মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম
সত্য-মিথ্যার লড়াই সর্বকালের। সত্য বিজয়ী, আর মিথ্যা পরাজিত। পবিত্র ক্বোরআনুল কারীমে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন: وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا
“এবং বলুন, ‘সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই ছিল।”
(তরজমা-ই কানযুল ঈমান)
আল্লাহ্ তা‘আলার প্রিয়জন তথা আউলিয়া-ই কিরামের পদধুলিতে ধন্য আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। ইসলামের সুমহান সত্য ও সুন্দর বাণী পৌছিয়ে দিয়ে তাঁরা এদেশের মানুষকে ইসলামের মূলধারা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আত’-এর আদর্শে উজ্জীবিত করে তোলেন এবং তাদের অন্তরসমূহে ঈমানের মূল নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রেম ও ভালবাসার প্রদীপ জ্বালাতে সক্ষম হন। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা থেমে নেই। তারা এ প্রদীপ নিভিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সঠিক পথের পথিকদের ভুলপথে দিকভ্রান্ত করতে ইসলামের চরম শত্রু ইহুদি-নাসারাদের মদদপুষ্ট বাতিল ফির্কারা বিভিন্ন ধরণের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন প্রভৃতি দাঁড় করিয়ে ক্বোরআন-সুন্নাহ্র অপব্যাখ্যা দিয়ে সরলপ্রাণ মু’মিন-মুসলমানদের ঈমান হরণ করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে।
এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে সতর্কবাণী দিয়ে ইরশাদ হয়েছে:
إِنَّ هَذَا الْعِلْمَ دِينٌ، فَانْظُرُوا عَمَّنْ تَأْخُذُونَ دِينَكُمْ.
“নিশ্চয় এ ইল্ম হলো দ্বীন। কাজেই কার কাছ থেকে তোমরা দ্বীন গ্রহণ করছো তা যাচাই করে নাও।”
সুতরাং সঠিক জ্ঞানচর্চা ও সরলপ্রাণ মু’মিগণের ঈমান রক্ষায় ‘জামেয়া’র ন্যায় দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ক্বুতবুল ইরশাদ, সায়্যিদুল আউলিয়া, শাহানশাহে সিরিকোট আলে রসূল , সায়্যিদ আহমদ শাহ সিরিকোটী ১৯৫৪ সালে বাতিল ফির্কার সর্বপ্রকারের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে এবং সত্যিকার নায়েব-ই রসূল ‘সাচ্চা আলিম’ তৈরীর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া’।
‘জামেয়া’ প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
পঞ্চাশের দশকের কোন এক সময় হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট ত্বরীক্বত ও হিদায়ত প্রচারের লক্ষ্যে শহর থেকে দূরে বাঁশখালী থানার দুর্গম এলাকা শেখেরখীল গ্রামে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। সেখানকার অধিবাসী হুযূর ক্বেবলার অত্যন্ত নিষ্ঠাবান মুরীদ মাওলানা মরহুম এজহার সাহেবসহ এলাকার লোকজন সংগঠিত হয়ে একটি ওয়ায মাহফিলের আয়োজন করলেন। মাহফিলে আমন্ত্রিত প্রধান আকর্ষণ ও ওয়া-ইযহিসেবে হুযূর ক্বেবলা তাশরীফ রেখে নূরানী তাক্বরীর আরম্ভ করলেন। তাক্বরীরের প্রারম্ভে তিনি হামদ ও সালাতের পর পবিত্র ক্বোরআনের ওই আয়াত শরীফ তিলাওয়াত করলেন, যাতে আল্লাহ্ তা‘আলা প্রিয়নবী হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি’র উপর দুরূদ ও উত্তমরূপে সালাম পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আয়াতটি হলো-
إِنَّ اللّٰهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِيِّ يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا.
‘নিশ্চয় আল্লাহ্ ও তাঁর ফিরিশতাগণ নবীর উপর দুরূদ পড়ছেন, হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর উপর দুরূদ পড়ো এবং অতি উত্তমরূপে সালাম পড়ো।” অর্থাৎ নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি দুরূদ ও সালাম পড়ার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত শরীফটি তিলাওয়াত করার পর মজলিসে উপস্থিত সুন্নী মুসলমানগণ ব্যতীত অন্য লোকেরা দুরূদ ও সালাম তো পড়লোনা, বরং তা নিয়ে উপহাস করলো। আল্লাহ্র নির্দেশের তাদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা ও আল্লাহ্র হাবীবের শান-মানের প্রতি এহেন জঘন্য অবজ্ঞা দেখে হুযূর ক্বেবলা আলায়হির রাহমাহ্ একদিকে মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর বেলায়তী দৃষ্টিতে দেখতে পান যে, এদেশে ইসলামী লেবাসে দুশমনে রসূল’র অশুভ অনুপ্রবেশ ঘটেছে, যাদের যথা সময়ে খন্ডন ও প্রতিহত করা না হলে এতদঞ্চলের মানুষের ঈমান-আক্বীদাহ ও আমল হুমকির মুখে পড়বে। তাই বাতিল ফির্কার বিরুদ্ধে আদর্শিক মেধাভিত্তিক লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবেই শাহানশাহে সিরিকোটের বরকতময় হাতে তৎকালীন ‘নয়া মাদরাসা’ এ ‘জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মাদ্রাসার জায়গা নির্ধারণ, ভবন নির্মাণ ও পৃষ্ঠপোষকতা
জায়গা নির্ধারণ, ভিত্তি স্থাপন থেকে শুরু করে এর যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে হযরত সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি যেন অদৃশ্য কারো ইঙ্গিতের অনুসরণ করছিলেন। তাঁর ঘোষণা অনুসারে “শহর ভি নাহো, গাঁও ভি নাহো, মসজিদ ভি হ্যায়, তালা-ব ভি হ্যায়”- তথা মাদ্রাসাটি এমন জায়গায় হবে, যা (অজ) গ্রামও হবে না, (একেবারে কোলাহলপূর্ণ) শহরও হবে না। সেখানে মসজিদও থাকবে, পুকুরও থাকবে। মাদরাসার জন্য অগ্রিম স্থান চয়ন হুযূর ক্বেবলার বাস্তবরূপী কারামতই ছিল। হুযূর ক্বেবলা একদিন সরাসরি নাজিরপাড়া দায়েম-নাজির জামে মসজিদে নামাযের পর তাশরীফ রাখলেন। মাদ্রাসার এ স্থানটি তিনি পছন্দ করলেন। আলহামদুলিল্লাহ্! হুযূর ক্বেবলার এ কারামতটি এ ঘটনা থেকেও সুস্পষ্ট হয় যে, বর্তমান জামেয়া ভবনের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ বসত-ভিটায় বসবাসরত স্বনামধন্য মরহুম মুহাম্মদ সৈয়দ মেম্বারের মজযূব-নেককার পিতা মরহুম মোনাফ খলীফা বর্তমান মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাপূর্ব খালি উলুবন বিশিষ্ট জমিটার পার্শ্ব দিয়ে যাবার সময় প্রায়শ বলতেন, “এ জায়গা থেকে ইল্মের খুশবু আসছে।”
এবার মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের পালা। হুযূর ক্বেবলা এ যুগান্তকারী কর্মের জন্য চয়নকৃত সৌভাগ্যবান বান্দাদের অন্তরকে তাঁর বিলায়তী শক্তি দিয়ে এদিকে দ্রুত আকৃষ্ট করে এ জান্নাতী কাফেলায় শামিল করেছিলেন। সুতরাং দেখা গেল যে, আমাদের হক্ব সিলসিলার শীর্ষস্থানীয় মুরব্বীদেরও তখন একমাত্র প্রচেষ্টা ছিল আপন মুর্শিদে বরহক্বের সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমেই আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলকে রাযি করে নিবেন। হুযূর ক্বেবলাও তখন পরামর্শ করার সুন্নাতটুকু পালন করেছিলেন। উপস্থিত মুরব্বীদের নিকট থেকে প্রস্তাব আসতে লাগলো। কেউ বললেন, প্রাথমিক পর্যায়ে বাঁশের ঘরে সুন্নিয়তের কিল্লাটি নির্মিত হোক, কেউ বললেন, সেমিপাকা ঘরে মাদ্রাসাটির সূচনা হোক ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তখন এ কথাই সুস্পষ্ট হলো যে, যতক্ষণ পর্যন্ত পাকা মনোরম বিল্ডিং-এ ‘জামেয়া’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি পাকাপোক্ত হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত হুযূর ক্বেবলাও সন্তুষ্ট হবেন না। ঠিক তখনই জামেয়া-আন্জুমান প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি, আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন মুরব্বী আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আল্-ক্বাদেরী হুযূর ক্বেবলার মর্জি অনুসারেই সবিনয় আরয করলেন, “জামেয়া পাকা দালানেই হবে।” এবং তিনি সর্বাপেক্ষা ব্যয়বহুল আইটেমটি দানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। সাথে সাথে হুযূর ক্বেবলার নূরানী চেহারায় হাসির ঝলক প্রস্ফূটিত হলো। তারপর অন্যান্য মুরব্বীদের প্রতিশ্রুতি আসতে শুরু করলো। তাঁদের মধ্যে আল্হাজ্ব আমিনুর রহমান আল্-ক্বাদেরী, আলহাজ্ব ওয়াজের আলী সওদাগর, আলহাজ্ব আকরাম খাঁ, আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম সওদাগর প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এতে হুযূর ক্বেবলা খুশি হলেন এবং সবার জন্য বিশেষ দো‘আ করলেন।
এ মাদ্রাসার পৃষ্ঠপোষকতা কে কোত্থেকে করবেন সে সম্পর্কে তিনি অনেক রহস্যময় মন্তব্য করেছিলেন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ মাদরাসা পরিচালনার ভার স্বয়ং আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করেছেন বলে তিনি তাঁর মুরীদদেরকে অভয় দেন। তিনি বলেন- “আমার কানে আওয়াজ আসছে যে, “ইয়ে নয়া মাদরাসা হাম খোদ চালাওঙ্গা” অর্থাৎ এই নতুন মাদরাসা আমি নিজেই চালাবো। সত্যিকার অর্থেই এ মাদরাসা চলছে যেন অদৃশ্য শক্তির ব্যবস্থাপনায়। টাকা-পয়সা যখন যা প্রয়োজন তা ভাবনা-চিন্তা করতে না করতেই চলে আসছে। শুধু মাদরাসার টাকা নেয়ার জন্যই আজ আলাদা অফিস খুলে বসতে হয়েছে। কত চেনা-অচেনা লোক এসে হাদিয়া, সাদক্বাহ, মান্নত, নিয়্যতের টাকা, যাকাত-ফিতরা ইত্যাদির টাকা দিয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। মান্নতকারীদের আশাভঙ্গ করেনা এ জামেয়া -তাই, আজ জামেয়ার মান্নত পূর্ণ হওয়ার কথা মানুষের মুখে মুখে। শাহ্ সিরিকোটী বলেছিলেন- “ মুঝসে মুহাব্বত হ্যায় তো, মাদ্রাসা (জামেয়া) কো মুহাব্বত করো, মুঝেহ দেখনা হ্যায় তো, মাদ্রাসা (জামেয়া) কো দেখো, ”ভ্রান্ত মতবাদীদের বিরুদ্ধে ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়তকে বিজয়ী করতে ইশ্ক্বে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ভিত্তিতে এ মাদরাসা তৈরি করেছিলেন। ফলে, আজ ভেজাল থেকে আসল ইসলামকে পার্থক্য করার অতন্দ্র প্রহরী ‘সাচ্চা আলিম’ বের হচ্ছে এ মাদ্রাসা থেকে।
জামেয়া প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্য
শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি আলায়হি জামেয়ার ভিত্তি ইসলামের প্রকৃত ‘মতাদর্শ’ আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের বাস্তব রূপরেখা ‘মসলকে আ’লা হযরত’-এর উপর রাখেন। স্বয়ং তিনি ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের সময় ইরশাদ করেন: ‘ইস মাদ্রাসা কী বুনিয়াদ মসলকে আ’লা হযরত পর ঢালী গেয়ী।’ এরপর তিনি যে নূরানী বাণী ইরশাদ করেছেন, তা থেকে জামেয়া প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়- ‘‘কাম করো, ইসলামকো বাঁচাও, সাচ্চা আলিম তৈয়ার করো।’’ অর্থাৎ ‘‘কাজ করো, দ্বীন-ইসলামকে রক্ষা করো, সাচ্চা আলিম তৈরী করো।’’ কাজও কীভাবে করবে সেটার রূপরেখাও তিনি নিজে দিয়েছেন। ‘‘জামে‘আহ্ কী খিদমত কো আপ জুমলাহ্ ভাইয়ো! নম্বরে আউয়াল মে রাখো, বাক্বী দুনিয়াকে ধান্ধেঁ আওর কামোঁ কো দো-সেরে তে-সরে নম্বর মে রাখো। এসী হিসাব সে আপ ভাইয়োঁকে সা-থ ভী আয়সা মু‘আ-মালাহ্ হোগা।’’ আপকে তামাম নেক কামোঁ কো এসী তারতীব সে সর আন্জাম দিয়া জায়েগা। ইনশা-আল্লাহ্! অর্থাৎ জামেয়ার খিদমতকে আপনারা, সব ভাই, প্রথম নম্বরে রাখো, দুনিয়ার বাকী কাজ-কারবারকে দ্বিতীয়, তৃতীয় নম্বরে রাখো, এ-ই অনুপাতে আপনারা সব ভাইয়ের সাথেও এমন আচরণ করা হবে, আপনাদের সমস্ত নেক কাজ এ অনুপাতে সম্পন্ন হবে। ইনশা-আল্লাহ্!’’ সুতরাং সত্যিকার নবীপ্রেমিক আলিম-ই দ্বীন তৈরী করা জামেয়া প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
জামেয়ার জন্য সুদক্ষ পরিচালক নিয়োগ
‘জামেয়া’র মহান প্রতিষ্ঠাতা প্রথমে জোর দিলেন আদর্শ ও উদ্দেশ্যের নির্ভেজাল ও সুদক্ষ পরিচালক নিয়োগের উপর। সুতরাং জামেয়ার সর্বপ্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিলেন উপমহাদেশের অপ্রতিদ্বন্ধী বুযুর্গ আলিম ও আ’লা হযরতের মসলকের একজন মহান ব্যক্তিত্ব হযরতুল আল্লামা মুফতী ওক্বার উদ্দীন রেযভীকে। এরপর অধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত হলেন একই মসলকের আরেক অতি দক্ষ আলিম-ই দ্বীন হযরতুল আল্লামা নসরুল্লাহ্ খান। এরপর থেকে জামেয়ার জন্য সুযোগ্য অধ্যক্ষ ও যুগশ্রেষ্ঠ ওস্তাদমন্ডলী নিয়োগের পরম্পরা অব্যাহত রেখেছেন। তাঁরা যেমন সাচ্চা আলিম ছিলেন, তেমনি তাঁরা ছিলেন, সাচ্চা আলিম তৈরী করার সুদক্ষ কারিগরও। কোন প্রতিষ্ঠানের সাফল্য ও উত্তরোত্তর উন্নতি নির্ভর করে সুযোগ্য উত্তরসুরী পৃষ্ঠপোষক নিয়োজিত হওয়ার উপরও। অতি সৌভাগ্যের বিষয় যে, শাহানশাহে সিরিকোট তাঁর সুযোগ্য ও সুদক্ষ উত্তরসূরী ও খলীফা হিসেবে রেখে গেছেন মাদারযাদ ওলী ও যুগশ্রেষ্ঠ আলিম ও হাফেয হুযূর ক্বেবলা হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ সাহেবকে, তাঁরই নূরানী হাতে অর্পিত হয়েছে শরীয়ত, ত্বরীক্বত ও জামেয়ার যথাক্রমে খিলাফত ও পৃষ্ঠপোষকতা। সুতরাং হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রহমাহ্ এ জামেয়াকে এমন পৃষ্ঠপোষকতা ও কৃপাদৃষ্টি দ্বারা ধন্য করলেন যে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেটাকে ‘কাশ্তী-ই নূহ’ (হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম-এর নৌযান) ও ‘জান্নাত-নিশান’ (বেহেশত-সদৃশ্য) ঘোষণা করেছেন।
শ্রেষ্ঠ ও সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া
সুন্নীয়তের প্রাণকেন্দ্র ‘জামেয়া’ দেশের যে কোন মহলের যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে শিক্ষার উচ্চতর মানের কারণে সর্বমহলে বিনা বিতর্কে প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে ভূমিকা রাখায় সরকারের জরিপ ও পর্যবেক্ষণে এ মাদরাসা একাধিকবার ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’র স্বীকৃতি ও মডেল মাদরাসার গৌরব অর্জন করেছে। জামেয়ার অধ্যক্ষ মহোদয়, উপাধ্যক্ষ মহোদয় ও প্রধান ফক্বীহ সাহেব এবং মেধাবী শিক্ষার্থীরা যথাক্রমে ‘শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ’, ‘শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক’ ও ‘শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী’ নির্বাচিত হয়ে সম্মাননা সনদ ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। সম্প্রতি থানা পর্যায়ে ‘জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০২২’ প্রতিযোগিতায় জামেয়ার সম্মানিত উপাধ্যক্ষ মহোদয় ‘শ্রেষ্ঠ শ্রেণি শিক্ষক’ মনোনীত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। এছাড়াও ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত জ্ঞান প্রতিযোগিতায় ক্বিরাআত, হামদ, নাত, রচনা প্রভৃতি বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করছে জামেয়ার মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এর দ্বারা দেশ-বিদেশে জামেয়ার গৌরব ও খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। এসব সাফল্য অর্জন হুযূর ক্বেবলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র কৃপাদৃষ্টিরই বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহ্ তা‘আলা জামেয়ার এ গৌরব ও খ্যাতি আরো সমৃদ্ধ করুন।
জামেয়ার অন্যন্য বৈশিষ্ট্য
শিক্ষার্থীদের মেধা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসায় যুগোপযোগি পদ্ধতিতে শিক্ষা দেয়া হয়। ইলম ও আমল-এর সমন্বয়ের লক্ষ্যে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার তা’লীম তরবিয়াতে গুরুত্ব দেয়া হয়। ব্যক্তি এবং সমাজ জীবন ও কর্মে ইসলামের মূল রূপরেখা সুন্নিয়াত বাস্তবায়নে গুরুত্বারোপ করা হয়। প্রতি বছর আল্লাহ্ তা‘আলা ও রাসূলের মেহেরবানীতে কামিল হাদীস ও ফিক্বহ্ ২য় বর্ষের ছাত্ররা সহীহ্ বুখারী শরীফ ও কিতাবুল আশ্বাহ্ ওয়ান নাযায়ির সিলেবাস সম্পন্ন করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আসছেন। সম্মানিত শিক্ষকম-লী নিষ্ঠার সাথে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি ‘তাখাস্সুস ক্লাস’ (বিশেষ পাঠদান শ্রেণিকার্যক্রম)-এ শ্রেণিকক্ষ ও আলমগীর খানক্বাহ শরীফে বা’দ যুহর, বা’দ মাগরিব ও বা’দ ‘ইশা সহীহ্ বুখারী শরীফ ও কিতাবুল আশ্বাহ্ ওয়ান নাযায়ির, আরবী ব্যাকরণের মৌলিক গ্রন্থাবলি বিশেষত: নাহু, সরফ, বালাগাতসহ গুরুত্বপূর্ণ কিতাবসমূহের পাঠ সম্পন্ন করেন। আর এটি হুযূর ক্বেবলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সদয় নির্দেশেই পরিচালিত হয়ে আসছে। হুযূর ক্বেবলা হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর পবিত্র হস্তে লিখিত ও প্রেরিত ২৩ রবিউল আখির, ১৪০১হি./২৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮১ ইংরেজি তারিখের চিঠি শরীফের এক পর্যায়ে লিখেছেন- (তরজমা)
অর্থাৎ ‘‘আপনাদের প্রতি আমার নিষ্ঠাপূর্ণ আপীল হচ্ছে ‘আপনারা জামেয়ার ছাত্রদের শিক্ষাগত অবস্থার প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করুন, যাতে তারা সরফ, নাহভ ও অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ে এত বেশি যোগ্যতা অর্জন করতে পারে যেন শিক্ষাগ্রহণ করে শিক্ষাদান করতে গিয়ে এবং মুনাযারা বা তর্কযুদ্ধে গিয়ে সহীহ্ ইবারত পাঠ ও বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে। তারা যেন বাতিল ফির্ক্বাগুলোর মূলোৎপাটন করতে পারে। তারা যেন শুধু নিজেরা সুন্নী হয়ে ক্ষান্ত না হয়ে ‘সুন্নীগর’ (সুন্নীতে পরিণতকারী) হতে পারে। এখান থেকে যেন বাতিল বা মিথ্যার সাথে জিহাদ করতে সক্ষম হয়ে (শেষ সনদ নিয়ে) বের হতে পারে। আপনাদেরই রং যেন তাদের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এসব আলিম মাসলাকের (সুন্নী মতাদর্শ)-এর যে কোন প্রান্তে পৌঁছে যায়, নির্দ্বিধায় মসলকের খিদমত করতে পারে। মসলকের সহীহ্ খিদমতই হযরাতে কেরাম আলায়হিম আজমা‘ঈনের মহান উদ্দেশ্য। যদি আমাদের নিজেদের মাদরাসাগুলো থেকে যোগ্য আলিম তৈরী না হয়, তবে এ শূন্যতা কোত্থেকে পূরণ হবে?
গবেষণা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা
হুযূর ক্বেবলার নির্দেশে জামেয়ার ছাত্রদের যুক্তিশীল ও বাগ্মীতায় পারদর্শী করার লক্ষ্যে সাপ্তাহিক জল্সাহ্ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিষয়ভিত্তিক তথ্য সম্বলিত বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ছাত্ররা অংশ নিয়ে থাকে। বিতর্কের মাধ্যমেও ছাত্রদের মেধার বিকাশ ঘটে। জামেয়া-ই অন্যতম মাদরাসা, যেখানে নাহ্ভ-সরফ ও আক্বাইদের বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের ব্যবস্থা রয়েছে। নির্ধারিত বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন এবং প্রত্যেক ছাত্রের জন্য মীলাদ ক্বিয়াম পরিবেশন, হামদ-না’ত শিক্ষা, ওয়ায, ফাত্ওয়া-ফরায়েয প্রণয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ, সাধারণত একজন দক্ষ আলিমের দায়িত্বে থাকে শিক্ষকতা, দ্বীনী কিতাবাদি রচনা/প্রণয়ন, ফাত্ওয়া প্রদান, ফরায়েয লিখন ও ওয়ায-নসীহত ইত্যাদি। এ থেকে ইসলামের মৌলিক আক্বীদাহ্গত বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্ররা ক্রমশঃ দক্ষ তার্কিক ও যুক্তিবাদী হয়ে উঠছে।
অতএব, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার সুমহান লক্ষ্য হচ্ছে- ইসলামের মূল রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের আক্বীদায় বিশ্বাসী মাসলাকে আ’লা হযরতের উপর আস্থাশীল, নবীপ্রেমে উজ্জীবিত হাক্কানী রাব্বানী আলিম সৃষ্টি করা। তাঁদের মাধ্যমে মানুষের মনে আল্লাহ্ভীতি, নবীপ্রেম এবং আউলিয়ায়ে কেরামের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা সৃষ্টি করে দ্বীনের সহীহ খিদমত আঞ্জাম দেয়া। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে এ মহান নি’মাতকে মনেপ্রাণে ভালোবাসা এবং সেটার কল্যাণে সর্বোচ্চ অবদান রাখার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন, বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন।
—০—
তথ্যসুত্র:
১। স্মারক: আসলাফ-ই জামেয়া, প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৭ খৃষ্টাব্দ
২। আনজুমান ও জামেয়া প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট, কৃত: মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান, স্মারক: স্মরণীয়-বরণীয়
৩। আনজুমান ওয়েবসাইট (old.anjumantrust.org)
পরিচালক: আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।