মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
লক্ষ্য করুন! এ হাদীস শরীফে রহমতে আলম শুধু এতটুকু বলেননি যে, হযরত উম্মুল ফদ্বলের গর্ভাশয়ে সন্তান রয়েছে বরং ওই সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কেও বলেছেন। এ সবই তো গায়েবের খবর, যেগুলো তিনি দিচ্ছেন। অর্থাৎ এ সন্তান আব্বাসী বংশের মূল পুরুষ (مورث اعلى) হবে। তাঁর বংশ থেকে অনেকে খলীফা হবেন। এমনকি তাঁর বংশ হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম নাযিল হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী হবে। সুবহা-নাল্লাহ্!
সুবহা-নাল্লাহ্! এ‘তো হুযূর খাতামুন্ নবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইলমে গায়বের তাজাল্লীরাশি। তিনি সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সবার সেরা জ্ঞানী। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা আলাযহির রাহমাহ্ বলেন-
اور كوئى غيب كيا تم سے نهاں هو بھلا
جب نه خدا هى چھپا، ثم په كروڑوں درود
অর্থ: যখন খোদ খোদা তা’আলা, ইয়া রসূলাল্লাহ্! আপনার নিকট থেকে গোপন থাকেননি, তখন আর এমন কি জিনিস থাকতে পারে যা আপনার থেকে গায়ব বা গোপন? অর্থাৎ কিছুই গোপন নেই। আপনার উপর কোটি কোটি দরূদ বর্ষিত হোক।
হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম-এর জ্ঞানের গভীরতার স্থান এতই উচূঁ যে, তিনি খোদা আ‘আলার মহান দরবারে এভাবে দো’আ করেছেন-
وَقَالَ نُوحٌ رَّبِّ لا تَذَرْ عَلَى الأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا○
তরজমা: এবং নূহ আরয করলো, হে আমার রব! পৃথিবী পৃষ্ঠের উপর কাফিরদের মধ্যে কোন বসবাসকারী রেখো না! [সূরা নূহ: আয়াত-২৬, কানযুল ঈমান]
إِنَّكَ إِن تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبَادَكَ وَلا يَلِدُوا إِلاَّ فَاجِرًا كَفَّارًا○
তরজমা: নিশ্চয় যদি তুমি তাদেরকে থাকতে দাও, তবে তারা তোমার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করে ফেলবে; আর তাদের সন্তান-সন্ততি হলে তারাও হবে না কিন্তু পাপী, অকৃতজ্ঞ।
দেখে নিন! হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম-এর অন্তর্দৃষ্টির অদৃশ্য জ্ঞানের জ্বলওয়া। অর্থাৎ তিনি কাফির পুরুষদের পৃষ্ঠদেশে যেই বীর্য ছিলো, আর কাফির নারীদের গর্ভাশয়ে যেই সন্তান ছিলো, তা কি পুত্র না কন্যা? শুধু এতটুকু ইল্ম ছিলো না, বরং তিনি তাদের সম্পর্কে এ পর্যন্ত জানতেন যে, তাদের হৃদয়গুলোতে কুফর থাকবে, না ঈমান, তারা সৎ কর্মপরায়ণ হবে, না অসৎ কর্মপরায়ণ? সম্মানিত পাঠকগণ! এ দলীলগুলো কি একথার প্রমাণ বহন করে না যে, আল্লাহ্র খাস বান্দাগণ, বিশেষত, নবী ও অলীগণকে আল্লাহ্ তা‘আলা مَا فِى الْاَرْحَامِ (মায়ের গর্ভাশয়ে কি আছে) সে সম্পর্কেও জ্ঞান দান করেছেন? অবশ্যই দান করেছেন। যারা এটা মানে না তাদের বেলায় নি¤œলিখিত পংক্তিটা প্রণিধান যোগ্য-
پھول كى پتى سے كٹ سكتاهے هيرے كا جگر
مرد نادان پر كلام نرم ونازك بے اثر
অর্থ: ফুলের পাতা (পাপড়ি) দিয়ে হিরার বুক-কলিজা
কাটা সম্ভব, কিন্তু অজ্ঞলোকের উপর নম্র-নাজুক কথা কোন প্রভাব ফেলে না।
আগামীকাল কী করবে?
পাঁচ বিষয়ের ইলমের মধ্যে ‘আগামীকাল কে কি করবে? সেটার জ্ঞানও আল্লাহ্ তা‘আলা আপন প্রিয় রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন। এটা প্রায় সবার জানা কথা যে, খায়বারের যুদ্ধের সময় একদিন সরকার-ই দো-জাহান ঘোষণা করলেন-
لَاُعْطِيَنَّ هٰذِهِ الرَّايَةَ غَدًا رَجُلًا يَفْتَحُ اللهُ عَلٰى يَدَيْهِ يُحِبُّ اللهَ وَرَسُوْلَه- (مشكوة باب منافب على رضى الله عنه)
অর্থ: আগামীকাল আমি এ ঝান্ডা ওই ব্যক্তিকে দেবো, যার হাতে আল্লাহ্ তা‘আলা খায়বারের বিজয় দান করবেন। আর সে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে ভালবাসে।
সুতরাং রহমতে আলম পরদিন ঝান্ডা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাতে দিয়েছিলেন। আর তিনি খায়বারকে জয় করে নিয়েছিলেন। এতে একথা মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট হলো যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে مَا ذَا تَكْسِبْ غَدًا (আগামীকাল কে কি করবে)-এর জ্ঞানও দান করেছেন।
কে কোথায় মারা যাবে?
এখন ওই পাঁচ বিষয়ের জ্ঞানের মধ্যে এ বিষয়ে জ্ঞানের কথাও জেনে নিন যে, কে কোথায় মারা যাবে! বদরের যুদ্ধের সময় হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদিন পূর্বে একটি লাঠি দ্বারা যুদ্ধের ময়দানে রেখা টেনে বলেছিলেন, ‘‘এটা অমুক কাফির নিহত হবার স্থান।’’ এ হাদীস শরীফের বর্ণনাকারীর বর্ণনা হচ্ছে-
فَمَا مَاتَ اَحَدُهُمْ عَنْ مَوْضَعِ يَدِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- (مسلم ج -٢ باب غزوة بدر)
অর্থ: নিহত কাফিরদের থেকে কেউই হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাত মুবারক রাখার স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও নিহত হয়নি। যে স্থানটিকে যে ব্যক্তির নিহত হবার জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন সেখানেই তার লাশ পাওয়া গেছে।
মোটকথা: ওই পাঁচ বিষয়ের জ্ঞানও আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পবিত্র আক্বিদা বা বিশ্বাস।
রাসূল-ই আকরামের ইল্মে গায়ব ও সাহাবা-ই কেরাম
এ কথা সবাই জানে ও মানে যে, ক্বোরআন মজীদকে সব চেয়ে বেশী যাঁরা বুঝেছেন, তাঁরা হলেন আল্লাহ্ রসূলের সাহাবা-ই কেরামের পবিত্র দল। আজকাল ওহাবী-দেওবন্দী আলিমরা যে সব আয়াত পড়ে পড়ে রাসূল-ই আকরামের ইল্মে গায়ব’কে অস্বীকার করছে, সাহাবা-ই কেরামের ‘ইল্মে কি ওইসব আয়াত ছিলো না? গোটা দুনিয়ায় এমন কে আছে, যে বলতে পারে যে, সাহাবা-ই কেরাম এ আয়াতগুলো সম্পর্কে জানতেন না? নেই, মোটেই নেই। আবশ্যই সাহাবা-ই কেরামের ওইসব আয়াতের জ্ঞান নিখুঁতভাবে ছিলো; বরং তাঁদের মতো জ্ঞান ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কারো মধ্যে নেই।
সাহাবা-ই কেরামের, ওইসব আয়াতের স্বচ্ছ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তাঁরা বারবার হুযূর-ই আকরাম থেকে গায়বের খবরাদি জানতে চাইতেন, আর হুযূর-ই আকরামও তাঁদেরকে সেগুলোর খবর দিতেন। উদাহরণ স্বরূপ, ‘কিতাবুল ফিতান’ ও ‘কিতাবুর রাক্বাক্ব’-এর অসংখ্য হাদীস তো তেমনি যে, সেগুলোতে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবা-ই কেরামকে গায়বের খবরগুলো দিয়েছেন। আর সাহাবা-ই কেরাম তো হুযূর-ই আকরামকে একথা বলেননি যে, আপনি এসব গায়বের খবর কিভাবে দিয়েছেন? ক্বোরআন মজীদে তো ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ্ ব্যতীত কেউ গায়ব জানে না? বরং সব চিন্তাধারার লোকেরা এবং সব ভাবধারার আলিমরা একথা জানেন যে, সাহাবা-ই কেরামের এ নিয়ম ছিলো যে, তাঁরা বারংবার হুযূর-ই আকরামকে গায়বের বিষয়াদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। আর তাঁরা হুযূর-ই আকরামের বর্ণিত গায়বের খবরগুলোর উপর ঈমান ও দৃঢ় বিশ্বাস রাখতেন।
ইমাম বোখারী باب ما يكره من كثرة السوال-এ বর্ণনা করেছেন, হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একদিন যোহরের নামাযের পর নিম্বর শরীফের উপর দান্ডায়মান হলেন আর ক্বিয়ামতের দিনের ও ক্বিয়ামতের পরের বড় বড় ঘটনাগুলো বর্ণনা করলেন। তারপর এরশাদ করলেন, ‘‘যে ব্যক্তি যে জিনিষ সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করতে চাও, করতে পারো! কেননা, আল্লাহ্রই শপথ! আমি যতক্ষণ পর্যন্ত এখানে অবস্থান করবো, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা যে জিনিষ সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করবে, আমি তোমাদেরকে সেটা সম্পর্কে খবর দেবো।’’ এ কথা শুনে উপস্থিত সাহাবা-ই কেরাম কাঁদতে লাগলেন। আর হুযূর-ই আকরাম একথা বারংবার বলতে লাগলেন- ‘‘প্রশ্ন করো, আমাকে প্রশ্ন করো।’’ হযরত আনাস বলেছেন, উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়ালো, فَقَالَ اَيْنَ مَدْخَلِىْ يَا رَسُوْلَ اللهِ আর লোকটি বললো, ‘‘হে আল্লাহ্ রাসূল! আমাকে কোথায় প্রবেশ করানো হবে- জান্নাতে, না দোযখে?’’ হুযূর-ই আকরাম বললেন, ‘‘তোমার ঠিকানা জাহান্নাম।’’ তারপর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে হুযাফাহ্ দাঁড়ালেন আর আরয করলেন, ‘‘হে আল্লাহ্র রাসূল! আমার পিতা কে?’’ হুযূর এরশাদ ফরমালেন, ‘‘হুযাফাহ্।’’ [বোখারী শরীফ: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৮৩]
বোখারী শরীফের এ হাদীস শরীফ কি একথা ঘোষণা করছেনা যে, সাহাবা-ই কেরামের এতে নিশ্চিত বিশ্বাস ছিলো যে, সরকার-ই দু’জাহান আল্লাহ্র দান ক্রমে ইল্মে গায়বের ধারক ছিলেন? নিশ্চয়ই, অবশ্যই!
হযরত হাস্সান ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর নি¤œলিখিত কবিতার মাধ্যমে এ নিবন্ধের ইতি টানছি-
نَبِىٌّ يَرٰى مَا لَا يَرَى النَّاسُ حَوْلَه
وَيَتْلُوْ كِتَابَ اللهِ فِى كُلِّ مَشْهَد
فَاِنْ قَالَ فِىْ يَوْمٍ مَقَالَةَ غَائِبِ
فَتَصْدِيْقُهَا فِىْ ضَحْوَةِ الْيَوْمِ اَوْغَد
অর্থ: নবী-ই আকরাম তাঁর চতুর্পাশের সবকিছু দেখেন,
যেগুলোকে অন্য কোন মানুষ দেখতে পায় না। আর নবী সর্বত্র খোদার কিতাব তিলাওয়াত করেন।
আর যদি নবী-ই আকরাম কোন গায়ব বা অদৃশ্যের কথা কোন দিন বলে দেন, তবে আজ কিংবা কাল প্রকাশ্য দিবালোকে সেটার সত্যায়ন-বাস্তবায়ন হয়ে যায়।
পরিশেষে, একথাও বলে রাখা দরকার যে, যেখানে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো জ্ঞানের অস্বীকার করা হয় সেখানে ‘ইলমে যাতী’ (স্বত্তাগত বা সরাসরি জ্ঞান) বুঝানো উদ্দেশ্য, পক্ষান্তরে, আল্লাহ্র দানকৃত জ্ঞানকে অস্বীকার করায় কোন কারণ বা উপায় নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রসূলকে পঞ্চ বিষয়ের জ্ঞান, যেগুলোর কথা সূরা লোকমানের ৩৪ নম্বর আয়াতে এরশাদ হয়েছে. দান করেছেন। এতে বিশ্বাস করা যেমন ফরয, তেমনি অস্বীকার করা বে-দ্বীনি।
লেখক: মহাপরিচালক আন্জুমান রিচার্স সেন্টার।