হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রহ.)
অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান >
এলমে লুুদুন্নিয়ার প্রস্রবণ, উলুমে এলাহিয়ার ধনভান্ডার, হাক্বীকতের গুপ্ত রহস্যাবলীর অন্তরদ্রষ্টা, গাউসে জমান মাওলানা মুর্শিদেনা খাজায়ে খাজেগান হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন মাওলা আলী শেরে খোদা হযরত আলী মুরতুজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশধর। তাঁর মাযহাব ছিল হানাফী, তরীক্বা ছিল কাদেরী।
গাউসিয়াতে কোবরা ও বেলায়তে ওজমা’র উচ্চাসনে মহান সাধক হযরত ফকির মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির ঔরসে ১২৬২ হিজরিতে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জিলার হরিপুর শহরের নিকটবর্তী চৌহর শরীফে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মহান পিতার এক অলৌকিক ঘটনায় দেখা যায় একদিন তিনি একাকী ‘গজল’ গাইছিলেন। এমতাবস্থায় হঠাৎ সুন্দর পোশাক পরিহিত এক সুদর্শন পুরুষ তাঁর সামনে হাযির হয়ে বললেন, গজল শোনাও’। নির্দেশ মতে গজল গাওয়া শেষ হলে আগন্তুক বললেন, ‘‘তুমি আমাকে চেন?’’ হযরত ফকির মুহাম্মদ ছাহেব ইতোপূর্বে তাঁকে কোনদিন দেখেন নি বিধায় বললেন, না। আগন্তুক উত্তরে বলেন, আমি খিজির (আলায়হিস্ সালাম), তোমার গজল শুনে মুগ্ধ হয়েছি, তোমার মধুর সুর শুনে আমি এসেছি। ভবিষ্যতেও আসব। তিনি তাকে ‘তাওয়াজ্জুহ্’ দিলেন অর্থাৎ পূর্ণতা দান করলেন। এবং এ ঘটনা কাউকে প্রকাশ না করার জন্য নিষেধ করেন। হযরত ফকির মুহাম্মদ বাড়ি ফিরে গেলে তার কথোপকথনে আধ্যাত্মিকতার উৎকর্ষতার প্রকাশ পায়। গ্রাম্য লোকেরা এহেন পরিবর্তনে ফকির মুহাম্মদ’র নিকট এর রহস্য জানতে চান। তিনি কোন কিছু প্রকাশ না করে গম্ভীর থাকেন। লোক জনের বাড়াবাড়িতে একদিন অতিষ্ঠ হয়ে হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম’র ঘটনা প্রকাশ করে দেন। সে সময়কার সোয়াত রাজ্যের দেশিয় রাজার দরবারে একজন বৃটিশ সামরিক অফিসার আবির্ভুত হয়ে হুকুম করেন হাজারা জিলার ঐ এলাকার ফকির মুহাম্মদ নামে একজন পরিচিত লোক আছে তাকে আমি এখানে আসতে বলেছি খবর দিয়ে নিয়ে এসো। রাজার লোকজন নির্দিষ্ট এলাকায় গিয়ে খোঁজ করে জানতে পারেন যে, ফকির মুহাম্মদ ওখানকার লোক। বার্তা বাহক ফকির মুহাম্মদকে ইংরেজ সামরিক অফিসার তাঁকে তলব করেছেন বলে সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছেন, ফকির মুহাম্মদ প্রথমে প্রমাদ গুনলেন, তার সাথে বৃটিশ সেনাবাহিনীর অফিসারের কি সম্পর্ক? পরক্ষণেই তার মনে উদয় হলো উনি হতে পারেন খিজির আলায়হিস্ সালাম। সোয়াত রাজার বৈঠকখানায় পৌঁছুলে আগন্তুক আর্মী অফিসার ফকির মুহাম্মদ সাহেবকে বাইরে ডেকে নিয়ে একান্তে বললেন, তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ? ফকির মুহাম্মদ উত্তরে বললেন, জ্বি, ঐ আগন্তুক হলো বৃটিশ আর্মি অফিসার, ফকির মুহাম্মদকে ওয়াদা ভঙ্গের জন্য তিরস্কার করলো এবং পূর্বে প্রদত্ত ‘তাওয়াজ্জু’ ফিরিয়ে নিলেন। সংগে সঙ্গে ফকির মুহাম্মদ পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেলেন। তার ওপর বর্ধিত তাওয়াজ্জু প্রত্যাহৃত হয়ে গেলে ফকির মুহাম্মদ পূর্বাবস্থায় ফিরে যান। মানসিকভাবে ভীষণ মুচড়ে পড়েন। কাউকে কিছু বলতে বা কারো নিকট হতে কোন উপদেশ নেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পেলেন না। প্রাপ্য ধন হারানোর অসহ্য ব্যথায় তিনি প্রায় দিশেহারা। এমন এক সময় তার আবার রিয়াজত’র কথা উদ্ভব হয়। রিয়াজত কি করে করতে হবে, কেমন করে শুরু করবে কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিলেন না। গ্রামের মধ্যে ৬/৭টি মসজিদ ছিল, ঐ মসজিদগুলোতে ভিস্তিওয়ালারা বিনিময় গ্রহণে ওজুর পানি হাউসে সরবরাহ করতেন। তাঁর মাথায় এক বুদ্ধি এসে গেল। ভিস্তিওয়ালাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি বললেন তাঁরা যেন ওজুর পানি সরবরাহ না করেন। বিনিময় নেবে ভিস্তিওয়ালারা, আর পানি সরবরাহ করবেন ফকির মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত। রিয়াজত বা সাধনা ছাড়া কোন কিছু অর্জন হলে এর মূল্য বোঝা দায়। রিয়াজত, সাধনা, অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত সবকিছুর প্রতি আলাদা মমত্ববোধ থাকে। প্রাপ্তধন আগলিয়ে রাখার সবরকম প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে সর্বক্ষণ। এখানেও রিয়াজত মনে করে সাওয়াবের একাজকে প্রাধান্য দিয়ে ফকির মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি রিয়াজত শুরু হলো অনিদিষ্টকালের জন্য। এশা নামায শেষে চামড়ার মশক ভর্তি পানি মাথায় নিয়ে মসজিদের ওজুখানার হাউজ ভর্তি করা শুরু হয়ে ফজরের আজানের পূর্বক্ষণে শেষ হতো। এভাবে বহুদিন কেটে গেলো। রিয়াজত বা সাধনা চলতে থাকে। স্থানীয়রা এ ব্যাপার দেখে অনেকেই স্তম্ভিত ও হতভম্ব। আমাদের হুজুর ক্বিবলা আওলাদে রসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) কুতুবুল আউলিয়া জামেয়া ও আন্জুমান ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা হযরতুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলতেন, ‘কোন খেদমত ছাড়া কাউকে কিছু দিতে মন চায় না।’ অর্থাৎ বিনা কষ্টে বিনাশ্রমে কিছু পেলে কদর থাকে না। হযরত ফকির মুহাম্মদ’র বেলায় এটা প্রযোজ্য হয়েছিল। কেননা, তিনি হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম’র নিষেধ সত্ত্বেও তাওয়াজ্জুর কথা গোপন রাখতে পারেননি। তাই তিনি পরবর্তীতে এক সুকঠিন কাজে নিজেকে সোপর্দ করলেন। অনেক দিন পানি সরবরাহ করতে করতে তার মাথার চুলগুলো যে কখন হারিয়ে গেছে বলতেই পারেনি। নিবিষ্টমনে একাগ্রচিত্তে মন প্রাণ লাগিয়ে যখন অধ্যবসায় শুরু হয় তখন অনেক কিছুই দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। একদিন ফজর নামাযের আজানের পূর্বে সর্বশেষ মসজিদের হ্উাজে মাথা হতে মশক নিয়ে পানি ঢালতে গেলে তার হাতে রক্ত লেগে যায়। অর্থাৎ মাথায় চুল না থাকায় মশকের চাপে মাথার চামড়া ফুটো হয়ে রক্ত বের হয়ে গেছে। রক্তমিশ্রিত পানি হাউজে না ঢেলে পাহাড়ের পাদদেশে পানি ফেলতে উদ্যত হলে হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম এর আবির্ভাব হয়। তিনি ফকির মুহাম্মদকে বললেন, তোমার রিযাজত বা সাধনায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তোমাকে পুনরায় তাওয়াজ্জু ফিরিয়ে দিলাম।
আরো বললেন, যেহেতু বাইয়াত সুন্নাত, কাজেই কোন বুযুর্গ ব্যক্তির নিকট ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করুন। অতঃপর তিনি হযরত এয়াকুব আলী শাহ্ গিনছাতরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে পীরের খেদমতে থেকে গেলেন।
তিনি কখনো মুর্শিদের সাথে সকাল কিংবা বিকেলে ভ্রমনে বের হলে দেখা যেতো পীর-মুরীদ দু’জনই পাশাপাশি হাঁটছেন। একদিন এক মুরিদ মুর্শিদকে বললেন, হুযূর আপনি হাজারা জিলার লোকটির সাথে যখন ভ্রমণে বের হন তখন দেখা যায়, কেউ কারো আগে যান না। পাশাপাশি চলেন, এর কারণ কি? মুর্শিদ উত্তরে বললেন, ‘‘তিনি (ফকির মুহাম্মদ) এ যুগের ‘গাউস’ আদবের কারণে আমি তার অগ্রে যাই না, আর তিনিও আমার আগে চলেন না, যেহেতু আমি তাঁর মুর্শিদ। (সুবহানাল্লাহ্)। হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম থেকে ফয়ূজাত লাভ করায় তিনি সকলের নিকট খিজিরী উপাধি নিয়ে পরিচিত হন।
হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভে সমর্থ হননি। শুধুমাত্র পবিত্র কুরআন শরীফ পড়তে জানতেন। তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন পিতা হযরত ফকির মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, ‘এক কোষে দুই তলোয়ার রাখা যায় না, এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি কিছুদিনের মধ্যে স্রষ্টার সান্নিধ্যে গমন করেন। আট বছর বয়সে তিনি ‘চিল্লা’ সাধনা করার ইচ্ছা পোষণ করে কেউ তাঁকে সেবা করতে চান কিনা জানতে চাইলে প্রতিবেশী একজন তাঁর ‘খেদমত’ করবেন বলে ওয়াদা করলেন। হুযূরের নির্দেশ মতো পাশে একটি ‘থালা’ রাখা হলো, প্রত্যেক দিন নির্দিষ্ট সময়ে তিনি থালায় রক্ত বমি করতেন। পানাহার সম্পূর্ণ বন্ধ। একসময় শরীরের এমন জীর্ণ দশা হল যে, রক্তবমির বদলে পানি বমি হতে লাগল। এভাবে চল্লিশ দিন পূর্ণ হলে বমি বন্ধ হল। এ রকম অকল্পনীয় ও অভাবনীয় রিয়াজত দেখে এলাকাবাসী বিস্মিত হন। এ থেকে সকলেই নিশ্চিত হল যে, এ ছেলেটি ভবিষ্যতে মস্তবড় ‘ওলী’ হবেন। এ রকম কষ্টসাধ্য রিয়াজত দ্বারা শারীরিক, মানসিক ও চারিত্রিক ত্রুটি সম্পূর্ণরূপে ধবংশপ্রাপ্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়ে পরিপূর্ণ রূহানী শক্তি হাসিল হয়। কিছুদিন পর সোয়াতে অবস্থানরত সে সময়কার শ্রেষ্ঠ ওলী হযরত আখুন ছাহেবের সাক্ষাতে গমন করলেন কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে। হযরত আখুন ছাহেবের আস্তানার চতুর্দিকে হাজার হাজার দর্শণার্থীর ভিড় দেখে সঙ্গীরা প্রমাদ গুনলেন। দু’দিন থাকার পর সঙ্গীরা হুযুরকে বললেন, যেখানে শক্তিশালী পাঠানরা দেখা করতে পারছে না সেখানে একজন শিশু কিভাবে দেখা করবে। তারা ফিরে যাবার অনুরোধ করলে হযরত চৌহরভী অবিচল স্থির কণ্ঠে বললেন, অন্তত আর একটি দিন অপেক্ষা করার জন্য, আরো বললেন আগামী ভোরে সাক্ষাত না হলে ফিরে যাবেন। বুজুর্গানে দ্বীন’র ‘কাশফ’ তথা অন্তরদৃষ্টি ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করেন। ভোরে হযরত আখুন ছাহেবের সাথে সাক্ষাৎ হবে এটা তিনি অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন বিধায় এ রকম প্রতিজ্ঞা করেছেন। সুবহানাল্লাহ্ , আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারীদের মধ্যে এ রকম হাজারো ‘কারামত’ প্রত্যক্ষ করা যায়। সঙ্গীদের একটু ধৈর্যধারণ করার কথা বলে স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘দূর দেশ হতে প্রেমের শরাব পান করতে এ প্রেমের ‘শরাব খানায়’ এসেছিলাম, কিন্তু আফসোস! আমরা ওই প্রেম সুধা হতে বঞ্চিত হয়ে ফিরলাম।’’ আরো বললেন, হযরত আখুন ছাহেব চাশতের নামাযের সময় মসজিদের উঁচু সিঁড়ির ওপর বসে দূর হতে আসা আল্লাহর বান্দাদের সাক্ষাত দেবেন। সুতরাং তোমরা একটু ধৈর্য ধরো। ঐ মহাত্মাকে এক নজর দেখে বাড়ি ফিরব। চাশতের নামাযের সময় হযরত আখুন ছাহেব হুজরার দরজা খুলে খাদেমকে নির্দেশ দিলেন ‘‘আগত মুসাফিরদের মধ্যে হাজারা জিলার এক ব্যক্তি আছেন তাকে খোঁজ করে নিয়ে এসো।’’ খাদেম ভিড়ের মধ্যে হাজারা জিলার কেউ আছেন কি, তাঁকে হযরত আখুন ছাহেব স্মরণ করেছেন। সঙ্গীরা হযরত চৌহরভী ছাহেবকে দেখা করে আসতে অনুরোধ জানালে নির্বিকার থাকেন। এখানে হাজারা জিলার অনেকেই থাকতে পারেন, আমি একজন নগন্য লোক। যারা তালাশ করছেন তারাই খুঁজে নেবেন ওই ব্যক্তিকে। আমি নিজ হতে কিছু বলবো না। কোন সাড়া না পেয়ে তালাশকারীরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে দেখে সফরসঙ্গীরা নিরাশ হয়। এমতাবস্থায় এক সঙ্গী হুজুরের দিকে ইংগিত করে তালাশকারীদের দেখিয়ে দিলে কোলে করে হুযূরকে হযরত আখুন ছাহেবের হুজরায় নিয়ে যান। বেলায়তের সূর্য হযরত চৌহরভী ছাহেবকে দেখেই হযরত আখুন ছাহেব পশতু ভাষায় দাগাদি, দাগাদি, দাগাদি, অর্থাৎ ইনিই তিনি, ইনিই তিনি, ইনিই তিনি, যাঁকে আমি তালাশ করছি। সুবহানাল্লাহ্! হযরত আখুন ছাহেব বললেন, ‘‘ওহে বেলায়তের পরশমনি, দোয়া কর।’’ হযরত চৌহরভী ফরমান ‘হযরত আখুন ছাহেব যখন হাত উঠালেন তখন মনে হল সমস্ত আসমানের বোঝা আমার ওপর ন্যস্ত হল। যখন দোয়া শেষ করলেন, তখন ওই বোঝা মহা আনন্দের কারণ হল:
