মানব জীবনের সার্থকতা আনতে মাহে রমযান ও যাকাত
হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান
আল্লাহ্ তাআলার জন্যই সমস্ত গুণগান, প্রশংসা ও স্তুতি, যিনি নিজ বান্দার প্রতি অতিশয় দয়ালু ও মেহেরবান। তাঁর কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদেরকে পাপমুক্ত করার জন্য মাহে রমযানের মত মাস দিয়েছেন। তিনি সকল অক্ষমতা, অপারগতা ও দোষ-ত্রুটি হতে চিরপবিত্র, মহামহিম পালনকর্তা। একত্ব ঘোষণা করি তাঁর, যার মত কেউ নাই, কিছু নাই। সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি সেই আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তাঁরই একত্বের নিশান- উড্ডয়নকারী আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। যাঁর আনীত বিশ্বাস ছাড়া পারলৌকিক মুক্তির আর পথ নেই।
মাহে রমযান আবারও এসেছে আমাদের জীবনে, এ কারণে আল্লাহর দরবারে আবারো কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া। কারণ, এ মাসটি সুস্থতার সাথে জীবনে একবার পাওয়াও মহা সৌভাগ্যের বিষয়।
আমরা জানি, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মহিয়সী রমণীদের মধ্যে পবিত্র কুরআনে একজন মাত্র মহিলার নাম উল্লেখ হয়েছে। তিনি হলেন বিবি মারইয়াম আলায়হাস্ সালাম, যিনি হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালামের জননী। এজন্য মুসলিম বিশ্বে তিনি বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। সাহাবীগণের মধ্যে একজন মাত্র সাহাবী, যাঁর নাম কুরআনে পাকে উক্ত হয়েছে, তিনি হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আর বছরের মধ্যে বারোটি মাসের এগারোটি মাসের নাম আল্লাহর কুরআনে উল্লেখ নেই, শুধু একটি মাসের নামই মিলবে, তা হল, ‘শাহরু রামাদ্বান’। সঙ্গত কারণেই মুসলিম মানসে এ মাসের মর্যাদা, শ্রদ্ধা ও গুরুত্ব অনন্য দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে। হবে নাই বা কেন, আল্লাহ তাআলা এ মাসটিতে যে অবতীর্ণ করেছেন তার সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠতম আসমানী গ্রন্থ’ আল কুরআন। স্বয়ং কুরআনই এ প্রসঙ্গে উচ্চকিত, “মাহে রমাদ্বান, যাতে অবতীর্ণ হয়েছে আল কুরআন”। নিজের আগমনী জানান দিয়ে পবিত্র কুরআন প্রকারান্তরে মাহে রমযানের অনন্য মহিমাই কি গেয়ে ওঠল না?
সাধককুল স¤্রাট বড়পীর গাউসুল আ’যম সায়্যিদ আব্দুল কাদের জ্বিলানি রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘রমাদ্বান’ শব্দের ব্যুৎপত্তি প্রসংগে মন্তব্য করেন, এটি আরবী রা-মীম-দ্বোয়াদ- এ বর্ণত্রয় হতে উৎকলিত। এর অর্থ জ্বালিয়ে ভস্ম করা। যেহেতু এ মাসের সাধনা মানুষের মন থেকে পাপের কালিমাকে দাহ করে ভস্ম বানায়, আর একে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করে দেয়, তাই এর নাম রমাদ্বান। অবশ্য আমাদের প্রচলিত বানান উচ্চারণ-বিভ্রাট প্রসূত। গাউসে পাক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু আরো বলেন, ‘রমাদ্বান’ শব্দে পাঁচটি বর্ণ রয়েছে, যা একেকটি স্বতন্ত্র অর্থদ্যোতক। ‘রা’- তে রিদ্বওয়ান (বা আল্লাহর সন্তুষ্টি) ‘মীম’ দিয়ে মুহাব্ব্ত (তাঁর প্রেম-ভালবাসা), ‘দ্বোয়াদ’ দিয়ে ‘দ্বিমান (যামিনদারী) আলিফ-এ ‘উলফত’ (বা অনুরাগ) এবং নূন-এ ‘নূর’ (বা খোদায়ী জ্যোতি)। মোদ্দা কথা হল, বর্ণিত পাঁচটি বিশেষ নেয়ামত’র হাতছানি নিয়ে রমাদ্বান’র মাস আসে। আল্লাহর বান্দা এ মাসের ইবাদত বন্দেগী, রিয়াযত-সাধনায় মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে যখন আল্লাহর প্রতি একাগ্রচিত্তে নিবেদিত হয়, তখন তাঁর ভেতর এ নেয়ামতগুলো বিকশিত হতে থাকে। বুঝা যায়, মাসটির নামের ভেতরও নিহিত আছে খোদায়ী রহস্যের অনন্ত লীলা, হাদীস শরীফের বর্ণনা মতে মাহে রমযানের প্রথম দশক রাহমাত, মধ্যবর্তী দশক মাগফিরাত এবং শেষ ভাগ দোযখ থেকে নাজাত বা মুক্তির। মানুষের জীবনের সার্থকতা হল, তাকে দোযখের আগুন দূরে রাখা এবং বেহেশ্তের অনন্ত সুখের কাননে প্রবিষ্ট করানো। এ দৃষ্টিতে মাহে রমযানের বরাদ্দকৃত রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের প্রাপ্তি একজন বান্দাকে সাফল্যের স্তরে পৌঁছিয়ে দেয়। তাই মাহে রমযান জীবনে একবার পাওয়াও সৌভাগ্যের ব্যাপার। কা’ব বিন আজরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম একবার নির্দেশ দিলেন, সকলে আমার মিম্বরের কাছে সমবেত হও। আমরা হাজির হলাম। আল্লাহর রাসূল মিম্বরের প্রথম ধাপে যখন আরোহণ করলেন, বললেন,‘আমীন’। এ ভাবে দ্বিতীয় ধাপে চড়েও বললেন, ‘আমীন’। অতঃপর তৃতীয় ধাপে আরোহণ করে বললেন, ‘আমীন’। আমরা আরয করলাম, ‘আমরা আজ হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে যা শুনেছি তা আর কখনো শুনিনি।’ তখন আমাদের প্রিয়নবী ইরশাদ করলেন, জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম দুআ করলেন, “বিতাড়িত ওই ব্যক্তি, যে মাহে রমযান পেয়েও মাগফিরাত অর্জন করতে পারল না’। তখন আমি বললাম, ‘আমীন’। দ্বিতীয় ধাপে চড়ার পর তিনি আবার বললেন, ‘হতভাগা সে ব্যক্তি, যার সামনে আমার নাম উল্লেখ হল, অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পড়ল না।’ তখন আমি বললাম, ‘আমীন’। আর যখন আমি তৃতীয় ধাপে দাঁড়িয়েছি, তখন তিনি বললেন, দূর হয়ে যাক সেই ব্যক্তি যার মা-বাবা দু’জন বা কোন একজন বার্ধক্যে উপনীত হয়, আর সে তাদের খেদমত পূর্বক জান্নাতের উপযোগী হতে পারেনি’। এতে আমি বললাম, ‘আমীন’। হাদীস খানা ইমাম হাকেম স্বীয় গ্রন্থে’ লিপিবদ্ধ করেছেন। ইবনে হিব্বান অনুরূপ বর্ণনা হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সূত্রে গ্রন্থিত করেন।
আমরা জেনেছি, মাহে রমযানেই পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। শুধু তাই নয়, যে রাতে কুরআনের অবতরণ হয়, ওই রাতটিকে আল্লাহ তাআলা মর্যাদামণ্ডিত রাত বা ‘লাইলাতুল কদর’ বলে বর্ণনা করেছেন। একটি স্বতন্ত্র সূরা শুধু ওই রাতের মহিমা বর্ণনায় নাযিল হয়েছে। সেই রাতটির এতই মর্যাদা যে, যা এ রাত বিহীন সহস্র মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠতম। কুরআন মজীদ অবতরণের মাস মাহে রমযান, আর এতে নিহিত কদরের রাত, সুতরাং এ মাস শবে কদরের মাসও বটে। আসমানী অন্যগ্রন্থ’ও এ মাসেই অবতীর্ণ হয়।
মাহে রমযান এমন একটি মাস, যার আগমনে জান্নাতেও সাজ সাজ রব পড়ে যায়। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মাহে রমযানের জন্য একটি বছরের শুরু থেকে জান্নাত সুসজ্জিত করা হয় আগামী এক বৎসরের মেয়াদের জন্য।
তিনি সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, যখন মাহে রমযানের প্রথম দিন আসে, আরশের নিচে জান্নাতের পত্র পল্লব হতে বিশেষ এক হিমেল হাওয়া বইতে থাকে, তা এক পর্যায়ে জান্নাতের স্বচ্ছলোচনা হুরদের ওপর বয়ে যায়। তখন তারা আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানায়, হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের জন্য আপনার অনুগত বান্দাদেরকে বেহেশতের সঙ্গী বানিয়ে দিন। যাতে তাঁদের দ্বারা আমাদের নয়ন জুড়াবে, আর আমাদের দ্বারা তাঁদের চক্ষু শীতল হবে।
[বায়হাকী]
এমন একটি মুবারক মাস আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে, এর মর্যাদার লক্ষ্যে আমাদের উচিৎ মাসটিতে সঙ্গত আচরণ করা। বিশেষ করে ফরয রোযা পালনের সাথে সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আচরণে নিজেদের পরিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ ‘আবেদ’ বা আল্লাহর অনুগত বান্দায় পরিণত করতে পারি। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিযাল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন বান্দা এমন নেই যে, মাহে রমযানের রোযা রাখে অযথা কথাবার্তা থেকে বিরত থেকে, আল্লাহর যিকরে (স্মরণ) থেকে, আর তার হালালকে হালাল জেনে এবং হারামকে হারাম জেনে, অথচ রমযানের সমাপ্তির সাথে সাথে তার সমস্ত গুনাহ্ মার্জনা হয়নি। (অর্থাৎ সংযত আচরণে রোযা পালনের প্রতিদানে তার সকল অপরাধ অবশ্যই ক্ষমা করা হবে। এ রোযাদারের প্রতি তাসবীহ্’র বিনিময়ে বেহেশতে তার জন্য সবুজ জমরদের প্রকোষ্ঠ হবে…।
যাকাত : অপরিহার্য এক আর্থিক ইবাদত
মহান আল্লাহ তাআলা মানুষকেই সৃষ্টির সেরা হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকেই তিনি জীবন জীবিকার সুচারু পরিচালনার জন্য বোধ বুদ্ধি, মেধা ও প্রজ্ঞা দান করেছেন। মানুষই উপার্জন করে আর স্ব-উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের ও মানুষের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। মানুষকেই তিনি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদত করার যোগ্যতা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “মহাগ্রন্থ’ মুত্তাকীদের পথ নির্দেশনা, যাঁরা অদেখা বিষয়ে বিশ্বাস রাখে, আর নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদের যা (রুজি) দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে। [সূরা বাকারা : ২-৩]
এখানে বাধ্যতামূলক ও অতিরিক্ত উভয়বিধ দানের কথা বুঝানো হয়েছে।
সম্পদের নির্ধারিত অংশ ব্যয় করা ফরয। এর অতিরিক্ত নফল। বাধ্যতামূলক দান’র মধ্যে যাকাত উল্লেখযোগ্য বিষয়। যা আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় ব্যয় না করলে তাঁর অবাধ্যতা হিসাবে ধর্তব্য হয়।
ইসলামের মৌলিক পাঁচ ভিত্তির অন্যতম হল যাকাত। এটি সম্পূর্ণ একটি আর্থিক ইবাদত। আল্লাহ্তে বিশ্বাসী বান্দা তার অস্তিত্ব দিয়ে শুধু বন্দেগী করে না; বরং তার উপার্জিত অর্থ সম্পদ দিয়েও বন্দেগী করে থাকে। অর্জিত বা বৈধ পন্থায় প্রাপ্ত সম্পদ নির্ধারিত পরিমাণ অংকে উপনীত হয়ে এক বছর কাল সঞ্চিত থাকলে তার ওপর যাকাত দেয়া ফরয। এ নির্দেশ অলংঘনীয়।
যাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা। যাকাতের মাধ্যমে অর্জিত সম্পদে সংমিশ্রিত নিঃস্ব-দরিদ্র্যের নির্ধারিত অংশ বের করা হয় বলে নিজের অর্থ সম্পদ পবিত্র হয়ে যায়। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ইবাদতের নিয়্যতে মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত বর্দ্ধিষ্ণু সম্পদ উদ্ধৃত্ত অবস্থায় পূর্ণ এক বছর অতিক্রান্ত হলে তার মোট মূল্যের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ শতকরা আড়াই ভাগ ফকীর মিসকীন তথা শরীয়তের নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাই যাকাত।
কোন ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য শর্ত হল, মুসলমান হওয়া, স্বাধীন হওয়া, সুস্থ মস্তিষ্ক হওয়া ও বালেগ বা বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া অতএব, অমুসলিম, ক্রীতদাস, উম্মাদ ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ওপর যাকাত ফরয নয়। যাকাত ফরয হওয়ার সাধারণ হুকুম ঘোষিত হওয়া হিজরতের পূর্বে, মতান্তরে ২য় হিজরীতে। বিস্তারিত ব্যবহারিক বিধান জারী হয় ১১ হিজরীতে। [মেরআত শরহে মিশকাত]
যাকাত আচার সর্বস্বতা নয় এটি ইসলামের স্তম্ভ, পবিত্র এক আর্থিক ইবাদত।
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত মুআয রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ইয়ামনের গভর্নর করে পাঠাবার সময় ইরশাদ করেন, ‘নিঃসন্দেহে এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে তুমি যাচ্ছ, যারা আহলে কিতাব। তাদেরকে প্রথমে এ স্বাক্ষ্যের প্রতি আহবান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। যদি তারা তা মেনে নেয়, তবে তাদের জানাবে যে, আল্লাহ্ তাআলা তাদের ওপর দিবারাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যদি তারা ওই নির্দেশের আনুগত্য করে, তবে তাদেরকে একথাও জানিয়ে দেবে যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তাআলা তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং নিঃস্বদেরকে প্রদান করা হবে। যদি তারা এটা মেনে নেয়, তবে তাদের উৎকৃষ্ট সম্পদগুলোর ব্যাপারে সতর্ক থেকো। মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করো। কেননা, তাদের আহাজারি ও আল্লাহর মধ্যে কোন প্রতিবন্ধক নেই।’
[সূত্র: বুখারী মুসলিম, মিশকাত প্রভৃতি]
যাকাত বর্তায় সম্পদের ওপর। উভয়পাশে আছে দাতা ও গ্রহীতা। যাকাত দাতার ওপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্য শর্তাবলি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। যাকাত গ্রহীতা বা কোন ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া যায়, তার বিবরণ সুস্পষ্টভাবে পবিত্র কুরআনেই প্রদত্ত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, যাকাত হলো তাদের জন্য, যারা ১. ফকীর (অভাবগ্রস্থ’), ২. মিসকীন (নিঃস্ব), ৩. যাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারী (যদি তা রাষ্ট্রীয়ভাবে সংগৃহীত হয়), ৪. যাদের (ইসলামের প্রতি) চিত্তাকর্ষণ প্রয়োজন, ৫. চুক্তিবদ্ধ ক্রীতদাস-দাসীর মুক্তির খাতে, ৬. ঋণগ্রস্থ’ ব্যক্তি, ৭. আল্লাহর পথে (শরীয়তসম্মত ধর্মযুদ্ধে) সৈনিকদের সাহায্যে এবং ৮. মুসাফির (বিপন্ন) হলে। এটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত (বিধান)। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান।’ (৯:৬০)
বর্ণিত খাতসমূহের ৪ নং খাত প্রযোজ্য ছিল ইসলামের প্রারম্ভিক যুগে। পরে দ্বীনের মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় সে খাত রহিত হয়। বাকি খাতগুলো অপরিবর্তিত।
যাকাতদাতার বৈশিষ্ট্য ও খাতসমূহ বর্ণিত হল, এবার সম্পদের জন্য প্রযোজ্য শর্তাবলি যা দ্বারা এর ওপর যাকাত ফরয হয় তা দেখা যেতে পারে। প্রথমত: সম্পদ উৎপাদনোপযোগী বা বাড়ানো যায়, এমন হওয়া, মৌলিক প্রয়োজন (যেমন-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও ব্যবহার্য উপকরণ বা বস্তু সামগ্রী) হতে অতিরিক্ত হওয়া, ঋণের দায় থেকে মুক্ত হওয়া এবং পূর্ণ এক বছর উদ্ধৃত্ত অবস্থায় অতিক্রান্ত হওয়া। আর সর্বোপরি সম্পদ নেসাব পরিমাণ হওয়া, অর্থাৎ সে সম্পদের মূল্য বা সঞ্চিত অর্থ সাড়ে সাতভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্য পরিমাণ হওয়া। সে সম্পদ যাকাতদাতার পূর্ণ মালিকানাধীন ও হস্তগত হওয়াও বিধেয়।
যাকাত ফরয হওয়ার পেছনে সামাজিক কল্যাণের মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিহিত। মনে রাখা উচিত, যাকাত দরিদ্র্যের প্রতি ধনীর করুণা নয় বরং আল্লাহর নির্ধারিত এ অংশটি তারই প্রাপ্য অধিকার। গরিব যাকাত নেবার জন্য বাধ্য নয়, পক্ষান্তরে যাকাত দাতা পরের হক থেকে সম্পদকে মুক্ত রাখতে যাকাত দিতে বাধ্য। আর এ বাধ্যতা আল্লাহ তাআলাই আরোপ করেছেন। এ কারণেই প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের নির্ধারিত হক (বা প্রাপ্য) রয়েছে।’ (৭০:২৪)