ইমাম হুসাইন সত্য ও ন্যায়ের পথে এক আপোষহীন সৈনিক

0

মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাসুম

কিয়া বাত রযা উস চমনিস্তানে করম কি,
যাহরা হে কলি জিস মে হোসাইন অউর হাসান ফুল।
অর্থ: হে রেযা, ওই দয়ার বাগানের কথা কী বলার আছে!
যার কলি হলেন ফাতেমা যাহরা আর দু’ ফুল হলেন হযরত হাসান ও হযরত হোসাইন।
সুলতানে কারবালা, ইমামে আলী মকাম ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু চতুর্থ হিজরির শা’বান মাসের ৪র্থ দিবস মঙ্গলবার (৮ জানুয়ারি ৬২৬খ্রি:) কুরাইশ রাজবংশের বনু হাশেম গোত্রে শেরে খোদা মাওলা আলী ও হযরত ফাতেমা যাহরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার ঔরশে ও গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্ম গ্রহণের পর তাঁর পিতা মহব্বত করে তাঁর নাম রাখেন হারব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্মের শুভ সংবাদ শুনে খুবই আনন্দিত হয়ে তাঁকে দেখতে এসে জিজ্ঞেস করলেন নাম কী? হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাঁর নাম হারব। তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাঁর নাম হারব নয়; বরং হুসাইন। উপনাম হলো আবু আব্দুল্লাহ। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কানে আযান ও ইকামত দিলেন এবং জন্মের সপ্তম দিনে স্বয়ং নিজে একটি দিংবা দু’টি মেষ জবেহ করে তাঁর আকীকা দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তাঁর মাথার চুল মু-ন করে তা ওজন করে সমপরিমাণ রৌপ্য গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু দরবারে রিসালত ও বেলায়তের কেন্দ্রস্থলে লালিত পালিত হয়ে একজন যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন এবং মুহাদ্দিসে রূপান্তরিত হন। তাঁর যুগের লোকেরা তাঁর নিকট থেকে ফতোয়া গ্রহণ করতেন। তিনি অত্যন্ত সাবলিল ভাষায় বক্তব্য রাখতেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ১২৯ টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ইবনে আছাকির বর্ণনা করেছেন, তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। যখনই তাঁর নিকট কোন ফকির আসত, তখন তাঁর নিকট যা থাকত, তা দিয়ে দিতেন। একদা এক ফকির তাঁর দরবারে এসে আরজ করলেন,হুযূর! আমি অত্যন্ত গরিব আর আমার পরিবার অনেক বড়। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। ইমামে আলী মকাম এ কথা শুনে তাকে বললেন, তুমি বস। কিছুক্ষণ পর জনৈক ব্যক্তি পাঁচ থলে দিনার নিয়ে তাঁর দরবারে উপস্থিত হলো। তিনি পাঁচ থলে দিনার ঐ ফকিরকে দিয়ে দিলেন এবং নিজের জন্য কিছুই রাখেননি। তিনি দিন-রাত ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন। তিনি নিয়মিতভাবে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করতেন আর আল্লাহর স্মরণে সদা মশগুল থাকতেন। এমনকি তিনি শাহাদাত বরণের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কোন নফল নামাযও ত্যাগ করেননি। এমনকি অন্তিম মুহুর্তেও দুই রাকাত নামায আদায় করেছেন।

হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ় মনোবলের অধিকারী, অকুতোভয় সৈনিক। তিনি জিহাদের ডাকে প্রয়োজনের মুহূর্তে সাড়া দিতে কখনো পিছপা হননি। তাঁকে একবার হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর নিকট দূত হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনীর সাথে কনস্টান্টিনোপলে (ইস্তাম্বুল অভিযানের) যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

৬৮০খ্রিস্টাব্দে সাহাবীয়ে রাসূল হযরত আমীরে মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ওফাতের পর ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়া ক্ষমতায় বসেই স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বস্তুত সে ছিল দুশ্চরিত্র, বেনামাজি ও মদ্যপায়ী। সে ইসলামে চিরতরে নিষিদ্ধ মদ্যপান, সুদ ও একই সাথে দুই সহোদরাকে বিবাহ করা প্রভৃতি হারাম কাজকে বৈধ বলে ঘোষণা দেয়। ফলে সমাজে ব্যভিচার, জুয়া, মদ্যপানসহ নানা রকম অনাচার বিস্তার লাভ করে। এ অবস্থায় ধর্মপ্রাণ, সজ্জন ও বিবেকবান মুসলমানগণ উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হয়ে পড়েন। দুঃশাসন, অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবেশ পর্যন্ত উধাও হয়ে যায়। দমন, পীড়ন ও জুলুমের ভয়ে মানুষ নিশ্চুপ থাকাকেই শ্রেয় জ্ঞান করতে লাগলো, এহেন অবস্থার প্রেক্ষাপটে কুফাবাসী ইমাম আলী মকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ১৫০ মতান্তরে ১২০০ চিঠির মাধ্যমে কুফায় যেতে অনুরোধ করে। তারা ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে দেখতে চায় না, তারা ইমাম হোসাইনকেই খিলাফতের অধিকতর যোগ্য মনে করে, তাই তাঁর জন্য জানমাল কোরবানি দিতে প্রস্তুত এবং আহলে বায়তের অনুরক্ত বলে পয়গাম পাঠায়। কুফাবাসীর এই পুনঃ পুনঃ ডাক ও স্বনির্বদ্ধ অনুরোধে সাড়া দিতে মনস্থির করেন তিনি। তাদের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তিনি আপন চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কুফায় পাঠান। ৪০ হাজার মানুষ ইমাম মুসলিমের হাতে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নামে বায়াত গ্রহণ করেন। পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে এ মর্মে বর্ণনা দিয়ে মুসলিম ইবনে আকিল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একজন পত্রবাহককে চিঠি দিয়ে তাঁকে কুফায় আসতে অনুরোধ জানান। চিঠি লেখার পর পরই অবস্থা অন্যরকম হয়ে যায়। তাঁর আগমনের সংবাদ ইয়াজিদ জানতে পেরে উত্তেজিত হয়ে কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশিরকে পদচ্যুত করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে বসরার সাথে কুফার দায়িত্বও প্রদান করে এবং হুকুম জারি করে হুসাইন যেন কোনোভাবেই কুফায় প্রবেশ করতে না পারেন। প্রয়োজনে তাঁর সাথে যুদ্ধ করার সে নির্দেশও দেয় ইয়াজিদ। ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ ছদ্মবেশে দ্রুত কুফায় এসে গভর্ণর হাউজে প্রবেশ করে। তারপর কূফাবাসীরা তার প্রাসাদ মুসলিম ইবনে আকিল ও তাঁর অনুসারীরা ঘেরাও করে আছেন। তিনি সৈন্য দিয়ে হামলা চালিয়ে তাদের হত্যার হুমকি দেন। এতেই কাজ হয়। সবাই দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে। একজনকেও মুসলিম ইবনে আকিল তাঁর পাশে দেখতে পান নি। অতঃপর ইবনে জিয়াদ তাঁকে গ্রেফতার করে নির্মমভাবে হত্যা করেন। হত্যার আগে তিনি ইমাম হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে আরেকটি চিঠি দিয়ে কুফায় আসতে নিষেধ করেন। এই চিঠি তাঁর কাছে পৌঁছার আগেই কূফাভিমুখে রওনা হয়ে যান। পথিমধ্যে তিনি কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং হযরত মুসলিমের শাহাদাতের খবর পান। কিন্তু তিনি সেখান থেকে মক্কায় ফিরে না এসে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকেন, তাঁরা কুফা থেকে দুই মঞ্জিল দূরে তিনি ‘যি জাশাম’ নামক স্থানে ইয়াজিদ বাহিনীর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। এক হাজার সৈন্যের এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন হুর ইবনে ইয়াজিদ। তিনি হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিপ্রবণ ছিলেন। তবে নির্দেশিত দায়িত্ব পালনেও ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। হযরত ইমাম আলী মকাম তার কাছে কুফাবাসীর চিঠি ও দূত মারফত তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা বলেন। হুর ইবনে ইয়াজিদ এ ব্যাপারে তার অজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেন। এক পর্যায়ে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সামনে যাওয়ার অথবা ফিরে যেতে চাইলেন। হুর ইবনে ইয়াজিদ তাঁকে অনুমতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বরং ইবনে জিয়াদের নির্দেশ মোতাবেক এমন একটা জায়গায় হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কাফেলাকে ঠেলে নিয়ে যান, যেখানে কাফেলা অধিকতর অনিরাপদ হয়ে পড়ে। হুর ইবনে ইয়াজিদ কাফেলাকে কারবালা প্রান্তরে নিয়ে যান। ইমাম আলী মাক্বাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্থানটির নাম জানতে চাইলে তাঁকে জানানো হয়, জায়গাটির নাম কারবালা। শুনে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন: এটা দুঃখ ও বালা মুসিবতের জায়গা। এখানেই আমাদের অবতরণের, রক্ত ঝরানোর ও কবরের স্থান। ওদিকে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ আমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্যের একটি দল প্রেরণ করে হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। পরবর্তীতে আরো সৈন্য পাঠানো হয় এবং ঐতিহাসিকদের মতে, মোট সৈন্য সংখ্যা অন্তত ২০ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়। অথচ, যার বিরুদ্ধে যুদ্ধের এই বিশাল আয়োজন, তাঁর কাফেলায় মোট লোকসংখ্যা একশ’র বেশি নয়। যাদের মধ্যে কিছু নারী এবং শিশুও ছিলেন। বস্তুত হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধ করার জন্য আসেননি। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, সংঘাত, হানাহানি তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি শান্তি-নিরাপত্তা, ভ্রাতৃত্ব, পারস্পারিক সহাবস্থান দৃঢ় করার পক্ষে আন্তরিক ছিলেন। যখন কারবালা প্রান্তরে তিনি, তাঁর পরিবার ও সঙ্গী-সাথীরা ইয়াজিদের সৈন্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পতিত, অবরুদ্ধ ইমাম বাহিনীর তাঁবুর পাশেই ফোরাত নদী। তাঁবু থেকে নদীর বয়ে যাওয়া কলকল ধ্বনি কানে আসে; কিন্তু ফোরাতের এক ফোঁটা পানিও মুখে পড়ে না ইমাম বাহিনীর। কারণ এজিদের পাপিষ্ঠ সৈনিক দল যে নদীও অবরুদ্ধ করে রেখেছে। মরুভূমির প্রচন্ড গরম এবং উত্তপ্ত বালিতে সকলেরই প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। এতদসত্ত্বেও তিনি পাপীষ্ঠ ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করার সিদ্ধান্তে অটল এবং আত্মসমর্পণে একেবারেই নারাজ। তিনি বরং যুদ্ধ ও রক্তপাত এড়ানোর জন্য সচেষ্ট। তিনি আমর ইবনে সাদের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব দেন: ১. আমাকে সেখানেই যেতে দাও, যেখান থেকে আমি এসেছি। ২. আমাকে স্বয়ং ইয়াজিদের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দাও। ৩. আমাকে কোনো মুসলিম দেশের সীমান্তে পাঠিয়ে দাও। সে দেশের জনগণের যে অবস্থা হয় আমিও তা গ্রহণ করবো। যা আমর বিন সাদের পছন্দ হয়। এ বার্তা ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠায়। প্রস্তাব ৩টি ইবনে জিয়াদেরও মনোপূত হয়। কিন্তু বাধা আসে সিমারের কাছ থেকে। তার প্ররোচনায় ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ আমর বিন সাদকে এ মর্মে বার্তা পাঠায় যে, ‘ইমাম হুসাইন যদি তাঁর সঙ্গী-সাথীগণসহ আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে তবে যুদ্ধ করবে না। তাদের আমার কাছে নিয়ে আসবে। আর যদি তারা আত্মসমর্পণ না করে তবে যুদ্ধ ছাড়া গত্যন্তর নেই।’ কিন্তু বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন, হক্বের ঝান্ডা বাহক ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইবনে যিয়াদের সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। অবশেষে ৯ মুহাররম রাতে ইমাম আলী মকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজ সাথীদের সাথে পরামর্শ করেন। পরদিন ১০ মুহাররম ৬১ হিজরীতে ফজর নামাজের পর যুদ্ধ যখন অনিবার্য তখন ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এক আবেগময় ভাষণ দেন। তাঁর সেই ভাষণ পাপিষ্ট অন্তরগুলোয় কোন রেখাপাত করেনি। এরপর শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। অন্যায়, অবিচার, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সত্যের জন্য রণাঙ্গনে অকুতোভয় লড়াই করে একে একে তিনি সহ ৭২ জনের সবাই বীরত্বের সাথে শাহাদাতের সুধা পান করেন। কুখ্যাত সীমারের নির্দেশে সিনান বিন আনাস হযরত ইমাম হুসাইনের মাথা মুবারক শরীর থেকে আলাদা করে। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) জাতীয় কবি নজরুলের ভাষায়-
“কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে।”

কিন্তু সে কাঁদন পাষাণ হৃদয় সীমারদের কাঁদাতে পারেনি। তবে সে দৃশ্যে আজও মুসলিম উম্মাহর অশ্রু ঝরছে। পরিবারের নারী ও শিশুসহ বাকিরা বন্দী হন। যুদ্ধ শেষে শহীদদের শিরোচ্ছেদ করে ইয়াজিদের বেরহম সৈনিকরা। শহীদদের লাশ বিকৃত করা হয় এবং ঘোড়া দিয়ে মাড়ানো হয়। হযরত ইমামের পরিবারের শিবিরের তাঁবুতে লুটপাট করা হয়। তাদের হত্যা বা পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও হয়। ছিন্ন মস্তকসমূহ ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের কাছে পাঠানো হয়।

কারবালার ঘটনায় ইয়াজিদের ভুমিকা
ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে শহীদ করার ব্যাপারে ইয়াজিদ সরাসরি জড়িত ছিল। ইয়াজিদ শাসক হওয়ার পর মদিনায় নিযুক্ত উমাইয়া শাসক ওয়ালিদ ইবনে উতবাকে নির্দেশ দিয়েছিল-“হুসাইনকে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে, আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরকে ও আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইরকে শক্তভাবে বায়আত করার জন্য পাকড়াও কর। যে বায়আত তথা আমার আনুগত্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করবে তার মাথা কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও”।

শেষ পর্যন্ত ইমাম হোসাইন বায়‘আত না করে মক্কায় হিজরত করেন। কুফাবাসীরা ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট অসংখ্য পত্রাদি প্রেরণ করে তাকে সেখানে আসতে আহবান জানালো। তারপর ইমাম-ই আলী মাক্বাম প্রথমে মুসলিম ইবনে আক্বীলকে অবস্থা জানার জন্য পাঠালেন। অবস্থা প্রথমে ভালো থাকার সংবাদ পেয়ে তিনি কূফাভিমুখে রওনা হন, তারপর কারবালা প্রান্তরে উপনীত হয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য হন। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনাদি সংঘতি হয়।

পরিশেষে বলা যায়, কারবালার ঘটনার একপিঠে ছিল পাশবিক নৃশংসতা ও নির্মমতা। যার হোতা ছিল ইয়াজিদ, ইবনে সা’দ, ইবনে জিয়াদ এবং শিমার। আর অপর পিঠে ছিল একত্ববাদ, দৃঢ় ঈমান, মানবতা, সাহসিকতা, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা এবং সত্য প্রতিষ্ঠায় আত্মদানের বিরল কাহিনী। হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তবু ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে প্রতিরোধ সংগ্রামের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। ইয়াজিদ যেমন অভিশপ্ত তেমনি ইয়াজিদীরাও অভিশপ্ত, নির্লজ্জ ও অবিবেচক। আর যারা ইয়াজিদের পক্ষে সাফাই গায় তারা ইসলামের দুশমন। ইয়াজিদ কোন মতেই কুসতুনতুনিয়া-বিষয়ক হাদীসের সুসংবাদের আওতায় আসবে না। সে ক্ষমা পাবার উপযোগীও নয়। ইমামে আহলে সুন্নাত শাহ্ আহমদ রযা খাঁন রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরবারে যখন ইয়াজিদের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হল তিনি বলেন, ইয়াজিদ নিঃসন্দেহে অপবিত্র ছিল, তাকে অপবিত্র বলা ও লিখা জায়েয এবং তাকে রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলা যাবে না। কেননা, সে তার অন্তরে হযরত আলী এবং হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের প্রতি রাগ ও শত্রুতা পোষণকারী। সে আহলে বাইতে রিসালাতের শত্রু। [ফতোওয়ায়ে রযবীয়া, ১৪/২০৩]

পক্ষান্তরে হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সত্যের উপর ছিলেন। তিনি ইয়াযীদ ও ইয়াযীদের বাতিল খিলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে ইসলামের গৌরবকেই অক্ষুন্ন রেখেছেন। সত্য ও ন্যায়, সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হজরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁর সঙ্গী-সাথিরা যেভাবে বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ত্যাগ চিরকাল দেশে দেশে যুগে যুগে এ ধরনের সঙ্কট ও সমস্যা উত্তরণের ব্যাপারে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সত্যের পথে এবং অসত্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের তা জোগাবে হিম্মত ও প্রেরণা।

লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল-আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •