অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَكْثِرُوْا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَاتِ يَعْنِىْ الْمَوْتَ
[رواه الترمذى والنسائى]
عَنْ بُرَيْدَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُوْرِ فَزُوْرُوْهَا [رواه مسلم]
অনুবাদ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা আনন্দ ধ্বংসকারীর অর্থাৎ মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো। [তিরমিযী ও নাসাঈ] হযরত বুরায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম এখন তোমরা কবর যিয়ারত করো।
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মৃত্যু এক কঠিন বাস্তবতা, যা অনিবার্য সত্য, প্রত্যেক আত্মা মরণশীল। মানুষ কখন কোথায় কিভাবে মৃত্যু বরণ করবে তা আল্লাহ্ই অধিক জ্ঞাত। মৃত্যু থেকে পালাবার কোন সুযোগ নেই। যতবড় শক্তিধর সৃষ্টি হোক, মৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই। আমরা আল্লাহর জন্য নিশ্চয়ই তাঁরই দিকে ফিরে যাবো। ক্ষণস্থায়ী জীবনের মোহ ও ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে চিরস্থায়ী জীবনের কথা ভুলে যাওয়া কখনো একজন মু’মিনের কাম্য নয়। মৃত্যুকে অধিক অধিক স্মরণ করা, উত্তম ও নেক আমলের মাধ্যমে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা ঈমানের পরিচায়ক। বর্ণিত হাদীস শরীফ দু’টির প্রথমটিতে বেশি বেশি মৃত্যুর স্মরণ করা ও দ্বিতীয় হাদীসে কবর যিয়ারতের নির্দেশনা রয়েছে কেননা কবর যিয়ারতের মাধ্যমে পরকালের কথা ও মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়।
কবর যিয়ারতের সময় আমরাও আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত সময়ে কবরবাসীদের সাথে মিলিত হওয়ার স্বীকারোক্তি ব্যক্ত করছি। উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَيْفَ اَقُوْلُ لَهُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ قَوْلِى اَلسَّلاَمُ عَلَى اَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَيَرْحَمُ اللهُ الْمُسْتَقْدِمِيْنَ مِنَّا وَالْمُسْتَاخِرِيْنَ وَاِنَّا اِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمُ فَلاَ حِقُوْنَ [رواه مسلم]
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আমি কবর যিয়ারতকালে কবরবাসীদের জন্য কি বলব? নবীজি এরশাদ করেন, তুমি বলবে, ‘মু’মিন ও মুসলিম গৃহবাসীদের উপর সালাম এবং আল্লাহ্ ক্ষমা করুন, আমাদের মধ্যে যারা অগ্রগামী এবং আমাদের মধ্যে যারা পশ্চাৎগামী আর নিশ্চয় আমরা আল্লাহ্ চাইলে আপনাদের সাথে মিলিত হব। [মুসলিম শরীফ]
মৃত্যু চিরন্তন সত্য
এটা মহান আল্লাহর চিরন্তন শাশ্বত বিধান যে, যারাই এ পৃথিবীতে এসেছেন এ পার্থিব জগত থেকে তাদেরকে বিদায় নিতেই হবে। বাদশাহ হোক, ফকীর হোক, রাজা হোক, প্রজা হোক, পুরুষ হোক, নারী হোক, শিশু হোক বৃদ্ধ হোক প্রত্যেক মানুষ ও প্রাণীকুলের জন্য মৃত্যু অপরিহার্য। كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ প্রত্যেক আত্মা মৃত্যুর স্বাদ আশ্বাদনকারী। [আল কুরআন, পারা: ৪]
আফসোস, আমরা মানুষ, আমরা কিন্তু মৃত্যুর কথা স্মরণ করিনা। অথচ আমরা বিশ্বাস করি আমাদেরকে মৃত্যুবরণ করতেই হবে। প্রতিদিন আমাদের সম্মুখে কতো মানুষের জানাযা দৃশ্যমান হচ্ছে, কতজন কতভাবে মৃত্যুবরণ করছে, এতো সব কিছু দেখার পরও আমরা গুনাহের কাজ থেকে বিরত হচ্ছি না, প্রতিনিয়ত গুনাহের কাজে আমরা লিপ্ত আছি।
মৃত্যুর স্মরণ
একদা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মসজিদের দিকে তাশরীফ নিয়ে যাচ্ছিলেন, এমতাবস্থায় নবীজি এমন একদল লোকদের দেখলেন যারা হাসাহাসি করে কথা বলছিলেন, নবীজি এরশাদ করলেন, তোমরা মৃত্যুকে স্মরণ কর, আল্লাহর শপথ! যার কুদরতী হস্তে আমার প্রাণ। আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তোমরা কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে। [ইয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড-৪, পৃ. ৩৯২]
মৃত্যুর কথা স্মরণকারী শহীদগণের সঙ্গী হবেন
উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ্! শহীদদের সাথে কাদের হাশর হবে? রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দিনে রাতে বিশবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করে তাঁকে কিয়ামত দিবসে শহীদগণের সাথে উঠানো হবে। [মুকাশিফাতুল কুলুব, পৃ. ১৮৬]
মাহবুবে খোদা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মৃত্যু মু’মিনের জন্য উপহার স্বরূপ। [হিলয়াতুল আউলিয়া, খন্ড-৮, পৃ. ১৯৯, কানযুল উম্মাল,
খন্ড-৫ম, পৃ. ৫৪৬, মুকাশিফাতুল কুলব, পৃ.১৮৬]
তিনটি জিনিস উত্তম
হযরত আবুদ্ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, আমি দারিদ্রকে বিনয়ের জন্য উত্তম মনে করি। মৃত্যুকে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্য উত্তম মনে করি, রোগ ব্যাধিকে নিজের গুনাহ্ ক্ষমা হওয়ার কারণ হিসেবে উত্তম মনে করি। [বায়হাক্বী, শুয়াবুল ঈমান]
মৃত্যু বন্ধুর সাথে মিলনের সেতুবন্ধন
হযরত হিব্বান ইবনে আসওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, اَلْمَوْتُ جَسْرٌيُوْصِلُ الْحبيبَ اِلى الْحَبِيْبِ মৃত্যু একটি সেতু, যার মাধ্যমে বন্ধুর সাথে বন্ধুর মিলন ঘটে। [শরহুস সুদূর, পৃ. ১৭]
মালাকুল মওত
মালাকুল মওত হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস্ সালাম’র সন্নিকটে এলেন, তার প্রাণ বের করবেন, ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম বললেন, এক বন্ধু আরেক বন্ধুর প্রাণ কবজ করতে কি দেখেছেন? একথা শুনে মালাকুল মাওত আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হলেন, আল্লাহ্ তা‘আলা বললেন, তুমি যাও ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে বলে দাও? আপনি কি কখনো এক বন্ধুকে অপর বন্দুর সাথে সাক্ষাৎ করাকে মন্দ জানতে পেরেছেন? তখন ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম মালাকুল মাওতকে বলে দিলেন, এখনই আমার রূহ কবজ করে নিন। [শরহুস সুদুর, পৃ. ১৭]
হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজের ক্রন্দন
আমিরুল মু’মেনীন হযরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু একদা এক আলেমকে বলেন আমাকে উপদেশ দিন, তিনি বলেন, আপনি খলিফা হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু থেকে রক্ষা পাবেন না। আপনার পূর্ব পুরুষগণ হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছেন। এখন আপনার পালা, এ কথা শুনে আমিরুল মু’মেনীন দীর্ঘক্ষণ ক্রন্দন করলেন।
[মুকাশিফাতুল কুলুব, পৃ.১৮৯]
আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মৃত্যুর প্রতি ভালোবাসা
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আবু যাকারিয়া (রা.) বর্ণনা করেন, যদি আমি জানতে পারি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে এখতিয়ার দিয়েছেন যে, আমি যদি ইচ্ছে করি একশত বৎসর বেঁচে থাকব অথবা আজকে মারা যাবো তাহলে আমি আজকের মৃত্যু বরণ করাকে গ্রহণ করে নিতাম। যেন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাত করতে পারি। [শরহুস সুদুর, পৃ. ১৮]
ঘরে কবর নির্মাণ করে রেখেছে
হযরত রবীঈ বিন হুশাইম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নিজ ঘরে এক কোণে কবর খনন করে রেখেছিলেন এবং দিনে কয়েকবার এতে শয়ন করতেন, সর্বদা মৃত্যুর কথা স্মরণ করে বলতেন, যদি আমি এক মুহূর্তের জন্যও মৃত্যুর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে পড়ি, তখন আমার সকল আমলই বিনষ্ট হয়ে যাবে। [মুকাশিফাতুল কুলুব, পৃ.১৯০]
মৃত্যুর সময় কলেমা শরীফ পড়ানো
عَنْ اَبِىْ سَعِيْدِ الْخُدُرِىْ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَّنُوْا مَوْتَاكُمْ لاَ اِلهَ اِلاَّ اللهُ [رواه مسلم]
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা তোমাদের মৃত্যু পথযাত্রীকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু তালকীন পাঠ করাবে।
[সহীহ্ মুসলিম খন্ড ২য়, পৃ. ৬৩১, আবু দাউদ শরীফ, খন্ড-৩, পৃ. ১৯০]
হে আল্লাহ্ আমাদেরকে বেশি বেশি মৃত্যুর স্মরণ ও নেক আমল করার তাওফিক দিন। আমীন।
লেখক: অধ্যক্ষ, মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম।