শিশুরা আমাদের প্রাণ

0

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইশতিয়াক রেযা

অবতরণিকা

মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বান্দাদের উপর যেসব নিআমতরাজি দিয়েছেন তম্মধ্য সবিশেষ উল্লেখযোগ্য নিআমত হল আমাদের সন্তানেরা|  মা-বাবার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত সবচেয়ে বড় উপঢৌকন সন্তান-সন্ততিদের জন্ম থেকে শুরু করেই মৃত্যু অবধি মা-বাবার দায়িত্ব পালনের যেন অন্ত নেই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তোমাদেরই মধ্য হতে তোমাদের জন্য স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের স্ত্রীদের থেকে তোমাদের জন্য পুত্র ও পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন। আর ভালো-ভালো জিনিসের থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করেছেন। তবুও কি তারা ভিত্তিহীন জিনিসের প্রতি ঈমান রাখবে আর আল্লাহর নিআমতসমূহের অকৃতজ্ঞতা করবে? “ সূরা নাহল (১৬) : ৭২|

 শিশুর শৈশব

সন্তান সন্ততির প্রতিটা কিছুই মা-বাবার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ| শিশুর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল হল শৈশবকাল।  জন্মের পর থেকে কৈশোর বা বয়ঃসন্ধি কালের পূর্বের সময়টাকে বলা হয়  শৈশব| শিশুর জ্ঞানীয় বিকাশের প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণায় সুইজারল্যান্ডের মনোবিজ্ঞানী International Bureau of education এর ডিরেক্টর  জ্যাঁ পিঁয়াজের কালজয়ী মতবাদ Piaget’s theory of cognitive development (পিয়াজেট থিওরী অব কজিট্যাটিভ ডিভেলপমেন্ট) অনুসারে শৈশব কালের দুটি পর্ব রয়েছে। একটি হল প্রাক কর্মক্ষম পর্ব এবং অন্যটি হল কর্মক্ষম পর্ব। ডেভেলপমেন্টাল সাইকোলজি অনুসারে শৈশবকালকে হাঁটা শিক্ষার সময়, খেলার সময়, বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় এবং বয়ঃসন্ধিকাল সময়ে ভাগ করা হয়েছে। শৈশবকালের ধারণাটি ১৭শ থেকে ১৮শ শতাব্দিতে উদ্ভব হয় বিশেষত দার্শনিক জন লক (1632 –1704) ) এর শিক্ষা বিষয়ক gZev‡`| এর আগে শৈশবকালকে বড়দের অসম্পূর্ণ সংস্করণ হিসাবে দেখা হত।

মায়ের চাঁদরে শিশু

“মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু যেন ভাই,

ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই।

সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক মাথার’ পরে আজি

অন্তরে মা থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজি।”

মায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি কাজী কাদের নেওয়াজ তার ‘মা’ কবিতায় যে অসাধারণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন যা বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে বিরল| ‘মা’ শব্দটি যদিও ছোট্ট ,  কিন্তু তার পরিধি অসীম। সবচেয়ে কাছের মানুষ তিনি, সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ও| মা’ শব্দটির সঙ্গে মিশে আছে মায়া-মমতা ও ভালোবাসা। মা সব সময়ই সন্তানের প্রতি একটু বেশিই খেয়াল রাখে। সবার কাছেই মায়ের চেয়ে আপন আর কেউ নেই। সন্তানই মায়ের কাছে সব। মায়ের বুকের হূদস্পন্দন তার কাছে পরিচিত। মায়ের বুকের দুধে, শরীরের উষ্ণতায় সবার বেড়ে ওঠা, তেমনিভাবে মা তার সন্তানকে আগলে ধরে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ফরাসি সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এবং মানবাধিকারকর্মী Victor Hugo (1802-1885) বলেন, “A mother’s arms are made of tenderness and children sleep soundly in them.”

সন্তানের কিছু হলে তা যেন সবার আগে বুঝতে পারে মা। শরীর খারাপ করলে, মন ভালো না থাকলে, যদি মায়ের সামনে আসা হয় কিভাবে যেন তিনি বুঝে ফেলে।একেই বলে মায়ের ভালোবাসা। একেই বলে মায়ের চাদরে শিশুর অকৃত্রিম ভালোবাসা।

 পিতার আবেগে শিশু

 প্রবাদ আছে, “এই পৃথিবীতে একমাত্র বাবাই এমন এক ব্যক্তি যে নিজের চেয়ে নিজের সন্তানকে এগিয়ে যেতে দেখতে চায়।” বাবা মানে আপনজন, বাবা মানে নির্ভরতা, বাবা মানে প্রখর রোদে শীতল ছায়া সমৃদ্ব উচু বটবৃক্ষ, গহীন অন্ধকারে আলোর মশাল| অনেক আদর, একটু শাসন, আদর–স্নেহ, পরম মমতায় আগলে রাখেন যে মানুষটি হলেন বাবা।

 শিশুর অধিকার

মার্কিন প্রকৃতিবাদী, নিবন্ধকার, কবি ও দার্শনিক ছিলেন Henry David Thoreau (1817 –1862) কতইনা অসাধারণভাবে বলেছেন, “Every child begins the world again.” একটি শিশু যেহেতু জন্মের মাধ্যমে নতুন  একটি পৃথিবী তৈরী করে, কাজেই আমাদের ও উচিত তাদের অধিকারের বিষয়ে সচেষ্ট হওয়া| কেননা আজকের শিশু আগামি দিনে জাতির সোনালী ভবিষ্যতের কর্ণধার| সুন্দর কল্যাণকর জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন সুন্দর পরিবেশ যেখানে জাতির ভবিষ্যত স্থপতিগণ সকল সম্ভাবনাসহ সুস্থ,স্বাভাবিক ও স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্নিক এবং সামাজিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারবে| শিশুদের জন্য এরূপ একটি পরিবেশ গঠন কারো দয়া বা অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না| এজন্য প্রয়োজন শিশুর অধিকার সম্বলিত উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তার সফল বাস্তবায়ন| এই বাস্তব সত্য উপলব্ধি করে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে শিশু অধিকারের উপর বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে| বাংলাদেশও পরিবর্তনশীল সময়ের দাবী অনুযায়ী শিশু অধিকারের উপর বিভিন্ন আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে|

যাহোক, শিশু অধিকার বলতে আমরা কী বুঝি? একটি শিশুর সুন্দর সুস্থ পরিবেশের মধ্য দিয়ে মনোদৈহিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার জন্যে যে সকল অধিকারের প্রয়োজন তাকে শিশু অধিকার বলে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম সকল মানবসন্তানই শিশু হিসেবে বিবেচিত। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের জাতির ভবিষ্যৎ। তারা শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের শিক্ষায়, চিন্তা চেতনায় ও মননে যত সমৃদ্ধ হবে জাতির ভবিষ্যৎ তত শক্তিশালী হবে। কিন্তু বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। দারিদ্র্যের কশাঘাতে বহু শিশু তাদের বেঁচে থাকার অধিকার, বিকাশের অধিকার, জীবনযাত্রার মান ভোগ ও বিনোদনের  অধিকার ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরা অভাবের তাড়নায় তাদের শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করছেন। আবার ছিন্নমূল শিশুরা পেটের তাগিদে নিজেরাই টোকাই হচ্ছে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নানা অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। শিশুদের এমন অবস্থায় আইন আছে, সরকারি-বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সনদ এবং প্রতিশ্রুতি আছে কিন্তু এগুলো প্রতিপালিত হচ্ছে না।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে তা হলো-

  • শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার, যেমন- স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার,বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ|
  • বিকাশের অধিকার, যেমন— শিক্ষার অধিকার, শিশুর গড়ে ওঠার জন্যে উপযুক্ত একটি জীবনযাত্রার মান ভোগের অধিকার, অবকাশযাপন, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার|
  • সুরক্ষার অধিকার, যেমন শরণার্থী শিশু, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন শিশু, শোষণ, নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এমন শিশুর অংশগ্রহণের অধিকার, যেমনঃ শিশুদের স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার, অন্যান্যের সঙ্গে অবাধে সম্পর্ক গড়ে তোলার অধিকার এবং তথ্য ও ধারণা চাওয়া-পাওয়ার অধিকার।

দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের শিশু অধিকার সনদের আলোচ্য সুবিধাগুলাতে বাংলাদেশের শিশুরা পাচ্ছে কি না তা ভেবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কারণ বাংলাদেশের অধিকাংশ শিশু তাদের প্রয়োজনীয় অধিকার পায় না। এমন অবস্থায় জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সবাইকে একটা ঐকমত্যে আসতে হবে। তাহলেই কেবল বাংলাদেশের শিশুরা তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে।

শিশুদের ভালোবাসা আল্লাহর ইবাদত| কেবল মা-বাবা হিসেবেই নয় সাধারণ মানুষ হিসেবেও শিশুর প্রতি সদয় হওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কেননা শিশুর প্রতি ভালোবাসার বদৌলতে  জাহান্নাম হারাম হয়ে জান্নাত আবশ্যক হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আল্লাহ তাআলা শিশুদের স্বার্থ রক্ষায় গর্ভধারিনী কিংবা দুগ্ধদানকারী মায়ের অনেক ফরজ ইবাদতও শিথিল করে দিয়েছেন। শিশুদের প্রতি মানুষের নিষ্পাপ ভালোবাসায় রয়েছে বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা বা দয়ার প্রতিফলন|  এ কারণেই আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন- ‘ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি পার্থিব জীবনের শোভা এবং স্থায়ী সৎকর্ম। তোমরা প্রতিপালকের পুরষ্কার পাওয়ার জন্য শ্রেষ্ঠ এবং কাঙ্ক্ষিত হিসেবেও উৎকৃষ্ট। (সুরা কাহাফ: আয়াত ৪৬)।

তাই আসুন, শিশু সন্তানের প্রতি সদয় হই। আল্লাহi বিধান পালনার্থে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এগিয়ে আসি।

লেখক ইংরেজি বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম।

 

 

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •