যিকরে মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম

0

মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম

بِسْم اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْم
وَرَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ-] [
“এবং আমি আপনার জন্য আপনার ‘যিক্র’ (স্মরণ)কে সমুন্নত করেছি।”

সম্মানিত পাঠক, একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, ওস্তাদের যিক্র (স্মরণ) কে শাগরেদ, মুর্শিদের যিক্র (স্মরণ) কে তাঁর সত্যিকার মুরীদ এবং দানশীল ব্যক্তির যিক্র (স্মরণ) কে তার দুয়ারের ভিখারী ও সাহায্যপ্রার্থী উন্নত করে, কিন্তু মাহবূব-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম ওই মহান ও মহত্বের অধিকারী সত্ত্বা, যাঁর ‘যিক্র শরীফ’ কে স্বয়ং খোদা তা‘আলা সমুন্নত করেছেন।

 র্ফশ ও আরশে হুযূর ’র যিকর
ক্বোরআন ও হাদীস অধ্যয়ন করার মাধ্যমে এ হাক্বীক্বত স্পষ্ট হয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা রসূল-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘যিক্র শরীফ’র চর্চা এত বেশি করেছেন যে, ফরশ-ই যমীন থেকে সুউচ্চ আরশ পর্যন্ত প্রত্যেক বস্তুকে তাঁর মহত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে অবগত করে দিয়েছেন। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কতই সুন্দর বলেছেন-
عرش پہ تازہ چھیڑ چھاڑ فرش پہ طرفہ دھوم دھام
کان جدھر لگائیے تیری ہی داستاں ہے
“আরশের উপর তাজা তাজা আলোচনা, ফরশ (যমীন) এর উপর আজ উৎসব! যে দিকেই কান লাগাবেন, সেদিকে শুধু হে আল্লাহর রসূল“ আপনারই গুণগান শোনা যাচ্ছে!”

 সালাত ও সালাম-এর হাদিয়া
আসমানসমূহে তাঁর চর্চা এতবেশি হয়েছে যে, সকল আসমানের ফিরিশতা আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুমে সারাক্ষণ তাঁর দরবারে দুরূদ ও সালামের নাযরানা পেশ করে হচ্ছে। ক্বোরআন মাজীদের পারা-২২, সূরা আহযাব-এ এসেছে,
إِنَّ اللّٰهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِيِّ-] [
“নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা এবং তাঁর ফিরিশতাগণ দুরূদ প্রেরণ করেন এ অদৃশ্যের সংবাদদাতা নবীর প্রতি।”

 বিশ্বকুলের প্রতিটি অণুকণা তাঁর সম্পর্কে অবগত
যমীনের উপর তাঁর ‘যিক্র শরীফ’-এর চর্চা হওয়ার একটি অর্থ এও রয়েছে যে, অবাধ্য জিন ও অবাধ্য মানবকুল ব্যতীত বিশ্বকুলের প্রতিটি অণু-পরমাণু তাঁর নবী ও রসূল হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ়বিশ্বাস রাখে। প্রত্যেককেই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর মহত্ব ও মর্যাদার ‘ইল্ম’ (জ্ঞান) দান করেছেন। যেমন- হাদীস শরীফে রয়েছে,
مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ شَئْ ٌإلَّا يَعْلَمُ أَنِّي رَسُولُ اللّٰه إلَّا عَاصِيَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ-] [
“কাফির জিন ও কাফির মানবকুল ব্যতীত আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তীতে যা কিছু রয়েছে, তারা আমার রসূল হওয়া সম্পর্কে অবগত।”

 ‘আদ্ববা- (عضبَاء) উষ্ট্রীর আশ্চর্যজনক ঘটনা
রসূল-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি উষ্ট্রী ছিল, যার নাম ছিল ‘আদ্ববা- (عضبَاء)। যখন এ উষ্ট্রী বন-জঙ্গলে বিচরণ করত, তখন জঙ্গলের ঘাস নিজ থেকেই সেটার নিকটবর্তী হয়ে যেত, যাতে সেটা কোন কষ্ট ছাড়াই তা খেতে পারে। আর জঙ্গলে সমস্ত হিং¯্রপ্রাণী সেটার জন্য রাস্তা ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে যেত, যাতে এটি কোন প্রকারের শঙ্কা অনুভব না করে। আর সেগুলো প্রাঞ্জলভাষায় বলতে থাকত-إِنَّكِ لمُحَمَّدٍ “হে ‘আদ্ববা-! আমরা তোমার আদব ও সম্মান এ কারণেই করছি যে, তুমি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর বাহন।”[ ] সুতরাং জানা গেল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা রসূল-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘যিক্র শরীফ’র এত বেশি চর্চা করেছেন যে, বন-জঙ্গলে বসবাসকারী হিং¯্রজন্তু এবং যমীনে উৎপন্ন হওয়া ঘাসকে পর্যন্ত হুযূরের এবং হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর উষ্ট্রীর ‘ইল্ম’ (জ্ঞান) দান করেছেন। আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি সুন্দর বলেছেন-
چاند شق ہو پیڑ بولیں جانور سجدہ کریں
بارک اللہ مرجع عالم یہی سرکار ہے۔

“টুকরো হয় চাঁদ, গাছ কথা কয়, পশু সাজ্দায় পতিত হয়,
সুবহানাল্লাহ্! সৃষ্টির কেন্দ্র এই আসনেই সমাসীন।।”[ ] এ কারণে যখন তিনি নুবূয়তের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং তাওহীদ ও রিসালতের উপর ঈমান আনার হুকুম দিয়েছিলেন, তখন পাথরের ভেতর থেকেও-
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ
-এর আওয়াজ এসেছিল। কবির ভাষায়-
؎ جس وقت گواہی کی ہوئی ان کو ضرورت
بت بول اُٹھے پڑھنے لگے کلمہ شجر بھی۔

“যে সময় তাদের সাক্ষ্যের প্রয়োজন হয়েছিল, মূর্তি বলে উঠেছিল, বৃক্ষ কলেমা পড়তে লাগল।”

 স্থানে স্থানে হুযূর ’র নাম ক্বুদরতের কলম লিখে দিয়েছে
যদিওবা হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ‘যিক্র শরীফ’ কে বেশ কয়েকভাবে সমুন্নত করা হয়েছে, কিন্তু এখন আমরা শুধু এটি বর্ণনা করবো যে, ক্বুদরতের কলম যমীন ও আসমানের মধ্যে স্থানে স্থানে তাঁর বরকতময় নাম লিখে দিয়ে জগতের অনু-পরমাণুকে তাঁর সুমহান সত্ত্বা সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং তাদেরকে তাঁর নামের নূররাশি দ্বারা আলোকিত ও ফয়যপ্রাপ্ত করেছেন।

 আরশ-ই আ’যমের উপর হুযূর ’র নাম মুবারক
সায়্যিদুল মুফাস্সিরীন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা রেওয়ায়াত করেন,
আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ঈসা আলায়হিস সালামকে ইরশাদ করেন:
يَا عِيْسٰى آمِنْ بِمُحَمَّدٍ وَمُرْ مَنْ أَدْرَكَهُ مِنْ أُمَّتِكَ أَنْ يُؤْمِنُوْا بِهِ فَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ آدَمَ، وَلَوْلَا مُحَمَّدٌ مَا خَلَقْتُ الْجنَّةَ وَالنَّارَ، وَلَقَدْ خَلَقْتُ الْعَرْشَ عَلَى الْمَاءِ فَاضْطَرَبَ فَكَتَبْتُ عَلَيْهِ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ فَسَكَنَ-] [
“হে ঈসা! (আলায়হিস সালাম) আমার মাহবূব মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নিজে ঈমান আনো এবং আপন উম্মতকে নির্দেশ দাও যে, যারা তাঁর রহমতপূর্ণ সময় পাবে, তাঁর উপর যেন ঈমান আনে। কেননা যদি মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম না হতেন, তবে আমি না আদম আলায়হিস সালামকে সৃষ্টি করতাম (না তাঁর বংশধরদের) এবং না জান্নাত ও দোযখকে। (তাঁর মহত্বপূর্ণ শান এ যে,) যখন আমি পানির উপর আরশ বানিয়েছি, তখন আরশ কেঁপে উঠেছিল। অতঃপর আমি তার উপর লিখে দিলাম-
لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ
(আমার এবং আমার মাহবূবের নামের বরকতে) আরশের অস্থিরতা দূর হয়ে গেল এবং সেটা প্রশান্ত ও স্থির হয়ে গেল।”