এক জামানা ছোহবতে বা-আউলিয়া
বেহতর আজ ছদ ছালাহ্ তা-আত বে-রিয়া
এক মুহূর্ত আউলিয়া কেরামের সঙ্গ লাভ করা শত বছরের কবুল হওয়া ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। তিনি স্বপ্নযোগে রাতে কিছু দেখেছেন কিনা জানতে চাইলেন হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে। প্রত্যুত্তরে বললেন, হ্যা, তাঁর চিল্লাস্থলটিই দেখেছেন, ‘‘আপনি ওখানেই অবস্থান করুন, অন্য কোথাও যাবেন না। পীর ছাহেব আপনার বাড়িতে এসে আপনাকে মুরিদ করাবেন।’’
কিছুদিন পর ‘নুরে মোতলাক’ হযরত এয়াকুব শাহ্ গিনছাতরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কাষ্মীর হতে হাজারা জিলায় নির্দিষ্টস্থানে চৌহর শরীফে এসে ‘আবদুর রহমান’ বলে এলাকায় কেউ আছেন কিনা জানতে চাইলে স্থানীয় লোকেরা তাকে হযরত চৌহরভী’র হুজরা খানায় নিয়ে যান। মুর্শিদকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করতেই তিনি হুজরার বাইরে আসেন, অতঃপর মুর্শিদসহ তিনি হুজরা শরীফে তশরীফ নেন। মুর্শিদ ‘বাইয়াত’ শেষে তাঁকে অপরিসীম কৃপাদান করে বিদায় হন। হযরত ‘উম্মী’ ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছিল না। পবিত্র ‘কুরআন’ পাঠ করতে ও লিখতে পারতেন। মোটামুটি ‘কুরআন’ পাঠ শিক্ষা উস্তাদের নিকট থেকে হলেও প্রচলিত ইলমে হাদিস, তাফসীর, ফিক্হ, উসুল ইত্যাদি শিক্ষা কোন জাহেরী উস্তাদ হতে লাভ করেন নি এবং লিখার পদ্ধতিও কোন শিক্ষকের নিকটে শেখেন নি। তিনি অল্প বয়সে সম্মানিত পিতা হযরত ফকির মুহাম্মদ খিজরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির স্থলাভিষিক্ত হয়ে ‘গাউসিয়াত’ ও ‘কুতুবিয়াত’র সর্বোচ্চ পদে আসীন হন। তাঁর মৃত্যুশয্যায় এক ভক্ত ‘সমগ্র জগতের কুতুব অর্থাৎ গাউসে আ’যমের পদে এখন কে অধিষ্ঠিত আছেন প্রশ্ন করলে হুজুর বললেন, ‘‘হযরত শাহে জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির পরে ওই মহামর্যাদাপূর্ণ পদে আল্লাহর কোন ওলী দুনিয়াতে আসেননি, তাঁর স্থান শূন্যই ছিল। বহুকাল অতিবাহিত হবার পর একটি ছেলে জন্মলাভ করেন এবং অল্প বয়সেই পিতৃহীন হয়েছেন। তিনি ওই অবস্থায় অতি স্বল্প বয়সেই শাহে জিলান সৈয়্যদুনা হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির প্রকৃত নায়েব হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ওই মহাপুরুষ অসীম আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসহকারে বিশ্বজগতের গাউসরূপে অধিষ্ঠিত আছেন।’’ (তিনিই সে মহাপুরুষ ছিলেন) তাঁর প্রধান খলীফা গাউসে জমান কুতবুল আকতাব হযরত মাওলানা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে ফরমান যে, ‘‘গাউসিয়াতের মহামর্যাদাপূর্ণ পদ খান্দানে কাদেরিয়ার জন্য সংরক্ষিত। যদি এ খান্দানের কোন ব্যক্তি উপযুক্ত না থাকে তবে অন্য সিলসিলা থেকে গাউসে জামান মনোনীত হন। তিনি আরো ফরমান এটা অত্যন্ত লজ্জার কারণ হবে যদি আমাদের অনুপযুক্ততার কারণে আমাদের ঘরের দৌলত অন্য কাউকে দেয়া হয়।’’
হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট দোয়া করতেন, ‘তাঁকে যেন কেউ না চেনে, এমন কি যাঁরা তাঁর নিকট আসবে, তারা যেন মিসকিন, ফকির ও দ্বীনি আলেম হন। আমীর ওমরাহ্ বা ধনী ব্যক্তিদের জন্য তাঁর দরজা বন্ধ হয়। আল্লাহ্ পাক তাঁর এ দোয়া কবুল করেছেন বলে জানান, পীর মীর আলী শাহ্ ছাহেব একবার তাঁকে বললেন, ‘‘অনেক মেহমান তাঁর নিকট আসে, কিন্তু হাদিয়া তোহফা তেমন আসেনা। আমি একটি দো‘আ শিখিয়ে দিচ্ছি যাতে আপনার হাদিয়া তোহফা বৃদ্ধি পায়।’’ তখন হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন হযরত ছাহেব! খোদার নিকট আমি লজ্জাবোধ করি যে, ‘‘লোকেরা আমাকে বুযুর্গ মনে করে আসবে, আর আমি পয়সা রোজগারের জন্য ওজিফা পাঠ করবো।’’
তিনি স্বল্প ও মিষ্ঠভাষী ছিলেন। শ্রুতিমধুর বাক্যালাপে সিলসিলার কার্যাদি সমাপ্ত করতেন। অনর্থক কথা-বার্তা বলতেন না। একদিন এক মাওলানা জটিল মাসআলার সমাধান খুঁজতে হুজুরের নিকট আসলে অতি সরল পদ্ধতিতে সমাধান করে দিলেন এবং এ কথা কাউকে না বলার জন্য অছিয়ত করলেন। তিনি ‘জজবাত’ ও ‘জালালিয়াত’ মুক্ত ছিলেন। তাঁরই প্রধান খলিফা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ আরজ করলেন, ‘‘আল্লাহর ওলীর আখেরী দরজা কি তাখাল্লাক বে আখলিকাল্লাহ্? অধিকাংশ সময় তিনি বলতেন আমি ‘উম্মী’ বা অশিক্ষিত। কেউ মাসআলা জিজ্ঞেস করলে একজন আলেমের নিকট জেনে নাও। তাঁর অবিস্মরণীয় কিতাব দরূদ সম্বলিত ত্রিশপারা ‘মুহাইয়্যিরুল উকুল ফী বয়ানে আওছাফে আকলিল উকুল’ মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) অনেক বছর পূর্বে লেখা হলেও জীবদ্দশায় তিনি এটা লুকিয়ে রাখেন। ইন্তেকালের কয়েক বছর পূর্বে রেঙ্গুন (ইয়াংগুন) প্রবাসী প্রধান খলীফা হযরত মাওলানা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটির নিকট জানালেন এ অপূর্ব বিস্ময়কর সৃষ্টির কথা। এটা বোখারী শরীফের মতো ত্রিশপারা সম্বলিত, পারাগুলো কুরআন শরীফের পারা হতে একটু বড়। যদি সম্ভব হয় সেখানকার লোকজন চাঁদা সংগ্রহ করে কিতাবখানা ছাপিয়ে দিও। এতে মাখলুকাতের উপকার হবে। এ বিশাল দরূদ শরীফ লেখা সম্পন্ন করতে সময় লেগেছিল ১২ বছর ৮ মাস ২০ দিন অথচ ঘুর্ণাক্ষরেও এটা প্রণয়নের কথা কেউ জানতে পারেননি। বিশ্বখ্যাত এ ওলীর বাসগৃহ ছিল কাঁচা, ছাদ ছিল ফুটো, বৃষ্টির পানিতে ঘরের ভিতরে পানি এসে গেলে রাতে তিনি থালায় করে পানি বাইরে ফেলতেন। মেহমানদের আপ্যায়ন করতে তিনি অধিক মনোযোগী থাকতেন। ঘরে তৈরি রুটি তরকারি নিয়ে তিনি প্রতিদিন খানকায় যেতেন। অবশিষ্ট থাকলে খাওয়া হতো, না হয় উপোস থাকতেন। তিনি ছিলেন প্রিয় নবীর প্রতিচ্ছবি। যখন তিনি জানতে পারলেন যে, প্রিয়নবী মসজিদের চাঁটাই সেলাই করেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে চাটাই সেলাই করতে লেগে যান।
