পার্থিব জীবনের সমৃদ্ধিতে পরকাল থেকে উদাসীন হওয়া চরম দুর্ভাগ্য

0

হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ ۖ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا ۖ وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٌ ۚ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ ৫৭:২১ سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرُسُلِهِ ۚ ذٰلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ ۚ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ ৫৭:২২ مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا ۚ إِنَّ ذٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ

আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমাঃ (মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন-) তোমরা জেনে রেখো,পার্থিব জীবন তো নয়, কিন্তু ক্রীড়া-কৌতুক, সাজসজ্জা, তোমাদের পরষ্পরের মধ্যে অহমিকা প্রদর্শন করা এবং সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে একে অপরের চেয়ে অধিক চাওয়া মাত্র তা ওই বৃষ্টির ন্যায়, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, অত:পর তা শুকিয়ে যায়। ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, এরপর তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর আখেরাতে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমা ও তাঁর সন্তুষ্টি। এবং পার্থিব জীবন তো নয়, কিন্তু প্রতারনার উপকরণ। তোমরা অগ্রবর্তী হও তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং ওই জান্নাতের দিকে যার প্রশস্থতা হচ্ছে আকাশ ও পৃথিবীর (সম্মিলিত) বিস্তৃতি। (এটা) প্রস্তুত করা হয়েছে তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও তাঁর সমগ্র রাসূলের উপর ঈমান আনয়ন করেছে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে চান দান করেন। এবং আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। পৌছেনা কোন মুসিবৎ পৃথিবীতে এবং না তোমাদের উপর ব্যক্তিগতভাবে। কিন্তু তা একটা কিতাবের মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে, এরই পূর্বে যে, সেটাকে আমি সৃষ্টি করি। নিশ্চয় এটা আল্লাহর জন্য সহজ। (২০-২২ নং আয়াত, সূরা আল হাদীদ)

আনুষঙ্গিক আলোচনা
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
উদ্ধৃত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-মানবকুলের পরকালের নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হওয়া আর আযাবে বন্দী হওয়ার বড় কারণ হচ্ছে পার্থিব ক্ষনস্থায়ী সুখ ও তাতে নিমগ্ন হয়ে পরকাল থেকে উদাসীন হয়ে যাওয়া। এ জন্য মহান আল্লাহ আলোচ্য ২০নম্বর আয়াতে পার্থিব জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু হয় এবং যাতে দুনিয়াদার ব্যক্তি মগ্ন ও আনন্দিত থাকে, প্রথমে সেগুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে গেলে পার্থিব জীবনের মোটামুটি বিষয়গুলো যথাক্রমে এই: প্রথমে ক্রীড়া এরপর কৌতুক এরপর সাজসজ্জা, এরপর পারষ্পরিক অহমিকা, এরপর ধন ও জনের প্রাচুর্য নিয়ে পারষ্পরিক গর্ববোধ। এ ধারাবাহিকতায় প্রতিটি স্তরেই মানুষ নিজ অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে এবং একেই সর্বোত্তম জ্ঞান করে। কিন্তু যখন এক স্তর ডিঙ্গিয়ে অন্য স্তরে গমন করে তখন বিগত স্তরের দুর্বলতা ও অসারতা তার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। যেমন, বালক-বালিকারা খেলা-ধুলাকে জীবনের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ ও সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় ধন মনে করে। কেউ তাদের খেলার সামগ্রী ছিনিয়ে নিলে তারা এত ব্যথা পায়, যেমন বয়স্কদের ধন-সম্পদ, বাড়িঘর ছিনিয়ে নিলে তারা ব্যাথা পায়। কিন্তু এই স্তর অতিক্রম করে সামনে অগ্রসর হলে পর তারা বুঝতে পারে যে, যেসব বস্তুকে তারা জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাব্যস্ত করে নিয়েছিল, সেগুলো ছিল অসাড় ও অর্থহীন। যৌবনে সাজ-সজ্জা ও পারষ্পরিক অহমিকাই থাকে জীবনের লক্ষ্য। বাধ্যর্ক্যে ধনে ও জনে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগীতা শুরু হয়। কিন্তু যৌবনে যেমন শৈশবের কার্যকলাপ অসাড় মনে হয়েছিল, বাধ্যর্ক্যে পৌছেও তেমনি যৌবনের কার্যকলাপকে অনর্থক মনে হতে থাকে। বার্ধ্যক্য হচ্ছে জীবনের সর্বশেষ মনজিল। এ মনজিল ধন ও জনের প্রাচুর্য এবং ঝাঁক-জমক ও পদের জন্য গর্ব, জীবনের মহান লক্ষ্য হয়ে যায়। আল্লাহর কুরআন বলে-এ অবস্থাও সাময়িক ও ক্ষণস্থায়ী। এর পরবর্তী দুটি স্তর বরযখ ও কেয়ামতের চিন্তা করা। এগুলোই আসল ও চিরস্থায়ী।
এসব বিষয় দেখা ও অনুধাবন করার পর একজন বুদ্ধিমান ও চাক্ষুষ্মান ব্যক্তি এ সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পারে যে, দুনিয়া একটি প্রতারণার স্থান। এখানকার সম্পদ প্রকৃত সম্পদ নয় যা বিপদসমূহে কাজে আসতে পারে। অতঃপর পরকালের আযাব ও সওয়াব এবং দুনিয়ার ক্ষণভঙ্গুরতায় অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এরূপ হওয়া উচিৎ যে, মানুষ দুনিয়ার সুখ ও আনন্দে মগ্ন না হয়ে পরকালের চিন্তা বেশি করবে। কেননা-الدنيا مزرعة الاخرة অর্থাৎ দুনিয়া আখেরাতের ক্ষেতস্বরুপ।

سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ
উপরোক্ত আয়াতাংশে বর্ণিত “অগ্রে ধাবিত” হওয়ার এক অর্থ এই যে, জীবন, স্বাস্থ্য ও শক্তি-সামর্থ্যরে কোন ভরসা নেই। অতএব সৎকর্মে শৈথিল্য ও টালবাহানা করোনা। এরূপ কারণে কোন রোগ অথবা ওজর তোমার সৎ-কর্মে বাধা সৃষ্টি করতে পারে কিংবা তোমার মৃত্যু ও হয়ে যেতে পারে। অতএব এর সারমর্ম এই যে, অক্ষমতা ও মৃত্যু আসার আগেই তুমি সৎকর্মের পুজি সংগ্রহ করে নাও। যাতে জান্নাতে পৌছাতে পার।
অগ্রে ধাবিত হওয়ার দ্বিতীয় অর্থ এই যে, সৎকর্ম সম্পাদনে অপরের অগ্রণী হওয়ার চেষ্টা করা যেমন, মাওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তার উপদেশাবলীতে বলেছেন-তুমি মসজিদে সর্বপ্রথম গমনকারী এবং সর্বশেষ নির্গমনকারী হও। সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন জেহাদে সর্বপ্রথম সারীতে থাকার জন্য অগ্রসর হও। সাইয়্যেদুনা হযরত আনাস বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেছেন-নামাজের জামাতে প্রথম তাকবিরে উপস্থিত থাকার জন্য চেষ্টা করো॥
(তাফসিরে রুহুল মায়ানী শরিফ)
জান্নাতের পরিধি প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে যে, এর প্রস্থ পৃথিবী ও আকাশের সমান। সূরা আলে ইমরানে এ এই বিষয়বস্তুর আয়াতে سمواتবহুবচন ব্যবহৃত হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, সপ্ত আকাশ ও সপ্ত পৃথিবীর বিস্তৃতি একত্রিত করলে জান্নাতের প্রস্থ হবে। বলাবাহুল্য যে, প্রত্যেক বস্তুর দৈর্ঘ্য প্রস্থ অপেক্ষা বেশি হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, জান্নাতের বিস্তৃতি সপ্ত আকাশ ও পৃথিবীর চাইতে বেশি। عرضশব্দটি কোন সময় কেবল বিস্তৃতি অর্থে ব্যবহৃত হয়। তখন দৈর্ঘ্যের বিপরীত অর্থ বুঝানো উদ্দেশ্য থাকেনা। উভয় অবস্থাতেই জান্নাতের বিশাল বিশাল বিস্তৃতিই বুঝা যায়।

ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
আলোচ্য আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় তাফসীরবেত্তাগণ উল্লেখ করেছেন-পূর্বের আয়াতে জান্নাত ও তার নেয়ামত সমূহের দিকে ধাবিত হওয়ার আদেশ বিদ্যমান ছিল। এতে কেউ কেউ ধারণা করতে পারে যে, জান্নাত ও তার অক্ষয় নেয়ামতরাজি মানুষের কর্মের ফল এবং মানুষের কর্মই এর জন্য যথেষ্ট। আলোচ্য আয়াতে এহেন ধারণা দূরীকরনের লক্ষ্যে এর শপথ করেছেন যে, তোমাদের ক্রিয়াকর্ম জান্নাত লাভের জন্য যথেষ্ট কারণ নয় যে, ক্রিয়াকর্মের ফলেই জান্নাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে। মূলতঃ মানুষ দুনিয়াতে যেসব নেয়ামত লাভ করেছে, তার সারাজীবনের সৎকর্ম এগুলোর বিনিময়ও হতে পারেনা। জান্নাতের অক্ষয় ও চিরস্থায়ী নেয়ামতরাজীর মূল্য হওয়া তো দূরের কথা। অতএব মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও কৃপার বদৌলতেই মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে। সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে রাসূলে করিম রাউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-তোমাদের আমল তোমাদের কাউকে নাজাত দিতে পারেনা। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন-আপনিও কি অনুরূপ? তিনি বললেন-হ্যাঁ। আমিও আমার আমল দ্বারা জান্নাত লাভ করতে পারিনা।(তাফসিরে মাযহারি শরিফ) আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পা হলেই লাভ করতে পারি। সুবহানাল্লাহ।
মূলতঃ মুমিন নর-নারী পার্থিব জীবনে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করতঃ ইবাদত ,রিয়াজত করাই আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন স্বরূপ। আর আখেরাতে চিরস্থায়ী জীবনের সাফল্য ও নাজাত লাভে ভরসা করবে আল্লাহ ও রাসূলের অপার কৃপা-করুণার উপর।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকলকে উপরোক্ত দরছে কুরআনের উপর আমল করার সৌভাগ্য নসীব করুন। আমীন।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •