দরসে কোরআন :অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
فَلَمَّا رَأَوْهُ زُلْفَةً سِيئَتْ وُجُوهُ الَّذِينَ كَفَرُوا وَقِيلَ هَذَا الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تَدَّعُونَ- قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَهْلَكَنِيَ اللَّهُ وَمَنْ مَعِيَ أَوْ رَحِمَنَا فَمَنْ يُجِيرُ الْكَافِرِينَ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ- قُلْ هُوَ الرَّحْمَنُ آمَنَّا بِهِ وَعَلَيْهِ تَوَكَّلْنَا فَسَتَعْلَمُونَ مَنْ هُوَ فِي ضَلَالٍ مُبِينٍ- قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَصْبَحَ مَاؤُكُمْ غَوْرًا فَمَنْ يَأْتِيكُمْ بِمَاءٍ مَعِينٍ-
আল্লাহর নামে আরম্ভ যিনি পরম করুণাময়, দয়ালু
তরজমাঃ (মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন) অতঃপর যখন তারা ওটা (অর্থাৎ প্রতিশ্রুতির বিষয়) সন্নিকটে দেখতে পাবে তখন কাফিরদের মুখমন্ডল মলিন হয়ে পড়বে এবং তাদেরকে বলা হবে এটাই হচ্ছে তা-যা তোমরা চাচ্ছিলে। (ওহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) আপনি বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখেছ, যদি আল্লাহ আমাকে ও আমার সঙ্গিদেরকে ধ্বংস করে দেন কিংবা আমাদের প্রতি দয়া করেন তবে সে কে আছে, যে কাফিরদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? (ওহে নবী!) আপনি বলুন, তিনিই পরম দয়াময় (রহমান) আমরা তাঁর উপর ঈমান আনায়ন করেছি এবং তাঁরই উপর নির্ভর করেছি। সুতরাং এখন তোমরা জানতে পারবে কে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে । (ওহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) আপনি বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি? যদি তোমাদের পানি ভূ-গর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কে তোমাদের নিকট সরবরাহ করবে পানির ¯্রােতধারা। [২৭-৩০ নং আয়াত, সূরা আল মূল্ক]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَهْلَكَنِيَ اللَّهُ এর শানে নুযুল
উদ্ধৃত আয়াতের শানে নুযুল বর্ণনায় মুফাচ্ছেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন, মক্কার কাফির-মুশরিকগণ এনতেজার করতো রাসূলে খোদা আশরাফে আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহুম এর ওফাতের জন্য। তাদের এহেন অসদুদ্দেশ্য খন্ডন করতঃ আলোচ্য আয়াত নাযিল করে এরশাদ হয়েছে, আমাদের ওফাত হয়ে যাওয়া তো তোমাদেরকে আযাব হতে রক্ষা করতে পারবে না। সুতরাং কেন তোমরা সেটার আশায় বসে রয়েছো? এ আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে প্রতীয়মান হয় যে,মুমিন-মুসলিমসহ আল্লাহ ওয়ালাদের মৃত্যু কিংবা ধ্বংস কামনা করা কাফির-মুশরিকদেরই বৈশিষ্ট্য। [নূরুল ইরফান শরীফ]
قُلْ هُوَ الرَّحْمَنُ آمَنَّا بِهِ وَعَلَيْهِ تَوَكَّلْنَا
মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী- “(ওহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!) আপনি বলুন, তিনি পরম দয়াময় আল্লাহ , আমরা তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করেছি এবং তাঁরই উপর ভরসা করি” এর ব্যাখ্যায় মুফাসসরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন “তাওয়াক্কুল” তথা আল্লাহ রাব্বুল আ‘লামীনের উপর সকল কর্মকান্ডে সর্বাবস্থায় যথার্থরূপে নির্ভরশীল হওয়া মুমিনগণের একটি অত্যাবশ্যকীয় ও উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তাওয়াক্কুলের বরকতে-বদৌলতে মুমিনের জাগতিক ও পারলৌকিক সকল কার্যক্রম বরকতময় ও ফলদায়ক হয়। এজন্য কুরআনে কারীমের অসংখ্য আয়াতে ও হাদিসে নববী শরীফের অগণ্য রেওয়ায়াতে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বান্দাগণকে সকল কার্যক্রমে তাওয়াক্কুল অবলম্বনের প্রতি সবিশেষ তাগিদ দান করেছেন। যেমন, এরশাদ হয়েছে, وعلى الله فاليتوكّل المؤمنون অর্থাৎ মুমিনগণ যেন (সর্বাবস্থায় সকল প্রকার কার্য সমাধা করণে) একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করে। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ومن يتوكّل على الله فهو حسبه অর্থাৎ যারা আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয় তিনিই অর্থাৎ আল্লাহই তাদের জন্য যথেষ্ট (সকল উদ্দেশ্য পূরণের জন্য) অন্য আয়াতে আরো এরশাদ হয়েছে, فاذا عزمت فتوكّل على الله অর্থাৎ যখন (কোন বিষয়ে) দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে তখন একমাত্র আল্লাহর উপরই নির্ভরশীল হবে। (তা বাস্তবায়ন করার জন্য) হাদিসে নববী শরীফে রাসূলে কারীম রাউফুর রাহীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,لو انكم تتوكّلون على الله حقّ لو كلّه لرزقكم كما يرزق اطير تغدو خماصاوتروح بطانا অর্থাৎ হে উম্মত! যদি তোমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর যথার্থরূপে ভরসা করো তবে তিনি রিজিক দিয়ে থাকেন (আকাশে উড্ডীয়মান) পক্ষীকুলকে যারা ভোরে খালি পেটে বের হয়ে যায় আর সন্ধায় উদর পূর্তি করে বাসায় ফিরে। (সুবহানাল্লাহ)
তাওয়াক্কুলের প্রকৃত স্বরূপ
প্রকৃত ও পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল ঈমানদারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য। হযরাতে সূফিয়ায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দ্বীন তাওয়াক্কুলের স্বরূপ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এখানে সংক্ষেপে এতটুকু আলোকপাত করতে চাই যে, বাহ্যিক উপায়-উপকরণ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকার নাম তাওয়াক্কুল নয়। বরং তাওয়াক্কুল হল সামর্থ্য অনুযায়ী যাবতীয় বাহ্যিক উপায়-অবলম্বন করার পর ফলাফলের ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সমর্পন করা এবং বাহ্যিক উপায়াদীর জন্য গর্ব না করে আল্লাহর উপর ভরসা করা। এ ব্যাপারে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম নমুনা আমাদের সামনে রয়েছে। স্বয়ং মুসলিম সৈন্য বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা, সামর্থ অনুযায়ী অস্ত্র-শস্ত্র ও অন্যান্য সমরোপকরণ সংগ্রহ করা, রনাঙ্গনে পৌছে স্থানোপযোগী যুদ্ধের মানচিত্র তরী করা, বিভিন্ন ব্যুহ রচনা করে সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহুমকে তথায় সংস্থাপিত করা ইত্যাদি বস্তুনিষ্ঠ ব্যবস্থা বৈ তো নয়। রাসূলে আকরাম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ব-হস্তে এসব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে প্রকারান্তরে একথাই বলে দিয়েছেন যে, বাহ্যিক উপকরনাদি ও মহান আল্লাহর অবদান। এগুলো থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করা তাওয়াক্কুল নয়। এক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে পার্থক্য এতটুকু যে, মুমিনগণ সব সাজ-সরঞ্জাম বৈষয়িক শক্তি-সামর্থ অনুযায়ী সংগ্রহ করার পর ও ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপরই করে। পক্ষান্তরে অমুসলিমরা এ আধ্যাত্মিকতা থেকে বঞ্চিত। তারা বৈষয়িক শক্তির উপরই ভরসা করে। সবগুলো ইসলামী যুদ্ধে এ পার্থক্যটি প্রকাশ পেতে দেখা গেছে।
قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَصْبَحَ مَاؤُكُمْ غَوْرًا
উদ্ধৃত আয়াতে মহান আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহরাজি হতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুগ্রহ বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করণের বিষয় উল্লেখ হয়েছে। পানির অপর নাম জীবন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তোমরা যারা পৃথিবীতে বসবাস করো, ভূ-পৃষ্ঠকে খনন করে কূপ তৈরী কর এবং সেই কূপের পানি দ্বারা নিজেদের পান ও শস্য উৎপাদনের কাজ করো,তোমরা ভুলে যেয়ো না যে, এগুলো তোমাদের ব্যক্তিগত জায়গার নয়, বরং মহান আল্লাহর দান। কেননা, তিনিই পানি বর্ষণ করেছেন, এবং সেই পানিকে বরফের সাগরে পরিণত করে পচনবোধ করার জন্য পর্বতশৃঙ্গে রেখে দিয়েছেন। অতঃপর এই বরফকে আস্তে আস্তে গলিয়ে পর্বতের শিরা-উপশিরার পতে ভূ-গর্ভের অভ্যন্তরে নামিয়ে দিয়েছেন। এরপর কোন পাইপ লাইনের সাহায্য ছাড়া সেই পানিকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন। এখন তোমরা যেথা ইচ্ছা মাটি খনন করে পানি বের করতে পার। তিনি এই পানি মৃত্তিকার উপরের স্তরেই রেখে দিয়েছেন, যা কয়েক ফুট মাটি খনন করেই বের করা যায়। এটা মহান আল্লাহরই এহছান-অবদান। তিনি ইচ্ছা করলে একে নিন্মের স্তরে তোমাদের নাগালের বাইরে নিয়ে যেতে পারেন। তা যদি ভূ-গর্ভের গভীরে চলে যায়, তবে কোন শক্তি পানির এই ¯্রােতধারাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? হাদিসে এরশাদ হয়েছে, উপরোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করায় পর বলা উচিৎ অর্থাৎ বিশ^ পালনকর্তা আল্লাহ তায়ালাই পুনরায় এই পানি আনতে পারেন, আমাদের শক্তি নেই।
পরিশেষে মহান আল্লাহর আলিশান দরবারে কায়েমানো বাক্যে ফরিয়াদ জানাই তিনি যেন সকল মুমিন নর-নারীকে উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করে উভয় জাহানে সফলকাম হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।