মৃত্যুর স্বাদ -মূল: শাহ্ সুফি আল্লামা আলম ফক্বরী
ভাষান্তর: মাওলানা মুহাম্মদ জসিম উদ্দিন আবিদী
আল্লাহ্ তা’আলার প্রিয় বান্দার উপর বিপদ বেশী আসে
আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য প্রাপ্তরাই হচ্ছেন তাঁর বিশেষ প্রিয় বান্দাহ। যাঁদের মধ্যে আম্বিয়ায়ে কেরাম আলায়হিমুস্ সালাম, শোহাদায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম ও আউলিয়ায়ে কেরাম রাহমাতুল্লাহি আলায়হিম পরিগণিত হয় সর্বাগ্রে। তাঁদের উপর দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ্ তা’আলার বিশেষ পুরষ্কারের অবতারণা হয়। তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা অনেক উচ্চপর্যায়ের। এ ধারাবাহিকতায় তাঁদের উপর যখন কোন বিপদ বা রোগ আসে, তখন সাধারণ মানুষের চাইতে অনেক গুণ বেশী হয়ে আসে। যেমন হাদীসে পাকে ইরশাদ হয়েছে-
عَنْ سَعْدٍ قَالَ سُئِلَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عليه وسَلَّمَ اَىُّ النَّاسِ اَشَدُ بَلَاءً قَالَ الانْبِيَاءُ ثُمَّ الْاَمْثَلُ فَلْاَمْثَلُ يُبْتَلىَ الرَّجُلُ عَلى حَسْبِ دِيْنِه فِاِنْ كَانَ فِىْ دِيْنِه صُلْبًا اِشْتَدَّ بَلَاءُهُ وَاِنْ كَانَ فِىْ دِيْنِه رِقَّةٌ صُعونَ عَلَيْهِ فَمَا زَالَ كَذَالِكَ حَتَّى يَمْشِىَ عَلَى الْاَرْضِ مَالَه ذَنْبٌ- (ترمذى-ابن ماجه)
অর্থ: হযরত সা‘আদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে, মানুষের মধ্যে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন কে হয়ে থাকেন? প্রতিত্তোরে তিনি ফরমান- আম্বিয়ায়ে কেরাম (আলায়হিমুস্ সালাম), অতঃপর যারা তাদের সাথে সাদৃশ্যমান (অনুসরণগত দিক থেকে), অতঃপর এর পরবর্তীদের সাদৃশ্যমান। মানুষকে তাদের দ্বীন অনুসারে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। কেউ স্বীয় দ্বীনে নড়বড়ে অবস্থায় থাকে, তার উপর বিপদাপদ ও হালকাভাবে দেয়া হয়। আল্লাহ্ তা‘আলার প্রিয় বান্দাহ্রা যমীনের উপর এভাবে চলতে থাকেন, তাদের একটি গোনাহ্ ও অবশিষ্ট থাকেনা (তারা নিস্পাপ)। [সহীহ তিরমিযী শরীফ ও সহীহ ইবনে মাজাহ্ শরীফ]
উক্ত হাদীস শরীফে এটা বর্ণনা করা হয়েছে যে, আম্বিয়ায়ে কেরাম আলায়হিমুস্ সালাম সব চাইতে বেশী বিপদাপদের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। তাঁরা এ সমস্ত বিপদাপদে এত বেশী আনন্দ উপভোগ করেন, যেমনিভাবে সাধারণ লোকেরা নি’মাত ও সুখ-শান্তি প্রাপ্ত হয়ে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। তাঁদের পরের স্তরের সমস্ত লোক বিপদাপদের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। যাঁরা তাঁদের সাথে সাদৃশ্য বজায় রাখেন, অর্থাৎ আউলিয়ায়ে কেরাম রাহমাতুল্লাহি আলায়হিম ও সৎ আমল সম্পাদনকারীগণ (সালেহীন রাহ.) তাঁরা ও বিপদাপদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে থাকে। যাতে করে এর মাধ্যমে তাঁরা অত্যধিক পূণ্যের অধিকারী হয়ে যান। তাঁদের বিপদাপদের ভয়াবহতা আম্বিয়ায়ে কেরাম আলায়হিমুস্ সালাম’র তুলনায় অপ্রতুল। এরপর ঐ সমস্ত লোকদের ক্রমিক আসে যাঁরা সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে আউলিয়ায়ে কেরাম (রাহ.) ও সালেহীনে ইযাম (রাহ.)’র চাইতে কম যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীনের উপর সুদৃঢ় অবস্থানে থাকেন, অন্যান্য বিষয় ও তাঁর পদস্খলন হয় না তাঁর বিপদাপদের পরীক্ষা ও কঠিন হয়ে থাকে। তিনি সুদৃঢ় অবস্থার অধিকারী। এ কারণে তিনি যখন তাঁর বিপদের কাঠিণ্যতা তথা ভয়াবহতার উপর ধৈর্যধারণ করেন এবং এটা বুঝতে সচেষ্ট হন যে, স্বীয় গোনাহের কারণে এটার ভাগী হয়েছি, তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ঈমানের পরিপূর্ণতা এসে যায়। সাথে সাথে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে তাঁর সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়ে যায়, ফলশ্রুতিতে তাঁর গোনাহ্ বিদূরিত হয়ে যায় এবং তাঁর মর্যাদা ও উচ্চাসনে পর্যবসিত হয়।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি স্বীয় দ্বীনে নড়বড় অবস্থায় থাকেন, তার বিপদও স্বল্প হয়ে থাকে। যাতে করে তার ধৈর্যহীনতার বিষয়টি প্রকাশ না পায়। স্বীয় ঈমান ও আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় না হওয়ার কারণে দ্বীনের সীমানা বেরিয়ে না পড়ে। যেমন হাদীসে পাকে রয়েছে-
عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عَلَيْهِ وسلم مَثَلُ الْمُؤْمِنِ كَمَثَلِ الزَّرْعِ لَاتَزَالُ الرِّيْحُ تَمِيْلُه وَلايَزَالُ الْمُؤْمِنُ يُصِيْبُهُ الْبَلَاءُ وَمَثَلُ الْمَنَافِقِ كَمَثَلِ شَجْرَةِ الْاَرْزَةِ لَاتَهْتَزُّ حَتَّى تُسْتَحْصَدُ- (مسلم)
অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল করীম ইরশাদ করেছেন- ঈমানদারের দৃষ্টান্ত ক্ষেতের সাথে। যেটাকে বাতাস নাড়াতে থাকে। অপরদিকে ঈমানদার বিপদাপদের বাতাসে নিমজ্জিত থাকে আর মুনাফিকের দৃষ্টান্ত হলো দেব দারু বৃক্ষের ন্যায়। যেটাকে কোন কিছুই নাড়ায় না, বরং একে উপড়ে ফেলা হয়। [সহীহ মুসলিম শরীফ]
عَنْ اَنَسٍ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلم يَقُوْلُ قَالَ اللهُ سُبْحَانَه وَتَعَالى اِذَا ابْتَلَيْتُ عَبْدِىْ بِحَبِيْبَتَيْه ثُمَّ صَبَرَ عَرَّضْتُه مِنْهُمَا الْجَنَّةَ يُرِيْدُ عَيْنَيْهِ- (صحيح بخارى)
অর্থ: ‘হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি- তিনি ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন, যখন আমি আমার বান্দাহকে তার দুটি প্রিয় বস্তুকে নিয়ে পরীক্ষা করি আর সে এর উপর ধৈর্যধারণ করে, তখন আমি তাকে এ দুটি বস্তুর বিনিময়ে জান্নাত প্রদান করে থাকি। বর্ণনাকারী বলেন- এ প্রিয় বস্তু হলো দুটি চোখ। [সহীহ বুখারী শরীফ]
পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী শহীদ
আধুনিক যুগে যদিওবা নিত্য নতুন রোগের তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ভয়াবহ জটিল ও ধ্বংসাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে প্রাচীন যুগে পেটের পীড়া খুবই কষ্টদায়ক রোগ ছিল। বর্তমান যুগেও পেটের পীড়া কমকষ্টদায়ক নয়। এ কারণে রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী শহীদ। যেমন হাদীস শরীফে রয়েছে-
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَتِيْكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الشَّهَادَةُ سَبْعٌ سِوَى القَتْلِ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ اَلْمَطْعُوْنُ شَهِيْدٌ وَالْغَرِيْقٌ شَهِيْدٌ وَ صَاحِبُ ذَاتِ الْجَنْبِ شَهِيْدٌ وَالْمَبْطُوْنَ شَهِيْدٌ وَ صَاحِبُ الْحَرِيْقِ شَهِيْدٌ وَالَّذِىْ يَمُوْتُ تَحْتَ الْمَهْرَمِ شَهِيْدٌ وَالْمَرْأَة تَمُوْتُ –
(ابوداؤد نسائى)
অর্থ: হযরত জাবির বিন আ‘তীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ্ তা‘আলার রাস্তায় প্রাণ বিসর্জন করা ছাড়াও আরো সাত প্রকারের শহীদ রয়েছে-
১. মহামারীতে মৃত্যুবরণকারী শহীদ, ২. পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী শহীদ, ৩. ফুস্ফুস প্রদাহ্ পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী শহীদ, ৪. পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারী শহীদ, ৫. আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ, ৬. কোন কিছুর নীচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ, ৭. সন্তান প্রসবকালীন সময়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ। [সহীহ আবূ দাউদ শরীফ, সহীহ নাসাঈ শরীফ]
পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারীদের জন্য এ সৌভাগ্য অর্জনের কারণ হলো এ রোগের কষ্টের দরূন এ ব্যক্তির গোনাহ্ দূরীভূত হয়ে যায়। এ কথাটি এক হাদীস শরীফে এভাবে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ سُلَيْمَانِ بْنِ صُرَدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ قَتَلَه بَطْنُه لَمْ يُعَذَّبْ فِىْ قَبْرِه- (ترمذى)
অর্থ: হযরত সোলায়মান বিন সুরাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণ করে, সে ব্যক্তিকে কবরের শাস্তি প্রদান করা হয় না। [সহীহ তিরমিযী শরীফ]
অন্য এক হাদীস শরীফ এ কথাটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ يَسَارٍ قَالَ كَنْتُ جَالِسًا وسُلَيْمَانُ بْنُ صُرَدٍ وَخَالِدُ بْنُ عُرْفَطَةَ فَذَكَرُوْا اَنَّ رَجَلًا لُوُفِّىَ مَاتَ بِبَطْنِه فَاِذا هُمَا يَشْتَهِيَانِ اَنْ يَّكُوْنَا شَهِدَا جَنَازَتَه فَقَالَ اَحَدُهُمَا لِلْاَخَرِ اَلَمْ يَقُلْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وسلم مَنْ يَّقُتُلُه بَطْنُه لَمْ يُعَزَّبْ فِىْ قَبْرِهِ فَقَالَ الْاَخَرُ بَلى الشَّهِيْدُ- (صحيح نسائى شريف)
অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ্ বিন ইয়াসার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে আমি সোলায়মান বিন সুরাদ ও খালিদ বিন উরফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এক সাথে বসা ছিল কতেক লোক বর্ণনা করলেন যে, অমুক ব্যক্তি পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। আমার সাথে বসা অপর দু’জন আকাঙ্খা প্রকাশ করে বলেন- হায়! আমি যদি তার জানাযায় উপস্থিত হতে পারতাম! তাঁদের একজন অপরজনকে বললেন- হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কী এটা ফরমান নি? যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণ করে, তার কবরের শাস্তি হবে না। অপরজন বললেন- হাঁ, তিনি শহীদ। [সহীহ নাসাঈ শরীউ]
উপরোক্ত হাদীস শরীফে দুটি কথা বর্ণিত হয়েছে। প্রথমত: যিনি পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবরের শাস্তি অবশিষ্ট থাকে না। অর্থাৎ- পেটের পীড়ার দরূণ তাঁর সমস্ত গোনাহ্ ক্ষমা হয়ে যায়। এ কারণে তিনি কবরে শাস্তি থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন। দ্বিতীয়ত: পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণ করলে শহীদের ন্যায় আখিরাতে যে পুরষ্কার শহীদগণ অর্জন করবেন, সেগুলো পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারীগণও অর্জন করবেন।