হাশর ময়দানে প্রত্যেক মুমিন আমল অনুযায়ী ‘নূর’ প্রাপ্ত হবে

0
হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
مَنْ ذَا الَّذِیْ یُقْرِضُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗ وَلَهٗۤ اَجْرٌ كَرِیْمٌۚ(۱۱) یَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِیْنَ وَالْمُؤْمِنٰتِ یَسْعٰى نُوْرُهُمْ بَیْنَ اَیْدِیْهِمْ وَ بِاَیْمَانِهِمْ بُشْرٰىكُمُ الْیَوْمَ جَنّٰتٌ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاؕ-ذٰلِكَ هُوَالْفَوْزُ الْعَظِیْمُۚ(۱۲) یَوْمَ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالْمُنٰفِقٰتُ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوا انْظُرُوْنَا نَقْتَبِسْ مِنْ نُّوْرِكُمْۚ-قِیْلَ ارْجِعُوْا وَرَآءَكُمْ فَالْتَمِسُوْا نُوْرًاؕ-فَضُرِبَ بَیْنَهُمْ بِسُوْرٍ لَّهٗ بَابٌؕ-بَاطِنُهٗ فِیْهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهٗ مِنْ قِبَلِهِ الْعَذَابُؕ(۱۳) یُنَادُوْنَهُمْ اَلَمْ نَكُنْ مَّعَكُمْؕ-قَالُوْا بَلٰى وَ لٰكِنَّكُمْ فَتَنْتُمْ اَنْفُسَكُمْ وَ تَرَبَّصْتُمْ وَ ارْتَبْتُمْ وَغَرَّتْكُمُ الْاَمَانِیُّ حَتّٰى جَآءَ اَمْرُ اللّٰهِ وَ غَرَّكُمْ بِاللّٰهِ الْغَرُوْرُ(۱۴) فَالْیَوْمَ لَا یُؤْخَذُ مِنْكُمْ فِدْیَةٌ وَّ لَا مِنَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْاؕ-مَاْوٰىكُمُ النَّارُؕ-هِیَ مَوْلٰىكُمْؕ-وَبِئْسَ الْمَصِیْرُ(۱۵)
তরজমাঃ (মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন-) কে আছে, যে আল্লাহ কে ঋণ দেবে উত্তম ঋণ। তাহলে তিনি তার জন্য দ্বিগুণ করবেন। যে দিন (অর্থাৎ কেয়ামতের দিন) আপনি মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদেরকে দেখবেন যে, তাদের জ্যোতি তাদের সম্মুখে ও ডানে ছুটোছুটি করছে। তাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, আজ তোমাদের সর্বাপেক্ষা খুশির বার্তা হচ্ছে ঐ সব জান্নাত, যে গুলোর পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান তোমরা সেখানে স্থায়ীভাবে থাকো। এটাই মহা সাফল্য। যেদিন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীগণ মুমিনদেরকে বলবে, ‘আমাদের দিকে একবার তাকাও! যাতে আমরা তোমাদের জ্যোতি থেকে কিছু অংশগ্রহণ করি। তোমাদের পেছনের দিকে ফিরে যাও, সেখানে জ্যোতি অন্বেষণ করো তারা ফিরে যাবে। তখনই তাদের মধ্যখানে একটি প্রাচীর দাঁড় করে দেয়া হবে, যাতে একটি দরজা থাকবে, এবং সেটার অভ্যন্তরে থাকবে রহমত এবং বাইরে থাকবে আযাব। মুনাফিকগণ মুমিনদেরকে ডেকে বলবেন, আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? তারা বলবে-হ্যা, কিন্তু তোমরাতো নিজেদের আত্মাসমূহকে ফিৎনার মধ্যে নিক্ষেপ করেছো, মুসলমানদের অনিষ্টের দিকে তাকিয়ে থাকতে এবং সন্দেহ করতে। আর মিথ্যার লিপ্সা তোমাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর আদেশ এসে পড়েছে। এবং তোমাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ সম্বন্ধে ঐ বড় প্রতারক প্রতারিত করে রেখেছে। সুতরাং আজ না তোমাদের নিকট থেকে কোন মুক্তিপন গ্রহন করা হবে এবং না প্রকাশ্য কাফিরদের নিকট থেকে। তোমাদের ঠিকানা হচ্ছে আগুন, তা তোমাদের সাথী এবং কতইনা মন্দ পরিণতি। [সুরা আল হাদিদ-আয়াত ১১ থেকে ১৫]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
مَنْ ذَا الَّذِیْ یُقْرِضُ اللّٰهَ قَرْضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗ উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-মহান আল্লাহ আলোচ্য আয়াতে তারই প্রদত্ত সম্পদ তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ব্যয় করাকে কর্জ বা ঋণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেহেতু জাগতিক জীবনে ঋণ একটি অবশ্যই পরিশোধযোগ্য বস্তু। এটা অনাদায়ী থাকেনা। আল্লাহ বান্দাকে আশ্বস্ত করেছেন-তোমার প্রদত্ত দানের প্রতিদান দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বর্ধিত করে দান করবেন। সুতরাং আনন্দচিত্তে শরিয়ত নির্দেশিত বিভিন্ন খাতে সাদকাহ –খায়রাত দান করো। আমলনামা সাওয়াবে সমৃদ্ধ হবে আর অন্তর জগত কৃপণতা মুক্ত হবে। কুরআনে করিমের সাদকাহ-খায়রাতের বর্ণনা সম্বলিত অসংখ্য আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, বান্দার দান-অনুদান আল্লাহর দরবারে কবুল ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য কতিপয় শর্ত অবশ্য পালনীয়।
যথা: প্রথমত; যে ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয়, তা হলাল ও পবিত্র হওয়া অপরিহার্য। কেনানা মহান আল্লাহ পরম পবিত্রতম সত্ত্বা। সুতরাং কোনরূপ অবৈধ ও অপবিত্র সম্পদের দান-খয়রাত আল্লাহর দরবারে কবুল হবেনা। দ্বিতীয়ত: কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশনানুযায়ী ব্যয় করা অবশ্য কর্তব্য। অর্থাৎ আল্লাহর পথে ব্যয় করার সময় কোন হকদারের হক যাতে নষ্ট না হয়, তার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। স্বীয় পোষ্যদের প্রয়োজনীয় খরচাদি তাদের অনুমতি ছাড়া বন্ধ অথবা হ্রাস করে দান করা কোন সাওয়াবের কাজ নয়। অভাবগ্রস্থ ওয়ারীশদেরকে বঞ্চিত করে সব ধন-সম্পদ ব্যয় করা কিংবা ওয়াকফ করে দেয়া সুন্নাতে রাসুলের শিক্ষার পরিপন্থী। এছাড়া আল্লাহর পথে ব্যয় করার হাজারো পন্থা রয়েছে। সুন্নাত সমৃদ্ধ দান-খয়রাত হলো-গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার তীব্রতার দিকে লক্ষ্য করে খাত নির্বাচন করতে হবে। ব্যয় কারীরা সাধারণত এ দিকে লক্ষ্য রাখেনা। তৃতীয়ত : নিজস্ব ধারণানুযায়ী কোন কাজকে সৎ কাজ মনে করে সেই খাতে ব্যয় করাই সওয়াব হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং খাতটি শরিয়তের বিচারে বৈধ ও পছন্দনীয় কিনা, তা দেখাও জরুরী। যদি কেউ অবৈধ খেলাধুলার জন্য স্বীয় সহায়-সম্পদ ওয়াকফ কর দেয়, তবে সে সওয়াবের পরিবর্তে আযাবের যোগ্য হবে। শরীয়তের দৃষ্টিতে পছন্দনীয় নয় এমন সব কাজের বেলায় এ কথাই প্রযোজ্য। চতুর্থত: দান-সাদকাহ গ্রহণ কারীর উপর কোন প্রকারের খোঁটা কিংবা অনুগ্রহ প্রকাশ করা যাবেনা। দান গ্রহনকারীর সাথে এমন কোন ব্যবহার করা যাবেনা, যাতে সে নিজেকে ঘৃণিত ও হেয় প্রতিপন্ন অনুভব করে কিংবা কষ্ট পায়। কেননা যে ব্যক্তি ব্যয় করে সে নিজের উপকারের জন্যই ব্যয় করে। অতএব, ব্যয় করার সময় প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির লক্ষ্য রাখা উচিৎ যে, কারও প্রতি তার অনুগ্রহ নেই। নিজের উপকারের জন্যই সে ব্যয় করছে। পঞ্চমত : যা কিছু ব্যয় করা হবে, খাঁটি নিয়্যতের সাথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করতে হবে। নাম যশের জন্য নয়। উল্লেখ্য যে, সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই এখলাস অপরিহার্য।
‎‏يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَى
উদ্ধৃত আল্লহর পবিত্র বাণীর ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণ উল্লেখ করছেন- আলোচ্য আয়াতে ‘সেদিন’ বলে মহাপ্রলয় ‘কেয়ামতের’ দিন কে বুঝানো হয়েছে। ‘নূর’ বন্টনের ব্যাপারটি পুলসিরাত অতিক্রমের কিছু পূর্বে ঘটবে।
সাহাবীয়ে রাসূল সাইয়্যেদুনা হযরত আবু উমামা বাহেলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এর বিশদ বিবরণ রয়েছে। এতে রয়েছে যে, একদা সাইয়্যেদুনা হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু দামেশকে এক জানাযায় শরীক হন। জানাযা শেষে সমবেত লোকদেরকে মৃত্যু ও পরকাল সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য তিনি মৃত্যু, কবর ও হাশরের কিছু অবস্থা বর্ননা করেন। নি¤েœ তার কিয়দংশ উদ্ধৃত করা হল।
অতঃপর তোমরা কবর থেকে হাশরের ময়দানে স্থানান্তরিত হবে। হাশরের বিভিন্ন মনযিল ও স্থান অতিক্রম করতে হবে। এক মনযিলে মহান আল্লাহর নির্দেশে কতেক মুখ-মন্ডলকে সাদা ও উজ্জ্বল করে দেয়া হবে এবং কিছু মুখমন্ডলকে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ করে দেয়া হবে। অপর মনযিলে সমবেত সব মুমিন ও কাফেরকে গভীর অন্ধকার আচ্ছন্ন করে ফেলবে। কিছুই দৃষ্টিগোচর হবেনা। এরপর নূর বন্টন করা হবে। সহাবীয়ে রাসূল সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মসউদ রদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রত্যেক মুমিনকে তার আমলের পরিমাণ অনুযায়ী নূর দান করা হবে। ফলে কারও নূর পর্বতসম, কারও খর্জুর বৃক্ষসম এবং কারও মানবদেহসম হবে। সর্বাপেক্ষা কম নূর সেই ব্যক্তির হবে, যার কেবল বৃদ্ধাঙ্গুলীতে নূর থাকবে। তাও আবার কখনো জ্বলে উঠবে, কখনো নিভে যাবে। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
উল্লেখ থাকে যে, ‘পুলসিরাত’ অতিক্রমের সময় নূর প্রাপ্ত হওয়া, সেখান থেকে নিরাপদে অতিক্রম করা, সেখানে ভয় ও আতংক থেকে নিরাপত্তা-মুমিনদের প্রকৃত খুশি কিংবা সাফল্য নয়, এটাতো প্রকৃত ও মৌলিক সাফল্যের পূর্বাভাস তথা ভূমিকা স্বরূপ-যা সামনে বিদ্যমান। অর্থাৎ জান্নাত ও সেখানকার নেয়ামতরাজী। স্মরণ যোগ্য যে, মুমিন দুনিয়ায় মৃত্যুবরণ করার সময়, কবরে ও হাশরের ময়দানে যে আরাম, খুশি ও সাচ্ছন্দ ভোগ করে তা তার কৃতকর্ম সমূহের মূল বিনিময় নয়। মূল বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। যা এসবের পরবর্তী লাভ করবে।
তাফসিরে রুহুল বায়ান শরীফে রয়ছে-হাশরের ময়দান থেকে চলার সময় মুনাফিকদেরকে ‘নূর’ দান করা হবে, তাদের বাহ্যিক কার্যাাদির । এ নূরের মধ্যে তারা চলবে কিন্তু যখন তারা পুলসিরাতে পৌছাবে, তখন মুমিনদের নূর স্থায়ী থাকবে আর মুনাফিকদের নূর নিভে যাবে। তখন তারা মুমিনদের ডেকে বলবে ‘আমাদের নূর তো নিভে গেছে এখন তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল আমাদের দিকে ফেরাও, যাতে তোমাদের আলোকিত মুখমন্ডল থেকে আমরাও উপকার লাভ করি। তখন মুমিনরা বলবে-হাশরের ময়দানের দিকে ফিরে যাও, যেখান থেকে আমরা নূর এনেছি। সেখান থেকে নূর গ্রহণ কর। মহান আল্লাহ উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করার সৌভাগ্য নসীব করুণ। আমীন।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, এফ ব্লক, মুহাম্মদপুর, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •