হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
اَلرَّحْمٰنُ (1 ( عَلَّمَ الْقُرْاٰنَ (2(خَلَقَ الْاِنْسَانَ ((3 عَلَّمَهُ الْبَیَانَ (4 ( اَلشَّمْسُ وَ الْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ (5( وَّالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ یَسْجُدٰنِ (6( وَ السَّمَآءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِیْزَانَ (7 ( اَلَّا تَطْغَوْا فِی الْمِیْزَانِ (8( وَاَقِیْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِیْزَانَ (9( وَالْاَرْضَ وَضَعَهَا لِلْاَنَامِ (10 ( فِیْهَا فَاكِهَةٌ ﭪ–وَّالنَّخْلُ ذَاتُ الْاَكْمَامِ(11( وَالْحَبُّ ذُو الْعَصْفِ وَالرَّیْحَانُ (12 ( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ (13( خَلَقَ الْاِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ (14 (وَخَلَقَ الْجَآنَّ مِنْ مَّارِجٍ مِّنْ نَّارٍ(15( فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ (16( رَبُّ الْمَشْرِقَیْنِ وَرَبُّ الْمَغْرِبَیْنِ (17(فَبِاَیِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ (18(
আল্লাহর নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমা: পরম দয়ালু (আল্লাহ) কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন (আপন মাহবুব নবীকে) তিনি মানব (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে) সৃষ্টি করেছেন। ( যা সৃষ্টি হয়েছে এবং যা সৃষ্টি হবে সব বিষয়ের) সুস্পষ্ট বিবরণ আল্লাহ তাঁকে (অর্থাৎ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ) শিখিয়েছেন। সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব অনুসারে রয়েছে। এবং তৃণলতা ও বৃক্ষরাজি সাজদা করে। আর তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন পরিমাপ দ-। যাতে তোমরা পরিমাপে ভারসাম্য লংঘন না করো। আর ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে পরিমাপ প্রতিষ্ঠা করো এবং ওজনে কম দিয়ো না। আর তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্টি জীবের জন্য। তাতে ফলমূল ও আবরনযুক্ত খেজুর বৃক্ষ রয়েছে। এবং খোসা বিশিষ্ট শস্যদানা ও সুগন্ধিময় ফুল। সুতরাং (হে জিন ও মানব!) তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ঠনঠনে মাটি থেকে, যেমন পোড়া মাটি। এবং জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নি-শিখা থেকে। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? তিনি উভয় উদয়াচল এর মালিক এবং উভয় অস্তাচলের মালিক। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন অনুগ্রহকে অস্বীকার করবে? (সূরা আর রহমান-১ থেকে ১৮ নং আয়াত)
আনুষঙ্গিক আলোচনা
শানে নুযুল: আলোচ্য সুরা আর-রহমান এর শানে নুযূল বর্ণনায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-কুরআনে করিমের আয়াত اسجدوا للرحمن (অর্থাৎ পরম দয়ালু কে সাজদা করো) যখন অবতীর্ণ হলো, মক্কার কাফিরগণ বলতে লাগলো-‘রাহমান কি? আমরা তো জানিনা।” এর জবাবে মহান আল্লাহ সূরা আর-রাহমান অবতীর্ণ করলেন। আর এরশাদ করলেন-‘ রাহমান’, যাঁকে তোমরা অস্বীকার করছো, তিনিই সেই স্বত্ত্বা, যিনি পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ করেছেন।
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে-মক্কাবাসীগণ যখন বললো-‘মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ কে কোন মানুষ শিক্ষা দেয়?’ তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হল। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করলেন-‘রাহমান’ তথা পরম দয়ালু স্বত্তাই আপন হাবীব মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। (তাফসিরে খাযেন ও খাযায়েনুল ইরফান শরিফ)
উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে প্রতীয়মান হয়-রাসূলে খোদা আশরাফে আম্বিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল নবী-রাসূল আলাইহিমুস সালাম অপেক্ষা সর্বাধিক ও শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী তথা জ্ঞানের আঁধার। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সাইয়্যেদুনা হযরত আদম আলায়হিস সালাম কে সব জিনিসের নাম শিক্ষা দিয়েছেন, সাইয়্যেদুনা হযরত সুলাইমান আলাইহিমুস সালাম কে পক্ষীসমূহের কথোপকথন শিক্ষা দিয়েছেন, সাইয়্যেদুনা হযরত দাউদ আলাইহিস সালামকে লৈাহ বর্ম তৈরী করন, সাইয়্যেদুনা হযরত খিজির আলায়হিস সালামকে ইলমে লাদুন্নি তথা ইলমে বাতেন এবং হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে কিশতি তৈরী করন শিক্ষা দিয়েছেন। আর নবীকূল সরদার মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পবিত্র কুরআনে করিম শিক্ষা দিয়েছেন- যাতে ‘লাওহে-মাহফুজ’ এর জ্ঞান ভান্ডারের বিশদ বিবরণ নিহিত রয়েছে। তাই আল্লাহর হাবীবের জ্ঞান-সমুদ্রের বিস্তৃতি অশেষ-অপরিসীম ও অপরিমেয়। যাঁর শিক্ষাদানকারী স্বয়ং আল্লাহ আর পবিত্র কুরআন হলো যাঁর অধীত মহা গ্রন্থ সেই স্বত্তার জ্ঞান-গরিমার পরিধি পরিমাপের কল্পনা ধৃষ্টতা বৈ অন্য কিছু নয়। (তাফসিরে নূরুল ইরফান শরীফ)
الشمس والقمر بحسبان
আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-মহান আল্লাহর দৃশ্যমান ও সুস্পষ্ট অপার কুদরতের নিদর্শনাবলীর অন্যতম হলো চন্দ্র-সূর্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবকূলের জন্য ভূ-মন্ডলে ও নভোমন্ডলে অসংখ্য অবদান-নেয়ামতরাজি সৃষ্টি করেছেন। উদ্ধৃত আয়াতে নভোমন্ডলীয় নেয়ামত সমূহের মধ্য থেকে বিশেষভাবে সূর্য-চন্দ্র এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, বিশ্বজগতের গোটা ব্যবস্থাপনা এই দুটি গ্রহের গতি ও কিরণ রশ্মির সাথে গভীরভাবে জড়িত রয়েছে। حسبان শব্দটি করো কারো মতে ধাতু। এর অর্থ হিসাব। কেউ কেউ বলেন যে, এটা حساب শব্দের বহুবচন। অতএব আয়াতের উদ্দেশ্য হলো- সূর্য ও চন্দ্রের গতি এবং কক্ষপথে বিচরণের অটল ব্যবস্থা। একটি বিশেষ হিসাব ও পরিমাপ অনুযায়ী চালু রয়েছে। সূর্য ও চন্দ্রের গতির উপরই মানব জীবনের সকল কার্যক্রম নির্ভর করবে। এর মাধ্যমেই দিবারাত্রির পার্থক্য, ঋতু পরিবর্তন এবং মাস ও বছর নির্ধারিত হয়। حسبان শব্দটিকে حساب এর বহুবচন ধরা হলে অর্থ এই হবে যে, সূর্য ও চন্দ্র প্রত্যেকের পরিক্রমনের আলাদা আলাদা হিসাব আছে। বিভিন্ন ধরনের হিসাব এর উপর সৌর ও চন্দ্র ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এসব হিসাবও এমন অটল ও অনড় যে, লাখো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও এতে এক মিনিট বা এক সেকেন্ডের পার্থক্য হয়নি। (সুবহানাল্লাহ)
والسماء رفعها ووضع الميزان
উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরশাস্ত্র বিশারদগণ উল্লেখ করেছেন- رفع আর وضع দুটি পরষ্পর বিপরীত অর্থ বোধক। رفع মানে সমুন্নত করা আর وضع মানে নীচে রাখা। আলোচ্য আয়াতে প্রথমে আসমানকে সমুন্নত করার কথা বলা হয়েছে। স্থানগত উচ্চতা ও মর্যাদাগত উচ্চতা উভয়ই এর অর্ন্তভূক্ত। কারণ আকাশের মর্যাদা পৃথিবীর তুলনায় উচ্চ ও শ্রেষ্ঠ। পৃথিবী আকাশের বিপরীত গণ্য হয়। সমগ্র কুরআনে করীমের এই বৈপরীত্য সহকারেই আসমান-যমীনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে আসমানকে সমুন্নত করার কথা বলার পর মীযান স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে, যা আকাশের বিপরীতে আসেনা। চিন্তা করলে দেখা যায় যে, এখানেও প্রকৃতপক্ষে আকাশের বিপরীতে পৃথিবীকে আনা হয়েছে। এর তিন আয়াতের পর বলা হয়েছে والارض وضعها للانام কাজেই মূলত: আসমান ও যমীনের বৈপরীত্যই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু বিশেষ রহস্যের কারণে উভয়ের মাঝখানে তৃতীয় একটি বিষয় অর্থাৎ মীযান স্থাপন করার কথা বলা হয়েছে। মনে হয় এতে রহস্য এই যে, মীযান স্থাপন এবং পরবর্তী তিন আয়াতে বর্ণিত মিযানকে যথাযথ ব্যবহার করার নির্দেশ, এতদুভয়ের সারমর্ম হচ্ছে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং আত্মসৎ ও নিপীড়ন থেকে রক্ষা করা। এখানে আকাশকে সমুন্নতকরন ও পৃথিবী স্থাপনের মাঝখানে মীযান এর কথা উল্লেখ করার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করার আসল উদ্দেশ্য ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। পৃথিবী শান্তি, ন্যায় এবং ইনসাফের মাধ্যমেই কায়েম থাকতে পারে। নতুবা অনর্থই হবে।
সাইয়্যেদুনা ইমাম ক্বাতাদাহ র. ইমাম মুজাহিদ র. ইমাম সুদ্দী র. প্রমূখ মীযান শব্দের তাফসীর করেছেন ন্যায় বিচার। কেননা, মীযান তথা দাড়িঁপাল্লার আসল লক্ষ্য ন্যয় বিচারই। তবে মীযানের প্রচলিত অর্থ হচ্ছে দাঁড়ি পাল্লা। কোন কোন তাফসির বিশারদ মিযানকে এই অর্থেই নিয়েছেন। এর সারমর্ম ও পারষ্পরিক লেন- দেনে ন্যায় ও সুবিচার কায়েম করা। এখানে মিযানের অর্থ এমন যন্ত্র দাখিল আছে, যদ্ধারা কোন বস্তুর পরিমাণ নির্ধারন করা হয়, তা দুই পাল্লা বিশিষ্ট হোক কিংবা আধুনিক কোন পরিমাপ যন্ত্র হোক।
والحب ذوالعصف والريحان
উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর বেত্তাগণ উল্লেখ করেছেন-জীন-ইনসান সহ প্রাণীকূলের জীবন ধারনের জন্য মহান আল্লাহ প্রদত্ত খোসা বিশিষ্ট শস্যদানা সহ বিভিন্ন প্রকারের রিজিক খোদায়ী অনুগ্রহ রাজির অন্যতম। حب মানে শস্য দানা। যেমন গম, বুট, ধান ও মসুর ইত্যাদি। عصف সেই খোসা কে বলা হয়, যার ভিত্তিতে আল্লাহর কুদরতে মোড়ক বিশিষ্ট অবস্থায় শস্যের দানা সৃষ্টি করা হয়। এই খোসার আবরনে মোড়ক বিশিষ্ট হওয়ার কারনে শস্যের দানা দূষিত আবহাওয়া ও পোকামাকড় ইত্যাদি থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকে। শস্যের দানার সাথে খোসা বিশিষ্ট কথাটি যোগ করে বুদ্ধিমান মানুষের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট করা হয়েছে যে, তোমরা যে রুটি-ডাল ইত্যাদি প্রত্যহ কয়েকবার আহার কর, এর এক একটি দানাকে সৃষ্টিকর্তা কিরূপ সুকৌশলে মৃত্তিকা ও পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এরপর কিভাবে একে কীট পতঙ্গ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য আবরন দ্বারা আবৃত করেছেন। এত কিছুর পরই সেই দানা তোমাদের মুখের গ্রাসে পরিণত হয়েছে। এর সাথে আরও একটি নেয়ামতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, এই খোসা তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুর খোরাক হয়, যাদের দুধ তোমরা পান কর ও যাদেরকে তোমরা বোঝা বহনের কাজে নিয়োজিত কর।