প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফে হাউযে কাউসার সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে। এ ছাড়াও অসংখ্য হাদীস শরীফে হাউযে কাউসার-এর বর্ণনা এসেছে। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের কাউসার-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে সূরা কাউসার নামে একটি সূরা নাযিল করেছেন। এরশাদ হয়েছে-
اِنَّاۤ اَعْطَیْنٰكَ الْكَوْثَرَؕ(۱) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْؕ (۲) اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْاَبْتَرُ۠(۳)
অর্থ: (আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন), ১. হে মাহবুব! নিশ্চয় আমি আপনাকে অসংখ্য গুণাবলী দান করেছি। ২. সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামায পড়–ন এবং কোরবানী করুন। ৩. নিশ্চয় যে আপনার শত্রু সে-ই সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত।
[তরজমা: কানযুল ঈমান: সূরা-১০৮, সূরা কাউসার, আয়াত-৩]
সূরা কাউসারের রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা তিন, শব্দ দশটি, বর্ণ সংখ্যা বিয়াল্লিশটি।
এ সূরার আলোচ্য বিষয়
১. হাউযে কাউসারের আলোচনা
২. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নিন্দুকের প্রতিবাদ।
৩. নবীজির সুউচ্চ মর্যাদার বর্ণনা ও সান্ত¦না প্রদান।
৪. নামায ও কোরবানীর বিধান আলোচনা।
অধিকাংশ তাফসীরকারদের বর্ণনামতে সূরাটি মাদানী, কেউ কেউ মক্কী সূরা বলে মত প্রকাশ করেছেন।
কাউসারের অর্থ
কাউসার শব্দটি আরবিতে একাধিক অর্থে ব্যহৃত হয়। كثير – কাসীর অর্থ- বেশি বা অধিক। اكثر -আকসার অর্থ- খুব বেশি। كثار কিসার অর্থ- খুবই বেশী। كوثر -কাউসার অর্থ- সীমাহীন বেশী। যা সৃষ্টির জ্ঞান গবেষণা বিবেক বুদ্ধি ও অনুধাবনের বাইরে।
উপরোক্ত অর্থের আলোকে কাউসার শব্দের বহুবিধ অর্থ পাওয়া যায়।
১. হাউযে কাউসার: যার পরিধি ও ব্যাপ্তির প্রশস্ততা এক মাসের পথ। যেটি ইয়াকুত পাথর ও অন্যান্য মণিমুক্তার উপর প্রবাহিত। যে হাউযের তীরে অসংখ্য মুক্তার তৈরী তাঁবু স্থাপিত থাকবে। সারিসারি সুজলা সুফলা বৃক্ষরাজিতে সুসজ্জিত থাকবে। যে হাউযে কাউসারের পানপাত্রের সংখ্যা আকাশের নক্ষত্রসম অসংখ্য অগণিত যা বর্ণনাতীত। যে কাউসারের পানি একমাত্র জান্নাতীরাই পান করার সুযোগ পাবে।
২. কাউসার দ্বারা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের উম্মতের আধিক্য। যে সংখ্যা সকল সম্মানিত নবীদের উম্মতের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে। হুযূরের অগণিত উম্মত, যারা পৃথিবীতে সর্বত্র দিগদিগন্তে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে আছেন।
৩. হুযূরে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সীমাহীন জ্ঞান (তিনি সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাজ্ঞানী)
৪. হুযূরের অসংখ্য প্রশংসা ও গুণাবলী, যা বর্ণনাতীত, তিনি তাঁর প্রভূ কর্তৃক প্রশংসিত।
৫. অথবা কাউসার দ্বারা ‘শাফায়াতে কুবরা’ বৃহত্তম সুপারিশের ক্ষমতা বুঝানো হয়েছে।
[তাফসীরে আযীযী, তাফসীরে নুরুল ইরফান]
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عَنْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَفَاعَتِىْ لاهل الْكَبَائِر مِنْ اُمَّتِىْ
[مسند احمد ـ ابو داود ـ والترمذى]
অর্থ: হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার শাফাআত আমার উম্মতের কবীরা গুনাহ্কারী উম্মতের জন্য।
[মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী]
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে-
عَنْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَا اَوَّلٌ النَّاسِ يَشْفَعُ فِى الْجَنَّةِ وَاَنَا اَكْثَرُ الْانبياءِ تبعًا [رواه مسلم]
অর্থ: হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি প্রথম ব্যক্তি যে জান্নাত সম্পর্কে আল্লাহর নিকট শাফাআত করব। নবীগণের মধ্যে আমার অনুসারীর সংখ্যাই হবে সবচেয়ে বেশী। [মুসলিম শরীফ]
সূরা কাউসার-এর শানে নুযূল
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের ছাহেবযাদা হযরত কাসিম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মক্কা মুকাররমায় ইন্তেকাল করেন এবং অপর ছাহেবযাদা হযরত ইব্রাহীম রাদ্বিয়াল্লাহি তা‘আলা আনহু মদীনা মুনাওয়ারায় ইন্তেকাল করেন। উভয়ের ইন্তেকালের পর আস ইবনে ওয়ায়েল প্রমূখ কাফির বললো, হুযূর ‘আবতার’ নির্বংশ হয়ে গেলেন।
তাঁর পর না তাঁর নাম থাকবে না তাঁর ধর্মের নাম থাকবে। তাঁর মৃত্যু হয়ে গেলে তাঁর নাম উচ্চারণ করারও কেউ থাকবে না। (নাউযুবিল্লাহ্ মিন যালিক) নবীজির প্রতি কাফিরদের এ ধৃষ্ঠতা প্রদর্শনের প্রতিবাদ ও তাদের ভ্রান্ত ধারণার খন্ডনে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সান্ত¦না প্রদানের জন্য সূরা কাউসার নাযিল করেন।
[তাফসীরে রুহুল বয়ান, ইবনে কাসীর, তাফসীর মাযহারী, তাফসীরে নুরুল ইরফান]
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, কাউসার মানে অজ¯্র কল্যাণ, বহু কল্যাণ, যা আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন। [বুখারী শরীফ] তাফসীরকারক হযরত সদরুল আফাযিল আল্লামা সৈয়্যদ নঈম উদ্দীন মুরাদাবাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘কাউসার’র বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা নবীজিকে অসংখ্য ফযীলত দান করে সৃষ্টিকূলের উপর সর্বোত্তম মর্যাদামন্ডিত ও মহিমান্বিত করেছেন। নবীজির বাহ্যিক সৌন্দর্য, অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য, পবিত্র বংশ মর্যাদা, মহাগ্রন্থ আল কুরআন নবীজির উপর অবতরণ, অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল প্রকার খোদাপ্রদত্ত জ্ঞানের আঁধার হিসেবে নবীজিকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান, মকামে মাহমুদ ও শাফাআতে কুবরার সুমহান প্রশংসিত স্থানে নবীজির অধিষ্ঠান। ইসলামের শত্রুদের উপর নবীজিকে বিজয় দান ইসলামকে বিশ্বজনীন কালজয়ী বিজয়ী ধর্ম হিসেবে ঘোষণা। এ ছাড়াও অগণিত ফযীলত নিয়ামত মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব নবীজিকে দান করেছেন। যেগুলোর পরিসংখ্যান বর্ণনা, সৃষ্টিকুলের ক্ষমতা ও সাধ্যের বাইরে। যে গুণাবলীর অন্ত নেই। তিনি মহান আল্লাহর অদ্বিতীয় সৃষ্টি রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
হাউযে কাউসারের পরিধি
হাউযে কাউসারের পরিধি, বিস্তৃতি ও প্রশস্ততা কতদূর পর্যন্ত হবে এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফের বিভিন্ন কিতাবে অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনায় এসেছে, কাউসার ‘আইলা’ ইসরাঈলের বর্তমান সামুদ্রিক বন্দর, ‘আইলাত’ হতে এডেন অথবা আম্মান হতে এডেন পর্যন্ত দীর্ঘ হব্ েআর আইলা হতে হুজফা পর্যন্ত যতটা দুরত্ব কাউসার ততটা চওড়া হবে। [বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ্ ও মুসনাদে আহমদ]
হাউযে কাউসার-এর অবস্থান
হাউযে কাউসার-এর অবস্থান সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
مَا بَيْنَ بَيْتِىْ وَمِنْبَرِىْ رَوْضَةٌ مِنْ رِيَاضِ الْجَنَّةِ
وَمِنْبَرِىْ عَلَى حَوْضىِ [رواه البخارى]
অর্থ: আমার গৃহ ও মসজিদের মিম্বরের মাঝে জান্নাতের বাগানসমূহের একটি বাগান। আর আমার মিম্বর রয়েছে আমার হাউযে কাসারের উপর। [বুখারী শরীফ]
প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক হাউযে কাউসার অবলোকন
রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
اَنَا فَرْطُكُمْ عَلَى الْحَوْضِ
অর্থ: আমি তোমাদের সকলের আগেই হাউযে কাউসারে উপস্থিত থাকব। [বুখারী, মুসলিম]
নবীজি আরো এরশাদ করেছেন-
اِنِّىْ فرطٌ لَكُمْ وَاَنَا شَهِيْدَ عَلَيْكُمْ وَاَنّى
واللهِ لاَنُظرُوا الى حَوْضى الان [رواه البخارى]
অর্থ: আমি তোমাদের আগেই কাউসারের নিকট পৌঁছব ও তোমাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিব। আল্লাহর কসম, আমি এখন আমার হাউয দেখতে পাচ্ছি। [বুখারী শরীফ]
নবীজির নূরানী দৃষ্টিশক্তির প্রসারতার প্রতি লাখো সালাম।
হাউযে কাউসার-এর চারপ্রান্তে চার খলিফা থাকবেন
‘তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান প্রণেতা আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হাউযে কাউসারের চারপ্রান্তে আমার চার সাহাবী থাকবেন। এক প্রান্তে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দ্বিতীয় প্রান্তে হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, তৃতীয় প্রান্তে হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং চতুর্থ প্রান্তে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থাকবেন। যে ব্যক্তি চারজনের যে কারো সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবে তাকে কেউ হাউযে কাউসার-এর পানি পান করাবেন না।
[তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান ৩০তম পারা, পৃ. ১০৭৮]
ইবাদত ও কোরবানীর নির্দেশ
আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা কাউসার-এর প্রথম আয়াতে রাসূলুল্লাহর প্রতি অশেষ কল্যাণ, প্রাচুর্য, অতুলনীয় মর্যাদা অনুগ্রহ ও সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদানের ঘোষণার পর বিনিময়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিমিত্তে আল্লাহর ইবাদত এবং আল্লাহরই নামে কোরবানী করার নির্দেশ দেন। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসীরকারক হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত তাফসীরে নুরুল ইরফানে বর্ণিত হয়েছে, অর্থাৎ পাঞ্জেগানা নামায নিয়মিতভাবে সম্পন্ন করুন। অথবা নফল নামায আদায় করুন। অথবা ঈদুল আযহার ওয়াজিব নামায আদায় করুন। নামাযের পর কোরবানী করুন। কোরবানী হিজরতের পর ওয়াজিব হয়েছে। এ কারণেই সুরাটি মাদানী।
দুশমনে রসূলের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ ও সতর্কবাণী
প্রিয় রসূলের পুত্র সন্তান, শিশু বয়সে ইন্তেকাল করার কারণে নবীজির প্রতি বিদ্বেষপ্রসূতঃ নবীজিকে শেকড়হীন আটকুঁড়ে, নিবংশ মন্তব্য করেছিল, তারাই আজ নির্বংশ হয়েছে। ইতিহাসে তাদের স্মরণ নাম নিশানও নেই। এসব দুশমনে রাসূল ইসলামের শত্রুরা যুগে যুগে ধ্বংশ হয়েছে। নবীজির বংশধারা আজো অব্যাহত আছে। কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। নবীজির গুণগান শানমান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের পতাকাকে আল্লাহ্ তা‘আলা সমুন্নত করেছেন। মহান আল্লাহ্ কিয়ামতের ময়দানে আমাদেরকে হাউযে কাউসারের পানি নসীব করুন।
লেখক: অধ্যক্ষ- মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।