রোহিঙ্গা-সংকট সমাধানে আদৌ কি কার্যকর হবে জাতিসংঘ প্রস্তাব

0

আবসার মাহফুজ

জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গাবিষয়ক রেজুলেশন বা প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক। রেজুলেশনটিতে প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং চলতি বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপটের মতো বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা প্রদান এবং জাতীয় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কর্মসূচিতে তাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ যে উদারতা ও মানবিকতা প্রদর্শন করেছে, রেজুলেশনটিতে তার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। তাছাড়া কক্সবাজারের অত্যন্ত জনাকীর্ণ আশ্রয় ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে ভাষানচরে স্থানান্তর এবং এ লক্ষ্যে এখানে অবকাঠামোসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তৈরি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যে প্রচেষ্টা ও বিনিয়োগ করেছে তারও স্বীকৃতি দেওয়া হয় রেজুলেশনটিতে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মধ্যকার সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরকে স্বাগত জানানো হয়েছে। সন্দেহ নেই, এমন উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। তবে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, জাতিসংঘ নানা সময়ে বিভিন্ন জনকাক্সিক্ষত উদ্যোগ নিলেও তা যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় সুফল মিলে না। এবারও রোহিঙ্গাদের নাগরিক-অধিকারে স্বদেশ ফেরার বিষয়ে গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবও যে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
গত ১৭ নভেম্বর ২০২১ বুধবার জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদে তৃতীয় কমিটিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ১০৭টি দেশের অভিন্ন মতে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার বিষয়ে প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। জাতিসংঘে ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক রেজুলেশনটি যৌথভাবে উত্থাপন করে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ১৮ নভেম্বর তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। প্রস্তাবে মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাসহ সব দেশছাড়া জনগোষ্ঠীকে ফেরত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের অত্যাচার যেন না হয়, তার নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা-সমস্যার মূল কারণ খুঁজে বের করা, বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত দ্বি-পাক্ষিক চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো পূরণ করা এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতসহ জাতিসংঘের সকল মানবাধিকার ব্যবস্থাপনাকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করতে এবারের রেজুলেশনে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। চলমান বিচার ও দায়বদ্ধতা নিরূপণ প্রক্রিয়ার ওপর রেজুলেশনটিতে সজাগ দৃষ্টি বজায় রাখার কথাও বলা হয়েছে। রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মিয়ানমার, ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রি-পাক্ষিক সমঝোতা স্মারকটি নবায়ন ও এর কার্যকর বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে রেজুলেশনটিতে। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা বলেছেন, রেজুলেশনটি সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন। এবারের রেজুলেশনটিতে ১০৭টি দেশসহ-পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে যে সংখ্যা ২০১৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং ওআইসি ছাড়াও রেজুলেশনটিতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশ সমর্থন যুগিয়েছে এবং পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার অজুহাতে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছিল দেশটির সেনাবাহিনীর পৈশাচিক অভিযান। সেইসঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল। এর কয়েক মাসের মধ্যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের কথায় উঠে আসে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের ওই লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোন জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সরকারের ওই দাবি নাকচ করে দিয়ে জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলেছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, মাত্রা, ধরন ও বিস্তৃৃতির দিক দিয়ে তা ‘গণহত্যার অভিপ্রায়কে’ অন্য কিছু হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টার সমতুল্য। আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের বিবৃতির পর বিশ^ব্যাপী আওয়াজ উঠে মিয়ানমারকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ব্যাপারে। শুরু হয় মানবিক চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষদের তৎপরতা। তারই ধারাবাহিতায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইড প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) ৫৭ জাতি ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে ১০১৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে মামলাটি করেছে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। মামলায় গাম্বিয়া তাদের ৪৬ পৃষ্ঠার অভিযোগে রাখাইন রাজ্যে জেনোসাইডের উদ্দেশ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ এবং সম্প্রদায়গুলোকে ধ্বংস করার অভিপ্রায়সহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) পূর্ণ তদন্ত শুরু করার জন্য একজন কৌঁসুলির যে আবেদনটির বিবেচনাধীন ছিল তাও অনুমোদন পায়। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন অভিযানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না তা তদন্তের অনুমোদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।
আইসিসির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এটা বিশ্বাস করার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে যে, ব্যাপকভাবে এবং/অথবা সিস্টেমেটিক সহিংস কর্মকা- ঘটানো হয়ে থাকতে পারে, যা মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পেছনে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকতে পারে। চেম্বার তাই বাংলাদেশ/মিয়ানমারের পরিস্থিতি তদন্তের অনুমোদন দিয়েছে। উল্লেখ্য, এর আগে বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা সংকটের দ্বিপক্ষীয় সমাধানের নামে সমস্যাকে দীর্ঘতর করেছে। বাস্তবতা অস্বীকার করে বা পাশ কাটিয়ে এসবের মাধ্যমে কার্যত মিয়ানমারের দায়মুক্তির মেয়াদকেই দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মামলা এবং অপরাধ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অনুমোদনের পর এ বিষয়ে ইতিবাচক পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হয়। যদিও গণহত্যার সংজ্ঞা নিয়ে মিয়ানমার ও তার বন্ধুদেশগুলো অহেতুক বিতর্ক তুলতে পারে, কিন্তু রাখাইনে যে মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা লুকানোর সুযোগ নেই। সে বিষয়ে প্রমাণের জন্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমই যথেষ্ট। বিশ্বের সচেতন ও মানবতাবাদী জনগণের মনেও এ ব্যাপারে কোনো সংশয় নেই। মিয়ানমার আইসিসির সদস্য না হলেও আইসিজের সদস্য। দেশটি জেনোসাইড প্রতিরোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে। কাজেই এই আদালতের সিদ্ধান্ত মানার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব বিবেচনায় আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা এবং আইসিসি’র তৎপরতাসহ নানাকারণে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে দিগন্তে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয়। প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য মিয়ানমারের বিচারের এখতিয়ার হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে বলে সিদ্ধান্ত দেয়ার পরই প্রাথমিক তদন্ত শুরু হয়। প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণ তদন্ত শুরুর জন্য আইসিসির কৌঁসুলি ফাতোও বেনসুদার একটি আবেদন করেন। এতে বিচারকরা সায় দেন। রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নৃশংতার অভিযোগের তদন্তে এটাই হচ্ছে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক আদালতের উদ্যোগ। পরে এর সাথে যোগ হয় ওআইসি’র পক্ষে দি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা। এরপর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের হেগে তিন দিনব্যাপী ওই মামলার শুনানি হয়। এতে মিয়ানমারের পক্ষে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি অংশ নেন। সে সময় তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে রাখাইনে সেনা অভিযানকালে কিছু সেনা আইন লঙ্ঘন করেছে। তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। অন্যদিকে মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখা যায় না বলে জানায় গাম্বিয়া। তারা রোহিঙ্গা গণহত্যা ও সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ করে। অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাইসহ সবকিছুর বিচার-বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা সর্বসম্মতভাবে এক ঐতিহাসিক আদেশ দেন। প্রসঙ্গত, কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চললেও এই প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আদেশ দেন।
রাখাইনে বসবাসরত সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গাকে সুরক্ষায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার যেসব আবেদন গাম্বিয়া করেছে, তার মধ্যে তিনটি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেছে আইসিজে। পাশাপাশি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আরেকটি আদেশও দিয়েছেন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যায় গাম্বিয়ার করা মামলায় জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ঐতিহাসিক রায়ে মানবতার জয় হয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে আদালত সর্বসম্মতভাবে মিয়ানমারের প্রতি চারদফা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী ৪ নির্দেশ হচ্ছে- এক. মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সব ধরনের হত্যা, হত্যাপ্রচেষ্টা নিরসন করতে হবে। সেই সঙ্গে দূর করতে হবে তাদের যে কোনো রকমের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতির আশঙ্কা। নিশ্চিত করতে হবে তাদের অধিকার। দুই. দেশটির সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী বা যে কেউ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর ব্যাপারে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র, উসকানি বা কুকর্মে সহযোগিতার সুযোগ পাবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। তিন. রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের প্রমাণ ধ্বংস করা যাবে না। সব প্রমাণ অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। চার. নির্দেশগুলো যথাযথভাবে যে পালিত হচ্ছে- ৪ মাস পর মিয়ানমার সে বিষয়টি নিশ্চিত করে আইসিজেকে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর থেকে চূড়ান্ত রায় দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রত্যেক ৬ মাস অন্তর অন্তর মিয়ানমারকে এ বিষয়ক প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। সেসব প্রতিবেদন গাম্বিয়াকে দেওয়া হবে। গাম্বিয়া সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের মতামত জানাবে। বিশ্বে আইনের শাসন ও মানবতার মর্যাদা রক্ষায় আইসিজে’র এ রায় নি:সন্দেহে ঐতিহাসিক এবং সারাবিশে^ মানবাধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে এ রায় নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততার কারণে মিয়ানমারকে রায় মানতে বাধ্য করা যায়নি। প্রসঙ্গত, আইসিজের প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে আদালতের আদেশ ঘোষণাকালে বলেছেন, ‘আদালত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে চরমবিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।’ অন্য ১৪জন স্থায়ী বিচারপতি ও দু’জন অ্যাডহক বিচারপতির প্যানেল বলেছে, ‘১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জাতিসংঘ গণহত্যা কনভেনশনে বর্ণিত সব অপরাধ রোধে মিয়ানমারকে তার ক্ষমতার মধ্যে থাকা সবকিছু করতে হবে।’ ওই কনভেনশনে কোনো জনগোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের আংশিক ও পুরোপুরি নিঃশেষ করাকে গণহত্যা বোঝানো হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার অভিযোগ ছিল, দুই বছর আগে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে সেনাবাহিনীর অভিযানে যে বর্বরতা চালানো হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের আন্তর্জাতিক গণহত্যা কনভেনশন ভঙ্গ করেছে মিয়ানমার।
এখন সর্বশেষ জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদে তৃতীয় কমিটিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আবারো সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হলো। বলা যায় একটি শক্তিশালী ম্যান্ডেট নিয়ে এবারের রেজুলেশন গৃহীত হলো জাতিসংঘে। এটি নতুন আশার সঞ্চার করেছে। রেজুলেশনটি নিজভূমি মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রেরণা যোগাবে, যা দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার টেকসই সমাধানে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত ফল নির্ভর করছে বিশ^সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও ন্যায়ের পথে তৎপরতার ওপর। অতীতের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পরাশক্তিগুলোর স্বার্থগত বিভাজনের কারণে জাতিসংঘের এসব প্রস্তাব বিশ্বে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। ইসরায়েল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়াখ্যাত ইসরায়েলের জন্মলগ্ন থেকেই সাধারণ পরিষদে (১৯৪৭-২০১৮) দেশটির বিরুদ্ধে ১৯৭টি প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল সেসবের তোয়াক্কা করেনি। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির পক্ষে কাজ করেছে। একইভাবে নিরাপত্তা পরিষদের ১৮৭টি প্রস্তাবও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল ডাস্টবিনে ফেলে রেখেছে। শুধু তা নয়, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষেদে ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বর সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ২৩৩৪ নম্বর প্রস্তার, যা ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের পর পূর্বজেরুজালেমসহ অধিকৃত অঞ্চলে কোনো বসতি ও জমি অধিগ্রহণ না করার কথা বলা হয়েছে, তাও মানেনি ইসরায়েল। অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রেও এরকম অনেক উদাহরণ আছে। সেসব বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় সম্প্রতি গৃহীত জাতিসংঘ প্রস্তাব কেমন ফল দেবে তা অনুমেয়। তবে, এ অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী শান্তির লক্ষে চীন-ভারত-রাশিয়া এবং সমগ্র মুসলিমবিশ^ সোচ্চারকণ্ঠ হলে কিছুটা হলেও ফল আসবে। প্রসঙ্গত, চীন, ভারত, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ স্বার্থগতকারণে বস্তুনিষ্ঠ ভূমিকা পালন না করায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তবে চীন-ভারত-রাশিয়া এবং আসিয়ান, আসেম, এমনকি মিয়ানমারকেও বুঝতে হবে, আনান কমিশনের সুপারিশের আলোকে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে অস্তিত্ব সংকটে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলের জন্যই এক ভয়ানক হুমকি হয়ে উঠতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞই রোহিঙ্গা সংকটকে আগুন নিয়ে খেলার শামিল বলে মনে করছেন। সব বিবেচনায় রোহিঙ্গা সংকট এখন এক বড় ‘টাইম বোমা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দ্রুত রোহিঙ্গা সংকট নিরসন না হলে তা শুধু বাংলাদেশের নয়; ভারত, চীন, রাশিয়া এবং মিয়ানমারসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের জন্যেও চরম মাথাব্যাথার কারণ হবে। এ অবস্থায় সংকট সমাধানে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে রোহিঙ্গাদের সমনাগরিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোর দ্রুত সুনিষ্পত্তি করা। একইসঙ্গে কোনো ধরনের কালক্ষেপণ ছাড়াই সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা। আমাদের বিশ^াস, জাতিসংঘসহ পুরোবিশ্ব মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই পুনর্বাসনে সোচ্চারকণ্ঠ হবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা জাতিসংঘ ও বিশ^নেতাদের কার্যকর ভূমিকা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •