মূল: আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলায়হি
ভাষান্তর : মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম
মাসআলা: মাতাপিতার ইন্তেকালের পর সন্তানদের উপর মাতাপিতার কী হক্ব তথা দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকে?
জবাব:
(১) সর্বপ্রথম হক্ব হচ্ছে, ইন্তেকালের পর তাঁদের জানাযা প্রস্তুতকরণ, গোসল, কাফন, নামায ও দাফন সম্পন্ন করা। আর এসব কাজে সুন্নাতসমূহ ও মুস্তাহাবগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবে, যেগুলোর মাধ্যমে তাঁদের জন্য সকল সৌন্দর্য, বরকত, রহমত ও প্রশস্ততার প্রত্যাশা থাকবে।
(২) তাঁদের জন্য সদাসর্বদা দো‘আ ও ‘ইস্তিগ্ফার’ (ক্ষমা প্রার্থনা) করতে থাকবে, এতে অলসতা করবে না।
(৩) সাদ্ক্বাহ্-খায়রাত ও নেক আমলসমূহের সাওয়াব তাঁদের নিকট পৌঁছাতে থাকা, সাধ্যমতে এতে কমতি করবে না। নিজের নামাযের সাথে তাদের জন্যও নামায পড়া, নিজ রোযাগুলোর সাথে তাদের জন্যও রোযা রাখা,বরং যত নেক কাজ করবে, সবগুলোর সাওয়াব তাদের এবং সকল মুসলমানের প্রতি প্রেরণ করা, যাতে তাদের সকলের নিকট সাওয়াব পৌঁছে যায় এবং এটা দ্বারা তার সাওয়াব হ্রাস পাবে না, বরং অনেক উন্নতি লাভ করবে।
(৪) তাঁদের উপর কারো কোন ঋণ থাকলে, তাহলে সেগুলো পরিশোধ করার জন্য সর্বোচ্চ দ্রুত চেষ্টা করা এবং নিজ সম্পদ থেকে তাঁদের ঋণ পরিশোধ হওয়াকে উভয় জগতের সৌভাগ্য মনে করা। নিজের সামর্থ্য না থাকলে, পরম প্রিয় আত্মীয়-স্বজন, অতঃপর অবশিষ্ট শুভাকাক্সক্ষীদের নিকট থেকে ঋণ পরিশোধে সহায়তা গ্রহণ করা।
(৫) তাঁদের উপর কোন ফরয রয়ে গেলে, যথাসাধ্য তা পালনের ক্ষেত্রে চেষ্টা করা; হজ্জ না করে থাকলে, স্বয়ং নিজে তাদের পক্ষ থেকে হজ্জ করা বা ‘বদল হজ্জ’ করানো, ‘যাকাত’ বা ‘ওশর’ অনাদায়ী থাকলে, সেটা আদায় করবে, নামায অথবা রোযা বাকী থাকলে, সেগুলোর ‘কাফ্ফারা’ দেয়া। وعلى هذا القياس (এর উপর অনুমান করো।) এভাবে তাঁদেরকে সর্বপ্রকারের দায়মুক্ত করার ক্ষেত্রে চেষ্টা করা।
(৬) তাঁরা শরী‘আতসম্মত বৈধ ওসীয়ত যা করেছেন, যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা; যদিওবা শরী‘আতের দৃষ্টিতে সেটা নিজের উপর আবশ্যক নয়। যদিওবা সেটা নিজের উপর বোঝা হয়; উদাহরণস্বরূপ তারা অর্ধেক সম্পত্তি ওয়ারিশ নয় এমন কোন প্রিয়জন বা অপরিচিত কারো জন্য ওসীয়ত করে গেছেন, তাহলে এক-তৃতীয়াংশের অধিক সম্পদের ক্ষেত্রে ওয়ারিশগণের সম্মতি ব্যতিরেকে ওসীয়ত কার্যকর হবে না। কিন্তু সন্তানদের উচিত যে, তাঁদের ওসীয়ত মেনে নেয়া এবং তাঁদের ইচ্ছা পূরণ করাকে নিজেদের আকাক্সক্ষার উপর অগ্রাধিকার দেয়া।
(৭) তাঁদের ওফাতের পরও তাঁদের শপথ সত্য রাখা। যেমন: মাতাপিতা শপথ করেছেন যে, আমার ছেলে অমুক স্থানে গমন করবে না, অথবা অমুকের সাথে মেলামেশা করবে না, অথবা অমুক কাজটি সম্পাদন করবে, তাহলে তাঁদের ওফাতের পর এটা ধারণা করবে না যে, এখন তো তারা নেই, তাঁদের শপথের কী স্মরণ; নয়, বরং সেটা ওভাবেই পালন করবে, যেরূপ তাঁদের জীবদ্দশায় পালন করা হতো, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন শর‘ঈ বাধা-বিপত্তি না হয়। এ বিধান শুধু শপথের উপরই নির্ভরশীল নয়, সকল প্রকারের বৈধ বিষয়াদিতে ওফাতের পর তাঁদের ইচ্ছার অনুগত থাকবে।
(৮) প্রতি জুমু‘আবারে তাঁদের কবর যিয়ারতের জন্য গমন করবে, সেখানে এমন উচ্চ স্বরে ‘সূরা ইয়া-সীন শরীফ’ পাঠ করবে, যেন তাঁরা তা শুনতে পান এবং এর সাওয়াব তাঁদের রূহে প্রেরণ করবে; পথিমধ্যে যখন কখনো তাঁদের কবর আসে, তখন বিনা সালাম ও ফাতিহা পাঠে যেন অতিক্রম না করা হয়।
(৯) তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে আজীবন সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
(১০) তাঁদের বন্ধু-বান্ধবের সাথে সদ্ভাব রক্ষা করা, সদাসর্বদা তাঁদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদা রাখা।
(১১) কখনো কারো মাতাপিতার ব্যাপারে অশালীন ভাষায় কথা (গালি-গালাজ) বলে, প্রত্যুত্তোরে তাঁদেরকে (নিজ মাতাপিতা) কে অশালীন কথা (গালি) না শুনানো।
(১২) সর্বাধিক কঠিন, সার্বজনীন ও চিরন্তন কর্তব্য হচ্ছে, কখনো কোন গুনাহ করে তাঁদেরকে কবরে কষ্ট না দেয়া; তার (সন্তান-সন্তুতি) সকল কৃতকর্মের সংবাদ মাতাপিতার নিকট পৌঁছে, নেক আমল দেখলে তাঁরা খুশি হন এবং তাঁদের চেহারা আনন্দে চমকিত ও উজ্জ্বল হয়ে থাকে। আর গুনাহ্ দেখলে, তাঁরা ব্যথিত হন এবং তাঁদের অন্তরে দুঃখ পান। মাতাপিতার প্রতি এটি সমীচীন নয় যে, কবরের মধ্যেও তাঁদেরকে কষ্ট দেবে।
আল্লাহ্, পরম ক্ষমাশীল, করূণাময়, মহাপরাক্রমশালী, পরম সম্মানিত, মহত্বের মালিক আপন হাবীব রউফ রহীম (আলায়হি ওয়া ‘আলা আ-লি আফদ্বালুস সলাতি ওয়াত তাসলীম)-এর ওসীলায় আমরা সকল মুসলমানকে নেক কার্যাদি সম্পাদনে সামর্থ্য দান করুন, পাপরাশি থেকে পরিত্রাণ দিন, আমাদের পূর্বপুরুষ মুরব্বীগণের কবরসমূহে সদাসর্বদা নূর ও খুশি প্রেরণ করুন। কেননা তিনি (আল্লাহ্) তাতে সক্ষম, আমরা অক্ষম। তিনি অমুখাপেক্ষী, আমরা (তাঁর প্রতি) মুখাপেক্ষী।
وَحَسْبُنَا اللهِ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ نِعْمَ الْمَوْلٰى وَنِعْمَ النَّصِيْرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إلَّا بِاللهِ الْعَلِيِّ الْعَظِيْمِ وَ صَلَّى اللهُ تَعَالٰى عَلٰى الشَّفِيْعِ الرَّفِيْعِ الْعَفُوُّ الْكَرِيْم الّرَؤُوْفُ الرَّحِيْم سَيِّدُنَا مُحَمَّدٍ وَّآلِهِ وَأَصْحَابِهِ أَجْمَعِيْن آمِيْن! والْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْن-
“আর আল্লাহ্ আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং উত্তম কর্মবিধায়ক। কতই উত্তম মালিক এবং কতই উত্তম সাহায্যদাতা। নেই কোন উপায় কল্যাণের এবং নেই কোন শক্তি পাপ থেকে ঁেবচে থাকার মহামহিম পরম মর্যাদাবান আল্লাহ্র সামর্থ ব্যতিরেকে; আল্লাহ্ তা‘আলা দুরূদ প্রেরণ করুন সুপারিশকারী, সুউচ্চ, মেহেরবান, দয়াময়, স্নেহশীল, করুণাময় আমাদের আক্বা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার প্রতি এবং তাঁর পবিত্র বংশধর ও সাহাবীগণের প্রতি। আর সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।”
এখন ওই হাদীসসমূহ, যেগুলো থেকে এ ‘ফক্বীর’ (আ’লা হযরত) এ কর্তব্যসমূহ বের করেছি, তন্মধ্য থেকে কিছু প্রয়োজন অনুযায়ী উল্লেখ করছি:
হাদীস নং- ০১:
এক আনসারী সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হুযূর পুর নূর সায়্যিদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে হাযির হয়ে আরয করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! মাতাপিতার ইন্তিকালের পর তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করার কোন পদ্ধতি বাকী আছে কি, যা আমি সম্পাদন করবো? তিনি (হুযূর করীম) ইরশাদ করেন:
“نَعَمْ، أَرْبَعَةٌ: اَلصَّلَاةُ عَلَيْهِمَا وَالْاِسْتِغْفَارُ لَهُمَا، وَإِنْفَاذُ عَهْدِهِمَا مِنْ بَعْدِهِمَا، وَإِكْرَامُ صَدِيْقِهِمَا، وَصِلَةُ الرَّحِمِ الَّتِيْ لَا رَحِمَ لَكَ إِلَّا مِنْ قِبَلِهِمَا؛ فَهٰذَا الَّذِيْ بَقِيَ مِنْ بِرِّهِمَا بَعْدَ مَوْتِهِمَا.
رواه ابن النجار عن أبى أسيد الساعدى رضى الله تعالى عنه مع القصة،
وَ رواه اليهقي فى سننه عنه رضى الله تعالى عنه قال:
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا يَبْقَى لِلْوَلَدِ مِنْ بِرِّ الْوَالِدِ إِلَّا أَرْبَعٌ الصَّلَاةُ عَلَيْهِ وَالدُّعَاءُ لَهُ وَإِنْفَاذُ عَهْدِهِ مِنْ بَعْدِهِ وَصِلَةُ رَحِمِهِ وَإِكْرَامُ صَدِيقِهِ.
“হ্যাঁ, চারটি বিষয়। তাঁদের জন্য নামায পড়া, তাঁদের ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাঁদের ওসীয়ত কার্যকর করা, তাঁদের বন্ধুমহলের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, যেসব আত্মীয়তা কেবল তাঁদের পক্ষ থেকে হয়, তার প্রতি সদ্ভাব বজায় রাখা। এগুলো হচ্ছে, সেসব নেক কর্ম, যেগুলো তাঁদের ওফাতের পরও তাঁদের সাথে বাকী থাকে।” (ইবনে নাজ্জার আবূ উসাইদ সা-‘ইদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে ওই ঘটনাসহ বর্ণনা করেছেন।)
আর বায়হাক্বী স্বীয় ‘সুনান’ গ্রন্থে ওই বর্ণনাকারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে রেওয়ায়ত করেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: “পিতার সাথে সদ্ব্যবহারের চারটি পন্থা বাকী থাকে। তাঁর জন্য নামায পড়া, দো‘আ করা, তাঁর ওসীয়ত কার্যকর করা, তাঁর আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাঁর বন্ধু-সাথীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।”
হাদীস নং- ০২:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
اِسْتِغْفَارُ الْوَلَدِ لِأَبِيْهِ مِنْ بَعْدِ الْمَوْتِ مِنَ الْبِرِّ
رواه ابن النجار عن أبى أسيد مالك بن زرارة رضى الله تعالى عنه
“মাতাপিতার সাথে সদ্ব্যবহারের মধ্যে এও রয়েছে যে, সন্তান তাঁদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে।” (ইবনে নাজ্জার হযরত আবূ উসাইদ মালিক ইবনে যুরারাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে হাদীসটি রেওয়ায়ত করেছেন।)
হাদীস নং- ০৩:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِذَا تَرَكَ الْعَبْدُ الدُّعَاءَ لِلْوَالِدَيْنِ فَإِنَّهُ يَنْقَطِعُ عَنْهُ الرِّزْقُ.
رواه الطبراني في التاريخ، والديلمي عن أنس بن مالك رضى الله تعالى عنه.
“যখন কোন ব্যক্তি মাতাপিতার জন্য দো‘আ করা ছেড়ে দেয়, তার রিয্ক্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।” (ত্বাবরানী ‘তারীখ’-এর মধ্যে এবং দায়লামী হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন।)
হাদীস নং- ০৪ ও ০৫:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِذَا تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ تَطَوُّعًا أَنْ يَجْعَلَهَا عَنْ أَبَوَيْهِ، فَيَكُونَ لَهُمَا أَجْرُهَا، وَلَا يُنْقَصُ مِنْ أَجْرِهِ شَيْءٌ-
رواه الطبراني في الأوسط و ابن عساكر عن عبد الله بن عمرو رضى الله تعالى عنهما و نحوه الديلمى فى مسند الفردوس عن معاوية بن حيدة القشيرى رضى الله تعالى عنه-
“যখন তোমাদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি কিছু নফল সাদ্ক্বাহ্ করে, তার উচিত যে, সেটা নিজের মাতাপিতার পক্ষ থেকে করবে, যাতে সেটার সাওয়াব তাঁরা পান এবং এর দ্বারা তার সাওয়াব থেকে কোন কিছু হ্রাস পাবে না।” (এ হাদীসটি ত্বাবরানী ‘আওসাত্ব’-এর মধ্যে এবং ইবনে আসাকির হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে রেওয়ায়ত করেন এবং অনুরূপ দায়লামী ‘মুসনাদুল ফিরদাউস’-এর মধ্যে মু‘আভিয়া ইবনে হায়দাহ্ ক্বোশাইরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে রেওয়ায়ত করেন।)
হাদীস নং- ০৬:
এক সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হাযির হয়ে আরয করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমি আমার মাতাপিতার সাথে জীবদ্দশায় সদ্ব্যবহার করতাম, তাঁরা এখন ওফাত বরণ করেছেন, তাঁদের সাথে এখন সদ্ব্যবহার করার পন্থা কী? তিনি (হুযূর করীম) ইরশাদ করেন:
إنَّ مِنْ الْبِرِّ بَعْدَ الْمَوْتِ أَنْ تُصَلِّيَ لَهُمَا مَعَ صَلَاتِكَ وَأَنْ تَصُوْمَ لَهُمَا مَعَ صَوْمِكَ . رَوَاهُ الدَّارَقُطْنِيّ
“ইন্তিকালের পর তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করার পন্থা হচ্ছে, তুমি তোমার নামাযের সাথে তাঁদের জন্যও নামায পড় এবং নিজের রোযাসমূহের সাথে তাদের জন্য রোযা রাখো।” (হাদীসটি দারে ক্বুত্বনী বর্ণনা করেছেন।)
অর্থাৎ যখন নিজে সাওয়াব অর্জনের জন্য কিছু নফল নামায পড়বে অথবা রোযা রাখবে, তখন কিছু নফল নামায তাঁদের পক্ষ থেকে (পড়বে) যা দ্বারা তাঁদের নিকট সাওয়াব পৌঁছাবে, অথবা নামায, রোযা ও নেক আমল করলে সাথে সাথে তাঁদের নিকট সাওয়াব পৌঁছানোর নিয়্যতও করে নেবে। এর দ্বারা তাদেরও সাওয়াব মিলবে এবং তোমারও (সাওয়াব) কম হবে না।
كما يدل عليه لفظ “مع” يحتمل الوجهين بل هٰذا ألصق بالمعية.
যেমনিভাবে “مع” শব্দটি তা বুঝায়, কেননা এতে উল্লেখিত দু’ সম্ভাবনা রয়েছে, বরং শেষ কারণটি সাহচার্যের অধিক উপযুক্ত।
‘মুহীত্ব’, ‘তাতারখানিয়া’ এবং ‘রদ্দুল মুহতার’-এ রয়েছে:
اَلْأَفْضَلُ لِمَنْ يَتَصَدَّقُ نَفَلًا أَنْ يَنْوِىَ لِجَمِيْعِ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ، لِأَنَّهَا تُصِلُ إِلَيْهِمْ وَلَا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِهِ شَيْئٌ-
“যে ব্যক্তি নফল সাদ্ক্বাহ্ করবে, তার জন্য উত্তম হচ্ছে, সে তাতে সকল মু’মিন নর-নারীর জন্য নিয়্যত করবে। কেননা এ সাওয়াব তাঁদের নিকটও পৌঁছবে এবং তাঁর সাওয়াবও হ্রাস পাবে না।”
হাদীস নং- ০৭:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ حَجَّ عَنْ وَالِدَيْهِ أَوْ قَضَى عَنْهُمَا مَغْرَمًا بَعَثَهُ اللّٰهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَعَ الْأَبْرَارِ. رواه الطبراني في الأوسط والدار قطنيّ فى السنن عن ابن عباس رضى الله تعالى عنهما-
“যে ব্যক্তি মাতাপিতার পক্ষ থেকে হজ্জ পালন করে অথবা তাঁদের ঋণ পরিশোধ করে, ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে নেককারদের সাথে উঠাবেন।” (হাদীসটি ত্বাবরানী ‘আওসাত্ব’-এর মধ্যে এবং দারে ক্বুত্বনী স্বীয় ‘সুনান’-এ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন।)
হাদীস নং- ০৮:
আমীরুল মু’মিনীন ওমর ফারূক্ব-ই আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর উপর আশি হাজার ঋণ ছিল, তিনি ওফাতকালে স্বীয় সাহেবযাদা হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমাকে ডেকে বললেন:
بِعْ فِيْهَا أَمْوَالَ عُمَرَ فَإِنْ وَفَتْ وَإِلا فَسَلْ بَنِي عَدِيٍّ فَإِنْ وَفَتْ وَإِلا فَسَلْ قُرَيْشًا وَلا تَعْدُهُمْ-
“আমার ঋণ পরিশোধে প্রথমে তুমি আমার মাল-সম্পদ বিক্রি করবে, যদি তাতে যথেষ্ঠ হয়, তাহলে তা দ্বারা ঋণ পরিশোধ করবে। অন্যথায় আমার সম্প্রদায় বনী আদীর নিকট থেকে প্রার্থনা করে পূরণ করবে, যদি তাতেও পূর্ণ না হয়, তাহলে ক্বোরাইশদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে আর তারা ছাড়া অপর কারো নিকট সাহায্য চাইবে না।”
অতঃপর সাহেবযাদাকে বললেন: اِضْمَنْهَا “তুমি আমার ঋণের যিম্মাদার হয়ে যাও। তিনি (ইবনে ওমর) যিম্মাদার হয়ে গেলেন। আর আমীরুল মু’মিনীন-এর দাফনের পূর্বে শীর্ষস্থানীয় মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণকে সাক্ষী বানিয়ে নিলেন যে, তিনি ওই আশি হাজার ঋণ আমার উপর রয়েছে। সপ্তাহ অতিবাহিত হয় নি, আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ওই সকল ঋণ পরিশোধ করে দেন।
رواه ابن سعد فى الطبقات عن عثمان بن عروة
হাদীস নং- ০৯:
জোহায়নাহ্ গোত্রের এক রমণী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা হুযূর সায়্যিদ-ই আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে হাযির হয়ে আরয করলেন: ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমার মাতা হজ্জ পালনের মান্নত করেছিলেন, তিনি তা আদায় করতে পারেন নি এবং তাঁর ইন্তিকাল হয়ে গেছে, আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করে নেব? (হুযূর করীম) ইরশাদ করেন:
نَعَمْ حُجِّي عَنْهَا، أَرَأَيْتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ أَكُنْتِ قَاضِيَةً؟ اِقْضُوْا اللّٰهَ فَاللّٰهُ أَحَقُّ بِالوَفَاءِ.
رواه البخارى عن ابن عباس رضى الله تعالى عنهما-
“হ্যাঁ, তাঁর পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় কর। দেখ, তোমার মাতার উপর যদি ঋণ থাকত, তাহলে তুমি কি তা পরিশোধ করতে না? অনুরূপ খোদা তা‘আলার ঋণ পরিশোধ কর, কেননা আল্লাহ্র ঋণ পরিশোধ করার অধিক হক্বদার।” (হাদীসটি ইমাম বোখারী ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন।)
হাদীস নং- ১০:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِذَا حَجَّ الرَّجُلُ عَنْ وَالِدَيْهِ تُقُبِّلَ مِنْهُ وَمِنْهُمَا وَاسْتَبْشَرَتْ أَرْوَاحُهُمَا فِي السَّمَاءِ وَكُتِبَ عِنْدَ اللَّهِ تَعَالَى بَرًّا-
رواه الدار قطنيّ فى السنن عن زيد بن أرقم رضى الله تعالى عنه.
“যখন ব্যক্তি স্বীয় মাতাপিতার পক্ষ থেকে হজ্জ পালন করে, ওই হজ্জ তার এবং তার মাতাপিতার পক্ষ থেকে কবূল করা হয়। আসমানে তাঁদের রূহসমূহ প্রফুল্ল হয় এবং ওই ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট মাতাপিতার সাথে সদ্ব্যবহারকারী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়।” (হাদীসটি দারে ক্বুত্বনী যায়দ ইবনে আরক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন।)
হাদীস নং- ১১:
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
مَنْ حَجَّ عَنْ أَبِيهِ وَأُمِّهِ فَقَدْ قَضَى عَنْهُ حَجَّتَهُ وَكَانَ لَهُ فَضْلُ عَشْرِ حُجَجٍ
رواه الدار قطنيّ فى السنن عن جابر بن عبد الله رضى الله تعالى عنهما. –
“যে ব্যক্তি আপন মাতাপিতার পক্ষ থেকে হজ্জ পালন করবে, তাঁদের পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় হয়ে যাবে এবং সে দশটি হজ্জের সাওয়াব অধিক পাবে।” (হাদীসটি দারে ক্বুত্বনী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন।)
[ সংক্ষেপিত]
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে মাতাপিতার অবাধ্যতা থেকে রক্ষা করুন এবং তাঁদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো পালন করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন, আমীন, বিরাহ্মাতিকা ইয়া র্আহামার রা-হিমীন। সাল্লাল্লাহু তা‘আলা ‘আলা সায়্যিদিনা মুহাম্মাদিন ওয়া আ-লিহি ওয়া সাহ্বিহি আজমা‘ঈন।
—-০—-
টিকা:
অর্থাৎ প্রতিনিধি হিসেবে অপরের পক্ষ থেকে ফরয হজ্জ আদায় করা, যার মাধ্যমে ওই দ্বিতীয় ব্যক্তির ফরয আদায় হয়ে যায়। এটি কিছু শর্ত সাপেক্ষে করা হয়, যেগুলো ‘ফাতওয়া-ই রযভিয়্যাহ্’ খ– ১০, পৃ. ৬৫৯-৬৬০ এর মধ্যে উল্লেখ রয়েছে।
‘ওশর’ দশমাংশকে বলা হয়। আর শরী‘আতে ওশর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওই যাকাত, যা ওশরী যমীন (তথা ওই যমীন, যেটাকে বৃষ্টি বা ইত্যাদি পানি সিক্ত করে)-এর মধ্যে কৃষি ফসল উৎপাদনের দ্বারা মুনাফা অর্জন করার কারণে আবশ্যক হয়, তখন ওই উৎপাদিত ফসলের উপর যাকাত ফরয। আর ওই যাকাতের নাম ওশর বা দশমাংশ, অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দশমাংশ ফরয হয়, যদিওবা কিছু ক্ষেত্রে অর্ধ দশমাংশ গ্রহণ করা হয়। (বাহারে শরী‘আত, খ–০১, অংশ-৫, পৃ. ৯১৬, সংক্ষেপিত)
এক ওয়াক্ত নামাযের কাফ্ফারা হচ্ছে, এক ‘সাদ্কাতুল ফিতর’ বা ‘ফিতরা’। এক ফিতরার পরিমাণ হলো- প্রায় দু’ কিলো পঁঞ্চাশ গ্রাম গম অথবা সেটার আটা বা সেটার অর্থ মূল্য। একদিনে ছয় ওয়াক্ত নামায- পাঁচ ফরয এবং এক বিতর ওয়াজিব। সুতরাং একদিনের নামাযে ছয় ফিতরা দিতে হবে। আর এক রোযার ফিদ্ইয়াও এক ফিত্রা। মনে রাখা উচিত যে, নামাযসমূহের ফিদ্ইয়া মৃত্যুর পরে দেয়া যেতে পারে এবং রোযাগুলোর ফিদ্ইয়া জীবদ্দশায়ও দিতে পারবে। তবে যখন এমন রোগাক্রান্ত হয়েছে, যা থেকে আর সুস্থ হওয়া আশা করা যায় না অথবা অতিশয় বৃদ্ধ হয়ে গেছে, যাকে ‘শায়খ-ই ফানী’ বলা হয়, তাহলে জীবদ্দশায় ফিদ্ইয়া দিতে পারবে।
ইমাম আলাউদ্দীন আলী ইবনে হুসামুদ্দীন (ওফাত: ৯৭৫ হি.), কানযুল ‘উম্মাল, কিতাবুন নিকাহ্, হাদীস: ৪৫৯৩৪, খ– ১৬, পৃ. ৫৭৭, ইবনুন্ নাজ্জার-এর সূত্রে
আবূ বকর আহমদ ইবনে হুসাইন বায়হাক্বী (ওফাত: ৪৫৮ হি.), আস্ সুনানুল কোবরা, কিতাবুল জানা-ইয, হাদীস: ৭১০২, খ– ৪, পৃ. ১০২
কানযুল ‘উম্মাল, কিতাবুন নিকাহ্, হাদীস: ৪৫৪৪৯, খ– ১৬, পৃ. ৪৬১, ইবনুন্ নাজ্জার-এর সূত্রে
পূর্বোক্ত, হাদীস: ৪৫৫৫৬
আল্ মু’জামুল আওসাত্ব, হাদীস: ৭৭২৬, খ–০৫, পৃ. ৩৯৪; মুসনাদুল ফিরদাউস, হাদীস: ৬৬৭৭, খ– ২, পৃ. ৩৩৭
রদ্দুল মুহতার, কিতাবুল হজ্জ, খ– ২, পৃ. ৫৯৬
তাতারখানিয়া, কিতাবুয যাকাত, খ– ২, পৃ. ৩১৯
আল্ মু’জামুল আওসাত্ব, হাদীস: ৭৮০০, খ–০৮, পৃ. ১১;
আবূ আবদুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে সা’দ বসরী বাগদাদী (ওফাত: ২৩০ হি.), আত্ ত্বাবাক্বাতুল কোবরা, খ– ৩, পৃ. ২৭৩
বোখারী, আস্ সহীহ, হাদীস: ১৮৫২
সুনানে দারে ক্বুত্বনী, কিতাবুল হজ্জ, হাদীস: ২৬০৭, খ– ৩, পৃ. ২৯৯
সুনানে দারে ক্বুত্বনী, কিতাবুল হজ্জ, হাদীস: ২৬০৭, খ– ৩, পৃ. ২৯৯
লেখক: পরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।