 অন্তরের অস্থিরতার একমাত্র চিকিৎসা
সপ্ত আসমান ও সপ্ত যমীন আরশ-ই মু‘আল্লার ঘেরাওয়ে রয়েছে। যমীন ও আসমান-এর মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সবকিছুকে আরশ-ই মু‘আল্লা বেষ্টন করে রেখেছে। এতে অন্তর্ভূক্ত আছে ফিরিশতা, মানবকুল, জিনজাতি, প্রাণীকুল, জড়পদার্থসমূহ, উদ্ভিদরাজি, একক বস্তু এবং যৌগিক বিষয়াদিও। চার উপাদানও রয়েছে এবং সেগুলো থেকে বিন্যাসপ্রাপ্ত ও গঠনপ্রাপ্ত বস্তুসমূহও। যখন আরশ-ই মু‘আল্লা (যা এসব বস্তুকে বেষ্টন করে রেখেছে)-এর অস্থিরতা ও কাঁপুনি হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় নাম ছাড়া দূর হয় না, তাহলে যেসব বস্তু সর্বদা আরশের বেষ্টনে বিদ্যমান, সেগুলোর অস্থিরতা তাঁর নাম মুবারক ব্যতীত কীভাবে যেতে পারে?
সুতরাং প্রত্যেক অস্থির ও নিরুপায় মানুষের উচিত, সে রসূল-ই পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নাম মুবারকের বেশি বেশি ওযীফা পড়বে এবং তাঁর পুত-পবিত্র শরী‘আতের অনুসরণ এবং পবিত্র সুন্নাতের পরিপূর্ণ আনুগত্য ও প্রতিপালন করবে, যাতে অস্থিরতার অসুখ এবং অসহিষ্ণুতার দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে প্রশান্তি ও স্থিরতা হাসিল করবে। এ রোগের চিকিৎসা এটি ছাড়া হতে পারে না। কেননা-
نام ہی نام ہَے جو کچھ ہے حقیقت کے سِوا
راستہ کوئی نہیں ان کی شریعت کے سِوا
فرض و واجب کے مراتب کا یہاں ہوش کہاں
مذہب عشق میں بولی نہیں سنت کے سِوا
شامیانہ نہیں خورشید قیامت کے لئے
کالی کملی کے سوا چادرِ عترت کے سِوا

১) হাক্বীক্বত ব্যতীত যা কিছু আছে, তা’তো নামই নাম। তাঁর শরীয়ত ব্যতীত কোন রাস্তা নেই।
২) ফরয-ওয়াজিবের মর্যাদাদির এখানে হুঁশই কোথায়?, ইশ্ক্বের মাযহাবে সুন্নাত অনুসারে কাজ করা ছাড়া কথা-ই নেই।
৩) ক্বিয়ামতের সূর্যের জন্য শামিয়ানা নেই, রসূলে আকরামের কালো রংয়ের চাদরই হলো আহলে বায়তের চাদর।

 লাওহ-ই মাহফূয-এর উপর সর্বপ্রথম আল্লাহ্ জাল্লাজালালুহু ও রসূল ’র নাম লিখা হয়েছে

আল্লাহ্ তা‘আলা যখন কলমকে সৃষ্টি করলেন, তখন সেটাকে হুকুম দিলেন: اُكْتُبْ )লিখ(। সেটা আরয করলো: مَاذَا اَكْتُبُ (কী লিখব?) ইরশাদ করলেন:
اُكْتُبِ الْقَدْرَ مَاكَان وَ مَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى الْاَبَدِ-
“প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে এবং যা কিছু হবে, সেসব কিছু লিখে দাও।”[ ] তখন কলম নির্দেশ মোতাবেক সবকিছু লিখে দিয়েছে এবং সর্বপ্রথম নি¤েœাক্ত শব্দাবলি লিখেছে-
بِسْم اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْم، إِنِّيْ أَنَا اللهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنَا مُحَمَّدٌ رَسُوْلِيْ-] [
“আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়। আমি আল্লাহ্, আমি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার রসূল।”

 مَاكَان (যা কিছু হয়েছে) এবং وَمَا يكُوْن (যা কিছু হবে)-এর ইলম
এটা দ্বারা বুঝা গেল যে, আল্লাহ্ তা‘আলা, যিনি “كُنْ” বলে এক মুহুর্তে যা ইচ্ছা, সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি শুধু “ اُكْتُبْ )লিখ(” বলে কলমকে সমস্ত مَاكَان (যা কিছু হয়েছে) এবং وَمَا يكُوْن (যা কিছু হবে)-এর ইলম দান করেছেন; সুতরাং সেটা তা লিখে ফেলেছে।
এও বুঝা গেল যে, রসূল-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে এ আক্বীদা রাখা যে, তিনি আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে- مَاكَان (যা কিছু হয়েছে) এবং وَمَا يكُوْن (যা কিছু হবে) -এর ইলম জানতেন। এটি কখনো শিরক্ নয়। কেননা যখন আল্লাহ্ তা‘আলা “ اُكْتُبْ )লিখ(” বলে কলমকে সমস্ত مَاكَان (যা কিছু হয়েছে) এবং وَمَا يكُوْن (যা কিছু হবে)-এর ইলম দান করতে পারেন এবং তাতে র্শিক আবশ্যক হয় না, তাহলে হযরত মাহবূব-ই হক্ব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য এমন ইলম মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে কীভাবে র্শিক আবশ্যক হবে?

 কসীদাহ্-ই বুরদা শরীফের একটি শে’র
ইমাম শরফুদ্দীন বুসীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র নিকট লাওহ্ ও কলমের ইলম হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর ইলমের অংশ বিশেষ। শে’র দেখুন-
فَاِنَّ مِنْ جُوْدِك الدُّنْيَا و ضَرَّتَهاَ
وَمِنْ عُلُوْمِك عِلْمُ اللَّوْحِ وَ الْقَلَمِ
“ইয়া রাসূলাল্লাহ্! (সাল্লাল্লাহু আলায়কা ওয়াসাল্লাম) এ দুনিয়া এবং আখেরাত উভয় আপনারই বদান্যতার কারণে এবং লাওহ্ ও কলম-এর সমস্ত ইলম আপনারই ইলমের অংশ।”
তাহলে কোন মুশরিক বলে বেড়ানো মুফতী ইমাম বুসীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির উপরও শিরকের ফাত্ওয়া লাগাবে!

 হযরত আদম আলায়হিস সালাম-এর হযরত শীস আলায়হিস সালাম-এর প্রতি ওসীয়ত
হযরত আবুল বশ্র সায়্যিদুনা আদম আলায়হিস সালাম স্বীয় সাহেবযাদা হযরত সায়্যিদুনা শীস আলায়হিস সালামকে নি¤েœ উল্লেখিত ওসীয়ত করেছেন:
كُلَّمَا ذَكَرْتَ اللهَ فَاذْكُرْ إِلٰى جَنْبِهِ اسْمَ مُحَمَّدٍ فَإِنِّي رَأَيْتُ اِسْمَهُ مَكْتُوْبًا عَلٰى سَاقِ الْعَرْشِ وَأَنَا بَيْنَ الرُّوْحِ وَالطِّيْنِ ثُمَّ إِنِّي طُوِّفْتُ فَلَمْ أَرَ فِي السَّمَاءِ مَوْضِعًا إِلَّا رَأَيْتُ اسْمَ مُحَمَّدًا مَكْتُوبًا عَلَيْهِ، وَلَمْ أَرَ فِي الْجَنَّةِ قَصْراً وَلَا غُرْفَةً إِلَّا وَرَأَيْتُ اسْم مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَكْتُوْبًا عَلَيْهِ، وَلَقَد رَأَيْتُ اسْمَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَكْتُوْبًا عَلٰى نُحُوْرِ الْعَيْنِ، وعَلٰى قُضْبَاِن اٰجَامِ الْجَنَّةِ، وَعَلٰى وَرَقِ شَجَرَةِ طُوْبٰى، وَعَلٰى وَرَقِ سِدْرَةِ الْمُنْتَهٰى، وَعَلٰى أَطْرَافِ الْحُجُبِ، وَبَيْنَ أَعْيُنِ الْمَلَائِكَةِ، فَأَكْثِرْ ذِكْرَهُ فَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ تُذَكِّرُهُ فِيْ كُلِّ سَاعَاتِهَا
“হে আমার পুত্র! যখন তুমি আল্লাহ্ তা‘আলার নাম ‘যিক্র’ (স্মরণ) করবে, তখন সেটার সাথেই হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর নামেরও ‘যিকর’ (স্মরণ) করবে। এ জন্য যে, আমি তাঁর নাম আরশ-ই মু‘আল্লার উপর, এমতাবস্থায় আমি রূহ ও মাটির মধ্যবর্তীতে ছিলাম; অতঃপর আমাকে প্রদক্ষিণ করানো হল এবং আসমানের প্রতিটি স্থানে, জান্নাতের মহলগুলো ও প্রাসাদসমূহের উপর, হুরদের বক্ষসমূহের উপর, জান্নাতের বৃক্ষরাজির শাখাগুলোর উপর, ত্বূ-বা বৃক্ষ ও সিদরাতুল মুনতাহার বৃক্ষের পত্র-পল্লবের উপর, পর্দাসমূহের কিনারাগুলোতে এবং ফিরশতাদের চোখযুগলের মধ্যবর্তী অংশের উপর লিখা দেখেছি। তাই হে আমার বৎস! তাঁর ‘যিক্র শরীফ’ অধিক পরিমাণে করবে; কেননা আল্লাহ্র ফিরিশতাকুল সদাসর্বদা তাঁর যিক্র করে থাকে।”[ ]

 মাহফিলে মীলাদ মুবারক
যেসব লোকেরা বর্তমান সময়ে মাহফিলে মীলাদ মুবারক আয়োজন করা থেকে বাধা দেয়, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাদের আবুল বশর হযরত আদম আলায়হিস সালাম-এর উপর্যুক্ত ওসীয়ত থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। যখন আল্লাহ্ তা‘আলার পবিত্র ফিরিশতাকুল আল্লাহ্র হুকুমে সারাক্ষণ তাঁর প্রিয় মাহবূব হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘যিক্র শরীফ’ করছেন এবং হযরত আদম আলায়হিস সালাম স্বীয় সাহেবযাদাকে ‘যিক্রে মোস্তফা’ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষভাবে ওসীয়ত করেন, তাহলে ‘মাহফিলে যিকরে মোস্তফা’ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামকে না-জায়েয ও হারাম হওয়ার ফাত্ওয়া লাগানো কী পরিমাণ বোকামী, মুর্খতা, গোমরাহী ও বেয়াদবী! এমন লোক রসূল-ই আকরম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত বলার কখনো হক্বদার নয়।
ذکر روکے فضل کاٹے نقص کا جو یا رہے
پھر کہے مردک کہ ہوں اُمّت رسُول اللہ کی
হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে স্মরণ করতে বাধা দেয়, হুযূর-ই আকরামের ফযীলতকে অস্বীকার করে। তার মধ্যে দোষ-ত্রুটি তালাশ করে- এতদ্সত্তেও এ হীন ও ইতর (নজদী) নিজেকে হুযূর-ই আকরামের উম্মত বলে পরিচয় দেয়। (তাদের লজ্জাবোধ করা চাই! কিন্তু তারা তা করে না।)- হাদাইক্বে বখশিশ

 হযরত সুলায়মান আলায়হিস সালাম-এর আংটির উপর হুযূরের পবিত্র নাম
খোদা তা‘আলা জাল্লা মাজ্দুহু’র প্রিয় নবী সায়্যিদুনা সুলায়মান আলায়হিস সালাম একদিন আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে আরয করলেন:
رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَهَبْ لِيْ مُلْكًا لَّا يَنْبَغِيْ لِأَحَدٍ مِنْ بَعْدِي إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ-] [
“হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করো আর আমাকে এমন রাজ্য দান করো, যা আমার পর তা কারো জন্য উপযোগী না হয়, নিশ্চয় তুমি মহান দাতা।” (তরজমা-ই কানযুল ঈমান)
তাঁর দো‘আ কবূল হয়ে গেল, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে আংটিতে রাখার জন্য একটি ‘নাগীনা’ (আংটির পাথর) দান করলেন। তিনি সেটাকে অংটির মধ্যে রেখে পরিধান করে নিলেন। ওই ‘নাগীনা’ (আংটির পাথর) এতবেশী বরকতপূর্ণ ছিল যে, সেটা পরিধান করতেই তিনি যুগের ‘শাহানশাহ্’ (বাদশাহ) হয়ে গেলেন। মানবকুল এবং জিনজাতিও তাঁর অনুগত হয়ে গেল। জিনেরা ছাড়াও পক্ষীকুল, হিং¯্রপ্রাণী, চতুষ্পদ জন্তু সবই তাঁর আনুগত্য করত এবং তাঁর অনুমতি ব্যতীত কোথাও যেত না। আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে বাতাসও তাঁর বশ্যতার অধীন হয়েছিল। তিনি যে স্থানে তাশরীফ নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা করতেন, পবিত্র ‘তখত’ (আসন)-এ বসে বাতাসকে হুকুম দিতেন, সেটা উঠিয়ে নিয়ে যেত তাঁর কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। তাঁর এ দৃষ্টান্তহীন রাজত্ব যমীনের শুধু কোন বিশেষ অংশে প্রতিষ্ঠিত হয় নি, বরং সমস্ত যমীনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ওই ‘নাগীনা’ (আংটির পাথর)-এর মধ্যে এ বরকত ও মহত্ব সায়্যিদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র নামের বদৌলতে অর্জিত হয়েছিল।
হাদীস শরীফে রয়েছে, হযরত উবাদা ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন:
إِنَّ فَصَّ خَاتَمِ سُلَيْمَانَ بْنِ دَاوُدَ كَانَ سَمَاوِيًا: أَيْ مِنَ السَّمَاءِ، أُلْقِيَ إِلَيْهِ فَوَضَعَهُ فِيْ خَاتَمِهِ أَيْ وَكَانَ بِهِ اِنْتِظَامُ مُلْكِهِ، وَكَانَ نَقْشُهُ أَنَا اللهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنَا مُحَمَّدٌ عَبْدِيْ وَرَسُوْلِيْ-
“হযরত সুলায়মান আলায়হিস সালামের আংটির ‘নাগীনা’ (আংটির পাথর) আসমান থেকে নাযিল হয়েছিল। তিনি সেটাকে আংটির মধ্যে রেখেছিলেন। এর মাধ্যমে তাঁর রাজ্য ব্যবস্থাপনা চলত। তাতে নি¤েœাক্ত শব্দাবলি নক্বশা করা ছিল-
أَنَا اللهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنَا مُحَمَّدٌ عَبْدِيْ وَرَسُوْلِيْ
“আমি আল্লাহ্, আমি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই; মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার খাস বান্দা ও রসূল।”
(আলী ইবনে বোরহানুদ্দীন হালাবী, আস সীরাতুল হালাবিয়্যাহ্্, খ– ১, পৃ. ৩১৪)
সুতরাং বুঝা গেল যে, যদিওবা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সকল নবীর পর পার্থিব জগতে শুভাগমন করেছেন, কিন্তু তাঁর শুভ অবির্ভাবেরও পূর্বে তাঁর নাম মুবারক দ্বারা ফায়েদা হাসিল করা হত। শুধু উম্মতই নয়, বরং সম্মানিত নবীগণ আলায়হিমুস সালামও তাঁর বরকতসমূহ দ্বারা উপকৃত হতেন। আর এ আক্বীদাহ্ও স্পষ্ট হয়ে গেল, সায়্যিদুনা সুলায়মান আলায়হিস সালাম আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হিস সালাম-এর প্রনিনিধি হওয়ার ভিত্তিতে শাসন পরিচালনা করেন, প্রকৃতপক্ষে ওই সময়ও সরকার-ই রিসালত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ্ তা‘আলা রাজত্ব ও বাদশাহীর ‘তাজ’ (মুকুট) দান করেছিলেন।
کیوں نہ ہو تم مالک مُلک خُدا مِلک خُدا
سب تمہارا ہے خُدا ہی جب تمہارا ہو گیا
“কেনই বা হবেন না আপনি খোদায়ী রাজ্যসভা ও প্রাচুর্যের মালিক, সবকিছু আপনারই, স্বয়ং খোদা তা‘আলা যে আপনার হয়ে গেছেন।”
পরিশেষে বলা যায়, ‘যিক্রে মোস্তফা’ ওই মহান ইবাদত, যা আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে বিস্তৃত করে দিয়েছেন। বর্তমান সময়েও অভিজ্ঞতা, ইতিহাস, খবরের কাগজ, মিডিয়ার বদৌলতে আমরা নিয়মিত জানতে ও দেখতে পারছি, বৃক্ষের পাতায় পাতায়, ফুলের পাপড়ীতে, মাছের গায়ে, ক্বোরবানীর পশুর গায়ে, গোশতের মধ্যে, আঙ্গুরের উপর, মেঘের উপর, শিশুর কাঁধের উপর, ছাগলের মাথার উপর, ব্যক্তির চোখের অভ্যন্তরে সাদা অংশের নিচে, পাথরের উপরসহ আরো বহু সংখ্যক সৃষ্টিতে দৃশ্যমান হচ্ছে, নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বরকতময় নাম ‘ مُحَمَّدٌ رَّسُوْلُ اللهِ’ (মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ্)। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে বেশি পরিমাণে হুযূরের ‘যিক্র শরীফ’ পাঠ করার তাওফীক্ব দান করুন। আ-মীন।

পরিচালক: আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •