তাহিয়্যা কুলসুম
আরবি বর্ষের প্রতিটি মাসই স্মরণীয়, উদযাপনীয়। কখনো তা চন্দ্রমাসের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে কখনো বা কোন মহামানবের জন্ম বা ওফাতের কারণে। তদ্রুপ হিজরী সনের ষষ্ঠ মাস ‘জুমাদাল উখরা’, দার্শনিক ইমাম গাযালী, জালাল উদ্দীন রুমী, হযরত খাজা বাক্বী বিল্লাহ্, সুফী হযরত আবু আহমদ আবদাল চিশতীসহ অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী বুযুর্গ ব্যক্তির ওফাতের কারণে স্মরণীয়। তবে ইসলামের ইতিহাসে এ মাসটি বিশেষভাবে আলোচিত যে কারণে তা হল মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুযোগ্য উত্তরসূরী নবীগণের পর সমগ্র সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠ, সাহাবীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় সাইয়্যিদুনা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ওফাত।
আরবের বিখ্যাত কোরাইশ বংশের তাঈম গোত্রে ৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবদুল্লাহ্। পিতার নাম ওসমান, উপনাম আবু কোহাফা এবং মায়ের নাম সালমা উরফে উম্মুল খায়র। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তাঁর নাম ছিল আবদুল কা’বা। এ নামকরণের তাৎপর্যে বর্ণিত ঘটনা অনুযায়ী তাঁর মা সালমা বিনতে সখর’র ঘরের কোন সন্তান জীবিত থাকত না। তাই হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু গর্ভে থাকাকালীন তিনি মান্নত করেছিলেন যদি এ সন্তানাটি জীবিত থাকে তাহলে তাকে কা’বা ঘরের খিদমতের জন্য সমর্পণ করে দিবেন। পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাম ‘আবদুল্লাহ্’ রাখেন। তবে তিনি ‘আবু বকর’ নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর উপাধি সিদ্দিকে আকবর, আতীক্ব।
সিদ্দিকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সম্পর্কে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা অনেকগুলো আয়াত নাযিল করেছেন। তাঁর সাহাবী হওয়া পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা সাব্যস্ত। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘‘এবং তিনি, যিনি সত্য সহকারে শুভাগমন করেছেন এবং সেই সব লোক যাঁরা তাঁকে সত্য বলে মেনে নিয়েছেন, তাঁরাই তো মুত্তাকী।’
এ আয়াতের তাফসীরে রয়েছে, আল্লাহর রসূলের সব কিছু সত্য বলে গ্রহণকারী বলতে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বুঝানো হয়েছে। রাসূলের ন্যিত সহচর হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নিঃসন্দেহে সর্বাগ্রে সত্য গ্রহণকারী। এ আয়াত থেকে বিশ্ববরেণ্য মুফাস্সির মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি দু’টি মাসআলা বর্ণনা করেছেন।
১. সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সাহাবীত্ব অকাট্যভাবে প্রমাণিত। তাঁকে সাহাবী মেনে নেওয়া ঈমানী বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এ বিষয়টি অবিশ্বাস করা ‘কুফরি।’
২. সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মর্যাদা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর সর্বাপেক্ষা উর্দ্ধে, কারণ আল্লাহ্ তা‘আলাই তাঁকে ‘দ্বিতীয়’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাইতো প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে ইমামতির স্থান দিয়েছেন।
হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে একবার ব্যবসায়িক কাজে সিরিয়া গেলেন। বস্তুত তিনি একজন কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। সিরিয়ায় তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, আকাশের সূর্য ও চন্দ্র তাঁর কোলে নেমে আসল। তিনি চাদর দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ভোরে তিনি এক পাদ্রীর নিকট এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে গেলেন। স্বপ্নের বর্ণনা শুনে পাদ্রী সিদ্দীকে আকবরের নিকট নাম, গোত্র, কোথাকার অধিবাসী, কী কাজ করেন সব বিস্তারিত জেনে নিলেন। সব শুনে পাদ্রী বললেন, ‘আপনি সৌভাগ্যবান, মক্কানগরে আপনারই গোত্রে শেষ নবীর আবির্ভাব হবে। যিনি পয়দা না হলে সমগ্র সৃষ্টিজগতের কিছুই সৃষ্টি হতো না। তিনি রাসূলগণের সর্দার। মক্কার লোকেরা তাঁকে ‘আল-আমীন’ বলে ডাকবে। আপনি তাঁর সত্য ধর্মে প্রথম দীক্ষিত হয়ে তাঁর প্রধান খলীফা হবেন। আমি যবূর, তাওরাত ও ইনজীলে তাঁর প্রশংসা পেয়েছি।’ স্বপ্নের এ ব্যাখ্যা শুনে তাঁর মনে আমূল পরিবর্তন আসে। কাল বিলম্ব না করে তিনি মক্কায় ফিরে আসেন। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি নবীজির সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তাঁর খেদমতে হাজির হলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে শুধু বললেন, ‘‘আমার প্রতি ঈমান এনে আমার ধর্মে দীক্ষিত হতে আর দেরি কিসের?’ আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বললেন, আমি কি কোন মু’জিযা প্রত্যাশা করতে পারি? নবীজী বললেন, ‘সিরিয়ায় দেখা স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা কি আমার মু’জিযা নয়?’ সাথে সাথে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কালেমা পড়ে প্রথম মুসলমান, প্রথম সাহাবী ও প্রথম খলীফা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
তিনি ঈমান গ্রহণে প্রথম, মুসলমান হওয়াতে প্রথম, সাহাবী হিসেবে প্রথম, প্রথম খলীফা হিসেবে প্রথম, নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাঁর নামাযের ইমাম হিসেবেও তিনি প্রথম, হিজরতের সময়ে প্রিয়নবীর সঙ্গী নির্বাচনেও তিনি প্রথম এবং তিনিই একমাত্র বিশ্বস্ত প্রিয়তম সহচর। দান-সদকার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রগামী। তাবুক যুদ্ধের সময় জেহাদের জন্য সর্বস্ব দান তাঁর দানশীলতার প্রমাণ বহন করে। এমনকি হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুও যে কোন সৎকাজে তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অনতিক্রম্য বলে স্বীকার করেছেন। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘‘এবং সবার মধ্যে অগ্রবর্তী প্রথম মুহাজির ও আনসারগণ এবং যাঁরা সৎকর্মের সাথে তাঁদের অনুসারী হয়েছেন, আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।’’
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে সব প্রশংসনীয় গুণাবলীতে উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও অগ্রণী হওয়ার বিরল ভাগ্যে ভূষিত করেন। প্রিয়নবীর অনন্তকালের সাথী, নবীপরবর্তী সর্বোত্তম ব্যক্তি হযরত সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর জীবনের সকল অধ্যায় ক্ষুদ্র পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাঁর জীবনের সকল ক্ষেত্র বর্ণনা করা পুস্তক রচনার শামিল। তাই এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাঁর খেলাফতের দিকটি বর্ণনা করার সৌভাগ্য অর্জন করছি।
‘খেলাফত’ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ প্রতিনিধিত্ব করা, স্থলাভিষিক্ত হওয়া। ‘খেলাফত’ শব্দ থেকেই ‘খলীফা’ শব্দের উৎপত্তি। যাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থলাভিষিক্ত হয়ে তাঁর দেয়া বিধি-বিধিান তথা কুরআন-হাদীসের আলোকে দ্বীন- ইসলামের হেফাজত ও প্রচার-প্রসার এবং ইসলামী রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যাদি পরিচালনা করেন, তাঁরাই খলীফা নামে পরিচিত। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণ অনুকরণের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাঁর যোগ্যতম খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন চারজন, যাঁদেরকে ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’ বলা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে দ্বীন’র রূপরেখা প্রদর্শন করেছেন, তা যথাযথ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে বাস্তব জীবনে তাঁর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন খোলাফায়ে রাশেদীন। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাঁদেরকে আল্লাহ্ ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাঁদেরকে তিনি অবশ্যই এ পৃথিবীতে নিজ খেলাফত প্রদান করবেন। যেভাবে তিনি তাঁদের পূর্ববর্তীদেরকেও শাসনদন্ড প্রদান করেছেন। আর তিনি অবশ্যই তাঁর দ্বীনকে সুদৃঢ় করবেন, যা তিনিই তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাঁদের ভয়ভীতির পরে তা শান্তিতে রূপায়ন করবেন। তাঁরা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না।’’ উক্ত আয়াতে খোলাফায়ে রাশেদীনের খেলাফতের সত্যতা, বিশুদ্ধতা ও আল্লাহর মকবুল হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। আর খোলাফায়ে রাশেদীনের সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ খলিফা হিসেবে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন সাইয়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। তাঁর খিলাফত ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং একান্ত প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণে তিনি খলিফাতুর রসূল বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যোগ্যতম উত্তরসূরি হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন।
পৃথিবী থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর্দা করার পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রের নতুন খলিফা নির্বাচন। দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনার পর আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সর্বাধিক প্রিয় এবং মুসলিম সমাজে সর্বাধিক আস্থাভাজন, যোগ্যতাসম্পন্ন ও সর্বোত্তম ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুই হলেন খলিফাতুর রসূল এবং ইসলামী রাষ্ট্রের খলীফা। খলীফা নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাধানের পর আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সর্বপ্রথম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাফনের প্রতি মনোনিবেশ করেন। তাঁর খেলাফতকালে যে দ্বন্দ্ব সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তা তিনি দমন করেন। পারস্য, সিরিয়া ও মিশরের বিপক্ষে অভিযান পরিচালনা করেন। বসরা ও দামেশক তাঁর শাসনামলে বিজিত হয়। অন্যান্য দেশেরও কতক অংশ তাঁর শাসনাধীনে আসে। তিনি খেলাফতের দায়িত্ব নিলে বিভিন্ন অন্তর্দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ইসলামের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে। একদিকে ভন্ড নবীর উত্থান, অন্যদিকে স্বধর্মত্যাগীদের দৌরাত্ম্য আর যাকাত আদায়ে অস্বীকৃতিকারীর শোরগোল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে তোলে। এভাবে গজিয়ে ওঠা প্রত্যেক ফিৎনার তিনি মূলোৎপাটন করেন। বিশ্ববাসী তাঁর অটল-মানসিকতা দেখে বিমোহিত হয়। পবিত্র কুরআন মজীদেও এমন অনেক আয়াত আছে যেখানে সিদ্দীকে আকবরের খেলাফতের প্রশংসার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ্ তা‘আলার ইরশাদ, ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের মধ্যে যে কেউ স্বীয় দ্বীন থেকে ফিরে যাবে তখন অনতিবিলম্বে আল্লাহ্ এমন সব লোককে নিয়ে আসবেন, যাঁরা আল্লাহর প্রিয় পাত্র এবং আল্লাহ্ও তাঁদের নিকট প্রিয়। তাঁরা মুসলমানদের প্রতি কোমল এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর। তাঁরা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে চান তিনি দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ।’’ তাঁর শাসন ব্যবস্থার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হল মজলিসে শূরা গঠন, ইসলামী রাষ্ট্রকে দশটি প্রদেশে বিভক্তকরণ, পুলিশ বিভাগ গঠন, বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা, প্রতিরক্ষা চৌকি স্থাপন ও ফতওয়া বোর্ড গঠন।
নিঃসন্দেহে সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যোগ্য প্রতিনিধি। স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হিকমতপূর্ণ কথা এবং কিছু কাজের মাধ্যমেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, একমাত্র সিদ্দীকে আকবরই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য সর্বাধিক যোগ্য। হযরত যুবাইর ইবনে মুতঈম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, একদা এক মহিলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করলেন। মহিলাটি আলাপ শেষে চলে যাবার প্রাক্কালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে পুনরায় আসার জন্য বলেন। মহিলাটি বললেন, আমি যদি আবার এসে আপনার দেখা না পাই? রাসূল বললেন, তাহলে তুমি আবু বকরের নিকট আসবে। উক্ত ঘটনাটি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বর্ণনায় এভাবে আসে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাটিকে বলেন, আমার পর আবু বকরের নিকট আসবে। কারণ আমার পর তিনিই খলীফা হবেন।
হযরত আয়শা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পূর্বে অসুস্থকালীন সময়ে আমাকে বললেন, তোমার পিতা-আবু বকর এবং তোমার ভাইকে ডেকে দাও। আমি আবু বকরের খেলাফতের ব্যাপারে অসীয়তনামা লিখে দিই। যেন আমার পর এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য না হয়। পরক্ষণে আবার বলেন, ডাকতে হবে না। কেননা আল্লাহ্ এবং মুমিনগণ আমার পর আবু বকর ব্যতীত অন্য কাউকে খলীফা হিসেবে মেনে নেবে না।
হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ অবস্থায় আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে নামায পড়াতে আদেশ দেন। অথচ সে সময় আমি উপস্থিত ছিলাম এবং পুরোপুরি সুস্থও ছিলাম। তাই আমরা তাঁকে খেলাফতের ব্যাপারে পছন্দ করলাম। যেহেতু প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নামাযের মতো দ্বীনের এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পছন্দ করেছিলেন।
এভাবে পবিত্র কুরআনের ইঙ্গিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বর্ণনা, সাহাবায়ে কেরামের ইজমা, সিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর হাতে সকল সাহাবীর বায়‘আত তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যোগ্য প্রতিনিধি হওয়ার ব্যাপারে সাক্ষ্য বহন করে। মাত্র দু’ বছর চার মাস’র মতো কম সময়ে হয়ে পড়া বিশৃঙ্খল রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন আবু বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। তাঁর এমন কৃতিত্ব তাঁকে ইসলামের ত্রাণকর্তার মর্যাদায় অভিষিক্ত করে।
খেলাফতের মতো এমন কঠিন কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য তাঁকে অপরিসীম ব্যস্ততায় সময় কাটাতে হয়েছে। তাও তিনি এর মধ্যে প্রিয়নবীর বিরহে সদা বিষণœ থাকতেন। সর্বদা নবীজির সাক্ষাতের আশায় ব্যাকুল থাকতেন। বিচ্ছেদ বেদনায় তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওফাতের আগে তিনি অন্তিম ইচ্ছা জানানোর জন্য হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ডেকে পাঠান। আর বললেন, হে আলী, তুমি নিজের হাতে আমার শেষ গোসল দিও। কারণ তুমি ওই মুবারক হাত দু’টি দ্বারা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোসল দিয়েছিলে। আমাকে ওই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করো না। আমার পুরনো জামা দ্বারা কাফন পরিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা পাকের দরজার সামনে রেখে বলবে, আপনার চির সাথী আজ আপনার সামনে। তাঁর শেষ ইচ্ছা, তিনি অন্তিম শয়নে আপনারই পাশে থাকবেন। যদি অনুমতি হয়, তবে বিনা চাবিতে রওযা পাকের দরজা খুলে যাবে। জুমাদাল উখরা মাসের ২১ তারিখ মাগরিবের পর তাঁর ওফাত হয়। জানাযার ইমামতি করেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারূক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। জানাযা শেষে তাঁর অসীয়ত অনুযায়ী কফিন রওযা পাকের দরজার সামনে রাখা হয় এবং সেভাবেই আরয করা হয়। মুহূর্তেই তালাবদ্ধ দরজা নিজে নিজে খুলে গেল এবং ভিতর থেকে স্পষ্ট আওয়াজ আসল, ‘আদখিলুল হাবীবা ইলাল হাবীবি, ফাইন্নাল হাবীবা মুশতাকুন ইলাল হাবীব’। অর্থাৎ বন্ধুকে বন্ধুর ঘরে রেখে যাও, কারণ বন্ধুর প্রতীক্ষায় অপর বন্ধুও উদগ্রীব। এভাবে রাসূলুল্লাহর যোগ্যতম প্রতিনিধি অনন্তকালের জন্যও রাসূলের সঙ্গী হয়ে আছেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম।