অভিশাপ আর কাকে বলে!

0

মনসুর নাদিম

অভিশাপ এহেন এক মিসাইল যাহা কাহারও জীবন মূহুর্তে তছনছ করিয়া দেয়। গতকাল সকিনার বাপকে কহিয়াছিলাম শীতে বাত ব্যাধির ব্যথা বাড়িয়া গিয়াছে। হাড্ডির জোড়ায় জোড়ায় জমিয়া থাকা দরদের ডিপো গুলি কনকনাইয়া উঠিতেছে। লৌকিকতা রক্ষার্থে আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ যৎসামান্য রক্ষা করিবার কোশিশ করিলেও বেশিরভাগ হইয়া উঠে না। শিকড় ফাউন্ডেশনের দ্বিতীয় প্রকাশনার সম্পাদনার দায়িত্ব এক কিসিমের জোর করিয়া চাপাইয়া দিবার পর আরও বেশি ব্যস্ত হইয়া গেলাম। মুল্লুকে ফেসবুক আসিবার পর লেখকের সংখ্যা বাড়িয়া গিয়াছে মাগার লেখার মান বাড়েনি। যাহা হোক, আজ কিছু অভিশাপ ও গজব লইয়া বয়ান করিবার আরজু লইয়া কীবোর্ডে আঙুল নাচাইতেছি।সকিনার বাপ আর মাস্টার সাহেব কয়দিন আগে আসরের নামাজের পর মসজিদের শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে বসিয়া আলাপ করিতেছিল। আমিও তাহাদের সহিত কিছুক্ষণ খোশ গল্প করিতে বসিয়া গেলাম। একজন সদ্য পদত্যাগ কারী মন্ত্রীর কথা আসিতেই প্রাসঙ্গিক নানা কথা আসিয়া গেল। মন্ত্রী সাহেব অনেক দম্ভোক্তি করিতেন। আখেরতক তিনি ধর্ম লইয়া কথা কহিলেন। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরিয়া যাইবার কথা কহিয়া ইসলাম, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লইয়া তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়াছিলেন। সকিনার বাপের মতে এইজন্যই মন্ত্রী গজবের শিকার হইয়াছেন। তাহার কথায় যুক্তি খুঁজিয়া পাই আগের কিছু ঘটনা দেখিলে। নমরুদ ফেরাউনের যুগে ফিরিয়া যাইবার দরকার নাই। কথিত কোরআনের পাখি আজ কারাগারে। তিনি আল্লাহ্র অলিদের সাথে বেয়াদবি পূর্ণ অনেক বয়ান করিতেন। তিনি কহিতেন, আল্লাহ্র অলিদের মশাই কামড়ায় নাকি, মাজারে মশারি টাঙান কেন? আরেকজন বলিয়াছিলেন-বিবি খাদিজাতুল কোবরা ইনটেক ছিলেন না। তিনি এখন দেশান্তরি। তসলিমা নাসরিন ধর্ম ও ধার্মিকদের বিরুদ্ধে নানা ছুরতের বিষোদগার করিয়া দেশ হইতে বিতাড়িত। জনৈক মাওলানা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা কহিতে কোন ছুরতে ঠোঁট নাড়াইতেন তাহা দেখাইবার পরপরই পরনারী লইয়া রিসোর্টে ধরা খাইয়া এখনও কারাগারে। সত্তর দশকের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নায়ক রহমান।সিলেটে শুটিং শেষে আসার পথে হযরত শাহ জালাল (রহ.)-এর মাজার। রহমান সাহেব একটা পা স্টাইল করিয়া গাড়ির বাহিরে ঝুলাইয়া রাখিলে ড্রাইভার কহিলেন-স্যার, পা টা ঢুকান সামনে মাজার। নায়ক রাগান্বিত হইয়া কহিলেন- মাজার অইছে তো কী হইছে? তুমি গাড়ি চালাও। কথা শেষ হইতে না হইতে চলন্ত ট্রাকের ধাক্কায় পা ভাঙিয়া বাকি জিন্দেগি নকল পা লইয়া খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কবর পর্যন্ত গিয়াছিল। আরেক মাওলানা কহিয়াছিলেন, বাংলাদেশের সকল মাজার লাথি মারিয়া গুঁড়াইয়া দিব। তিনি তো তাহা পারিলেন না মাগার তাহার পায়ে পচন ধরিয়া সেই পা কাটিয়া দুনিয়ায় রাখিয়া দেড় পা লইয়া কবরে যাইতে হইয়াছিল। এই সমস্ত ঘটনা হইতে মানুষ শিক্ষা গ্রহন করেনা বলিয়াই আজকের এই দশা। চট্টগ্রামের একটা আঞ্চলিক প্রবাদ আছে- ‘হাজির লগে পাজিগিরী, পীরর লয় মশকারি’। যাহারা ইহা অনুধাবন করিতে পারেন না তাহারা চোখ থাকিতেও অন্ধ। এই আলোচনা করিতে করিতে দুয়েকজন মুসল্লি আসিয়া তশরিফ লইল। কয়েকদিনের শৈত্য প্রবাহে শীতের বাসা যেন ভাঙিয়া দিয়াছে।কনকনে বাতাসে শিশু ও বয়স্করা জমিয়া গিয়াছে। বয়স বাড়িলে ইনসান পারিবারিক ঝামেলায় প্রাকৃতিক ঠা-ায় কাবু হইয়া যায়। সকিনার বাপের এক আত্মীয় একমাত্র ছেলের নামে জায়গা জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লিখিয়া দিবার পর এখন বৈরাগী হইয়া বসিয়া আছে। সিংহের মতো রাজার হালতে এতদিন গুজারিয়া এখন ছেলের আদেশ নিষেধের বাহিরে কিংবা বউমা’র ইশারা বিনা কিছুই করিবার হিম্মৎ নাই। সকিনার বাপ কহিলেন, ছেলেকে ভালবাসিয়া বিশ্বাস করিয়া জিন্দেগির কামাই তিলতিল করিয়া সঞ্চিত অর্থ সম্পদ অর্পন করিবার পর ছেলেটা ধীরে ধীরে বদলিয়া গিয়াছে। পরিবার না থাকায় মানুষটার কষ্ট বাড়িয়া গিয়াছে। এই শীতে একটু অজু গোসলে গরম পানির দরকার হয়। মাগার তাহার তরফ নজর দিবার ফুরসৎ কাহারও নাই। ইনসানের রূপ দুইটা। একটা ঘরে আরেকটা বাইরে। মা-বাবার পদতলে সন্তানদের বেহেস্ত বলা হইলেও কিছু কুলাঙ্গার সন্তান স্ত্রীর আঁচলে বেহেস্ত তালাশ করিয়া থাকে। পবিত্র কুরআনে পড়িয়াছি, ‘‘মা বাবার যেকোনো একজনকে পাইলে এমন ভাবে চালাইয়া যাওয়া যাহাতে মুখ দিয়া ‘উহু’ শব্দটা বাহির না হয়’’। আমাদের সন্তানেরা যেন মা-বাবার প্রতি যতœবান হয়। বয়স্কদের প্রতি সচেতন হয়। বয়সকালে মা-বাবা সন্তানদের জন্য বোঝা হইয়া যায়। যেই সন্তানেরা এই বোঝা কে নেয়ামত মনে করিয়া থাকে তাহারা আখিরাতের পুলসিরাত পার হইতে বিলকুল মুশকিল হইবেনা। কিছু লোক আছে, যাহারা বুড়া মা-বাবাকে তকলিফ দিয়াছে। মরার পরে মা-বাবার প্রকা- ছবি সামনের রুমে প্রদর্শনীর নিয়তে লটকাইয়া আগন্তুক অতিথিদের নজর কাড়া শটামি ব্যতীত কিছুইনা। মা-বাবার অভিশাপ অজান্তে লাগিয়া গেলে তাহা ভয়াবহ হইয়া যায় নিজের জন্য। এক মুসল্লি চিবুকের দাঁড়ি ক’গাছি চুলকাইয়া কহিলেন, তাহার পড়শি নিজের এতিম ভাইদেরকে ঠকাইয়া পৈতৃক সম্পত্তির বাটোয়ারাই নিজ হিস্যায় বেশি লইয়া ভাইদের বিশ্বাসের দেওয়ালে ফাটল ধরাইয়া নাক ডাকিয়া ঘুমাইতেছে। ইনসান মওতের কথা বিলকুল ভুলিয়া যায়। এই এতিম ভাইদের হক লইয়া তিনি মহাপ্রলয়ের দিন কী করিবেন তাহা কী তাহার জানা আছে? তিনি কী ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিয়াছেন ঐ আখিরাতে অন্যের জমি বিচারক তাহার গলায় বাঁধিয়া দিবেন। হায়রে কূপম-ূক! এই ছুরতের লোকদের জন্যই ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’ প্রবাদটার জন্ম হইয়াছে। এখন প্রশ্ন আসিতে পারে, এই ছুরতের কর্ম কাহারা করিয়া থাকে। কেন করিয়া থাকে? এক জরিপে দেখা গিয়াছে, এই ছুরতের কর্ম দুই ধরেনের মানুষ দ্বারা সংঘটিত হইতে পারে। ১, অত্যান্ত লোভী প্রকৃতির লোক। ২, স্ত্রৈণ বা দইয়ুছ (স্ত্রী’র আজ্ঞাবহ পুরুষ)দ্বারা। যে পুরুষ স্ত্রী কর্তৃক পরিচালিত হয় তাহার প্রতি করুণা হয়।শৈশবে পাঠ্য পুস্তকে নিজাম উদ্দিন ডাকাতের গল্প পড়িয়াছিলাম। একদিন নিজাম উদ্দিন এক দরবেশকে আটক করিয়া তাহার সর্বস্ব লুটে নিতে চাহিলে দরবেশ কহিলেন, তুমি কাহাদের জন্য এই লুটতরাজ করো? তাহারা কী তোমার এই গুনাহের ভাগ লইবে? নিজাম উদ্দিন দৃঢ বিশ্বাসের সহিত কহিল- কেন নিবেনা, আলবৎ নিবে। আমি তো তাহাদের জন্যই করছি। দরবেশ কহিলেন- এটা তোমার ভ্রান্ত ধারণা, তুমি বরং গিয়া জিজ্ঞেস করিয়া আসো। আমি এখানে অপেক্ষা করিব তুমি না আসা পর্যন্ত। নিজাম উদ্দিন দরবেশকে রশি দিয়া কষিয়া বাঁধিয়া বাড়ির তরফ ছুটিল। বাড়িতে গিয়া জনে জনে সকলকে জিজ্ঞাসা করিলে সকলেরই একই জবাব, আমরা কেন তোমার গুনাহের ভাগ নেবো? আমরা কী তোমাকে বলেছি’যে ডাকাতি করো। তুমি পরিশ্রম করো, হালাল রুজি কামাও। পরিবারের জবাব পাইয়া নিজাম উদ্দিন ভগ্ন হৃদয়ে গিয়া দেখে রশি খোলা অবস্থায় বন্ধনমুক্ত দরবেশ হাসিমুখে বসিয়া আছেন। নিজাম উদ্দিন বুঝিয়া গেলেন ইনি কোন সাধারণ দরবেশ নন। সাথে সাথে তওবা করিয়া দরবেশের শিষ্যত্ব গ্রহন করিয়াছিলেন। গল্প হইতে আমরা সৎ পথে চলিবার শিক্ষা পাইলেও আজকাল এই ছুরতের গল্প পাঠ্যপুস্তকে অনুপস্থিত। মানুষ হালাল হারাম চিনেনা। আল্লাহ্ সকলকে হেদায়েত করুন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •