বাংলায় গাউসে পাকের চর্চার সাড়ে আটশত বছর

0

ইমরান হুসাইন তুষার

হিজরী পঞ্চম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ, আধ্যাত্মবাদের মহান দিকপাল, অলীকুল স¤্রাট, মাহবুবে সোবহানী, গাউসুল আ‘যম পীরানে পীর দস্তগীর শেখ সৈয়্যদ মুহিউদ্দিন আব্দুল কাদির জিলানি রহমাতুল্লাহি আলায়হি পবিত্র কুরআন ও হাদীসের অমূল্য বাণীর সঠিক ব্যাখ্যা দানে ইসলামের আসল রূপ জনসম্মুখে তুলে ধরেন। তাঁর অপরিসীম জ্ঞানের পরিধি, অকাট্যযুক্তি, ভাষার লালিত্য, বাগ্মিতা, গতিময় বাচনভঙ্গির মাধ্যমে অধঃপতিত মানব সমাজকে তিনি ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেন। পাশাপাশি সমসাময়িক তরিকতের শায়খদের উপর তাঁর প্রভাব ছিল। আর তাই আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-“চিশতিয়া, নক্শবন্দিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া ও হযরত খাজা আজমীর তরীকতরূপী শরীয়ত তরীকতের ক্ষেত্রগুলোর কোন্টিতে (হে গাউসে আ’যম!) আপনার গাউসিয়াতের বৃষ্টি (ফায়েয্) বর্ষিত হয়নি? প্রতিটি তরীকতই আপনার প্রবর্তিত কিংবা ফায়েয্প্রাপ্ত।
ইলমে তাসাওউফে যে সমস্ত তরীকা রয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ তরীকা হিসেবে বিবেচিত হয় বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি কর্তৃক বিন্যাসকৃত ও প্রবর্তিত কাদেরিয়া তরীকা। এ তরীকার বিস্তৃতি ঘটেছে বিশ্বের নানা দেশে ব্যাপকভাবে, যা অন্য সব তরীকার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। যে কারণে আব্দুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর পরিচিতি বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হয়েছে। কাদেরিয়া তরীকা অনুযায়ী আত্মশুদ্ধিতার পথ পরিক্রমা শিক্ষা গ্রহণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু খানকা শরীফ ও তাসাওউফ চর্চাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সারা পৃথিবীতে কাদেরিয়া তরীকার নিসবত বা সম্বন্ধ অনুযায়ী রয়েছে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। তদরূপ বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, তাসাউফ চর্চা কেন্দ্র, সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। অসংখ্যক প্রকাশনাসহ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চতর গবেষণা।
বাংলায় কাদেরিয়া তরিকার প্রথম প্রচারক বাবা আদম শহীদ এবং শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি
বাংলাদেশে কাদেরিয়া তরিকার প্রভাব ব্যাপকভাবে রয়েছে। আমিনুল ইসলাম তার মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনে লিখেন “সুফীবাদের ইতিহাসে আবদুল কাদের জিলানীর ব্যক্তিত্ব ও মতবাদের প্রভাব অপরিসীম” আর তাই প্রাচ্যের সুফিপ্রধান ইসলামে তাঁর উপস্থিতি অতিশয় স্বাভাবিক। প্রাচ্যের সুফিধারায় বিশেষত বাঙলায় কাদেরিয়া তরিকার প্রসার হয়েছে ব্যাপকভাবেÑ প্রবল গতিতে। যে ক’জন প্রখ্যাত সূফি সাধক ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন অন্যতম। বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজ যোগে চট্টগ্রামে পৌঁছান। খোরাসান প্রদেশে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি উচ্চ শিক্ষার জন্য বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। নিজামিয়া মাদরাসা থেকে উচ্চ শিক্ষালাভের পর তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বাগদাদে হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর সহচার্যে আসেন এবং তাসাওউফের শেষ স্তর অতিক্রম করেন। তিনি প্রথমে মহাস্থানগড়ে খানকায়ে কাদেরিয়া স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত বাবা আদম শহীদ ১১৭৪ সালে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর ওফাত বার্ষিকীতে টঙ্গীবাড়ির আবদুল্লাহপুরে গরু জবাই করে “ফাতেহায়ে ইয়াযদাহুম” এবং “গেয়ারভী শরীফ” পালন করেন। গরু জবাই করা হলে বল্লাল সেন রাগে খানকার দায়িত্বে নিয়োজিত মুয়াবিয়ান আল বসরিকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে শহীদ করেন। এতে বাংলার বিভিন্ন স্থানে থাকা সুফিরা বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাবা আদমের সঙ্গে বল্লাল সেনের কয়েকবার সম্মুখ ও নৌ-যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধে পরাজয়ের আশংকায় বল্লাল সেন ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করলে বাবা আদম সরল বিশ্বাসে মেনে নেন। সেদিন রাতে ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা। বিক্রমপুরের দরগাহ বাড়িতে এশার নামাজের পর বাবা আদম রহমাতুল্লাহি আলায়হি মোরাকাবায় থাকা অবস্থায় বল্লাল সেন তার তরবারি দিয়ে তাঁকে হত্যা করে। বাবা আদম রহমাতুল্লাহি আলায়হি শহীদ হওয়ার পর রিকাবী বাজার দীঘিরপাড় সড়কের পাশে দাফন করা হয়।
রাজশাহীতে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যাদের নাম ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁদের অন্যতম। তিনি খোদ ওলীকুল শিরোমণি হযরত আব্দুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর অন্যতম প্রিয়তম পৌত্র। হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ৬১৫ হিজরির ২ রজব মোতাবেক ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ নগরীতে পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন হযরত আবদুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এর ২৭ পুত্রের একজন। হযরত শাহ্ মাখদুম রূপোশ রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন আযাল্লাহ্ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর দ্বিতীয় পুত্র। শাহ মখদুমের প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল কুদ্দুছ জালালুদ্দীন। তিনি ছিলেন হজরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি)’র পৌত্র আযল্লা শাহের পুত্র। ৬৮৫ হিজরিতে (১২৮৬ খ্রিস্টাব্দে) তিনি তাঁর বড় ভাই সৈয়দ আহমদ ওরফে মীরন শাহকে নিয়ে বাগদাদ হতে এখানে আসেন। মীরন শাহ লক্ষ্মীপুর জেলার কাঞ্চনপুরে এবং মখদুম শাহ কাঞ্চনপুরের সন্নিকটে শ্যামপুরে স্ব স্ব খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি তাঁর সঙ্গীর মাধ্যমে তরিকতের প্রচার প্রসার ঘটে।

বাংলা সাহিত্যে গাউসে পাক প্রসঙ্গ
বাংলাদেশে এই তরিকার প্রচার-প্রসারে উল্লেখযোগ্য দরবার ও বরেণ্য কবি সাহিত্যিক এবং ব্যক্তিত্বগণ বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। মহাকবি আলাওল, হায়াত মামুদ, জাতীয় মঙ্গলের কবি মোজাম্মেল হক, জ্ঞান তাপস ও বহুভাষাবিদ ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (যিনি সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় কাসিদায়ে গাউসিয়ার বঙ্গানুবাদ করেন) , ইসলামিক রেনেসার কবি ফররুখ আহমদের লিখনীর মধ্যে কাদেরিয়া তরিকার বৈশিষ্ট্য, হযরত বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হির অনন্য খেদমত ও বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন। মহাকবি আলাওল তো খোদ কাদেরিয়া তরিকার খলিফা। বাংলা সাহিত্যে গাউসে পাকের প্রথম উপস্থিতিÑ পরোক্ষভাবেÑ আলাওলের রচনায়। তৎকালীন রোসাঙ্গÑ বর্তমান মায়ানমারে অবস্থিতÑ এর কাজী, সৈয়দ মসউদ শাহা কবিকে ‘কাদেরী খিলাফত’ প্রদান করেন, যার বিবরণ কবি সিকান্দরনামা অনুবাদ-কাব্যে প্রকাশ করেন। মহাকবি আলাওলের ৬টি কাব্যগ্রন্থের একটি হচ্ছে সিকান্দরনামাÑএটি পারস্যের বিখ্যাত কবি নিজামী গঞ্জবীর এস্কেন্দর নামাহ’র কাব্যানুবাদ। এতে আলাওল ‘কবির আত্মকথা’ শিরোনামে একটি বৃহৎ অনুচ্ছেদ সংযোজন করেন। যেখানে ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্তের বর্ণনায় খানিক অগ্রসর হয়ে কবি লিখেনÑ
সৈয়দ মসউদ শাহা রোসাঙ্গের কাজী
জ্ঞান অল্প আছে বুলি মোরে হৈল রাজি।
দয়াল চরিত পীর আতুল মহত্ত্ব
কৃপা করি দিলেক কাদেরী খিলাফত।
যদ্যপিহ সত্য আহ্মি লই এহি ভার
পরশে পরশে তাম্র হেমাকার।
নিজ পীর মুর্শিদ তালতলা দরবার শরীফের পীর সাহেব আল্লামা সৈয়দ ইরশাদ আলী কাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হির নির্দেশে কবি কায়কোবাদের “গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ” নামের একটি সুবিশাল কাব্যগ্রন্থ রচনার মধ্যে দিয়ে গাউসে পাক সম্পর্কে তুলে ধরেন। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণের প্রসঙ্গ-কথায় কবি তনয়া জাহানারা বেগম লিখেছেন, “গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ মহাকবি কায়কোবাদের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ এবং নব্বইঊর্ধ্ব বয়সের রচনা। ইহার বহু বৎসর পূর্বেই কবির লেখনী স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার পীর কলকাতা তালতলাস্থ খানকা শরীফের সৈয়দেনা হজরত ইরশাদ আলী আল-কাদেরী কর্তৃক আদিষ্ট হইয়া তাঁহাকে পুনর্বার লেখনী ধারণ করিতে হয়। পীরানেপীর হজরত বড়পীর গওছল আজমের বংশধর ছিলেন এই পীর কেবলাহ্। গওছল আজমের উপর কবির নিজস্ব কোন রচনা নাই বলিয়া তাঁহাকে এই বিশেষ কর্তব্য পালনে অনুরোধ করা হয়। কবি তাঁহার জীবনসায়াহ্নে অসুস্থ কথার উল্লেখ করিয়া বিশেষত রচনাকার্য অসমাপ্ত থাকিতে পারে এই আশঙ্কায় বিনীতভাবে তাঁহার অক্ষমতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁহাকে এই আশ^াস প্রদান করা হয় যে গওছল আজমের জীবনী রচনায় হাত দিলে সমাপ্তির পূর্বে তাঁহার আয়ুষ্কাল শেষ হইবে না। পরম শ্রদ্ধাভরে এই আদেশ শিরোধার্য মানিয়া কবি ‘গওছ পাকের প্রেমের কুঞ্জ’ রচনায় মনোনিবেশ করেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতাহেতু গ্রন্থখানির রচনা বিঘিœত হইতে থাকে এবং ইহার রচনাকাল দীর্ঘ হইলেও সম্যকরূপে ইহাকে পরীক্ষা করিয়া দেখিবার অবকাশ তাঁহার ছিল না। সুস্থবোধ করিলে তিনি লেখায় মনোনিবেশ করিতেন এবং গওছ পাকের জীবনী রচনায় সত্যনিষ্ঠ হইয়া বহু তথ্য সংযোজন করিতে কবিকে বিবিধ গ্রন্থপাঠে উদ্যোগী হইতে হয়। ইহাতেও তাঁহার বহু সময় ব্যয় হয়। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি, অসুস্থ দেহ ও নিস্তেজ প্রাণ ক্ষণে ক্ষণে বাধার সৃষ্টি করিয়া চলে। দীর্ঘ পাঁচ বৎসর পর এই কাব্যগ্রন্থ রচনা সমাপ্ত হয় এবং ইহার প্রকাশনার দায়িত্বভার আমার স্বামী মরহুম আবদুল গফুরের হাতে দিয়া তিন মাস পর ১৯৫১ সালে ২১শে জুলাই তিনি ইহলোকের মায়া কাটাইয়া চলিয়া যান। বহু বিলম্বে হইলেও আমার পিতার শেষ রচনা এই কাব্যগ্রন্থ যে মুদ্রিত হইয়া আত্মপ্রকাশ করিল ইহাই আমার সান্ত¡না ও তৃপ্তি। আমার পিতার ইচ্ছায় ও নির্দেশক্রমে এই গ্রন্থের সমুদয় আয় সেগুনবাগানে অনুষ্ঠিত হজরত গওছ পাকের বাৎসরিক ওরশ শরীফে ব্যয়িত হইবে।
এছাড়াও মধ্য যুগের সাথে সাথে আধুনিককালের রকীব শাহ, কবি সুফিয়া কামাল, সাবির আহমেদ চৌধুরী, হাকিমাবাদের পীর সাহেব মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ, আলাউদ্দিন আহমাদসহ ১১জন কবির গাউছে পাকের প্রেমস্তুতি ও অনন্য রচনাবলীকে মলাটবদ্ধভাবে “বাংলা সাহিত্যে গাউছে পাক প্রসঙ্গ” গ্রন্থে তরুণ গবেষক মোহাম্মদ আবু সাঈদ তুলে ধরেছেন। ২০২১ সালে বাংলা একাডেমী আয়োজিত অমর একুশে বইমেলায় বইসই প্রকাশ করেন। আবু সাঈদ তার সংকলনে গাউছে পাক রচিত “কাসিদায়ে গাউছিয়া”-এর বাংলা অনুবাদের ৮টি গ্রন্থের তথ্য উল্লেখ্যসহ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, অধ্যক্ষ হাফেজ এম.এ.জলিল রহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং কবি রূহুল আমীন খানের বাংলা কাব্যানুবাদের ৫টি কাসিদার তুলনামূলক পর্যালোচনা তুলে ধরেন।

বাংলাদেশে উচ্চতর গবেষণায় হুযুর গাউছে পাক প্রসঙ্গ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ স্যারের তত্ত্বাবধায়নে একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসার অনার্স বিভাগের সাবেক প্রভাষক, এস. এম. মাছুম বাকী বিল্লাহ “ইসলামের প্রচার-প্রসার ও আধ্যাত্মবাদে হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি)এর অবদান” শিরোনামে তাঁর উত্থাপিত পিএইচ.ডি. ডিগ্রীর জন্য অভিসন্দর্ভ টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৯ সালে ২৫ এপ্রিল অনুমোদন দেন। এটি আমার জানা মতে এদেশে বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি-এঁর উপর প্রথম অ্যাকাডেমিক পর্যায়ে উচ্চতর গবেষণা। নিঃসন্দেহে এটা গাউছে পাক প্রেমি এবং এই সিলসিলার অনুসারীদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। দীর্ঘ ৫৩০ পৃষ্ঠার এই গবেষণাপত্রে গবেষক নয়টি অধ্যায়ে বিন্যাস করেছেন।

গাউসে পাকের নামে প্রতিষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞ
মাদরাসা : আওলাদে রসূল, গাউসে জামান আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসা রাজধানীর বুকে হুযুর গাউসে পাকের নামে প্রতিষ্ঠিত সর্ববৃহৎ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। তাঁর শাহজাদা রাহনুমায়ে শরীয়ত ওয়া ত্বরীকত, আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ ও পীরে বাঙাল সাবির শাহ (মাদ্দা জিল্লুহুল আলী)-দ্বয়ের হাত ধরে ঢাকা, চট্টগ্রামের রংপুর মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, হবিগঞ্জ, চাঁদপুর, সাতক্ষীরা, ফেনী, কুমিল্লা, সৈয়দপুরে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমিদয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট পরিচালিত একাধিক মাদরাসা ও খানকাহ গড়ে উঠেছে।
আল্লামা অধ্যক্ষ আব্দুস সাত্তার (মাদ্দা জিল্লুহুল আলী) প্রতিষ্ঠিত “নামাজগড় গাউছুল আযম কামিল মাদরাসা উত্তরবঙ্গে গাউছে পাকের নামে সর্ববৃহৎ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। সিলেট বিভাগে অধ্যক্ষ আল্লামা শেখ মুহাম্মদ আবদুল করিম সিরাজনগরী (মাদ্দা জিল্লুহুল আলী) প্রতিষ্ঠিত সিরাজনগর গাউসিয়া জালালিয়াহ্ মমতাজিয়া সুন্নিয়া ফাযিল মাদরাসা, মৌলভীবাজার। চট্টগ্রামে ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা কাজী নুরুল ইসলাম হাশেমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রতিষ্ঠিত আহসানুল উলুম জামেয়া গাউসিয়া কামিল মাদরাসা, হাটহাজারীতে আল্লামা আজিজুল হক আল কাদেরী (রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি) প্রতিষ্ঠিত ছিপাতলী জামেয়া গাউসিয়া মুঈনীয়া কামিল (এম.এ) মাদরাসা। নরসিংদীর পেশোয়ারী দরবারের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাজী বশির গোল পেশোয়ারী রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রতিষ্ঠিত গাউছিয়া পেশওয়ারীয়া সুন্নীয়া আলিম মাদরাসা। মশুরীখোলা দরবার শরীফের পীর সাহেব হযরত কেবলা শাহ আহসানুল্লাহ রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র কাদেরিয়া তরিকার পীর মুর্শিদ হযরত কালীম শাহ বোগদাদি রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র নামানুসারে বর্তমান পীর সাহেব আল্লামা শাহ মুহাম্মদ আহছানুজ্জামান (মাদ্দা জিল্লুহুল আলী) প্রতিষ্ঠিত হযরত কালীম শাহ বোগদাদি রহমাতুল্লাহি আলায়হি হেফজখানা ও এতিমখানা। নারায়ণগঞ্জে আল্লামা মাওলানা বাকী বিল্লাহ জালালী ক্বাদেরী (রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি) প্রতিষ্ঠিত জামেয়া গাউসিয়া তৈয়্যবিয়া তাহেরিয়া মাদরাসা অন্যতম।
মসজিদ : বাগদাদ শরীফের খলিফা হযরত হাফেজ এম. এ. জলিল (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) প্রতিষ্ঠিত শাহজাহানপুর গাউছুল আ’যম রেলওয়ে জামে মসজিদ এবং দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা এম.এ.মান্নান প্রতিষ্ঠিত মহাখালী গাউছুল আ’যম জামে মসজিদ অন্যতম দৃষ্টি নন্দন, বৃহৎ এবং বহুমুখী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বমহলে সুপরিচিত। শাহজাহানপুর গাউছুল আ’যম রেলওয়ে জামে মসজিদটি প্রতিষ্ঠায় আল্লামা খাজা আবু তাহের রহমাতুল্লাহি আলায়হি যুগপৎভাবে অবদান রাখেন।
এছাড়াও ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা ও সিলেটসহ দেশের প্রায় জেলায় কাদেরীয়া তরীকার চর্চায় অগণিত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও খানকা এ দেশের বরেণ্য মাশায়েখগণ ও সিরিকোট দরবারের বর্তমান সাজ্জাদানশীনগণের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

গাউসে পাকের নামে সাংগঠনিক কর্মযজ্ঞ
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ : গাউসে জামান আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলাইহি) কর্তৃক ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। এটি নিঃসন্দেহেই বলা যায় হুযুর গাউসে পাকের নামে বাংলাদেশে সর্ববৃহৎ তরিকত ভিত্তিক সংগঠন। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হতে ধর্মীয় এবং মানবসেবায় অনন্য ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বিশেষ করে করোনায় ৫ হাজারের বেশি মানুষের দাফন-কাফনে এগিয়ে এসে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। মুসলিমদের পাশাপাশি সৎকারের সহয়তা দিয়েছেন অন্যান্য ধর্ম অনুসারীদের, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দফনেও এগিয়ে এসেছেন তারা, আছে নারীদের জন্য নারী স্বেচ্ছাসেবী দল।
এছাড়াও আনজুমানে গাউছুল আ’যম বাংলাদেশ, আঞ্জুমানে মুহিব্বানে রাসূল গাউছিয়া জিলানী কমিটিসহ অগণিত ছোট-বড় ধর্মীয় এবং সামাজিক সংগঠন, সংস্থা রয়েছে।

কাদেরীয়া তরীকা ও আব্দুল কাদির জিলানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি’র জীবন ও কর্ম সম্পর্কীত গ্রন্থসমূহের মধ্যে কয়েকটি হলঃ
গাউসে পাক লিখিত গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ
* গুন্ইয়াতুত্ ত্বালেবীন (প্রথম খন্ড), (বাংলা অনু.) ড. আব্দুল্লাহ আল মা‘রুফ, ইফা,ঢাকা, ২০১২ খ্রি.
* দিওয়ানে গওসিয়া, (বাংলা ও ইং.অনু.) সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ এ.বি. মাহমুদ হুসেন, শাহ সাহেব লেন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ১৯৭৬ খ্রি.
* আল-ফাতহুর রাব্বানী, (বাংলা অনু.) ঐশী প্রেরণার অনন্ত উৎস, অধ্যাপক মাওলানা আখতার ফারূক, ঢাকা, পুস্তকালয়, ২০০৮ খ্রি.
ক্স আল-ফাতহুর রাব্বানী ওয়া আল ফায়জুর রাহমানী, (বাংলা অনু.)-এ.কে.এম. ফজলুর রহমান মুনশী,ঢাকা, ১৯৯৭ খ্রি.
* ফাতুহুল গায়িব (হযরত গওসুল আযমের অমর বাণী), অনুবাদ ও সংকলন-মাওঘএঠততঔদ্বঠডঘ অঠঔঠছডঘ মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম রহ.,ঢাকা.
* র্সিরুল আসরার ফিহা ইয়াহতাজু ইলায়হিল আবরার, বাংলা অনুবাদ-মুহাম্মদ আবদুল মজিদ, ঢাকা, ২০১২ খ্রী.
* সিররুল আসরার, বাংলা অনুবাদ-মাওলানা আবদুল জলীল (রহমাতুল্লাহি আলায়হি), ঢাকা, ২০০৯ খ্রি.
* কাসিদায়ে গাউসিয়া, (বাংলা কাব্যানুবাদ) মোহাম্মদ খছরুজ্জামান, সিলেট,মার্চ ২০১৭ খ্রি.
* কাসীদাতুল গাউছিয়া ও দরুদে একসীরে আযম, মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান সরদার, পিরোজপুর,২০০৪ খ্রি.
* কাসীদাতুল গাওসীয়া, মুহাম্মদ ফেরদাউস খান,ঢাকা, ১৯৭৫ খ্রি.
* হযরত বড়পীর গাউসুল আ‘যম সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী ক.ছি.আ, রেজায়ে মোস্তফা পাবলিকেশন্স,চট্টগ্রাম, ২০১৫ খ্রি.
* শানে গাউছুল আজম, কাজী মুফতি আব্দুল ওয়াজেদ, চট্টগ্রাম, ২০০৩ খ্রি.
* জোব্দাতুল আছার (হজরত ছৈয়েদুনা গৌছুল আজম বড় পীর ছাহেব রাজিয়াল্লাহু আনহুর পবিত্র জীবন চরিত),
শায়খ আব্দুল হক্ দেহলভী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি), বাংলা অনু.- আবুল হাছান মোস্তাফিজোর রাহমান খা,
সাবেক ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট, চট্টগ্রাম, প্রথম সংস্করণ-১৯৫৩ খ্রি.।
* গাউসুল আ‘যম ও গাউসিয়্যাত, ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি,(বাংলা অনু.) মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন, চট্টগ্রাম, ২০১০ খ্রি.
* বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জীলানী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি), (বাংলা অনু.) ড.আবুল ফাতাহ মুনিরুজ্জামান, পিরোজপুর, ২০১২ খ্রি.।
* কারামাতে গাউসুল আ’জম রাদিয়াল্লাহু আনহু, অধ্যক্ষ হাফেয এম. এ জলিল, ঢাকা, ১৯৯৭ খ্রি.
* বাহ্জাতুল আসরার, অনুবাদ- আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান, চট্টগ্রাম,
* গওসুল আযম হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি), মাওলানা মাওলানা নুরুর রহমান, ঢাকা, পুনর্মুদ্রন-২০১১.
* আমার পীর হজরত গওসল আজম (রহমাতুল্লাহি আলায়হি), চৌধুরী নূরুল আজিম কাদেরী, ঢাকা, ১৯৯০ খ্রি.
* বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) জীবন ও কর্ম, ফজলুল করীম আনওয়ারী ও মো. আবু তাহের, ঢাকা, ১৯৯৬ খ্রি.
* গাউসুল আজম ও গিয়ারভী শরীফ,মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী, চট্টগ্রাম, ২০১০ খ্রি.
* (নুযহাতুল খাতিরিল ফাতির ফি মানাকিবিশ শায়খ আবদুল কাদির, মোল্লা আলী ক্বারী রহ.), হযরত আবদুল কাদির জিলানরি জীবন ও কারামত, বাংলা অনুবাদ- মাওলানা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন, ঢাকা, ২০১০ খ্রি.
* গাউসুল আজম জিলানী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি)’র সংস্কার ও ত্বরীকা, মোছাহেব উদ্দীন বখতিয়ার, চট্টগ্রাম, ২০০২ খ্রি.
* জীলান সূর্যের হাতছানি, মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ, নারায়ানগঞ্জ, ১৯৮৭ খ্রি.
* শাজরায়ে আলিয়া কাদেরিয়া পাঠের আদব ও উপকারীতা, শাহজাহান মুহাম্মদ ইসমাঈল, ঢাকা.
* মালফুযাতে গাওসুল আযম (রহমাতুল্লাহি আলায়হি), হাফেয মাওলানা শিবলী আহাম্মদ,ঢাকা, ২০০৪ খ্রি.
* গেয়ারভী শরীফের ইতিহাস, অধ্যক্ষ হাফেজ এম এ জলিল, ১৯৯৭।

লেখক: সংগঠক ও প্রাবন্ধিক, রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর, হাকিকত কিতাবেভী, ঢাক ডিভিশন।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •