ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের তাৎপর্য
মুহাম্মদ রবিউল আলম
বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত রাহমাতুল্লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শান্তির ধর্ম ইসলাম নিয়ে পৃথিবীতে প্রেরিত হন। যুদ্ধপ্রিয় আরববাসীর নিকট এ শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচারে তিনি শুধু বাঁধাগ্রস্তই হননি, বরং নির্যাতিতও হয়েছেন। সমগ্র বিশ্বে ইসলাম প্রচারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মদিনা শরীফে হিজরত করেন। তিনি প্রথমে এবং ক্রমান্বয়ে সাহাবায়ে কিরাম। মদিনা শরীফে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে ইসলাম প্রচারে লিপ্ত হন। এতে কাফেরদের মনের জ্বালা আরো বেড়ে গেল। ইসলামকে নিশ্চিহ্ণ দেয়ার উদ্দেশ্যে কাফেররা নানা ষড়যন্ত্র ও চেষ্টা করেছে। এসব চেষ্টার একটি অংশ হল মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া।
মদিনা শরীফে সর্ব ধর্মের লোকেরা বিনা বাঁধায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারতো। ইসলামে সুদের লেনদেন হারাম হওয়ায় মুসলমানগণ সুদ প্রদানের শর্তে টাকা ধার করা সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটাকে সুদখোর ইহুদীগণ তাদের বিরাট আর্থিক ক্ষতি বলে বিবেচনা করলো। কারণ তারা সকলেই ছিল সুদখোর। তারা অন্য কোনো কাজ কর্ম করতো না। কেবল টাকা ধার দিত আর বসে বসে সুদের টাকায় জীবন যাপন করতো। মদিনা শরীফে স্বার্থসিদ্ধি করতে না পারায়, তারা মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার জন্যে গোপনে মক্কার কাফেরদের সাথে জোট করেছিল। পরবর্তীতে মক্কার কুরাইশগণ দলবদ্ধভাবে কয়েকবার মদীনার উপকণ্ঠে এসে মদিনাবাসী মুসলিমদের থেকে দস্যুবেশে হামলা করে লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল। এটিই ছিলো মক্কা-মদীনায় যুদ্ধের ভূমিকা বা বদর যুদ্ধের প্রাথমিক সূত্রপাত। তাছাড়া আরেকটি কারণ হল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট এ সংবাদ এসে পৌঁছেছে যে, আবু সুফিয়ান একটি বাণিজ্যিক কাফেলার পণ্য সামগ্রী নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে যাচ্ছে। আর এ বাণিজ্যে মক্কার সমস্ত কুরাইশদের অংশীদার। মক্কার এমন কোন কুরাইশ নারী বা পুরুষ ছিল না, যার অংশ এ বাণিজ্যে ছিল না। কারো কাছে এক মিসকাল পরিমাণ সোনা থাকলে, তাও সে এ বাণিজ্যের অংশ হিসেবে লাগিয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে, এ কাফেলার মোট পুঁজি ছিল ৫০ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা বা দিনার। ১৪০০ বছর পূর্বে যার মূল্য ছিল প্রায় ২৪ লাখ টাকা, যা বর্তমান বাজারে আনুমানিক ১৫০ কোটির অপেক্ষাও বেশি। প্রকৃতপক্ষে এ বাণিজ্য কাফেলাটি ছিল কুরাইশদের একটি বাণিজ্য কোম্পানী। ইমাম বাগাভী আলাইহির রাহমাহ্ বলেন, এ কথা সকলের জানা ছিল যে, কুরাইশদের এ বাণিজ্য এবং এ বাণিজ্যিক পুঁজিই ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি। এর ওপর ভরসা করেই তারা ক্ষমতার দাপট দেখাতো। সে কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাফেলার গতিরোধ করে মক্কার কাফেরদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে তাদের ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্যে সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দেন। হিজাযের কাছাকাছি এসে আবু সুফিয়ান ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে দমদমা ইবনে আমর গিফারীকে মজুরির বিনিময়ে তৎক্ষণাৎ মক্কা শরীফ পাঠিয়ে কুরাইশদেরকে সংবাদ দিল যে, তারা মুসলমানদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হতে যাচ্ছে। অত:পর আবু সুফিয়ান তার গতিপথ পরিবর্তন করে নিরাপদ রাস্তা দিয়ে মক্কার দিকে রওয়ানা হল। অপরদিকে মক্কার কুরাইশ সরদাররা সংবাদ শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল এবং মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার জন্যে আবু জাহেলের নেতৃত্বে মক্কার এক হাজার সৈন্যবাহিনী পথে বেরিয়ে পড়লো। কাফেরদের যুদ্ধ প্রস্তুতির সংবাদ পেয়ে মহানবী সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করেন। সাহাবায়ে কেরাম বলেছিলেন, আমরা আপনার সাথেই রয়েছি এবং থাকবো। আপনি যদি আমাদেরকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, তবে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়বো। সুবহানাল্লাহ। আমাদের একজন লোকও পেছনে পড়ে থাকবে না। আগামীকাল আপনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করলেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। হযরত মিকদাদ বিন আসওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা সেভাবে বলব না, যেভাবে মূসা আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় মূসা আলাইহিস সালামকে বলেছিলো, ‘আপনি ও আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করুন’। বরং আমরা আপনার ডানে,বামে,সামনে ও পেছনে থেকে যুদ্ধ করবো। এ কথা শুনে রাসূলে করীম খুশি হলেন। [বুখারী শরীফ]
অত:পর আত্মরক্ষার জন্যে রাসূলে করীম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বদর প্রান্তরের কাছাকাছি এসে তাঁবু স্থাপন করেন।
মুসলমানরা আত্মরক্ষার জন্যে বদর প্রান্তরের কাছাকাছি তাঁবু স্থাপন করে অবস্থান করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে লাঠি মুবারক দ্বারা চিহ্ণ করে দেখিয়ে বলেছিলেন যে, আগামীকাল ইনশাআল্লাহ এ জায়গায় অমুক মরবে, ওই জায়গায় অমুক মরবে। এভাবে কোন কাফের নেতা কোন স্থানে নিহত হবে, তা সাহাবায়ে কিরামকে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি তো খোদাপ্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী। তিনি জানতেন যে, তারা যুদ্ধ করবে এবং কোথায় কোথায় নিহত হবে। ইসলামে এ যুদ্ধের তাৎপর্য সীমাহীন। এ যুদ্ধ ছিল সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী। মুসলমান ও ইসলামের অস্তিত্ব অবশিষ্ট থাকার প্রশ্নে এ যুদ্ধে জয়লাভ করা খুবই জরুরী। এ কারণে রাসূলে করীম আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন,‘ হে আল্লাহ, যদি আজ মুসলমানদের এ দল নিশ্চিহ্ণ হয়ে যায়, তবে দুনিয়ায় আপনার এবাদত করার মতো কেউই থাকবে না। হে আল্লাহ, আপনি কি এটা চান যে, আজকের পরে কখনোই আপনার এবাদত করা না হোক? হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনার হাত মুবারক নামিয়ে ফেলুন। আপনার দোয়া আল্লাহর দরবারে কবূল হয়েছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। এদিকে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের প্রতি আদেশ পাঠালেন, যা কুরআনের ভাষায়-“স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন যে, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। সুতরাং তোমরা মুসলমানদেরকে অবিচলিত রাখো আর যারা কুফরী করে আমি তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেব। হে ফেরেশতাগণ, তোমরা শত্রুদের গর্দানের উপরিভাগে আঘাত করো এবং আরো আঘাত হানো প্রত্যেকের গিরায় গিরায়।” [আনফাল, আয়াত নং ১২]
এদিকে হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম রাসুলে করীমের নিকট এসে তাঁদের আগমণ বার্তা দিলেন নবীজী হযরত আবু বকর সিদ্দিককে বলেন, আবু বকর খুশি হও, তোমাদের কাছে আল্লাহর সাহায্য এসে পৌঁছেছে। জিব্রাইল আলাইহিস সালাম ঘোড়ার লাগাম ধরে ঘোড়ার আগে আগে চলছেন আর ধুলোবালি উড়ছে। এ সময়ে ফেরেশতারা মুসলমানদের সাহায্য করেন। যখন অভিশপ্ত ইবলিস কুরাইশদের কাছে সুরাকা ইবনে মালেকের আকৃতি ধারণ করে যুদ্ধে সাহায্য করার কথা বলেছিল কিন্তু মুসলমানদের পক্ষে ফেরেশতাগণের ভূমিকা দেখে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়নের সময় হারিছ বিন হিশাম তাকে আটকে রাখল। সে মনে করল যে, সে প্রকৃতই সুরাকা ইবন মালেক। কিন্তু ইবলিশ হারিছকে বুকে এত জোরে ধাক্কা দিল যে, সে মাটিতে পড়ে গেল। ইত্যবসরে ইবলিশ সেখান থেকে পলায়ন করল। এ অবস্থা দেখে মক্কার কাফেররা বলতে লাগল, সুরাকা তুমি কোথায় যাচ্ছ? তুমি কি বল নি আমাদের সাহায্য করবে এবং কখনো আমাদের থেকে পৃথক হবে না? সুরাকা বলল, আমি এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি , যা তোমরা দেখতে পাচ্ছো না। আল্লাহকে আমার ভয় হচ্ছে, তিনি কঠোর শাস্তিদাতা। এরপর ইবলিশ সমুদ্রে গিয়ে আতœগোপন করলো। (আররাহীকুল মাখতুম) ইবলিশের এ কথা আল্লাহ তায়ালা কুরআনে উদ্ধৃত করে বলেন- إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ অর্থাৎ আমি তোমাদের থেকে সরে দাঁড়ালাম। কেননা আমি যা দেখতে পাচ্ছি (ফেরেশতারদলকে) তোমরা তা দেখতে পাচ্ছো না। আল্লাহকে আমার ভয় হচ্ছে। (কারণ) আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা । [আনফাল,আয়াত:৪৮]
এ যুদ্ধে মুসলমানগণ বিজয়ী হন এবং কাফেররা পরাজিত হয়। ২য় হিজরী সালের ১৭ ই রমযান মোতাবেক ৬২৪ সনের ১৮ নভেম্বর মতান্তরে ১৭ মার্চ শুক্রবার বদর প্রান্তরে সংঘটিত যুদ্ধের নাম বদরের যুদ্ধ। ইসলামের ইতিহাসে এটি সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকে বদরের যুদ্ধে পাঠিয়ে মুসলমানদেরকে সাহায্য করেন। প্রয়োজনের সময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে সাহায্য করার দৃষ্টান্ত হিসেবে এ সাহায্য অমর হয়ে থাকবে। হযরত আলী বর্ণনা করেন, আমি বদরের কূপ থেকে পানি আনার সময় একটা তীব্র দমকা হাওয়া অনুভব করি। কিছুক্ষণ পর আরও একটি দমকা হাওয়া এল। এভাবে পর পর চার বার দমকা হাওয়া এলো। আসলে এটা ছিল প্রধান প্রধান চার সম্মানিত ফেরেস্তা বদর প্রান্তরে উপস্থিত হওয়ার চিহ্ন বহন করে। তাঁরা এক হাজার ফেরেস্তা নিয়ে তাঁবুর ডান দিকে সারিবদ্ধভাবে কাফেরদের উপর আক্রমণ করেন। এতে কাফেররা দিগি¦দিক হয়ে যায়। হযরত ইবনে আব্বাস বলেন, বনী গেফারের এক ব্যক্তি বলল, আমি এবং আমার চাচাত ভাই বদরের এক টিলায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধের দৃশ্য অবলোকন করছিলাম, আমাদের পরিকল্পনা ছিল বিজয়ী দলের সাথে মিশে গিয়ে লুটতরাজে অংশগ্রহণ করব। কেননা, তখন আমরা মুসলমান ছিলাম না। হঠাৎ একখন্ড মেঘ বদরের প্রান্তরে পড়তে দেখলাম এবং আমরা ঘোড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। হে খায়রুম! আগ্রসহ হও। ‘খায়রুম’ হচ্ছে হযরত জিব্রাইল এর বাহনের নাম। আমার চাচাত ভাই সেই আওয়াজ শুনে ভয়ে ঢলে পড়লো আর আমি মৃত প্রায় ছিলাম; কিন্তু বেঁচে গেলাম। [শাওয়াহেদুন নবুয়্যত] ফেরেশতাগণ কর্তৃক শত্রু নিধনের আলামত ছিল গলায় কালো দাগ। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, আমরা তরবারি দ্বারা আঘাত করার পূর্বেই কাফেরদের মস্তক দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়তো। এভাবে নিহত ৭০ জন কাফেরদের মধ্যে ৬৪ জন ছিল ফেরেশতাদের আঘাতে নিহত আর বাকি ৬ জন আমাদের হাতে নিহত হয়েছে। [তাফসীরে রুহল বয়ান]
মুসলমানদের জয়ের জন্যে আল্লাত তায়ালা যা করেছেন, এর বর্ণনা দিয়ে কুরআনে বলেন, “স্মরণ করুন, তিনি তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর বারি বর্ষণ করেন, যা দ্বারা তিনি তোমাদের পবিত্র করেন, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা অপসারণ করেন, তোমাদের হৃদয় দৃঢ় করেন এবং তোমাদের পা স্থির করেন।” [আনফাল,আয়াত:১১]
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ থেকে বহু শিক্ষানীয় বিষয় রয়েছে। তা থেকে কয়েকটি হল- ১. মুসলিমগণ কর্তৃক কোন যুদ্ধ আক্রমনাত্মক ছিল না; বরং আত্মরক্ষামূলক ছিল। বদরের যুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। সিরিয়া থেকে আগত বাণিজ্যিক কাফেলাটিকে গতিরোধ করে মক্কার কাফেরদেরকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলানো প্রয়োজন ছিল। কারণ তারা এ বাণিজ্যিক কাফেলার অর্থ দিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এ কারণেই তো রাসূলে করীম সাহাবায়ে কিরামকে বদরের যুদ্ধের পূর্বে ইরশাদ করেছিলেন, “ওরা তোমাদেরকে ঘিরে না ফেলা পর্যন্ত তরবারি চালনা করবেনা”। [সুনানু আবী দাউদ]
এ জন্যে কোন যুদ্ধে মুসলিমগণ আগে আক্রমণ করেন নি; বরং অমুসলিমগণ আক্রমণ করার পরই মুসলিমগণ আক্রমণ করেছিলেন। ২. বদর য্দ্ধু শুরু হওয়ার আগে রাসুলে করীম বদর পরিদর্শন করতে গেলে, কোন কাফের কোন স্থানে নিহত হবে, তা ইশারা করে সাহাবায়ে কিরামকে বলে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের পরে দেখা গেল যে, কাফেররা সেখানেই নিহত হল, যেখানে রাসূলে করীম দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বুখারী শরীফে বর্ণিত এ সহীহ হাদীস থেকে রাসূলে করীমের ইলমে গায়েব প্রমাণিত হয়। ৩. সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হল সব কিছুর জন্য আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করা। সাহাবায়ে কিরাম নিজের সাধ্যমত প্রস্তুতি গ্রহণ করে অল্প সংখ্যক সৈন্য ও যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে অস্ত্রে সুসজ্জিত বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করায়, তিনি ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করেন। বুখারী শরীফের হাদীস মোতাবেক যুদ্ধ শেষে কতিপয় সাহাবায়ে কিরাম সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তাঁরা সাদা পোশাক পরিহিত কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে দেখেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, আমরা যুদ্ধের আগে কখনো তাঁদেরকে দেখিনি, এমনকি যুদ্ধের পরেও দেখিনি। আবার কিছুসংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম বলেছেন, আমরা তরবারি ব্যবহারকারীকে দেখিনি; কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক লম্বা লম্বা তরবারিগুলো শত্রুদেরকে ঘায়েল করতে দেখেছি। ফলে মুসলিমগণ বিজয় লাভা করেন। ৪. যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্যের প্রাচুর্য্যরে ওপর নিভরশীল নয়, যা এ যুদ্ধ থেকে বোঝা গেল। ৫. মহানবী এ যুদ্ধে নিজেই সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ৬. আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ যে অপদার্থকে মূল্যবান বস্তুতে পরিবর্তন করতে পারেন, এরই একটি দৃষ্টান্ত রাসূলে করীম দেখিয়ে দিলেন। এ যুদ্ধে ওকাশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র তরবারি ভেঙ্গে গেলে, মহানবী তাঁকে খেজুরের একটি শুকনো ডাল দিয়ে বলেন, তুমি এটা দিয়ে যুদ্ধ করো। খেজুরের ডালটি ইস্পাতের তলোয়ারে পরিণত হয়ে গেলো। সুবহানাল্লাহ! এ তলোয়ারের নাম রাখা হয় ‘আউন’ বা সাহায্য। এটি দিয়ে তিনি জীবনভর যুদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে এ যুদ্ধের ময়দানে মুয়ায ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র একটি হাত আবু জেহেলের পুত্র ইকরামার আঘাতে দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। তিনি হাতের খন্ডিত অংশ নিয়ে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাছে উপস্থিত হলে, তিনি সেই খন্ডিত হাত সংযুক্ত করে, তাতে থুথু মোবারক লাগিয়ে দেন। এতে তাঁর হাত পূর্বের ন্যায় জোড়া লেগে গেল এবং উক্ত সুস্থ হাত নিয়ে তিনি হযরত ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র খেলাফতকাল পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। ৬. রাসূলে করীম যে মুস্তাজাবুত দাওয়াত ছিলেন, এ যুদ্ধের বিজয়ই এর প্রমাণ। ৭. মসিবতের সময় আল্লাহ দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করার শিক্ষাও এ যুদ্ধ থেকে পাওয়া যায়। ৮.এ যুদ্ধ থেকে বাস্তবতার শিক্ষাও পাওয়া যায়। ফেরেশতাগণ চাইলে এক নি:শ্বাসে কাফেরদেরকে ধ্বংস করে দিত পারতো; কিন্তু তাঁরা তা করেন নি; বরং স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তরবারি দিয়ে আঘাত করেই কাফেরদেরকে নিহত করেছেন, যাতে প্রমাণিত হয় যে, কাফেররা মুসলমানের তরবারির নিকট স্বাভাবিকভাবেই হেরে গেছে। ফেরেশতাগণ যদি কাফেরদেরকে অস্বাভাবিকভাবে বিনা যুদ্ধে ধ্বংস করে দিতো, তাহলে ইসলাম প্রচারের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হতো না, মুসলমানদের বিজয় ধ্বনি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তো না, কতিপয় সাহাবীর শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন হতো না, বদরী সাহাবীর মর্যাদা অর্জন হতো না, কাফেরদের মনোবল ভেঙ্গে যেতো না, সাহাবায়ে কেরামগণ তাঁদের সফলতার ব্যাপারে নিশ্চিত হতেন না, মুসলমানগণ পরবর্তীতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে আল্লাহ সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যেতেন, কাফেরদের কাছে মুসলমানদের শক্তি প্রমাণিত হতো না। এ কারণে উম্মতের শিক্ষার জন্যে রাসূলে করীম সদাই সব ক্ষেত্রে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে চলতেন।
সাহাবায়ে কেরামকে ভালোবাসা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। কারণ তাঁদের মাধ্যমেই আমরা ইসলাম পেয়েছি। ইসলামে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। বিশেষকরে বদর দিবসে আমাদের করণীয় হলো বদরী সাহাবীদের অবদানের কথা স্মরণ করে, তাঁদের জন্যে ইসালে সাওয়াব করা। তাঁদের আদর্শে আদর্শবান হয়ে জীবন-যাপন করাই প্রকৃত মু’মিনের আলামত।