সূরা তীন’র ফযীলত ও যায়তুন তৈলের বৈশিষ্ট্য

0

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

عَنْ عُمَرٍبْنُ الْخَطَّابِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلّمَ كُلُوا الزّيْتَ وَادَّهِنُوا بِهِ فَانّه مِنْ شجرةِ مُّبَارَكة-(رواه الترمذى)
অনুবাদ: হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,তোমরা যায়তুনের ফল খাও এবং এর তৈল ব্যবহার করো কারণ এটা একটা বরকতময় বৃক্ষ। [মিশকাত, দারেমী, তিরমিযী, শামায়েলে তিরমিযী: পৃষ্ঠা-১২১]

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফে যায়তুন তৈল সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে। এছাড়া অসংখ্য হাদীস শরীফে তীন ও যায়তুন সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। নভেমন্ডল ও ভূমন্ডলের এসব সৃষ্টি মহান স্রষ্টার একত্ববাদের এক অভ্রান্ত দলীল। স্বয়ং রাব্বুল আলামীন তীন ও যায়তুন এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে পবিত্র ক্বোরআনে সূরা তীন নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল করেছেন। এরশাদ হয়েছে-
وَالتِّينِ وَالزَّيْتُونِ۝ وَطُورِ سِينِينَ۝ وَهٰذَا الْبَلَدِ الأَمِينِ ۝ لَقَدْ خَلَقْنَا الإِنسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ۝ ثُمَّ رَدَدْنَاهُ أَسْفَلَ سَافِلِينَ۝ إِلاَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ۝ فَمَا يُكَذِّبُكَ بَعْدُ بِالدِّينِ۝ أَلَيْسَ اللَّهُ بِأَحْكَمِ الْحَاكِمِينَ۝
অনুবাদ: ১. ডুমুরের শপথ ও যায়তুনের, ২. এবং সিনাই পর্বতের, ৩. এবং ঐ নিরাপদ শহরের, ৪. নিশ্চয় আমি মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি, ৫. তারপর তাকে নিম্ন থেকে নিম্নতর অবস্থার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি, ৬. কিন্তু যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য অফুরন্ত প্রতিদান রয়েছে, ৭. অতঃপর কোন্ জিনিস তোমাকে শেষ বিচারের দিনটি অস্বীকার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে, ৮. আল্লাহ্ কি সব বিচারকের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন? [সূরা তীন, কান্যুল ঈমান: আয়াত-১-৮] মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনের ৯৫তম সূরা তীন মক্কী সূরা হিসেবে প্রসিদ্ধ। এ সূরার রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা আট, শব্দ চৌত্রিশটি, বর্ণ একশ পাঁচটি।

সূরার আলোচ্য বিষয়
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবূ যর গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের নিকট কিছু তীন বা তানজীবের একটি গুচ্ছ প্রেরণ করেছিলেন। নবীজি তা থেকে সামান্য আহার করলেন সাহাবাদের বললেন, তোমরাও এখান থেকে কিছু খাও। কেননা জান্নাত থেকে কোন ফল যদি অবতরণ হয়ে থাকে এটাই হচ্ছে সেই ফল। [তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা-৩০, পৃষ্ঠা-৯৩০]

তীন’র মর্মার্থ
তীন দ্বারা কি উদ্দেশ্য এ প্রসঙ্গে তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাফসীরে ইবনে কছীরে আল্লামা ইসমাঈল ইবনে কাছীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি উল্লেখ করেন, তীন, যায়তুন, তুরে সীনীন ও বালাদে আমীন হচ্ছে তিনটি জায়গার নাম। যেখানে আল্লাহ্ তা’আলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবী প্রেরণ করেছেন।
তীন ও যায়তুন দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্দেশ্য। যেখানে আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামকে প্রেরণ করেছেন, তুরে সীনীন দ্বারা সিনাই পর্বত উদ্দেশ্য যে পর্বতে আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম’র সাথে কথোপকথন করেছেন। ‘‘বালাদে আমীন’’ দ্বারা পবিত্র মক্কা নগরী উদ্দেশ্য। যেখানে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী ইমামুল আম্বিয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন।
ইমাম কুরতবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘‘তীন’’ দ্বারা আসহাবে কাহফের মসজিদ উদ্দেশ্য। হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র বর্ণনা মতে তীন দ্বারা জুদী পাহাড়ে অবস্থিত মসজিদে নূহ উদ্দেশ্য।
[তাফসীরে ইবনে কাছীর]

যায়তুনের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
যায়তুন একটা বৃক্ষের নাম। ঐ বৃক্ষের ফলকেও যায়তুন বলা হয়। সিরিয়া, দামেস্ক এবং এর আশে পাশের এলাকায় এ বৃক্ষ প্রচুর জন্মে। শীত প্রধান দেশেও এ গাছ পাওয়া যায়।

যায়তুন তৈলে বহুবিধ উপকার পাওয়া যায়
হযরত আবু নাঈম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, যায়তুন তৈলে সত্তর প্রকার রোগের উপশম হয়। এ গাছ শুষ্ক পর্বত সমূহে কোন প্রকার সেবাযতœ ছাড়াই উৎপন্ন হয়। যায়তুন ফল ও তৈল দুটিই বিশেষ উপকারী এবং ফলদায়ক। হৃদপিন্ড, মস্তিস্ক এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ দু’টিই। আরব দেশে যায়তুনের তৈল ঘি’র পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়। সূরা নূর-এ যায়তুনের বৃক্ষকে ‘‘শাজারাতিম মুবারাকা’’ বা বরকতময় বৃক্ষ বলা হয়েছে। [সূরা নূর: আয়াত-২৫] সূরা তীন ছাড়াও সূরা আবাসা, সূরা নাহ্ল এবং সূরা আনআমে যায়তুনের আলোচনা এসেছে। যায়তুনের বৃক্ষ হাজার বৎসর বাঁচে। মধ্যপ্রাচ্যে এটি শান্তি, সমৃদ্ধি, সৌন্দর্য ও শক্তির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। এটি নানা প্রকার ঔষধ তৈরীতে বিভিন্ন প্রকার প্রসাধন সামগ্রী কসমেটিক প্রস্তুতে সাবান তৈরীর কাজে ব্যবহার হয়। মানব সভ্যতার উন্নয়নে এ প্রাচীন বৃক্ষের ভূমিকা অপরিসীম। যায়তুনের বৃক্ষ চল্লিশ বৎসর বয়সে ফলবান হয়। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র বর্ণনা মতে এ গাছের প্রতিটি জিনিসই উপকারী ও ফলপ্রসু। এর তৈল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানো যায়, রান্নার কাজে ব্যবহার করা যায়, খাওয়া যায়, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করণের কাজে লাগে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং যায়তুন তৈল ব্যবহার করতেন।

নিরাপদ শহর
পবিত্র মক্কা নগরীকে নিরাপদ শহর বলা হয়েছে, এখানে শুধু মানুষ নয় বরং শিকারের পশু-বৃক্ষরাজি, গাছ-পালা পর্যন্ত নিরাপদ। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন ‘‘আল আমীন’’ আমানতদার তথা বিশ্বস্ত এদিকে ইঙ্গিত করে নবীজির কারণে মক্কা নগরী শপথের উপযোগী হয়েছে। এ মক্কা শহরে হুযূরের সাথে মহান আল্লাহ্র কথোপকথন হয়েছে। হুযূরের ওহী লাভ, পবিত্র ক্বোরআন অবতরণের সূচনা, মিরাজ তথা উর্দ্ধজগতে পরিভ্রমণ দিদারে এলাহী অর্জন মক্কা মুয়াজ্জামায় হয়েছে। [তাফসীরে নুরুল ইরফান]

মানব জাতি সুন্দরতম সৃষ্টি
আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম আকৃতিতে। [সূরা তীন: ৪] মানব সৃষ্টিতে দৈহিক গঠন, আকৃতি, ওজন, মস্তিস্ক, বাকশক্তি, বুদ্ধি বিবেচনা সকল কিছুতেই ভারসাম্যপূর্ণ সুব্যবস্থা বিদ্যমান। মানব জাতির গঠন প্রকৃতি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-
الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ ۝ في أَيِّ صُورَةٍ مَّا شَاء رَكَّبَكَ۝
অর্থ: তিনি আল্লাহ্, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন, সুঠাম এবং সুসামঞ্জস্য করেছেন, তাঁর ইচ্ছামত তোমার আকৃতি তৈরী করেছেন। [সূরা: ইন্ফিতার, আয়াত-৭-৮] মানব দেহের আকৃতি ও গঠনশৈলী সুনির্দিষ্ট পরিমাপের উপর প্রতিষ্ঠিত। মানুষের দৈর্ঘ্য সাধারণত- ১ থেকে ২ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বর্তমান দৈর্ঘ্যের চেয়ে যদি ২-৩ গুণ বেশী হতো তখন অবস্থা কি দাঁড়াত? এ অবয়ব ও পরিমাপ নির্ধারণ মহা প্রজ্ঞাময় প্রভূর প্রজ্ঞার সুস্পষ্ট উৎকৃষ্ট প্রমাণ। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবূ মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে এক মুষ্টি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। যা তিনি পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে গ্রহণ করেছিলেন। এ কারণেই মানবাকৃতির রূপ ও রঙের বৈচিত্র ও ভিন্নতা। কেউ শেতাঙ্গ কেউ কৃঞ্চাঙ্গ কেউ ভিন্ন ভিন্ন রঙের। [তাফসীরে ইবনে কাসীর: খন্ড- ১৫]

মানব আল্লাহর কুদরতের অনুপম সৃষ্টি
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানব জাতির গঠন আকৃতি ও তার চেহারা এতোই সুন্দর মনোরম যে, জ্বিন ও ফিরিস্তা পর্যন্ত তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ প্রসঙ্গে তাফসীরে নুরুল ইরফানে বর্ণনা করেন, মহান আল্লাহ্ মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে এমনভাবে সৌন্দর্য ও সুবিন্যস্তরূপে সৃষ্টি করেছেন, যেমনটি শোভা পায়। নাক হাতীর মতো লম্বা দেননি, পাখির ন্যায় অদৃশ্য রাখেননি, শরীরের গঠনও এমনভাবে করেছেন, যাতে কিয়াম (দাঁড়ানো), রুকু, সিজদা, ক্বাদাহ্ বৈঠক তথা সমস্ত ইবাদতই সম্পন্ন হতে পারে।

অকৃতজ্ঞ বান্দারা জাহান্নামে যাবে
আয়াতে বর্ণিত হয়েছে মানুষকে এতো সুন্দর ও সুঠামভাবে সৃষ্টি করা সত্ত্বেও বান্দা যদি আল্লাহর নিয়ামতের মূল্যায়ন না করে অকৃতজ্ঞ হয় ঈমান গ্রহণ না করে- কুফর-শির্কে লিপ্ত থাকে নানাবিধ অপকর্মে নিয়োজিত থাকে তখন তাকে নিম্ন থেকে নিম্নস্তরে পর্যবসিত করা হবে। অর্থাৎ মানুষ হয়েও জানোয়ার থেকে নিকৃষ্ট হবে। জাহান্নাম হবে তার ঠিকানা। ঈমানের দাবী অনুসারে যারা সৎ কর্ম সম্পাদন করবে আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করবে শরয়ী বিধি বিধান মেনে চলবে তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত প্রতিদান অর্থাৎ তারা চিরস্থায়ী সুখময় জান্নাতে প্রবেশ করবে।

বিচার দিবসকে অস্বীকার করা কুফরী
মহান সত্তা যিনি অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন মানব জাতিকে পুনরুজ্জীবন দান করা তার পক্ষে মোটেই অসম্ভব নয়। অতএব হে কাফিররা! কিয়ামত সংগঠিত হওয়া ও সকলের হিসাব-নিকাশ হওয়া কিভাবে তোমরা অস্বীকার করবে?
সূরার সমাপ্তিতে মহান আল্লাহ্র শ্রেষ্ঠতম বিচারক হওয়ার পরিচয় বিঘোষিত হয়েছে। সেদিন তাঁর মহান আদালতে প্রত্যেক নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করবে কারো প্রতি বিন্দুমাত্র অবিচার হবে না।

সূরা তীন’র শেষ আয়াতের গুরুত্ব
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন কেউ যখন সূরা তীন’র শেষ আয়াত ‘‘আলাইসাল্লাহু বেআহকামিল হাকেমীন’’ পড়বে সে যেন বলে ‘‘বালা ওয়াইন্না আলা যালিকা মিনাশ শাহেদীন।’’ হ্যাঁ আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ্র চাইতে কোনো বড় বিচারক নেই। মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে এ বরকতময় সূরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝার তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন।

লেখক: অধ্যক্ষ- মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •