ড. মুহাম্মদ লিয়াকত আলী
ইসলামে মানব জীবনের সামগ্রিক দিক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ নির্দেশনা রয়েছে। এতে জীবনের কোন প্রয়োজনীয় চাহিদা বাদ দেয়া হয়নি। তাই এটি মানব প্রকৃতির সহায়ক ও উপযোগী একমাত্র ধর্ম। এতে ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কেও নির্দেশনা রয়েছে। সতর্কতা সত্বেও কোন ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হলে তার সেবা ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার তাগিদ রয়েছে। সাহাবা কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম এর কেউ অসুস্থ হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের দেখতে যেতেন। তিনি রোগীর সাথে সুন্দর আচরণ ও তার সেবা করার আদেশ দিতেন।
রোগীর সেবা করা এবং তার সাথে সুন্দর আচরণ করা সাওয়াবের কাজ। এর দ্বারা পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা, আন্তরিকতা ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়। হাদীস শরীফে এসেছে,
مَنْ عَادَ مَرِيضًا، لَمْ يَزَلْ فِي خُرْفَةِ الْجَنَّةِ حَتَّى يَرْجِعَ.
“যে ব্যক্তি রোগী দেখতে যায় সে যতক্ষণ ফিরে না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতের ফল আহরণ করতে থাকে।”
إِذَا دَخَلْتُمْ عَلَى الْمَرِيضِ، فَنَفِّسُوا لَهُ فِي الْأَجَلِ.
“তোমরা যখন রোগী দেখতে যাবে, তখন তার জন্য দীর্ঘায়ু কামনা করবে।”
عَنِ البَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ أَمَرَنَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِسَبْعٍ، وَنَهَانَا عَنْ سَبْعٍ: أَمَرَنَا بِاتِّبَاعِ الجَنَائِزِ، وَعِيَادَةِ المَرِيضِ، وَإِجَابَةِ الدَّاعِي، وَنَصْرِ المَظْلُومِ، وَإِبْرَارِ القَسَمِ، وَرَدِّ السَّلاَمِ، وَتَشْمِيتِ العَاطِسِ، وَنَهَانَا عَنْ: آنِيَةِ الفِضَّةِ، وَخَاتَمِ الذَّهَبِ، وَالحَرِيرِ، وَالدِّيبَاجِ، وَالقَسِّيِّ، وَالإِسْتَبْرَقِ.
“বারা‘আ ইব্ন আযিব (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাতটি বিষয় পালনের আদেশ এবং সাতটি বিষয়ে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, জানাযায় অংশগ্রহণ করতে, রোগীকে দেখতে যেতে, দাওয়াত কবুল করতে, নির্যাতিতকে সাহায্য করতে, শপথ পূর্ণ করতে, হাঁচি প্রদানকারীর জওয়াব দিতে এবং সালামের জওয়াব দিতে। আর সাতটি বিষয়ে আমাদেরকে নিষেধ করেছেন, স্বর্ণের আংটি পরতে, রূপার পাত্র ব্যবহার করতে, সাধারণ রেশমি কাপড়, রেশমী মোটা বস্ত্র, কারুকার্য খচিত রেশমী বস্ত্র এবং মিহি রেশমী বস্ত্র ব্যবহার করতে।”
পরিবারের কোন সদস্য অসুস্থ হলে অন্যান্য সদ্যসদের দায়িত্ব হল তার সেবাযতœ করা এবং আরোগ্য লাভের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
تَدَاوَوْا فَإِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ لَمْ يَضَعْ دَاءً إِلَّا وَضَعَ لَهُ دَوَاءً، غَيْرَ دَاءٍ وَاحِدٍ الْهَرَمُ.
“তোমরা রোগের চিকিৎসা করাবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যে রোগ সৃষ্টি করেছেন তার নিরাময়ও (ওষুধ) সৃষ্টি করেছেন। তবে বার্ধক্য এমন একটি রোগ যার কোন চিকিৎসা নেই।”
সমাজে কোন ব্যক্তি অসুস্থ হলে সমাজবাসীর দায়িত্ব হল অসহায় ও পীড়িত ব্যক্তিদের সেবা শুশ্রুষা করা, সহায়তা দান করা এবং সর্বোচ্চ সহমর্মিতা প্রদর্শন করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
وَاللَّهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ.
“আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাকে সাহায্য করতে থাকেন যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকে।”
مَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ.
“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামত দিবসে তার বিপদ দূর করবেন।
রোগাক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল নাগরিকের অন্যতম মৌলিক চাহিদা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। প্রত্যেক নাগরিকের অধিকারসমূহ পূরণে রাষ্ট্রের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
পর্যাপ্ত হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও মাতৃসদন স্থাপন করে চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য করতে হবে। যাতে বিনা চিকিৎসায় কোন নাগরিকের অপমৃত্যু না হয়। সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা নিয়ে সাওয়াব লাভের আশায় রোগীর সেবা করতে হবে। ব্যবসায়িক মানসিকতা নিয়ে চিকিৎসার নামে কৌশলে রোগী থেকে অর্থ আদায় পরিহার করতে হবে। যারা সৃষ্টির সেবার উদ্দেশ্যে এ মহান দায়িত্ব পালন করেন তারা আল্লাহ তা‘আলার রহমত প্রাপ্ত হন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
مَنْ لَا يَرْحَمِ النَّاسَ، لَا يَرْحَمْهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ.
“যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয় না, আল্লাহ তা‘আলাও তার প্রতি দয়াপরবশ হয় না।”
টিকা:
. সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫৫২ ; জামি‘ তিরমিযী, হাদীস ৯৬৮; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস ২২৭৪৮।
. জামি‘ তিরমিযী, হাদীস ২০৮৭; সুনান ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৪৩৮।
. সহীহ আল বুখারী, হাদীস ১২৩৯;, জামি‘ তিরমিযী হাদীস ২৮০৯; সুনান নাসাঈ, হাদীস ১৯৪১; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস ২৮৭৩১।
. সুনান আবূ দাউদ, হাদীস ৩৮৫৫।
. সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৯৪৬; জামি‘ তিরমিযী, হাদীস ১৯৩০।
. সহীহ আল বুখারী, হাদীস ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫৭৮, ২৫৮০; সুনান আবূ দাউদ, হাদীস ৪৮৯৩; জামি‘ তিরমিযী, হাদীস ১৪২৬; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস ৫৬৪৬।
. সহীহ আল বুখারী, হাদীস ৭৩৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬০৩০, ২৩১৯; জামি‘ তিরমিযী হাদীস ১৯২২; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস ১১৩৮২।
লেখক: উপাধ্যক্ষ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।