বিস্ময়কর জ্ঞান তাপস শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী

0

অধ্যক্ষ মাওলানা হাফেজ কাজী আব্দুল আলীম রিজভী

শেরে মিল্লাত, মূফতীয়ে আহলে সুন্নাত, শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতী মুহাম্মদ ওবায়দুল হক নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি সালফে ছালেহীনের আদর্শ-লক্ষ্য, ধ্যান-জ্ঞান ধারক, মুসলিম মনীষী ছিলেন। তিনি একাধারে একজন বিজ্ঞ ও ইখলাস (একনিষ্ঠতা) সমৃদ্ধ ক্ষণজন্মা মনীষী, হাদীসশাস্ত্র বিশারদ, গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ও সূক্ষ্মদর্শী ফিক্হ শাস্ত্রবিদ, বিদগ্ধ তাফসীর বিশেষজ্ঞ। শিক্ষার্থীদের নিকট পিতৃস্নেহ সমৃদ্ধ আদর্শ শিক্ষাগুরু, সর্বস্তরের সুন্নী জনতার কাছে অন্তরের গহীনে খালেস নবীপ্রেম সরবরাহকারী আশেকে রাসূল, ওয়ায়িজ। বাতিলের মোকাবিলায় অসাধারণ বাগ্মীতা ও প্রত্যুৎপন্নতার অধিকারী অনলবর্ষী তর্কবাগিস। দেশে ও প্রবাসে শানে রেসালাত ও শানে বেলায়তের প্রচার-প্রসারে নিঃস্বার্থ ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মবীর ইত্যাদি বহুবিধ গুন-গরিমা, বিজ্ঞতা ও যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন। ঈমান-আকিদার প্রশ্নে সদা আপোষহীন, নবীদ্রোহী অলী বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে নিরন্তর ব্যঘ্র গর্জনে গর্জে উঠা, সুন্নিয়তের খেদমতে দিবা-নিশি অতন্দ্র ও অনিদ্র রজনি অতিবাহিত করা ইত্যাদি বিরল ও ব্যতিক্রমধর্মী বৈশিষ্ট্যের কারণে আল্লামা নঈমী (রহ.) স্বদেশে-পরদেশে, সমাজের উচু-নিচু, শিক্ষিত ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর নিকট সর্বাধিক সমাদৃত, গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় ছিলেন। ইল্মে দ্বীনের চলমান বিশ্বকোষ আল্লামা নঈমী (রহ.) এর সুদীর্ঘ আটাত্তর বছরের সমৃদ্ধ ও বর্ণাঢ্য জীবন দুটো মহা মূল্যবান বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল। ইল্মে দ্বীন অর্জন এবং নিরলস সাধনায় অন্যের নিকট বিতরণ। এ দুয়ের বাইরে অন্য কোনো বিশেষ কর্মে কিংবা লক্ষ্যে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়নি। আর এজন্যই হলো হাদীসে নববী শরীফ تعلموا العلم وعلموه الناس “অর্থাৎ তোমরা ইল্মে দ্বীন অর্জন করো এবং তা অন্যকে শিক্ষা দান করো।” এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বিরল প্রতিভা ও তীক্ষ্মমেধার অধিকারী মুফতীয়ে আজম আল্লামা নঈমী (রহ.) তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ওয়াজেদীয়া আলিয়া ও উপমহাদেশের খ্যাতনামা দ্বীনী শিক্ষার আধার সরকারি মাদ্রাসায়ে আলিয়া ঢাকা হতে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ ডিগ্রী কামিল হাদিস ও কামিল ফিক্হ ডিগ্রী খ্যাতি ও কৃতিত্বের সাথে অর্জন করার পরও তাঁর জ্ঞান তৃষ্ণা অতৃপ্ত থেকে যায়। তাই আরো উচ্চতর গবেষণাধর্মী গভীর পা-িত্য ও ইলমে দ্বীনের বিভিন্ন শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জনের লক্ষ্যে ইমামে আহ্লে সুন্নাত মুজাদ্দেদে দ্বীন ও মিল্লাত, বিশ্ব বরেণ্য আলেম ও আরেফে কামেল আশেকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লামা গাজী আজীজুল হক শেরে বাংলা আল-ক্বাদেরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, উপমহাদেশের প্রখ্যাত ফিক্হশাস্ত্র বিশারদ শায়খুল আরবে ওয়াল আজম, আরেফে কামেল মুফতী আহমদ ইয়ার খান নঈমী গুজরাটী রহমাতুল্লাহ আলায়হি, মাখদুমে আলম, শায়খে কামেল আরেফ বিল্লাহ শায়খুল হাদীছ আল্লামা সৈয়দ নূরুচ্ছফা নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মুফতী ওয়াকারুদ্দীন রজভী কাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখের খেদমতে গমন ও অবস্থান করত: শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী (রহ.) নিজের অতৃপ্ত জ্ঞান তৃষ্ণাকে সিক্ত করেন এবং ইলমে হাদীস, ইলমে তাফসীর ও ইলমে ফিক্হের উপর গভীর পান্ডিত্য অর্জন করে নিজের জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেন। এ কারণে দেশের শীর্ষস্থানীয় ওলামা মাশায়েখের কাছে তাঁর স্বতন্ত্র অবস্থান মূল্যায়ন ও সমাদর ছিল রীতিমত ঈর্ষনীয়। বাতিল পন্থীদের নিকট শেরে মিল্লাত যেন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।

আকর্ষণীয় পাঠদান। প্রখর স্মৃতিশক্তি, বহুমূখী ও বিস্ময়কর প্রতিভার আধাঁর আল্লামা নঈমী (রহ.) এর পাঠদান ছিল শিক্ষার্থীদের নিকট আকর্ষণীয় ও লোভনীয় বিষয়। প্রাঞ্জল ভাষা, সুস্পষ্ট ও সাবলীল উপস্থাপনা, রূহানিয়্যতসমৃদ্ধ চিত্তাকর্ষক বাচনভঙ্গী, সর্বোপরী আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের বলিষ্ট প্রভাবের কারণে শিক্ষার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় ধ্যানমগ্ন হয়ে একাগ্রচিত্তে তাঁর যবান নিঃসৃত কুরআন-হাদীসের অমৃতপাঠ শ্রবণ ও আয়ত্ব করতো। যাঁর ফল শ্রুতিতে ইলমে শরিয়ত ও মারেফতের জটিল কঠিন সুক্ষ্ম বিষয়াবলী, সর্বস্তরের জ্ঞানতৃষ্ণা কাতর ছাত্রদের কাছে সহজেই বোধগম্য হয়ে যেতো, ইলমে হাদীসের সর্বাধিক বিশুদ্ধ ও সর্ব বিষয়ের বিশদ বর্ণনাসমৃদ্ধ সহীহ বুখারী শরীফের ন্যায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের মহাগ্রন্থের দরস ক্লাসের সময়ে শ্রেণীকক্ষে ক্লাসের বাইরে সকাল কিংবা সন্ধায় আলমগীর খানেকাহ শরীফে সারা বাংলাদেশ থেকে সমাগত নবীপ্রেমে পাগলপারা শাগরেদগণের সম্মুখে ঘন্টার পর ঘন্টা দান করে চলেছেন। বিরতি কিংবা ক্লান্তি, অবসাদ-অবহেলা বা অমনোযোগীতার লেশমাত্র নেই উস্তাদ-শাগরেদ কারো কাছে, এ যেন রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রহমতের চাদরে আচ্ছাদিত রুহানী ফুয়ুজাত-বরকত পরিপুষ্ট এক অদৃষ্টাপূর্ব স্বর্গীয় মজলিশ, মজলিশের সবাই যেন মদীনা ওয়ালা নবীর প্রেমের মহাসমুদ্রে ডুব দিয়ে ইলমে নববীর মহা মূল্যবান মণি-মুক্তা আহরণে মগ্ন। হাদীসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং উস্তাজে হাদীসের রূহানিয়্যতের বরকত, এহেন সম্মোহনী শক্তিসমৃদ্ধ ও ফলপ্রসু পাঠদানের জন্য শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী (রহ.) এর ক্লাসে সবসময় শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভীড় পরিলক্ষিত হতো। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলীর কারণে শায়খুল হাদীস আল্লামা নঈমী (রহ.) একজন প্রাত:স্মরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন শিক্ষক সমাজের জন্য।

তাফসীর শাস্ত্রে আল্লামা নঈমী (রহ.)
মুসলিম মিল্লাতের কাছে শেরে মিল্লাত আল্লামা নঈমী (রহ.) শায়খুল হাদীছ “মুফতীয়ে যমান” হিসেবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও সমাদৃত হলেও কুরআনের তাফসীর শাস্ত্রেও তাঁর দখল-দক্ষতা খিদমত ও অভিজ্ঞতা কোন বিচারেই গৌণ ছিলনা বরং ইলমে তাফসীরের জগতেও তিনি পরিপূর্ণ পারদর্শিতা ও সুগভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। পবিত্র কুরআনে করীমের সর্বপ্রথম, বিশুদ্ধতম ও সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য তাফসীর হলো হাদীসে নববী শরীফ, ছাহেবে কুরআন নবীয়ে দোজাহান সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে। আর আল্লামা নঈমী (রহ.) তাঁর সুদীর্ঘ অর্ধশতাধিক শিক্ষকতার জীবনে তালেবে ইলমদের সবচেয়ে বেশী পড়িয়েছেন সহীহ বুখারী শরীফসহ আন্যান্য হাদীস শাস্ত্রের গ্রন্থাবলী, হাদীছ শাস্ত্রের জঠিল-কঠিন বিষয়ের সমাধান দান ও দুই হাদীসের তা‘য়ারুজ তথা দুই হাদীসে মর্মের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নিরসনে তাঁর দক্ষতা ছিল ঈষর্নীয়। তাছাড়া, তাফসীর শাস্ত্রের বিশ্ববিশ্রুত ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহ যথা: তাফসীরে তাবারী শরীফ, তাফসীরে কবীর, তাফসীরে কুরতুবী, তাফসীরে কাশশাফ, তাফসীরে আবীস সাউদ, তাফসীরে রূহুল মায়ানী, তাফসীরে ইবনে কাছীর এবং তাফসীরে দুররে মানছুর ও বায়জাভী শরীফ, রূহুল বয়ান শরীফসহ সকল প্রসিদ্ধ তাফসীরের গ্রন্থাবলী তাঁর অধ্যয়ন ও নখদপর্নে ছিল। হুজুর আল্লামা নঈমী (রহ.) আজীবন কামিল হাদীস ক্লাসে তাফসীরে বায়জাভী শরীফ পড়িয়েছেন। শিক্ষার্থীদের তুলনামূলকভাবে অন্যান্য তাফসীরের চেয়ে, মোটামুটি কঠিন বায়জাভী শরীফে মুকাদ্দামার দুর্বোধ্য ও কঠিন স্থানগুলো সুস্পষ্ট ও সাবলীল ভাষায় হৃদয়ঙ্গম করিয়ে দিতেন ছাত্রদের অনায়াসে। এটা তাঁরই বুজুর্গী ও রূহানিয়্যতের ফয়জান নিঃসন্দেহে। কামিল তাফসীরের ক্লাসে আরো বিভিন্ন তাফসীরের কিতাব এবং দরস দিয়েছেন তিনি ছাত্রদের। তাফসীরের ক্লাসে দরস দানের সময় বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য তাফসীরের কিতাব ও উসুলে তাফসীরের কিতাবের রেফারেন্স দান করত: তাঁর দরছকে অধিকতর সমৃদ্ধ, বিষয়বস্তুকে আরো বেশী খোলাছা ও আকর্ষণীয় করতে সক্ষম হতেন তিনি, শিক্ষার্থীদের তখন মনে হতো তাফসীরুল কুরআন আর উলুমুল কুরআনের প্রায় সকল নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহ তাঁর নখদপর্ণে ছিল। যে কোন বিষয়ের কিতাব পড়ানোর সময় তিনি ছাহেবে কিতাব তথা গ্রন্থকারের মত ও লক্ষ্যকে সহজেই বুঝতেন তিনি তার শাগরেদদের বুঝাতে সক্ষম হতেন। কিতাবের বিষয়বস্তুর মর্ম উদ্ধারের জন্য এটি একটি বড় সহায়ক বিষয়। এক্ষেত্রে হুজুর আল্লামা নঈমী (রহ.) বড় সফল শিক্ষাগুরু ও অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন।

দেশে-প্রবাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার শিক্ষার্থী আর নবী-অলী প্রেমে পাগলপারা লক্ষ লক্ষ সুন্নী, অগনিত গুনগ্রাহী-শুভানুধ্যায়ীদেরকে শোকের অতল সমুদ্রে নিমজ্জিত করে চলে গেলেন ৬ জুলাই ২০২০ইং সোমবার বিকেল ৪.৪৫ ঘটিকায় আল্লাহ-রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর একান্ত সান্নিধ্যে। বিশ্ব বরেণ্য আল্লামা মুফতী ওবায়দুল হক নঈমী (রহ.)। রেখে গেলেন ঈমান আকিদার প্রশ্নে আজীবন আপোষহীন থাকার, সর্বক্ষণ ইলমে দ্বীন অর্জনে কিতাব অধ্যয়ন ও আহরিত জ্ঞান অন্যের নিকট বিতরণের এক নৈতিক তাড়না অনুভবের এবং জাগতিক মোহে মোহাবিষ্ট না হয়ে আল্লাহ-রাসূলের আনুগত্য ও নৈকট্য লাভে সর্বক্ষণ উজ্জীবিত ও তৎপর থাকার এক কল্যাণকর আদর্শ। সর্বোপরী কথায় কর্মে ও চিন্তা-চেতনায় সুন্নিয়তকে ধারণ ও লালন করত: সমাজের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠানিকরূপ দেখার এক গুরু জিম্মাদারী ছেড়ে গেলেন এদেশের সর্বস্তরের সুন্নী জনগোষ্ঠীর উপরে। এ গুরু দায়িত্ব পালনে মহান আল্লাহ সকলকে সদা সচেতন, ঐক্যবদ্ধ, কার্যকর ও দায়িত্বশীল ভুমিকা পালনের তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক: অধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •