গাউসুল আ’যম সায়্যিদুনা শায়খ আবদুল ক্বাদের জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর জীবন, কর্ম ও কারামত

0

মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম
মহামহিম আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষ এবং জিনের হিদায়ত ও পথপ্রদর্শনের জন্য নানা সময়ে ও স্থানে কমবেশি একলক্ষ চব্বিশ হাজার নবী ও রসূল প্রেরণ করেছেন। প্রত্যেক নবী ও রসূল আল্লাহ তা‘আলার পৃথক পৃথক ‘সিফাত’ (গুণাবলি)’র বিকাশস্থল হয়ে দুনিয়াতে তশরীফ এনেছেন, সবশেষে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় সমস্ত ‘সিফাত’ (গুণাবলি) শুধু নয়, বরং স্বীয় ‘যাত’ (সত্ত্বা)’র প্রকাশস্থল বানিয়ে আপন মাহবূব, সর্বশেষ নবী, হুযূর করীম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। অতঃপর ‘যাত’ (সত্ত্বা)’র প্রকাশস্থল শুভাগমন করার পর আর অপর কোন নবী’র প্রয়োজন রইলো না, নুবূয়তের দ্বার সদাসর্বদার জন্য বন্ধ হয়ে গেল। আর মাহবূবে খোদা আমাদের আক্বা ও মাওলা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অদৃশ্যের সংবাদ দিয়ে এরশাদ করলেন:
اِنَّ اللهَ يَبْعَثُ لِهٰذِهِ الْاُمَّةِ عَلٰى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لهَا دِيْنَهَا-
‘প্রত্যেক শতাব্দির শেষ প্রান্তে এ উম্মতের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা একজন মুজাদ্দিদ অবশ্যই প্রেরণ করেন, যে উম্মতের জন্য তার দ্বীনকে সজীব করে দেবে।’
হুযূর নবী-ই রহমতের নূরে নযর বংশধর, শাহানশাহে বাগদাদ, হযরত সায়্যিদুনা শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী, গাউসুল আ’যম, রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুও তেমনি একজন ‘মুজাদ্দিদ’ (সংস্কারক) ছিলেন। এজন্য তাঁর অন্যতম মহান উপাধি ‘মুহিউদ্দীন’ (দ্বীনকে পুনর্জীবিতকারী)।

 শুভ বিলাদত শরীফ
তাঁর শুভ জন্ম হয়েছিলো ১০৭৮ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৪৭০/৪৭১ হিজরীর রমযান মাসের ১ তারিখ সাহ্রির ওয়াক্তে পারস্যের কাম্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ উপকূলে জীলান বা গীলান অঞ্চলের নায়ক মহল্লায় হযরত ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বংশধারায় এক ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারে। তিনি ছিলেন ‘নজীবুত্ব ত্বরফাঈন’ অর্থাৎ পিতা ও মাতা উভয় দিক দিয়ে অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত। স্বর্ণের খনিতে স্বর্ণই উৎপন্ন হয়। হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নিজের বংশীয় ধারা সম্পর্কে বলেছেন- (اَنَا نَجِيْبُ الطَّرْفَيْنِ) অর্থাৎ আমি পিতা ও মাতা উভয় দিক দিয়েই সম্ভ্রান্ত। সায়্যিদুনা গাউসুল আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশীয় ধারা সম্মানিত পিতা সায়্যিদ আবূ সালেহ্ মূসা জঙ্গী-দোস্ত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে সায়্যিদুনা ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাই তিনি পিতার দিক দিয়ে হাসানী সায়্যিদ। আর তাঁর মহীয়সী আম্মাজান হযরত উম্মুল খায়র ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার বংশীয় ধারা তাঁর পিতা হযরত সায়্যিদ আবদুল্লাহ্ সাউমা‘ঈ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে সায়্যিদুনা ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পর্যন্ত পৌঁছেন। তাই তিনি মায়ের দিক দিয়ে হোসাইনী সায়্যিদ।
সুতরাং তিনি তো ‘মুহিউদ্দীন’ হবেনই। এদিকে ইঙ্গিত করে আ’লা হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁর প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘হাদাইক্বে বখশিশ’-এ লিখেছেন-
تو حسینی حسنی کیوں نہ محی الدین ہو۔ائے خضر مجمع بحرین ہے چشمہ تیرا
উচ্চারণ
তু হুসায়নি হাসানী কিউঁও না মহিউদ্দীন হু
আয় খিদ্বর মাজমাঈ বাহ্রায়ন হ্যায় চশমা তেরা।।
‘আপনি হোসাইনী এবং হাসানী, আপনি কেনই বা ‘মুহিউদ্দীন’ (দ্বীনে ইসলাম’র নবজীবন সঞ্চারক) হবেন না, হে উম্মতের ’খিদ্বর’ )বা সজীবতা), আপনার ফয়েযও (হাসানী ও হোসাইনী ) উভয় ধারার মোহনা বা সংযোজন। যেখানে থেকে আমার বেলায়েতের ধারা জারী।’

কাব্যানুবাদ
তুমি হোসাইনী, হাসানী, দ্বীনের পরানে পানি,
হে খিদ্বর দু কুল ধারা, মোহনায় উৎস তোমার।।

 তাঁর পবিত্র নাম, উপনাম ও উপাধি
সরকারে গাউসে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মুবারক নাম হচ্ছে, ‘আবদুল ক্বাদের’, তাঁর ‘কুনিয়ত’(উপনাম) ‘আবূ মুহাম্মদ’; তাঁর মহান ‘লক্বব’ (উপাধী) সমূহের অন্যতম হচ্ছে, ‘মুহিউদ্দিন’, ‘মাহবূবে সোবহানী’, ‘গাউসুস সাক্বালাইন’, ‘গাউসুল আ’যম’, ‘পীরানে পীর দস্তগীর’, ‘শায়খুশ শুয়ূখ’, ‘সুল্তানুল আওলিয়া’, ‘সরদারে আওলিয়া’, ‘ক্বিনদীলে লা-মক্বানী’, ‘ইমামুল আওলিয়া’, ‘আস্ সায়িদুস সানাদ্’, ‘ক্বুতুব-ই আওহদ’, ‘শায়খুল ইসলাম’, ‘ক্বুতুব-ই বাগদাদ’, ‘বায-ই আশ্হাব’ ইত্যাদি।

 তাঁর শুভজন্মের ব্যাপারে স্বয়ং হুযূর-ই করীম’র নিকট থেকে সুসংবাদ প্রদান
হুযূর সায়্যিদুনা গাউসে জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শুভ জন্ম সম্পর্কে হুযূর করীম হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন। মাহবূবে সোবহানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র পরম সম্মানিত পিতা হযরত আবূ সালেহ্ মূসা জঙ্গী-দোস্ত রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি হুযূর গাউসে আ’যমের শুভ জন্মের রাতে স্বপ্নে দেখলেন যে, সরওয়ারে কায়িনাত হুযূর আহমদ মুজতাবা, মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় সাহাবা-ই কিরাম, আওলিায়া-ই ‘ইযামসহ তাঁর গৃহে শুভাগমন করেছেন, আর এরশাদ করলেন:
يَااَبَا صَالِح أَعْطَاكَ اللهُ إِبْناً وَهُوَ وَلِىٌّ وَ مَحْبُوْبِىْ وَ مَحْبُوْبُ اللهِ تَعَالٰى وَ سَيَكُوْنُ لَهُ شَانٌ فِى الْاَوْلِيَاءِ وَ الْاَقْطَابِ كَشَانِىْ بَيْنَ الْأَنْبِيَاءِ وَالرُّسُلِ.
‘হে আবূ সালেহ! আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে এমন এক সন্তান দান করেছেন, যিনি ওলী, আর তিনি আমার ও আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়। ওলীগণ ও আক্বতাবগণের মধ্যে তাঁর এমন শান-মর্যাদা হবে, যেমন আম্বিয়া ও রসূলগণের মধ্যে আমার শান বিদ্যমান।’

কবির ভাষায়-
غوث اعظمؓ در میان اولیاء ۔ چوں محمد ﷺ در میان انبیاء
‘গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ওলীগণের মধ্যমণি, যেমনি হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নবীগণের মধ্যমণি।’
তেমনিভাবে হুযূর শাহানশাহে বাগদাদের পিতা সায়্যিদ আবূ সালেহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে স্বপ্নে নবীকুল স¤্রাট হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছাড়াও অপর নবীগণ আলায়হিমুস সালামও এ সুসংবাদ দিয়েছেন যে, “সকল ওলী তোমার প্রিয় সন্তানের অনুগত হবেন আর তাদের গর্দানের উপর তাঁর ক্বদম মুবারক থাকবে।”

কবির ভাষায়-
جس کی منبر هوى گردن اولیاء ۔ اس قدم کی کرامت پہ لاکھوں سلام

‘যাঁর সুমহান মর্যাদার মিম্বর হয়েছে ওলীগণের গর্দান মুবারক, ওই নূরানী ক্বদমের কারামতের প্রতি লক্ষ লক্ষ সালাম।’

 তাঁর ইরশাদ: “আমার এ ক্বদম আল্লাহর প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপরই”
হযরত গাউসুল আ‘যম বিলায়তের সুমহান মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, তাঁর অপরিসীম আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, আল্লাহর ক্বুদরত ও প্রিয়নবীর মু’জিযার বাস্তব বহিঃপ্রকাশ। তাঁর মর্যাদার কথা তিনি নিজেই ব্যক্ত করেছেন-
وَکُلُّ وَلِیٍّ عَلٰی قَدَمٍ وَاِنِّىْ – عَلٰی قَدَمِ النَّبِیِّ بَدْرِ الْکَمَال
অর্থ: প্রত্যেক ওলী আমার পদাঙ্কের অনুসারী। আর আমি আল্ল¬াহর নবী সাল্ল¬াল্ল¬াহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্ল¬াম-এর পদাঙ্ক শরীফের অনুসারী, যিনি (রিসালতাকাশের) পূর্ণাঙ্গ চাঁদ।
‘হযরত হাফেয আবুল ‘ইয্ আবদুল মুগীস ইবনে আবূ হারব বাগদাদী থেকে বর্ণিত, আমরা শায়খ মুহিউদ্দীন আবদুল ক্বাদের ইবনে আবূ সালেহ্ জীলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মাহফিলে, বাগদাদে হালবার খানক্বায় উপস্থিত ছিলাম। ওই সময় তাঁর মজলিসে ইরাকের শায়খগণ ব্যাপকহারে উপস্থিত ছিলেন। আর শায়খ মুহিউদ্দীন আবদুল কাদের জীলানী তাঁদের সামনে বক্তব্য রাখছিলেন। এ সময়ে তিনি এরশাদ করলেন: قَدَمِیْ هٰذِهِ عَلٰی رَقَبةِ کُلِّ وَلِیِّ االله “আমার এ ক্বদম আল্লাহর প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপরই।” তখনই শায়খ আলী ইবনুল হায়তী দন্ডায়মান হলেন এবং চেয়ারের উপর চড়লেন। আর শায়খ (-ই জীলানী)’র ক্বদম শরীফ নিয়ে নিজের গর্দানের উপর রাখলেন এবং তাঁর আঁচলের নিচে প্রবেশ করলেন। উপস্থিত সবাই আপন আপন গর্দান এগিয়ে দিলেন।’

 খাজা গরীব নাওয়ায ’র পরম শ্রদ্ধা নিবেদন
যে সময় হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বাগদাদ শরীফে এ ঘোষণা দেন, তখন খাজা গরীব নাওয়ায সায়্যিদুনা মুঈনুদ্দীন চিশ্তী আজমিরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি স্বীয় যৌবনকালে খোরাসানের ‘দামন-ই কূহ’ নামক স্থানে ইবাদতে রত ছিলেন। বাগদাদ শরীফে এরশাদ হচ্ছে, আর এখান থেকে গরীব নাওয়ায রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি স্বীয় মস্তক মুবারক ঝুঁকিয়ে দিলেন। আর এমনভাবে ঝুঁকালেন যে, মস্তক মুবারক যমিনের নিকটবর্তী হয়ে গেছে এবং এরশাদ করেন: بَلْ قَدَمَاكَ عَلٰى رَأْسِىْ وَ عَيْنِىْ ‘বরং আপনার কদম যুগল আমার মাথা ও চোখযুগলের উপর।’ এভাবে সকল আউলিয়া-উল্লাহ গাউসে পাকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শে’র-

جوولی قبل تھے یا بعدہوئے یاہوں گے –
سب ادب رکھتے ہیں دل میں میرے آقا تیرا
উচ্চারণ:
যো ওলি ক্ববল থে ইয়া বা’দ হুয়ে ইয়া হুঙ্গে
ছব আদব রাখতে হ্যাঁয় দিল মে মেরে আক্বা তেরা।।
‘যত ওলী আপনার পূর্বে ছিল এবং পরে হয়েছেন বা হবেন; হে আমার আক্বা! সকল সম্মানিত ওলী অন্তর দিয়ে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখেন।’
আ’লা হযরত রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আরো বলেন-
وہ کیا مرتبہ اے غوث ہے بالاتیرا –
او نچے اونچوں کے سروں سے قدم اعلٰی تیرا
উচ্চারণ
উয়হ্ কিয়া মরতবা আয় গাউস হ্যায় বালা তেরা
উঁেছ উছোঁকে সেরোঁসে ক্বদম আ’লা তেরা।
‘ইয়া গাউসে আ’যম! বাহ্, কী চমৎকার আপনার মর্তবা কতইনা উঁচু, বড় বড় উঁচু মযার্দা সম্পন্ন আউলিয়া কেরামের শির আর গর্দানসমূহের চেয়ে আপনার কদম মুবারক উঁচু, বরং তারা নিজ গর্দানোপরি তা বরণ করে নিয়েছেন।’

কাব্যানুবাদ: কতই উচ্চ সে মর্তবা ওহে গাউস তোমার, উঁচুদের উঁচু ঝুঁকে নেয় সে চরণভার।।

 তাঁর জ্ঞানচর্চা ও কর্মজীবন
সকল আলিম ও আউলিয়া এ কথার উপর একমত যে, সায়্যিদুনা শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘মাদারযাদ’ তথা মাতৃগর্ভের ওলী। রমযানুল মুবারকের প্রথম দিনে শুভ জন্মগ্রহণ করে তিনি রোযা রাখা শুরু করেন। শায়খ-ই জীলানীর মমতাময়ী জননী এরশাদ করেন, যখন আমার প্রিয় সন্তান আবদুল কাদের জন্মগ্রহণ করেছে, রমযান শরীফের দিনের বেলায় দুধ পান করত না।’ শিশুকাল থেকেই তাঁর বিলায়তের ঝান্ডা স্বমহিমায় উড্ডীন ছিল। তিনি ইল্ম, হিকমত, ইলমে ফিক্হ, ইলমে হাদিস, ইলমে তাফসীরসহ প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ইমামে রব্বানী শায়খ আবদুল ওহাব শা’রানী, শায়খুল মুহাদ্দিসীন আবদুল হক্ব মুহাদ্দ্সি দেহলভী এবং আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে ইয়হ্ইয়া হালবী রহমাতুল্লাহি আলায়হিম আজমাঈন লিখেছেন যে, হুযূর গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তেরটি ইলমের উপর তাক্বরীর করতেন। অপর স্থানে আল্লামা শা’রানী বলেন, হুযূর গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মাদ্রাসা-ই আলিয়াতে লোকেরা তাঁর নিকট তাফসীর, হাদিস, ফিক্হ ও ইলমুল কালাম শিক্ষার্জন করত। এভাবে শায়খ-ই জীলানী ক্বোরআনুল কারীমের একটি আয়াতের চল্লিশটি অর্থ বয়ান করা, জটিল জটিল মাসআলা-মাসা-ইল সহজে সমাধান দেয়া, ‘যাহিরী’ (দৃশ্য) ও ‘বাত্বেনী’ (অদৃশ্য) ইলমের তা’লীম দেয়াসহ বহু অতুলনীয় গুণাবলির ধারক ছিলেন। তিনি হাম্বলী ও শাফেয়ী ফকীহ্গণের ইমাম ও পেশোয়া ছিলেন।

 তাঁর রচনাবলি

হুযূর শায়খ-ই জীলানী সত্যান্বেষীদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে সুপ্রসিদ্ধ কিতাবগুলো হচ্ছে, ‘আল্ ফাতহুর রাব্বানী ওয়া ফায়যূর রহমানী’, ‘মাল্ফূযাত’, ‘ফুতূহুল গায়ব’, ‘জালা-উল খাত্বির ফিল বাত্বিনি ওয়ায যাহির’, ‘ক্বসীদাতু বাজুল আশহাব’, ‘ক্বসীদায়ে খামরিয়া’, ‘গুনিয়াতুত ত্বালেবীন’, ‘সিররুল আসরার’ ইত্যাদি।

 তাঁর বৈবাহিক জীবন
হযরত গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর চারজন স্ত্রী ছিলেন। চল্লিশ বছর বিবাহিত জীবনে তিনি ৪৯ জন সন্তান-সন্তুতি লাভ করেন। তাঁদের মধ্যে ২৭ জন পুত্র, আর ২২ জন কন্যা ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই الولد سرّ لابيه অর্থাৎ সন্তান পিতার উত্তরসূরী হিসেবে ওলী-বুযুর্গ ও উচ্চ স্তরের আলিম ছিলেন।

 তাঁর ইবাদত-রিয়াযত ও তাক্বওয়া
আল্লাহ তা‘আলার দ্বীনের পথে শাহানশাহে বাগদাদ ছিলেন সুদৃঢ়, অটল, অবিচল। স্বয়ং নিজেই এরশাদ করেন: ‘আমি (আল্লাহর পথে) বড় বড় জটিলতা ও কঠিন অবস্থাকে সহ্য করেছি, যদি সেগুলো কোন পর্বতের উপর দিয়ে অতিক্রম করত, তাহলে সেটা বিদীর্ণ হয়ে যেত।’

হুযূর সরকারে বাগদাদ ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, মুত্তাক্বী ও অধিক ইবাদতগুযার। শায়খ সা’দী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘গুলিস্তা’ কিতাবে লিখেছেন,
شیخ عبد قادر گیلانی را دیدند رحمۃ اللہ علیہ درحرم کعبہ روی برحَصَا نِہادہ بود و میگفت اے خدا وند ببخشای و اگر مستوجب عقوبتم مرا روزِ قیامت نابینا برانگیز تا در روئے نیکاں شرمسار نباشم ۔
অর্থ: ‘শায়খ আবদুল ক্বাদের গীলানী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি)কে পবিত্র কা’বার হেরমে ধূলাকণার উপর মাথা রেখে এ দো’আ করতে দেখা গেছে যে, হে খোদা! আমাকে ক্ষমা করুন। আর যদি আমার শাস্তি অনিবার্য হয়ে থাকে, তাহলে কিয়ামত দিবসে আমাকে অন্ধ করে উঠানো হোক, যাতে আমি পূণ্যবানদের সামনে লজ্জিত না হই।’
শায়খ আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে আবুল ফাতহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমি চল্লিশ বছর পর্যন্ত হযরত শায়খ মুহিউদ্দীন সায়্যিদ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিদমত করেছি, এ সময়ে তিনি এশার ওযূ দ্বারা ফজরের নামায পড়তেন এবং তাঁর নিয়মিত আমল ছিল যে, যখনই ওযূহীন হতেন, তখনই ওযূ করে নিয়ে দু’রাকা‘আত নফল নামায আদায় করে নিতেন। হুযূর গাউসুস সাক্বলাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পনের বছর পর্যন্ত সারারাত এক খতম ক্বোরআন মাজীদ তিলাওয়াত করতেন। এছাড়াও তিনি প্রতিদিন এক হাজার রাকা‘আত নফল নামায আদায় করতেন।

তাঁর খোদাপ্রদত্ত কারামাত
হুযূর শায়খ-ই জীলানীর কারামত ও বরকত অগণিত, অসংখ্য। এভাবে বলা যায় যে, আম্বিয়া-ই কিরামের মধ্যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সর্বাধিক মু’জিযা দেয়া হয়েছে, তেমনি আউলিয়া-ই কিরামের মধ্যে সায়্যিদুনা গাউসে আ’যমকে সর্বাধিক কারামত দেয়া হয়েছে। ডাকাত দলের তাওবা করে ইসলাম গ্রহন, চোরকে ক্বুতুব-এর মর্যাদা দান, সমস্ত যমিনের উপর রাজত্ব করা, লাঠি মুবারক থেকে নূররাশির ঝলক বের হওয়া, তাঁর মাদ্রাসার দরজা দিয়ে গমনকারীদের জন্য শাস্তি মওকূফ হওয়া ও ক্ষমাপ্রাপ্তির সুসংবাদ দেয়া, ডুবে যাওয়া বরযাত্রী ১২ বছর পর অক্ষত অবস্থায় তীরে ফিরে আসা, মুরগী জীবিত হওয়া, কবরের আযাব বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারামত সারা বিশ্বে অত্যন্ত সুপ্রসিদ্ধ।
কবির ভাষায়-
نگاہ ولی میں یہ تاثیر دیکھی ۔ بدلتی ہزاروں کی تقدیر دیکھی

‘ওলী-আল্লাহর কৃপা দৃষ্টিতে এ প্রভাব দেখেছি যে, হাজারো দূর্ভাগার তাক্বদীর পরিবর্তন হতে দেখেছি।’

 ক্বাদেরিয়া তরীক্বার অনুসারীদের জন্য সুসংবাদ প্রদান
হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ক্বাদেরিয়া তরীক্বতের প্রতিষ্ঠাতা। রুহানিয়াত অর্জনে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ তরীক্বা। এ তরীক্বার অনুসারীগণ শাহানশাহে বাগদাদের নিকট সর্বাধিক মহব্বতের পাত্র হন।
হুযূর গাউসে পাক স্বয়ং এরশাদ করেন: إِنَّ يَدِىْ عَلٰى مُرِيْدِىْ كَالسَّمَاءِ عَلَى الْاَرْضِ ‘নিশ্চয় আমার হাত আমার মুরীদ-এর উপর এভাবে রয়েছে, যেমন যমিনের উপর আসমান বিদ্যমান।’ আরো এরশাদ করেছেন, إِنْ لَمْ يَكُنْ مُرِيْدِىْ جَيِّداً فَاَنَا جَيِّدٌ ‘যদি আমার মুরীদ উন্নত না হয় তাতে কী, আমি (তার মুনিব আবদুল কাদের) তো উত্তম।’ আমাদের পরম সৌভাগ্য আমরা গাউসে পাকের কৃপাদৃষ্টি পেয়েছি।

কবির ভাষায়-
خدا کے فضل سے ہم پر ہے سایہ غوث اعظم کا ۔
ہمیں دو نوں جہاں میں ہے سہارا غوث اعظم کا
‘খোদা তা‘আলার অপার অনুগ্রহে আমাদের উপর গাউসে আ’যমের কৃপার ছায়া বিদ্যমান, উভয় জগতে আমাদের রয়েছে গাউসে আ’যমের ভরসা।’
হযরত আবূ মাস‘ঊদ আবদুল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি এরশাদ করেন:
ضَمِنَ الشَّيْخُ مُحِىُ الدِّيْنِ عَبْدَ الْقَادِرِ رَضِىَ اللهُ تَعَالٰى عَنْهُ لِمُرِيْدِيْهِ إِلٰى يَوْمِ الْقِيَامَةِ أَنْ لَا يَمُوْتَ اَحَدٌ مِنْهُمْ إِلَّا عَلٰى تَوْبَةٍ.
‘শায়খ মুহিউদ্দীন আবদুল ক্বাদের রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু স্বীয় মুরীদগণের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত এ কথার জামিনদার হয়েছেন যে, তাদের মধ্য থেকে কেউই তাওবা করা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করবে না।’

 তাঁর ওফাত শরীফ
ইসলামের এ মহান সাধক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ওলীকুল সম্রাট ৫৬১ হিজরি মোতাবেক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ রবিউস্ সানি সোমবার রাতের শেষ প্রহরে ৯১ বৎসর বয়সে তাঁর মাওলা-ই হাক্বীকী (প্রকৃত বন্ধু)’র সাথে মিলিত হন। যে কারণে অনেক খানক্বাহ শরীফে এগারো শরীফ বা গিয়ারভী শরীফও অনুষ্ঠিত হয়। তিনি শুয়ে আছেন বাগদাদ নগরীতে। সবশেষে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে দো‘আর হাত তুলি-
قادری کر قادری رکھ قادریوں میں اٹھا ۔
قدر عبد القادر قدرت نما کے واسطے
উচ্চারণ
কাদেরি কর, কাদেরি রাখ, কাদেরিয়োঁ মে উঠা
ক্বদরে আবদুল কাদেরে কুদরত নুমাকে ওয়াস্তে।।

পরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।
—০—

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •