মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র মানবপ্রেম-
মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন আলকাদেরী >
মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে শুভাগমন করেছিলেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। যখন অবিশ্বাসীদের হাতে অত্যচারিত হয়েছেন তখনও তাদের হেদায়ত বা সত্যের পথে আসার জন্য সত্য উপলব্ধি করার শক্তি দানের জন্য এবং তাদের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর দরবারে দো‘আ করেছেন। বিশ্বনবী মানবতার নবী এ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য।
আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ রহমত বা দয়া হিসেবে এ জগতে তশরিফ এনেছিলেন রহমাতুল লিল আলামীন। তাই তিনি মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি আহ্বান করেছেন প্রেম ও ভালবাসার মাধ্যমে, শক্তির মাধ্যমে নয়। প্রশ্ন হতে পারে, প্রেম-ভালবাসার মাধ্যমেই ইসলাম প্রচারিত হয়ে থাকে, তাহলে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হায়াতে জাহেরীতে এত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল কেন? এ বিষয়ে সরাসরি বলতে গেলে বলতে হবে, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে কোন আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালিত হয়নি। ইসলামের ইতিহাসে সব যুদ্ধই পরিচালিত হয়েছিল আত্মরক্ষামূলক আর যুদ্ধের মাধ্যমে কেউ ইসলাম গ্রহণ করেননি।
ইসলাম গ্রহণের পিছনে রয়েছে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মানবপ্রেম, মানবতাবোধ ও সুকোমল আচরণ আর পরবর্তী সময়ে তাঁর সঠিক অনুসারীদের মাধ্যমে মানবজাতি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। মানবতার মুক্তির দিশারী সৃষ্টি জগতের প্রতি দয়া বা রহমত প্রদর্শনের দিকে উদ্বুদ্ধ করে এরশাদ করেন-
الرَّاحِمُوْنَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمنُ اِرْحَمُوْا مَنْ فِى الْاَرْضِ يَرْحَمُكُمْ مَنْ فِى السَّمآءِ
অর্থাৎ সৃষ্টি জগতের প্রতি দয়াবানগণ বা রহমতকারীগণের প্রতি রাহমানুর রহিম দয়া করেন। অতএব তোমরা জমীনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া কর, আসমানের অধিপতি তথা ¯্রষ্টা তোমাদের প্রতি দয়া বা রহমত করবেন।
[মিশকাত শরীফ, ৪২৩]
মানব প্রেমের মাধ্যমে শান্তির এ প্রক্রিয়া তিনি শুধু আঞ্চলিক বা জাতীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য ষষ্ঠ হিজরীতে (৬২৮খ্রি.), তিনি স্বাক্ষর করেন, প্রথিবীর ইতিহাসে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বপ্রথম লিখিত শান্তি চুক্তি যা হুদায়বিয়ার সন্ধিনামে আখ্যায়িত। এ চুক্তির প্রতিটি ধারা মুসলমানের বিপক্ষে হওয়া সত্ত্বেও মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তিনি এ চুক্তি সম্পাদন করেন। এ ছাড়াও মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে রাসূলুল্লাহ্ লেখার পরিবর্তে আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম লেখা সত্ত্বেও মানবপ্রেম ও মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কারণে তিনি নির্দ্ধিধায় তাতে স্বাক্ষর করলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর মাতৃভূমি মক্কা শরীফ থেকে তাঁকে হিজরত করতে বাধ্য করা হয়েছিল, অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর প্রতিশোধের পরিবর্তে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মক্কা শরীফে তথা আরবের সব মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের নিশ্চয়তা বিধান করেন। এভাবে গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মানবপ্রেম তথা সৃষ্টিপ্রেমের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করেছেন। আকৃষ্ট করেছেন মানব জাতিকে সত্যের প্রতি, ন্যায়ের প্রতি, ইসলামের প্রতি।
উত্তম চরিত্র বা আদর্শ গ্রহণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তিনি এরশাদ করেন-
اِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ اَحْسَنُكُمْ اَخْلاًقًا
অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে অতি ভাল-মানুষ সেই যে চরিত্রের দিক থেকে উত্তম বা চরিত্রবান।
[মিশকাত শরীফ, ৪৩১ পৃ.]
অন্য হাদীসে পাকে রয়েছে-اِنَّ مِنْ اَحِبَّكُمْ اِلَىَّ اَحْسَنُكُمْ اَخْلاًقًا
অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অতি মাহবূব যে চরিত্রবান। [মিশকাত শরীফ, পৃ. ৪৩১]
এভাবে তিনি মানবতার কয়েকটি ধারা গ্রহণের প্রতি উৎসাহ্ বা উদ্দিপনা প্রদান করেছেন। যেমন মিশকাত শরীফের ৪১৫ পৃষ্ঠায় باب حفظ اللسان والفيبة والشتم রয়েছে-عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ رَضِىَ اللهُ عَنْه اَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اَضْمِنُوْا لِىْ سِتًّا مِنْ اَنْفُسِكُمْ اََضْمَنُ لَكُمُ الْجَنَّةَ اُصْدُقُوْا اِذَا حَدَّثْتُمْ وَاُوفُوْا اِذَا وَعَدْتُّمْ وَاَدُّوْا اِذَا أُءْ تِمُنْتُمْ وَاحْفِظُوْا فُرُوْجَكُمْ وَغُضُّوْا اَبْصَارَكُمْ وَكُفُّوْا اَيْدِيَكُمْ ـ
অর্থাৎ হযরত উবাদা ইবনে সামেত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত নিশ্চয়ই নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা ছয়টি দায়িত্ব বা জিম্মাদারী আদায় কর বা পালন কর, তাহলে আমি তোমাদের জান্নাতের দায়িত্ব গ্রহণ করব, যখন কথা বলবে সত্য বল, ওয়াদা করলে পূর্ণ কর, আমানত রাখলে যথাযথভাবে হেফাজত করতঃ হস্তান্তর কর এবং তোমাদের গুপ্ত অঙ্গ তথা চরিত্র হেফাজত কর। আর তোমাদের দৃষ্টিশক্তি হেফাজত কর ও তোমাদের হাত তথা শক্তি অপব্যবহার থেকে রক্ষা কর।
এভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের মানবপ্রেম আদর্শ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করলে সমাজে সহনশীলতা ভ্রাতৃত্ববোধ সম্প্রীতি ভালবাসা ও সৃষ্টিপ্রেম প্রতিষ্ঠিত হবে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ গ্রহণে ও অনৈতিক, জুলুম, অত্যাচার, অনাচার, ব্যভিচার, পরিত্যাগ করার প্রতি উদাত্ত আহ্বান করে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক আল্লামা ড. ইকবাল বলেন-
مصطفےبرسان خوهش را كه دين همه اويست
اگر باونر سيدى تمام بولھبى است
অর্থাৎ নিজেকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শে পরিচারিত কর। কারণ এটিই দ্বীন। যদি তাঁর আদর্শে পরিচালিত না হও, তাহলে পুরোটাই আবু লাহাবী।
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের সবাইকে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মানবপ্রেমের শিক্ষা, আদর্শ অনুসরণ করার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধি তথা ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ ও শান্তি লাভ করার শক্তি দান করুন।
লেখক: উপাদ্যক্ষ, জামিরজুরী রজবিয়া আজিজিয়া রহমানিয়া সুন্নিয়া ফাযিল মাদরাসা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।