গাউসিয়ত ও সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.)

0

মুফতি কাজী মুহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ

মানব সৃষ্টির পেছনে মহান রাব্বুল আলামীন যে উদ্দেশ্য ও অপার রহস্য প্রচ্ছন্ন রেখেছেন তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিষয়টি তিনি স্বীয় কুদরতী ভাষায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে ব্যক্ত করেছেন-اِنِّىْ جَاعِلُ فِى الْاَرْضِ خَلِيْفَةً-
অর্থাৎ- আমি যমীনে খলীফা (প্রতিনিধি) সৃষ্টি করব। খলীফা তথা প্রতিনিধিত্বকারী হচ্ছেন তিনিই, যিনি সর্বক্ষেত্রে তাঁর পক্ষ হয়ে কার্য সম্পাদন করবেন। যেমন জ্বীন, ইনসানকে আল্লাহ্র পথে আহ্বান করবেন। হিদায়তের আলোকে তাঁদেরকে পরিচালিত করবেন, আল্লাহর প্রভুত্বকে জ্বীন ও ইনসানের জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দেবেন। শুধু তই নয়, সৃষ্টির উদ্দেশ্য সাধন তথা আল্লাহ্ ও তাঁর বান্দার মধ্যে, স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার মত গুরু দায়িত্ব এ খলীফার উপরেই ন্যস্ত। বস্তুত: তারা খালেক ও মাখলুকের মধ্যে অনুপম সেতু বন্ধন।
সর্ব প্রথম আল্লাহ্ তা‘আলার খলীফা হিসেবে (অধিকাংশ তাফসীরকারক ও ওলামায়ে কেরাম) হযরত আদম আলায়হিস্ সালামকে সাব্যস্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের মূল গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত হয় প্রিয় নবী হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরই উপর।
এতদসমর্থনে হাদীসে পাকে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ মহান বাণী প্রণিধানযোগ্য। তিনি ইরশাদ করেন-كنتُ نبيًّا وادم بين الماء والطين- অর্থাৎ- আমি তখনও নবী ছিলাম যখন হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর অস্তিত্ব পানি ও মাটির মধ্যভাগে ছিল। এখানে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস শরীফের মর্থার্থ হচ্ছে- হযরত আদম যখন অস্তিত্ব লাভ করেননি তখনও আমি নুবুয়ত তথা খেলাফতের দায়িত্বে সমাসীন ছিলাম।
আল্লামা মাহমুদ আলূসী বাগদাদী তাঁর প্রণীত প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ রুহুল মা‘আনীর ১ম খণ্ডের ২১৮ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছন-
فهو صلى الله عليه وسلم على الحقيقة الخليفة الاعظم والخليفة والامام المقدم فى الارض والسموات العلى ولولاه ما خلق ادم بل لا ولا-
অর্থাৎ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টির মধ্যে প্রধান খলীফা এবং যমীন ও উর্ধ্ব আসমান সমূহে তিনিই সর্বপ্রথম ইমাম। তিনি সৃষ্টি না হলে হযরত আদম আলায়হি সালাম তথা মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি হতো না, কখনোই না।
কিন্তু মানবীয় অবয়বে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-ই খলীফা হিসেবে প্রেরিত হন। তাঁর মাধ্যমেই সূচিত হয় আদম সন্তান মানব জাতির সৃষ্টির ধারা। মানব আকৃতির প্রথম সৃষ্টি হিসেবেই মুফাস্সিরীনে কেরাম খলীফা হিসেবে হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম-এর কথা বলেছেন। খেলাফতের ধারা তথা খলীফার সিলসিলা আদি পিতা হযরত আদম আলায়হিস্ সালামের মাধ্যমেই প্রবর্তিত হয়। এজন্য যুগে যুগে আল্লাহ্ তা‘আলা আদম সন্তানদের মধ্যে থেকেই পয়গম্বর হিসেবে তাঁর খলীফা নিযুক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন-ان الله اصطفى ادم ونوحا وال ابراهيم وال عمران على العالمين-
আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত আদম, নূহ এবং ইবরাহিম (আলায়হিমুস্ সালাম)-এর বংশধর এবং ইমরানের বংশধরদেরকে নবী-রাসূল তথা খলীফা হিসেবে সমগ্র সৃষ্টি জগতের উপর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছেন।
খেলাফতের ধারা সূচিত হওয়ার পর হতে আজ পর্যন্ত কোন যুগ বা কাল খেলাফতশূন্য বা খলীফাবিহীন থাকেনি। আর কেয়ামত পর্যন্ত এরূপ অব্যাহত থাকবে। কেননা স্বত্তার জন্য সমসাময়িক খলীফা হল একমাত্র প্রাণশক্তি। সমকালে মানব জাতির জন্য তিনিই হন পরিচালক। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে যোগাযোগের বাহন ও সেতুবন্ধন হিসেবেই সৃষ্টি করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী তাফসীরে রুহুল মা‘আনীতে বর্ণনা করেন-
لم تزل تلك الخلافة فى الانسان الكامل الى قيام الساعة وسافه القيام بل متى فارق هذا الانسان العالم مات العالم لانه الروح الذى قوامه فهوا العماد المعنوى للسماء والدار الدنيا جارحة من جوارح الجسد العالم الذى الانسان روحه-
অর্থাৎ- কেয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কামিল ইনসান এর মধ্যে উক্ত খেলাফত-ধারা বিদ্যমান থাকবে। বরং যখন খেলাফত সম্পন্ন কামেল ইনসান এ জগত হতে পৃথক হয়ে যান, তখন সৃষ্টি জগত হয়ে যায় নির্জীব। যাঁর মাধ্যমে জগতের অস্তিত্ব টিকে থাকে।
সমগ্র জগতরূপ শরীরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহের মধ্যে পৃথিবী একটি অঙ্গ। যার রূহ তথা জীবনী শক্তি হচ্ছে খেলাফত প্রাপ্ত ঐ কামিল ইনসান। এখানে সমগ্র বিশ্ব তথা সৃষ্টিকুলকে একটি শরীরের সাথে উপমা দিয়ে বলা হচ্ছে, একটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে, দুনিয়া হচ্ছে সেরূপ একটি অঙ্গ।

হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসূল হিসেবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর মাধ্যমে নুবূয়ত ও রিসালতের সমাপ্তি ঘটালেও দুনিয়ার বুকে অপরিহার্য ঐ খেলাফতের ধারা বন্ধ করে দেননি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর দ্বীনের পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। যে দ্বীনের শুভ সূচনা ঘটেছিল হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকেই, এ দ্বীনই আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যে সংযোগ সাধনের একমাত্র পন্থা; সে দ্বীনের পূর্ণতা ঘটলেও খেলাফতের ধারা এই দ্বীনের অনুগামিতার ভিত্তিতে অনন্তকাল ব্যাপী চলতে থাকবে। নুবূয়তের ধারা চলাকালীন খেলাফতের দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা যেভাবে নবী-রাসূলদের চূড়ান্ত মনোনয়ন দিয়েছিলেন, তেমনিভাবে নুবূয়ত পরবর্তী খেলাফতের ধারা গতিমান রাখার জন্যই শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী উম্মতে মুহাম্মদী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) থেকে বিশেষ কতেক মহাপুরুষ নির্বাচিত করে রেখেছেন। যুগে যুগে কালে কালে যাঁদের আবির্ভাব ঘটতে থাকবে। এ দায়িত্ব নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে আল্লাহ্র ওলী-আওতাদদের উপর অর্পিত হয়। বলা হয়- الولاية ظلّ النبوة (বেলায়ত হচ্ছে নুবূয়্যতের ছায়া) ওলীগণের মধ্যে এক একজন ওলী এক একজন নবীর নুবূয়্যতের ছায়াতলেই বিরাজ করেন। কেউ নুবূয়তে আদমী, কেউ বা নুবূয়তে নূহী, কেউ নুবূয়তে ইব্রাহীমীতে, কেউ আবার নুবূয়তে মুসাভী, কেউ নুবূয়তে ঈসায়ীর ছায়ায় থেকে বেলায়তের কক্ষ পথে আপন গিতধারা অব্যাহত রাখেন। খেলাফতের মহান দায়িত্ব তাদেরকেই প্রদান করা হয়, যাঁরা সরাসরি মুহাম্মদী নুবূয়ত ও বেলায়তের ছায়া লাভে ধন্য হয়েছেন।

হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইমামদের মধ্যে এ দায়িত্ব খেলাফত নামেই প্রবর্তিত ছিল। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং আয়িম্মায়ে আহলে বায়তের পর এ দায়িত্ব সরাসরি সায়্যেদুনা হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর উপর ন্যাস্ত হয়। খোলাফায়ে রাশেদীন ও আয়িম্মায়ে আহলে বায়তের পর সরাসরি তিনিই বেলায়তে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ছায়াতলে স্থান পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন। এর প্রতি ইঙ্গিত করেই গাউসে আ‘যম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, وكل ولى على قدم وانى- على قدم النبى بدر الكمال-
‘‘প্রত্যেক ওলী এক (নবীর) পদাঙ্কানুসারী আর নিঃসন্দেহে আমি গাউসে পাক, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পদাঙ্কের উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ প্রত্যেক ওলী কোন না কোন নবীর নুবূয়তের ছায়া তলে অবস্থান করেন। আমি অবস্থান নিয়েছি হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নুবূয়তের ছায়ার উপর। খেলাফতের পবিত্র আমানত তাঁর উপর ন্যস্ত হয়ে ‘‘গাউসিয়ত’’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
ইমামে আহলে সুন্নাত আ‘লা হযরত মাওলানা শাহ্ আহমদ রেযা খাঁন বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর নিকট একদিন প্রশ্ন করা হয়, ‘‘প্রত্যেক যমানায় কি ‘গাউস’ হয়ে থাকেন? উত্তরে আ’লা হযরত বললেন, ‘গাউসবিহীন আসমান ও যমীনের অস্তিত্ব অসম্ভব।’’ অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হল, ‘‘গাউস কি মুরাক্বাবার মাধ্যমেই জগতের অবস্থান সমূহ প্রত্যক্ষ করেন? উত্তরে তিনি বলেন, না, বরং জগতসমূহ গাউসের সামনেই আয়না সদৃশ উপস্থিত থাকে। অতঃপর আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এ প্রসঙ্গে বিষদ বর্ণনা করে বলেন, ‘‘প্রত্যেক গাউসের উভয় পাশে দু’জন উজীর থাকেন। গাউসের উপাধি আবদুল্লাহ্। ডানপাশের উজীরকে আবদুর রব এবং বাম পাশের জনকে ‘আবদুল মালিক’ নামে ভূষিত করা হয়। রূহানী ও দুনিয়াবী হিসেবে প্রশাসনকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। এই দু’জন গাউসের উজীর উভয় প্রশাসনকে পরিচালনা করেন। রূহানী প্রশাসনে বামের উজীরের ক্ষমতা প্রবল হয়, পক্ষান্তরে ডান পাশের উজীর দুনিয়াবী প্রশাসনে অধিকতর ক্ষমতাশালী। এর কারণ হচ্ছে, রূহানী প্রশাসন ‘‘ক্বলব’’ এর জগতেই প্রতিষ্ঠিত। আর ‘ক্বলব’ এর অবস্থান মানব দেহের বামপার্শ্বে। এ কারণেই রূহানী জগতে বামের উজীরের ক্ষমতা অধিকতর হয়ে থাকে। অপর পক্ষে এর বিপরীত অবশ্যই কার্যকর।

‘‘গাউসে আকবর’’ হিসেবে প্রথম সমাসীন হলেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তাঁর বামে ও ডানে উজীরের দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতোত্তর কালে এ দায়িত্বে নিযুক্ত হন সিদ্দীক আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, এরপর উভয় উজীর নিযুক্ত হন যথাক্রমে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। এভাবে পর্যায়ক্রমে এ দায়িত্বগুলো অর্পিত হয় হযরত আলী, ইমাম হোসাইন ও ইমাম হাসান আসকারী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম এর উপর। তাঁদের নিকট পর্যন্ত আহলে বায়তের ইমামগণ ক্রমান্বয়ে একজন গাউসিয়তের আসনে এবং পরবর্তী অপরজন উজীর হতে থাকেন। এবং এভাবেই তাঁরা পূর্ণাঙ্গ গাউসিয়তের আসনে সমাসীন ছিলেন। তাঁদের পর থেকে গাউসে আ‘যম আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর পূর্ব পর্যন্ত যাঁরা এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁরা প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে গাউসের মাক্বাম প্রাপ্ত হন। কিন্তু গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এ সম্মানের পরিপূর্ণ আসন লাভ করেন। এখানে তাঁর বিশেষত্ব দৃষ্টি কাড়ে।

হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নুবূয়ত অন্যান্য নবীদের মত বিশেষ কোন জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তা ছিল সমগ্র জগৎ জুড়ে। এ বিশাল প্রশস্থ নুবূয়তের ছায়া খেলাফত বা গাউসিয়তের প্রভাব ও কোন স্থান কিংবা জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র সৃষ্টি ব্যাপী এ বিস্তৃতি। এভাবে গাউসে পাকের গাউসিয়ত শুধু বাগদাদ বা কোন এলাকা ভিত্তিক নয়; সমগ্র বিশ্ব জুড়ে তাঁর গাউসিয়তের বিস্তার। তাঁর গাউসিয়তের ছায়াতলে সমগ্র ওলী ও আওতাদ, শরীয়তের জ্ঞানী, মহাজ্ঞানী, মনীষী, যমান-মকান, নির্বিশেষে সমস্ত বস্তুই আশ্রয় প্রাপ্ত। পূর্বেই বলা হয়েছে, খলীফাই আল্লাহ্ ও বান্দার মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধন।

হযরত গাউসুল আ‘যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু গাউসিয়তে সমাসীন হওয়ার পরে আল্লাহ্র নির্দেশে ‘কাশ্ফ’ যোগে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ইঙ্গিতে ঘোষণা দেন- قدمى هذه على كل ولى (আমার কদম প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপর)। এতে তাঁর গাউসিয়াতের প্রকাশ ঘটে। এ নির্দেশ প্রাপ্তির পরে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে, উপরে, অভ্যন্তরে, সমগ্র আউলিয়ায়ে কেরাম আপন আপন জায়গা থেকে অবনত শিরে এ ঘোষণা মেনে নেন। শুধু তাই নয়, সানজারের উপত্যকায় খাজা গরীবে নেওয়াজ মুরাকাবা অবস্থায় এ নির্দেশ লাভ করার সাথে সাথে সম্মান ও শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করে বলে উঠেন- হে গাউস! বরং আপনার কদম আমার শিরোপরি এবং দু’চক্ষুপরি। রূহানী জগত থেকে হুযূর গাউসে আ‘যম রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উত্তরে বলেন, হে মঈনুদ্দীন ইবনে গিয়াস উদ্দীন। যাও, আমি তোমাকে সমগ্র ভারতের বেলায়ত দান করেছি। এমনিভাবে গাউসে পাকের ফয়জ ও বরকতে আয়িম্মায়ে তরীক্বত যেমন খাজা নকশবন্দী, হযরত শেহাব উদ্দীন সোহ্রাওর্য়াদী, আবুল হাসান শাযলী, মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখ তরীক্বতের সূর্য হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন।

গাউসিয়তের এই মহান মক্বাম সরাসরি নুবূয়তে মুহাম্মদীর ছায়া দ্বারা আর বেলায়তে মুহাম্মদীর উত্তরাধিকার হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর নূরানী বংশধরদের জন্যই সংরক্ষিত। পর্যায়ক্রমে এই মকামে হুযূর গাউসে আ‘যম বিশেষত: গাউসে পাকের সিলসিলায়ে কাদেরিয়ার অনুসারী আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ওলীয়ে কামেলদের এ দায়িত্বে সমাসীন করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে গাউসে পাকের যোগ্যতম স্থলাভিষিক্ত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর খলীফা-ই আ‘যম মুর্শিদে বরহক্ব সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে বলেন, গাউসিয়তে কুবরা (সর্বোচ্চ গাউসিয়ত) ক্বাদেরিয়া সিলসিলার সাথে একান্ত সম্পৃক্ত। এ সিলসিলা থেকে যোগ্য ব্যক্তির অভাব ঘটলেই অন্য সিলসিলা থেকে ‘গাউস’ নির্বাচিত করা হয়। এটা বড় লজ্জার হবে যদি আমাদের অযোগ্যতার কারণে আমাদের নিজস্ব বস্তু অপরকে দিয়ে দেয়া হয়। চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এ কথা বলে ইঙ্গিতে এটাই জানিয়েছেন যে, গাউসিয়ত তখন তাঁর কাছেই মজুদ ছিল। অতঃপর তা স্থানান্তরিত হয়ে হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর কাছে ন্যস্ত হবে। তবে এজন্য প্রয়োজন হবে সুকঠিন সাধনার। বলা বাহুল্য, হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এমন অতুলনীয় রেয়াযত-সাধনা করেছেন, যার বিনিময়ে তিনি গাউসিয়তের মকাম লাভে সমর্থন হন। আপন মুর্শিদের সন্তুষ্টি বিধানে তার সাধ্য-সাধনা কিংবদন্তীর পর্যায়ে। তাই স্থির করা যায় যে, পরিপূর্ণ সাধনার মাধ্যমে তিনি গাউসিয়তের মক্বাম লাভ করে ওই মহান দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পাদন করেছেন।

হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর বর্ণনানুসারে গাউসে যমান এর মর্যাদা প্রাপ্তির জন্য যে সব উপাদান অপরিহার্য হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর মাঝে সে সব নিহিত ছিল পূর্ণমাত্রায়। যেমন- প্রথমত, তিনি আওলাদে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়ত, সাধনার ক্ষেত্রে তিনি বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে দীপ্তিমান। উপরন্তু তিনি একজন যমানার গাউসেরই সরাসরি খলীফা। হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি যে আপন যুগে গাউসে যমান ছিলেন তা সন্দেহাতীত। সে প্রসঙ্গে ছোট্ট একটি ঘটনার উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি-
একদিন জনৈক ব্যক্তিকে হুযূর চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেন, ঐ ব্যক্তিই গাউসে যমান, তিনি যদি (অদূরে একটি বৃক্ষ দেখিয়ে) ঐ বৃক্ষকে নির্দেশ দেন, হে বৃক্ষ, তুমি এখানে এস, এতটুকু বলতে না বলতেই তাঁর বাড়ীর সম্মুখস্থ একটি তূতবৃক্ষ নড়ে উঠে আপন স্থান ছেড়ে চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর দিকেই চলে আসতে লাগল। তখন হুযূর চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, আরে আমিতো এখনও তোমাকে আহ্বান করিনি, আমি শুধু প্রশ্নকারীকে বুঝাতে উদাহরণ দিয়েছিলাম মাত্র, তুমি আপন জায়গায় চলে যাও। ঐ বৃক্ষও তাই করলো। এ অলৌকিক ঘটনা দৃষ্টে লোকটির আর বুঝতে বাকী ছিল না যে, খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিই হলেন তৎকালীন যুগের গাউসে যমান।

তৃতীয়ত, গাউসে যমান হওয়ার জন্য গাউসে বাগদাদ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি যে বিশেষ দিকের প্রতি আলোকপাত করেছেন, তা হলো শরীয়ত ও তরীক্বত উভয় দিকের প্রচার-প্রসারে আত্মনিবেদিত হওয়া। গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমার একহাতে শরীয়তের মহাসাগর, আরেক হাতে তরীক্বতের বিশাল সমুদ্র। যখন যেটা থেকে ইচ্ছে হয় আমি গ্রহণ করি, বন্টন করি। এর বাস্তব রূপায়ন ঘটাতে তিনি শরীয়তের প্রসারে স্থাপন করেন নেযামিয়া মাদ্রাসা এবং সেখানে অধ্যাপনার মাধ্যমে শিক্ষার মহান ব্রত ও আদর্শকে অনুপ্রাণিত করেছেন, অপরদিকে তরীক্বতের দীক্ষা ও আধ্যাত্মিক অনুশাসনের জন্য তিনি খানক্বাহ্ও প্রতিষ্ঠিত করেন। যেখানে তিনি তরীক্বত, তাসাউফের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে ভক্ত মুরীদদের তালীম দিতেন।

গাউসিয়তের এ আদর্শের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নকারী, গাউসে পাকের যথাযথ পদাঙ্ক অনুসারী হিসেবে হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে এখানেও সম্পূর্ণ প্রত্যাশার অনুকুলেই পাওয়া যায়। মুর্শিদে বরহক্ব সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি একদিকে দ্বীনি শিক্ষার প্রসারে একের পর এক মাদ্রাসা স্থাপনের মাধ্যমে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন, অপরদিকে মানুষের রূহানীয়তকেও সজীব রাখতে, তরীক্বতের বাগান প্রস্ফুটিত রাখতে স্থাপন করেন খানকায়ে ক্বাদেরীয়া।

উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যাবলীর নিরিখে হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন গাউয়সিয়তের মক্বামে তর্কাতীতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। কালের অবিস্মরণীয় প্রতিভা, ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষ সমসাময়িককালের গাউসে যমান ছিলেন এ কথাটি চিরন্তন সত্য। হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর ওফাত শরীফের পর তাঁর সমুদয় দায়িত্ব অর্পিত হয় তদীয় শাহ্জাদা ও খলীফা হযরতুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর উপর। একদিনের ঘটনা: মুর্শিদে বরহক্ব হযরত সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি তখন বাংলাদেশের (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) চট্টগ্রামস্থ আন্দরকিল্লাহ্ কোহিনূর প্রেস সংলগ্ন মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের বাসায় অবস্থান করছিলেন। ডাকযোগে সিরিকোটি শরীফ থেকে প্রেরিত একটি চিঠি হুযূরের খেদমতে উপস্থিত। হুযূর না পড়েই তা বালিশের নিচে রেখে দিলেন। চিঠিতে প্রদত্ত সিরিকোটের খবরাখবর জানতে উদগ্রীব হন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। হুযূর তা এড়িয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আসর নামাযের সময় হলো। নামায আদায়ান্তে মুরীদান ভক্তরা আবার তাঁর খেদমতে জড়ো হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে চিঠিখানি নিতে নির্দেশ দিলেন। উর্দু পড়তে সক্ষম জনৈক মুরীদকে নির্দেশ দেয়া হল চিঠিটা পড়তে। চিঠি পঠিত হল। সিরিকোট থেকে এ চিঠি লিখেছেন শাহ্াজাদা আল্লামা সৈয়্যদ তৈয়্যব শাহ্ সাহেব। শ্রদ্ধেয় পিতা ও আপন মুর্শিদ ক্বিবলা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে তিনি তাঁর একটি অভিনব ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেছেন। হযরত তৈয়্যব শাহ্ সাহেব লিখেছেন, একদিন তিনি দেখতে পেলেন হুজুরা শরীফের দরজা খোলা। প্রবেশ করে দেখলেন সেখানে স্বয়ং সরকারে দো‘আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দু’টি বিশেষ সূরা সহযোগে দু’রাকাত নামায আদায় করার উপদেশ দিলেন। নির্দেশমত নামায শেষে তাঁর অন্তরে এক অপূর্ব হালাত সৃষ্টি হলো, তাঁর মনে হল তিনি টেলিগ্রাফ বার্তা আদান-প্রদান দপ্তরের মত একটি ঘরে আছেন। সেখানে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বার্তা প্রেরণে ব্যস্ত। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম জানালেন এখান থেকে আউলিয়ায়ে কেরামের দপ্তর ও দায়িত্ব বন্টন করা হয়, এবং এর বর্তমান কর্তৃত্ব সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হির উপর ন্যস্ত। অতঃপর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ ঘটনা অবহিত করে সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে জানাতে তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন। চিঠি পাঠ শেষ হলে হযরত সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, এ তথ্য আমার জানা ছিল। তোমাদের অবগতির জন্য চিঠি পাঠ করালাম। আমার স্থলে কে অভিষিক্ত হচ্ছেন তোমরা তা অনুধাবন করতে পারলে।

যমানার গাউসিয়তের মুকুট যাদের পরানো হবে তাঁদের বৈশিষ্ট্য এ যে, তাঁরা জাগ্রত অবস্থায় হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর স্বশরীর মোলাকাত লাভ করে থাকেন। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজ সাক্ষাতেই তাঁদের প্রয়োজনীয় নসীহত করে যান। গাউসে জিলানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকেও হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বশরীরে সাক্ষাত দিয়ে নসীহত করেছিলেন এবং নুবূয়তের যবান থেকে থুথু মুবারক খাইয়েছিলেন। অনুরূপ হুযূর ক্বিবলা তৈয়্যব শাহ্’র ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দর্শন দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, বর্তমান গাউসিয়তের অধিকারী হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। তাঁর হাতে বেলায়তের মক্বাম বন্টন হচ্ছে এবং অচিরেই এ দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হবে।

লক্ষণীয় যে, হুযূর ক্বিবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এ মক্বাম প্রাপ্তির পর গাউসে যমান হিসেবে শরীয়ত তরীক্বতের অনেক সংস্কার মূলক দায়দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন, যা গাউসে যমান ছাড়া অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর সম্পাদিত কর্মকাণ্ডগুলো পর্যালোচনা করলে উপরোক্ত দাবীর যথার্থতা সূর্যালোকের মতই প্রতিভাত হবে। বাতিলপন্থীদের অশুভ চক্রান্তে সরল ঈমানদারগণ যখন সঠিক পথ থেকে প্রায় বিচ্যুত হবার উপক্রম, তখন হুযূর ক্বিবলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর আবির্ভাব ছিল জয়জয়কার। তাঁর সংস্পর্শে দিশেহারা মানুষ খুঁজে পায় বিশুদ্ধ আক্বীদা ও ঈমানের সঠিক আস্বাদ। যার প্রমাণ ঈদ-এ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। জশনে জুলূসে ঈদ-এ মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর সুবিশাল মিছিলে জনসমুদ্রের মত নবী প্রেমিক ঈমানদারদের সমাবেশ। এগুলো এ কথাই প্রমাণ করে যে, ভ্রান্ত আক্বীদা বা বাতিল মতবাদে নবী প্রেম শূন্য হয়ে প্রায় ঈমান হারা হবার উপক্রম মুমিনদের অন্তরে এ জুলূসে রাসূল প্রেমের বন্যা বইয়ে দেয়। লক্ষ লক্ষ মুমিন এ মহাসমাবেশে এসে যেন খুজে প্রায় ঈমানের সঞ্জীবনী ধারা। হুযূর ক্বিবলার এ এক অবর্ণনীয় অতুলনীয় কালজয়ী ঈমানী বিপ্লব যা ঈমানদারের মনোরাজ্যে সংঘঠিত হয়। নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন সৃষ্টির উৎসমূল। তাঁরই বেলাদতের শুভক্ষণকে বর্ণাঢ্য ও সাড়ম্বরে উদযাপনের মাধ্যমে ভক্তি মুহাব্বতের এরূপ অনুপম সওগাত পেশ করা বাস্তবিকই এক বৈল্পবিক সংস্কার।

শরীয়তের ব্যাপক প্রচার-প্রসারকল্পে হুযূর ক্বিবলার একাধিক দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠান কায়েম করা, ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা, ঢাকা কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া মোহাম্মদপুর, চন্দ্রঘোনা তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া, হালিশহর তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়ার মত এমন অনেক দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁর গাউসিয়তের স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। তাঁর অমর বাণী ‘‘সাচ্ছা আউর হক আলেম তৈরী করো’’ আমাদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীতে (ইকরা) শব্দের সারমর্মের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও তাঁরই অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি হয়েছে দেশে-বিদেশে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দ্বীনি শিক্ষার অগ্রযাত্রায় তিনি এক কালজয়ী সিপাহসালার মহাপুরুষ। এ মহান কার্যক্রম যেন নিশ্চিত ও সুচারুরূপে পরিচালিত হতে থাকে সে জন্য শিক্ষামূলক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট পরিচালনার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এতে নিবেদিত প্রাণ ভাইদের ব্যাপক খেদমতে সংশ্লিষ্ট হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

তরীক্বতের ক্ষেত্রে হুযূর ক্বিবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর জয়যাত্রা যুগান্তকারী। লক্ষ লক্ষ হিদায়ত পিপাসু মানব মনে তিনি যুগিয়েছেন রূহানীয়তের অমীয় সুধা। তরীক্বতের ব্যাপক খেদমতের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন একাধিক খানকাহ্। বলুয়ার দীঘির পাড়স্থ খানকায়ে কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া, জামেয়া সংলগ্ন খানকায়ে কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া (আলমগীর খানকাহ্ শরীফ) ছাড়াও অঞ্চলে অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত খান্কাহ্ গুলোতে অহরহ পলিত হচ্ছে তরীক্বতের বিভিন্ন কার্যক্রম ইত্যাদি। এ রূহানী অনুষ্ঠানগুলোতে মানুষ খুঁজে পাচ্ছে রহমত ও ফুয়ূজাতের নিরবচ্ছিন্ন প্রস্রবণ। মুরীদদের কাছ থেকে তাঁর গৃহীত অঙ্গীকার হচ্ছে ‘আল্লাহ্ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য কাজ করব।’ হুযূর ক্বিবলার গাউসিয়তের ছায়াতে এসে মানুষের পরিবর্তন অবাক করার মত। খুন খারাবীতে লিপ্ত থাকতে পারতো এমন মানুষকে নামায পড়তে দেখা গেছে। কারণ তাঁর নির্দেশিত তাসবীহ্ তাহলীল সমূহ নামাযান্তে বলে প্রথমে নামায আদায় করতে হয়। এতে তিনি এক মূল্যবান সত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন। তা হচ্ছে শরীয়ত ও তরীক্বতের সমন্বয় না হলে মুক্তি সম্ভব নয়। এভাবে তিনি আধ্যাত্মিক বিপ্লব এনেছেন। যে ব্যক্তির হাতে সুরার পাত্র থাকতো, তাঁর সান্নিধ্যে এসে সে হাতে তাসবীহ্ দিয়েছে, গাউসিয়তের আসনে উপবিষ্ট হলেই এমনিভাবেই রূহানী ইনকিলাব তথা আধ্যাত্মিক নব চেতনার সঞ্চার করা সম্ভব হয়।

গাউসে যমান এর হাতে মানুষের আত্মার নিয়ন্ত্রণ থাকে। যখন যাকে ইচ্ছা আকর্ষণ করেন, যাকে ইচ্ছা করেন সত্যের পথে এনে ছেড়ে দেন। সচরাচর গাউসের দরবারে প্রচুর লোক সমাগত হয়। কখনো বা প্রচণ্ড ভীড়ও পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে গাউসে বাগদাদ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-এর একটি ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। একদিন জুমার নামায আদায় করে গাউসে পাক হুজরার দিকে গমন করছিলেন। পেছনে ছিলেন বিশিষ্ট মুরীদ হযরত ওমর বাজ্জাজ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি। মুরীদ দেখলেন গাউসে পাকের আশে পাশে এমনকি পথিমধ্যেও কোন লোকের উপস্থিতি নেই, এরূপ সচরাচর হয় না। তিনি ভাবলেন যেখানে গাউসে পাকের মোলাক্বাতের জন্য পথের দু’ধারে সারিবদ্ধ অপেক্ষমান জনতার ভিড় থাকে সেখানে আজ এমন জনশূন্য পরিস্থিতি হলো কেন? ভাবতে না ভাবতেই দেখতে পেলেন মুহূর্তের মধ্যেই চতুর্দিক হতে হাজার হাজার লোকের ভিড় শুরু হয়ে গেছে। জনস্রোতের তোড়ে হতবাক হয়ে ওমর ভাবলেন আমার পক্ষে আগের অবস্থায়ই ভাল ছিল। এখন আমি তাঁর নৈকট্য থেকে ছিটকে পড়েছি। মনে মনে একথা ভাবতে না ভাবতেই আবার গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তার উদ্দেশ্যে পেছনে ফিরে বললেন, ওমর তুমি কি জাননা মানুষের আত্মার গতিবিধি আমার হাতের নিয়ন্ত্রণাধীন? আমি যদি ছেড়ে দিতে চাই, তখন ছেড়ে দেই, আর মানুষ দূরে সরে যায়। আবার যখন তাঁদের আকর্ষণ করতে আমার ইচ্ছে হয়, তখন তাঁদেরকে আমার নিকটে নিয়ে আসি। অন্তরের গতি ধরে যখন টান দেই, তখন ইচ্ছা অনিচ্ছা, উভয় অবস্থাতেই তারা আমার নাগালে আসতে বাধ্য হয়ে যায়।

যুগে যুগে তেমনি প্রত্যেক গাউসে জামান সেই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকেন। এমনি ঘটনার অবতারণা হয়েছিল হুযূর ক্বিবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর জীবনেও। ১৯৭৮ বা ৭৯ সালের ঘটনা। হুযূর ক্বিবলা তখন অবস্থান করেছিলেন বলুয়ার দীঘির পাড়স্থ খানকায়ে কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়াতে। প্রত্যেক নামাযের শেষে হুযূর ক্বিবলা তরীক্বতের অনুরাগী ভাইদের বায়‘আত করে সিলসিলায়ে কাদেরিয়ার অন্তর্ভূক্ত করে নিতেন। একদিন জোহরের নামাযে লোক সমাগম ছিল নিতান্ত অল্প। স্বল্প সংখ্যক উপস্থিত লোকের মধ্যে নতুন বায়‘আত গ্রহণে আগ্রহী ছিলেন ৪/৫ জন। নামায শেষে হুযূর ক্বিবলা বায়‘আত করানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন। এমন সময় জনৈক খাদেম বায়‘আত অনুরাগীর অপ্রতুলতা দেখে ‘এখন বায়‘আত এর কাজ হবে না’ বলে ষোঘণা করলেন। তখনই হুযূর ক্বিবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি গাউসে পাক রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, হযরাতে কেরাম যখন যতখানি ইচ্ছা তাই এনে দেন। এখানে হুযূর ক্বিবলা রহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরাতে কেরামের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে আপন মহিমাকে লুকানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞজন মাত্রই বুঝে নিতে কসুর করেন না যে, হুযূর ক্বিবলার ইঙ্গিতময় বাণীতে সেই গাউসিয়তের মহিমা উজ্জ্বল দীপ্তি নিয়ে আত্ম প্রকাশিত।

উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, যেহেতু হুযূর ক্বিবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন, আওলাদে রসূল সিলসিলায়ে ক্বাদেরিয়ার একজন যোগ্য খলীফা, একজন গাউসে যামানের রক্তের উত্তরসূরী, রূহানীয়তেরও তেমনি যথাযোগ্য স্থলাভিষিক্ত ক্ষমতাবান, সেহেতু তিনি গাউসে যামান হওয়াতে সন্দেহ থাকা আদৌ যুক্তি সঙ্গত নয়। সন্দেহ পরায়ণরা আবার সন্দেহে দুলতে পারে যে, হুযূরকে এখানে গাউসে পাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কাউকে যোগ্য পিতা ও পুত্রের কাউকে তার বাবার মতো বললে যেমন পিতার মানহানি হয়না, তেমনি এখানেও ব্যাপারটা অনুরূপই। আল্লাহ্ বুঝার তাওফিক দিন। আ-মী-ন।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ- জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •