ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করাই নবী-রসূল প্রেরণ ও ঐশী গ্রন্থ অবতীর্ণের উদ্দেশ্য

0

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
لِّكَیْلَا تَاْسَوْا عَلٰى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوْا بِمَاۤ اٰتٰىكُمْؕ-وَاللّٰهُ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرِ ۙ ﹰ(۲۳) الَّذِیْنَ یَبْخَلُوْنَ وَ یَاْمُرُوْنَ النَّاسَ بِالْبُخْلِؕ-وَمَنْ یَّتَوَلَّ فَاِنَّ اللّٰهَ هُوَ الْغَنِیُّ الْحَمِیْدُ(۲۴) لَقَدْ اَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَیِّنٰتِ وَ اَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْمِیْزَانَ لِیَقُوْمَ النَّاسُ بِالْقِسْطِۚ-وَاَنْزَلْنَا الْحَدِیْدَ فِیْهِ بَاْسٌ شَدِیْدٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَ لِیَعْلَمَ اللّٰهُ مَنْ یَّنْصُرُهٗ وَرُسُلَهٗ بِالْغَیْبِؕ-اِنَّ اللّٰهَ قَوِیٌّ عَزِیْزٌ۠(۲۵) وَلَقَدْ اَرْسَلْنَا نُوْحًا وَّ اِبْرٰهِیْمَ وَ جَعَلْنَا فِیْ ذُرِّیَّتِهِمَا النُّبُوَّةَ وَالْكِتٰبَ فَمِنْهُمْ مُّهْتَدٍۚ-وَكَثِیْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ(۲۶)

হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী

আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমাঃ এ জন্য যে, দুঃখ করো না সেটার উপর যা তোমাদের হাতছাড়া হয় এবং খুশী না হও সেটার উপর, যা তোমাদের প্রদান করেছেন। আর আল্লাহ পছন্দ করেননা কোন দাম্ভিক, অহংকারীকে। (ঐসব লোক) যারা নিজেরাই কার্পণ্য করে এবং অন্যদের কার্পণ্য করতে বলে। আর যারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহ অভাবমুক্ত, সকল প্রশংসায় প্রশংসিত। নিশ্চয় আমি (অর্থাৎ আল্লাহ) আপন রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহকারে প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে কিতাব ও ন্যায় বিচারের পরিমাপযন্ত্র অবতীর্ণ করেছি যাতে লোকেরা ন্যায় বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং আমি (অর্থাৎ আল্লাহ) লোহা অবতীর্ণ করেছি,তাতে ভীষণ শক্তি ও মানবকূলের উপকার সমূহ রয়েছে। এবং এজন্য যে, আল্লাহ দেখবেন তাকেই, যে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমতাবান, পরাক্রমশালী। এবং নিশ্চয় আমি (আল্লাহ) হযরত নূহ ও হযরত ইব্রাহীম কে প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সন্তানদের মধ্যে নবুওয়ত ও কিতাব রেখেছি। সুতরাং তাদের মধ্যে কেউ সঠিক পথের উপর এসেছে এবং তাদের মধ্যে অনেকে ফাসিক্ব (পাপাচারী)।
[২৩-২৬নং আয়াত, সূরা আল-হাদীদ]

আনুষঙ্গিক আলোচনা
لِّكَیْلَا تَاْسَوْا عَلٰى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوْا بِمَاۤ اٰتٰىكُمْؕ-
وَاللّٰهُ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُوْرِ
আলোচ্য আয়াতে কুরআনের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরিনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-জাগতিক জীবনে মানবকুল যে বিপদাপদ, বালামুসিবত কিংবা আনন্দ-আহ্লাদ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ ইত্যাদির সম্মুখীন হয় তা সবই মহান আল্লাহ লাওহে-মাহফুযে মানুষের জন্মের পূর্বেই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। সুতরাং দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হয়ে আফসোস-আক্ষেপ করা সবর এর পরিপন্থী। আবার খোদায়ী অনুগ্রহ-অনুকম্পা পেয়ে শুকর-কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠাও কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনার বিপরীত। বরং পার্থিব জীবনে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ তেমন আক্ষেপ ও পরিতাপের বিষয় নয় এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থসম্পদ তেমন উল্লাসিত ও মত্ত হওয়ার বিষয় নয় যে, এগুলোতে মশগুল হয়ে বান্দা আল্লাহর স্মরণ ও পরকাল সম্পর্কে গাফেল হয়ে যাবে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ সূরা আল-বাকারায় এরশাদ করেছেন-
ولنبلونكم بشيء من الخوف والجوع ونقص من الأموال والأنفس والثمرات وبشر الصابرين
অর্থাৎ আমি আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, সম্পদ ও প্রাণের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। আর সুসংবাদ দিন সবরকারীদের।
রাসূলে করীম রউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে পাকে এরশাদ করেছেন-
الايمان نصفان نصف صبرو نصف شكر অর্থাৎ ঈমান দুই অর্ধাংশের সমষ্টি। প্রথমার্ধ হলো ধৈর্য্য আর দ্বিতীয়ার্ধ হলো শোকর তথা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। ইহকালীন জীবনে ঈমানদার দুর্যোগ-দুর্বিপাক কিংবা দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কৃপা-করুণার উপর দৃঢ় নির্ভরশীল হয়ে সবর অবলম্বন করবে। কোনরূপ হা-হুতাশ বা আফসোস-আক্ষেপ করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। আবার খোদায়ী নেয়ামত-রহমত পেয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অর্জিত হলে কৃতজ্ঞচিত্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণ-আনুগত্যে মশুগুল হবে মুমিন। কোন প্রকার আনন্দ উল্লাস তথা অহংকার প্রদর্শনে লিপ্ত হওয়া ঈমানী বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা। সবর আর শোকরই হলো ঈমানের পরিপূর্ণ রূপ।

সবর এর তাৎপর্য
আভিধানিক অর্থে সবর মানে সংযম অবলম্বন ও নাফসের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ। পবিত্র কুরআনে করীম আর হাদীসে নববীর পরিভাষায় ‘সবর’ এর তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথমত: নফসকে হারাম এবং নাজায়েজ বিষয়াদি থেকে বিরত রাখা। দ্বিতীয়তঃ এবাদত ও আনুগত্যে নফসকে বাধ্য করা এবং তৃতীয়তঃ যে কোন বিপদাপদ ও সংকটময় মূহুর্তে ধৈর্য ধারণ করা। অর্থাৎ যে সব বিপদাপদ এসে উপস্থিত হয় সেগুলোকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত বিধান বলে মেনে নেওয়া এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর তরফ হতে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা। অবশ্য কষ্টে পড়ে যদি মুখ থেকে কোন কাতর শব্দ উচ্চারিত হয়ে যায় কিংবা অন্যের কাছে তা প্রকাশ করা হয়, তবে তা সবর এর পরিপন্থী নয়। [তাফসীর ইবনে কাছীর] ‘সবর’ এর উপরোক্ত তিনটি স্তরই প্রত্যেক মুসলমানের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। সাধারণ মানুষের ধারনায় স্বভাবতঃ সবর এর তৃতীয় স্তরকেই সবর হিসাবে গণ্য করা হয়। প্রথমত দুটি স্তর যে এ ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে মোটেও লক্ষ্য করা হয়না। এমনকি এ দুটি স্তরও যে সবর এর অন্তর্ভূক্ত ধারণাও যেন অনেকের নেই। কুরআন-হাদীসের পরিভাষায় ধৈর্য্যধারণকারী বা সাবির সে সমস্ত লোককেই বলা হয়, যারা উপরোক্ত তিন স্তরেরই সবর অবলম্বন করে। কোন কোন রেওয়ায়তে উল্লেখিত রয়েছে-হাশরের ময়দানে ঘোষণা করা হবে-“ধৈর্য্যধারণকারীরা কোথায়?” এ কথা শুনার সঙ্গে সঙ্গে সে সব লোক উঠে দাড়াবে যারা তিন স্তরেরই সবর অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করে দিয়েছেন। এসব লোককে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে। ইমাম ইবনে কাছীর এ রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন যে, কুরআনের অন্যত্র এরশাদ হয়েছে- انما يوفى الصابرون اجرهم بغير حساب
অর্থাৎ সবরকারী বান্দাগণকে তাদের পুরষ্কার বিনা হিসাবে প্রদান করা হবে। এ আয়াতে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাছীর)
সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন: প্রত্যেক মানুষ স্বাভাবগতভাবে কোন কোন বিষয়ের কারণে অনন্দিত এবং কোন কোন বিষয়ের কারণে দুঃখিত হয়। কিন্তু যা উচিৎ তা হলো, বিপদের সম্মুখীন হলে সবর করে পরকালের পুরষ্কার ও সওয়াব অর্জন করতে হবে এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দের সম্মুখীন হলে কৃতজ্ঞ হয়ে পুরষ্কার ও সাওয়াব হাসিল করতে হবে।
(তাফসিরে রুহুল মায়ানি শরিফ)

لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِٱلْبَيِّنَـٰتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ
উপরিউক্ত আয়াতের তাফসীরে মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-অসংখ্য নবী-রসূল প্রেরণ, তাঁদের মাধ্যমে ঐশী মহা গ্রন্থ অবতীর্ণ করান এবং ন্য্যয়নীতির পরিমাপযন্ত্র দাঁড়িপাল্লা আবিস্কার ও ব্যবহারের আসল লক্ষ্য হলোليقوم الناس بالقسطঅর্থাৎ মানবকূল যাতে ন্যায় ও সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এরপর লৌহ অবতীর্ণ করার প্রসঙ্গ এরশাদ হয়েছে। এর লক্ষ্য ও প্রকৃতপক্ষে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। কেননা আম্বিয়ায়ে কেরাম আলায়হিমুস্ সালাম ও আসমানি কিতাব সমূহ ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রমাণাদি দান করেন এবং যারা সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেনা তাদেরকে পরকালের শাস্তির ভয় প্রদর্শন করেন। মীযান বা দাড়িপাল্লা সুবিচারের সীমা ব্যক্ত করে। কিন্তু যারা অবাধ্য তারা কোন প্রমাণ মানেনা এবং ন্যায়নীতি অনুযায়ী কাজ করতে সম্মত হয়না। তাদেরকে স্বাধীন ছেড়ে দেওয়া হলে পৃথিবীতে ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করা সূদুর পরাহত। তাদেরকে বশে আনা লৌহও তরবারীর কাজ, যা শাসকবর্গ অবশেষে বেগতিক হয়ে ব্যবহার করে। আরো লক্ষ্যনীয় বিষয় এইযে, কুরআনে করীমের দ্বারা ইনসাফ ও সুবিচার, দেনা-পাওনা পরিশোধ ও তাতে হ্রাস-বৃদ্ধির নিষেধাজ্ঞা জানা যায় এবং মীযান দ্বারা অপরের দেনা-পাওনার অংশ নির্ধারিত হয়। এই আসমানী কিতাব ও মীযান নাযিল করার লক্ষ্যই হচ্ছে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। এরপর লৌহের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে লৌহর ব্যবহার বেগতিক অবস্থায় করতে হবে। এটা ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার আসল উপায় নয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মানুষ কে ন্যায় ও সুবিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত করা প্রকৃতপক্ষে চিন্তাধারায় লালন ও শিক্ষার মাধ্যমে হয়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জোর-জবরদস্তি প্রকৃতপক্ষে এ কাজের জন্য নয়: বরং পথের বাধা দূর করার জন্য ব্যবহৃত হয় বেগতিক অবস্থায়। চিন্তাধারার লালন ও শিক্ষা-দীক্ষাই আসল বিষয়।

وَلِيَعْلَمَ ٱللَّهُ مَن يَنصُرُهُۥ وَرُسُلَهُۥ بِٱلْغَيْبِ
তাফসীরে রুহুল মায়ানী শরীফে রয়েছে-এখানে ওয়াও অব্যয়টি এই বাক্যকে একটি উহ্য বাক্যের, সাথে সংযুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ لينفعهم আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, আমি লৌহ-সৃষ্টি করেছি যাতে শত্রুদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়, মানুষ এর দ্বারা শিল্পকাজে উপকৃত হয় এবং আইনগতভাবে ও বাহ্যিকভাবে আল্লাহ জেনে নেন যে, কে লৌহের সমরাস্ত্র দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণ কে সাহায্য করে ও ধর্মের জন্য জিহাদ করে। আইনগতভাবে ও বাহ্যিকভাবে বলার কারণ এই যে, আল্লাহ তায়ালা সবকিছু পূর্বেই জানেন। কিন্তু মানুষ কাজ করার পর তা আমল নামায় লিখিত হয়। এর মাধ্যমেই কাজটি আইনগত প্রকাশ লাভ করে।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •