুনিয়ারই অংশ। কারণ কেউ আখেরাতের জান্নাতে যাওয়ার পর আবার সেখান থেকে বের হওয়ার বিধান নেই। কাজেই ওটা বরযখ এবং চূড়ান্ত অর্থে দুনিয়ারই অংশ। বরযখ বলে যারা এখন কবরে আছেন তারা আখেরাতের বাঁশি শুনে কবর থেকে উঠে হাশরের মাঠের দিকে (বর্তমান সিরিয়া) দৌড়াতে থাকবে। তাদের নবীগণ ইয়া নাফসী, ইয়া নাফসী বলতে থাকবেন। একমাত্র আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলবেন, ইয়া উম্মতি, ইয়া উম্মাতি!
তাহলে ‘দুন্ইয়া’র নিকট জগত/নশ্বর তুচ্ছ জগৎ বলতে বর্তমান আসমান যমীনকে বুঝায়। (এ জন্যই একটা বিতর্ক আছে যে, হযরত ই¯্রাফিলের প্রথম শিঙ্গা-ফুৎকারে আল্লাহ্ ছাড়া সব ধ্বংস হয়ে যাবে, এখন জান্নাত ও জাহান্নামও কি ধ্বংস হবে? উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। তবে দ্বিতীয় ফুৎকারে সব আবার অস্তিত্ব পাবে।)
তাহলে মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম না হলে আসমান-যমীন, গ্রহ-নক্ষত্র, মানুষ-জিন, পাহাড়-পর্বত, নদী নালা, ফুল-ফসল, নবী-ফিরিস্তা কিছুই সৃষ্টি করতেন না।
আর দুনিয়া না থাকলে আখেরাত কার জন্য থাকতো? তবুও সেদিকে না গিয়েও বলতে পারি আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর হাবীব ও খলীল প্রিয়নবী মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি না করলে ব্যাপক অর্থে দুনিয়া সৃষ্টি করতে না।
আশা করি এতে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হলোঃ ১. দুনিয়া অর্থ শুধু পৃথিবী (Planet Earth) নয় এবং ২. শেষ পয়গম্বর হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ নবী। তিনি না হলে যে আল্লাহ্ দুনিয়াই সৃষ্টি করতেন না। তাহলে ‘খলিফা ফিল আরদ্বে’ (Earth) আদি পিতা আদম আলায়হিস্ সালাম হতেন না, তার বংশও হতো না। তাহলে নবী ‘ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম বা মূসা-ঈসা আলায়হিস্ সালাম কেউ-ই হতেন না।
বর্তমানে বাংলাদেশে একজন দাজ্জাল বের হয়েছে, যে দাবী করছে যে, মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠ নবী নন বরং ‘ইব্রাহীম’ আলায়হিস্ সালাম হচ্ছেন ‘খাইরুল বারিয়্যাহ্’। এ ধরনের বহু দাজ্জাল বহু বিষয় ফেরি করছে। যেমন বাংলাদেশের ম. রমান ডাক্তার প্রচার করছে যে, নবীর শাফাআত নেই এবং ঈসা আলায়হিস্ সালামকে হত্যা করা হয়েছে। তারিখে তারিখে পাওয়ার প্রেজেন্টেশন দিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু বলছেনা।
যা হোক আমার বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে- খাতামুন্নবিয়্যীন, সাইয়্যেদুল মুরসালীন, আহমাদ মুজতাবা বা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মীলাদ বা জন্মের শুভলক্ষণকে কেবল আরদ বা অর্থে-এর বাসিন্দারা সেলিব্রেট করেনা বরং দুনিয়া বলতে যা বুঝায় সবাই উদযাপন করে।
আমেরিকা সফরের সময় আমি সল্টলেক স্টেট-এর এক মসজিদের ইমামকে জুমার আগে বলতে শুনেছি যে, মীলাদুন্নবীকে আমরা Observe করতে পারি কিন্তু সেলিব্রেট (Selibrate) করতে পারি না। ওই মসজিদের বাঙালী সেক্রেটারীকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন আরে এ তো মুয়াজ্জিন, আমাদের ইমামের তো চাকুরী চলে গেছে, বউকে প্রহার করার অভিযোগে। যা হোক, আমি বললাম, আমাদের দেশে মীলাদ বিরোধীরা এ সময় টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে মীলাদ উদযাপনের বিরুদ্ধে বলে মূলত Selibrate করে।
আমাদের মসজিদগুলোতে মাইরের ভয়ে মীলাদের বিরুদ্ধে বলে না। তবে কয়েকটি নিজস্ব মসজিদে কিছু ইমাম বলে এটা করা বিদ্আত। অথচ উনি মাসিক ‘তনখা’ নিয়ে থাকেন যা খায়রুল কুরুন বা ১২০ হিজরী সালের ভেতর না থাকায় তার মত অনুযায়ী বিদ্‘আত।
যদি আসমান-যমীন এবং দুয়ের ভেতর যা আছে সবাই তার অস্তিত্বের জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মিলাদকে উছিলা মানেন এবং কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তা আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করে থাকে, থাকাই উচি, তাহলে কিছু লোক বিদআত বিদআত বলে অরণ্যের রোদন করলে কী আসে যায়। বিশ্বের জনসংখ্যা ভেতর অধিকাংশ লোক তো আল্লাহকেই বিশ্বাস করে না। রাসূলকে তো নয়ই। তাতে কী আসে যায়।
পৃথিবীর অধিকাংশ ইসলামী কেন্দ্র মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ্ ইত্যাদিতে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদযাপন হয়, জশনে জুলুছ হয়, আলোচনা সভা হয়। এর মাঝে সৌদী আরব যদি সরকারিভাবে তা উদযাপন না করে তাহলে কী আসে যায়।
আমি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ বছর পড়েছি (১৯৮৩-১৯৮৭); ১২ রবিউল আউয়াল কখনও তারা বন্ধ দেয়নি। তবে মুহাম্মদ ইবনে সালমান যুবরাজ হয়ে এখন এ তারিখ সরকারি বন্ধ ঘোষণা করেছেন। ওয়াহাবী-ইজম-এর কারণে সৌদী আরব যে অবশিষ্ট বিশ্বের মুসলমানদের মন থেকে বিচ্ছিন্ন তা তিনি একাধিকার প্রকাশ করেছেন। (তার অন্যান্য কার্যাবলী সম্পর্কে মন্তব্য করলাম না)
মক্কা মুকাররমায় সাইয়েদ আলবী মালেকী ঘটা করে মীলাদ ও কেয়াম করতেন। এটা জেনেও তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে তৎকালীন যুবরাজ (পরে বাদশাহ্) আব্দুল্লাহ্ তার জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন।
আমরা জানি, মহান আল্লাহ্ আমাদের নবীজি ব্যতিত আর কোন নবী-রসূলকে গোটা বিশ্বের জন্য প্রেরণ করেননি। কোন নবীর এমন কোন বিশেষত্ব নেই যা আমাদের নবীজীকে দেওয়া হয়নি। হ্যাঁ, অন্যান্য রসূলদের মধ্যে একে অন্যের উপর বিশেষত্ব দেওয়া হয়েছিল বটে।
[তবে আমাদের নবীজিকে এমন অনেক বিশেষত্ব দেওয়া হয়েছে যা অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। সংখ্যায় তা হাজার হাজার।]
আমাদের প্রিয়নবীর সময় হচ্ছে- কেয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য। তাই তার উম্মত সকল নবীর সম্মিলিত উম্মত-সংখ্যার চেয়েও বেশি। আর তিনি হচ্ছেন সমগ্র বিশ্বের জন্য।
মে’রাজ রজনীতে বায়তুল মুকাদ্দাসে সকল নবীর সালাতের জমাতে ইমামতিকে করেছিলেন? কে প্রথম শাফা‘আত করবেন এবং তাঁর শাফা‘আত আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে। তাহলে তিনি নবীশ্রেষ্ঠ না হলে কে হবেন?
নবী বলে গেছেন- انا سيد ولد ادم ولا فخر আমি শ্রেষ্ঠ আদম-সন্তান, তবে অহঙ্কার করি না। এ ধরনের অনেক সহীহ্ হাদীস রয়েছে। তদুপরি এ বিষয়ে এ উম্মতের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত। দেড় হাজার বছর পর কোন মানুষরূপী দাজ্জাল যদি এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে তাকে রাস্তার কুকুরের মত এড়িয়ে যেতে হবে।’ যেমন কুকুর তেমন মুগুর’, না-ই বললাম।
যারা আমাদের প্রিয় নবীর শান-মানকে অবনমিত করতে চায় তাদেরকে আমরা এড়িয়ে যাওয়া এখন আর সমীচিন নয়, তাকে জাহেল মনে করে প্রথমে জ্ঞান দিতে হবে। তবে আমরা জানি, কুকুরকে ট্রেনিং দেওয়া যায় কিন্তু নবীর সাথে বেয়াদবী করলে ওই লোক আর হেদায়তের পথ খুঁজে পায় না। ময়লা পানির পাইপ বন্ধ না করলে চৌবাচ্চার পানিতে কখনও স্বাদ থাকে না।
বাংলাদেশের সুন্নীরা এখন জেগে আছে। প্রিয়নবীর মর্যাদাহানিকর বক্তব্য প্রদান করার আগে তাঁদেরকে কঠিন হিসেব কষতে হবে। এ দেশ আউলিয়াদের দেশ। এখানে বেয়াদবদের স্থান নেই ।
জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা আমাদের মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে গভীরভাবে ভালবাসেন। তিনিও জঙ্গিবাদের দোসরদের এ দেশে পানি ঘোলা করতে দেবেন না। এ শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশের অনেক শত্রু আছে। তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ সবক দেওয়া প্রয়োজন। এ দায়িত্ব গোয়েন্দা সংস্থার। তবে সরিষার মধ্যে ভূত থাকলে তা দিয়ে ঝাড়ফুঁক দিলে ভূত যাবে না। দেশের সচেতন আলেম হিসেবে আমরা দায়িত্ব পালন করছি। আশা করি জনগণ নবীর দুশনদের প্রত্যাখ্যান করবেন।
লেখক: অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।