দ্বীনি এলম শিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর আন্তরিক মুহাব্বত ছিল। হুযূরের প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা-এ ইসলামিয়া রহমানিয়া হরিপুরের ছাত্রদের জন্য লঙ্গরখানা হতে রুটি পাঠানো হতো। একবার নামাজের সময় এমন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল যে, ঘর হতে বের হওয়ায় ছিল দুষ্কর। খানকাহ্ শরীফে অবস্থানরত কেউই মাদরাসার ছাত্রদের জন্য রুটি নিয়ে যেতে সাহসী হলেন না দেখে হুজুর নিজেই এ বৃষ্টির মধ্যে রুটি তরকারি নিয়ে বের হলেন। তিনি সর্বদা খদ্দরের কাপড় পরিধান করতেন। হুজুর ২টি জিনিষ হতে তাওবা করেছিলেন। ১. ‘কাশ্ফ’ হতে, ২. নিজের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি হতে। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কালকারী হুজুর একদা ঘরে বলেছিলেন যেন তাঁর জন্য দু’খানা কালো চাঁদর তৈরি করে দেয়া হয়। এটা বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। পরক্ষণেই ফিরে এসে চাঁদর তৈরি না করার জন্য বললেন। পরদিন একজন ভক্ত এসে চাঁদর প্রস্তুতের জন্য সুতা, রং বুননের জন্য পারিশ্রমিক হুজুরের হাতে দিয়ে বললেন আমি বাইরে অন্যত্র চলে যাচ্ছি আপনি নিজের কাপড় প্রস্তুত করে নেবেন। কেননা, শীত ঘনিয়ে আসছে। তাওবা করার পর হতে আল্লাহর পক্ষ হতে শীতের সময় শীতের ও গ্রীস্ম মৌসুমে গরম কাপড় খেয়াল ব্যতীত যোগাড় হতো। সুবহানাল্লাহ্। হুযূর একদিন একস্থানে বিশ্রাম করছিলেন, সে সময় একজন লোক এসে গোসল করলো, হুযুর তাকে বললেন, তুমি জেনা করেছ? লোকটি প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে হুজুরের নিকট ক্ষমা চাইলো।
সঙ্গে সঙ্গে হুজুরের ভাবান্তর ঘটে, আল্লাহ্ পাক বান্দার পাপ কাজ দেখেও গোপন রাখেন, আর আমি আল্লাহর বান্দাদের গোপন দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে দিচ্ছি। ওই দিন হতে হুজুর কাশফ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সংযমী ও চরম ধৈর্যশীল। অভাবগ্রস্ত লোকদের সান্নিধ্য বেশী পছন্দ করতেন, আলেম ও ফকির দরবেশ আগমন করলে তাদের সম্মানে দাঁড়িয়ে যেতেন, সাক্ষাতের কোন নির্দ্ধারিত সময় ছিল না। যে কোন সময় যে কেউ দেখা করতে পারতেন। হুজুরের ছাহেবজাদা মুহাম্মদ ফজলে সোবহান জনৈক ব্যক্তির পরামর্শে জিজ্ঞেস করলেন হুজুরের পর কে গদীনশীন হবেন? একথা শুনে খুবই ক্রোধান্বিত হয়ে হুজুর বললেন, ‘গদীর উপর গাধা বসে, আমিত চাটাইতে বসার লোক। একদিন এক ভক্তকে কিছু উপঢৌকন দিয়ে বললেন, ‘তুমি হজ্বে যাও।’ হজব্রত পালন শেষে ফেরার পথে অমুক অমুক লোকদের এগুলো পৌঁছিয়ে দেবে। লোকটা ছিল খুবই ঘুম কাতুরে। যাত্রাকালে হুজুর সামনের ‘তুত’ গাছটিকে লক্ষ্য করে বললেন, এ লোকের ঘুম গচ্ছিত রাখ, পরে ফেরত দিও। হজব্রত পালন শেষে লোকটি হুজুরের নিকট সবিস্তারে বর্ণনা করলেন এবং বললেন যে তাঁর মোটেই ঘুম আসেনি। ঘুমের অভ্যাস নেই বললেই চলে। একথা শুনে হুজুর বললেন ‘তুত’ গাছ থেকে তোমার গচ্ছিত জিনিসটা নিয়ে নাও। একথা বলার সাথে সাথে লোকটির ঘুম এসে গেল। ঘুমের কারণে লোকটির কয়েক ওয়াক্ত নামাজ ক্বাজা হয়ে গেল। হুজুর একসময় ঘুম থেকে জাগিয়ে রুটি খেয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে যেতে বললেন। এক ভক্ত ‘এলমে লুদুন্নী’ কি জানতে চাইলে হুজুর বললেন সামনের ‘তুত’ গাছটিকে হেঁটে চলে আসতে হুকুম করলে চলে আসবে। কথা শেষ হতে না হতেই ‘তুত’ গাছটি শিকড় সমেত হাটা শুরু করে দিলে হুজুর ‘তুত’ গাছকে বললেন গেড়ে যেতে, তোমাকে আসতে বলিনি এ লোকটিকে দৃষ্টান্ত দেখালাম। সুবহানাল্লাহ! প্রিয় নবীজি চন্দ্রকে দু’ টুকরো করার কথা বলতে না বলতেই চন্দ্র টুকরো হয়ে যায়। আবার হুজুরের ইশারায় চন্দ্র স্থির হয়ে গেল, তেমনি প্রিয় নবীর উত্তরসূরি হুজুর চৌহরভীর বেলায়ও সে রকম কারামত পরিলক্ষিত হয়। এতে বোঝা যায় এ মহান আধ্যাত্মিক পুরুষের ক্ষমতা কত ব্যাপক ও অকল্পনীয়। সুবহানাল্লাহ্।
হুজুর চৌহরভী ও জনৈক পীর ছাহেব হজব্রত পালনে যাত্রাকালে এক দরবেশ এসে বললেন, সেতার বাজানোর কারণে গ্রামের মাওলানা তাঁকে ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়েছেন। আপনারা তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যেন আমাকে ‘কাফের’ না বলে। এ কারণে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। হুজুরের সঙ্গী-পীর ছাহেব গ্রামের মাওলানা ছাহেবকে কাফের ফতোয়া দেয়া হয়েছে বলে জানালেন মওলানা। প্রশ্নকর্তা সেতার বাজানো বন্ধ ও ফতোয়া ব্যবহার করার কথা বলবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সঙ্গি পীর ছাহেবকে কোন রকম সমাধান করতে বারণ করলেন। এও বললেন, হজ্বব্রত পালন শেষে ফিরতি পথে ফয়সালা করা হবে। ফিরতি পথে পীর ছাহেবকে সেতারা বাদকের ফতোয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে উভয়ই মাদরাসার ওই মুফতি আলেমের নিকট উপস্থিত হয়ে দেখেন যে, মুফতি নিজেই সেতার বাজাতে বাজাতে মেহমানদের সম্মানে উঠে দাঁড়ালেন। প্রশ্নকর্তা পীর ছাহেব মুফতি ছাহেবকে কাফের ফতোয়া দেয়া সত্ত্বেও তিনি কেন এখন সেতার বাজাচ্ছেন? প্রত্যুত্তরে মাওলানা বললেন, আপনাদের দু’জনের একজনের মেহেরবানীতে হয়েছে। পীর ছাহেব তখন হযরত চৌহরভী ছাহেবের নিকট এর রহস্য জানতে চাইলে হুজুর বলেন, যাত্রাপথে আপনি যখন সমাধানের কথা ভাবছিলেন, তখন আমি দেখলাম যে দরবেশ ওয়াদা করে সেতার বাজানো বন্ধ করলে রূহানী খোরাকের অভাবে মারা যেতেন আর আপনি (পীর ছাহেব) খুনের দায়ে অভিযুক্ত হতেন। (হুজুর) খুনের দায় হতে আপনাকে রক্ষা করলাম। আর মাওলানা ছাহেব এলমের ওপর গৌরব করে ব্যথিত ব্যক্তিকে ‘কাফের’ বলতেন তাকেও সে ব্যথা থেকে উদ্ধার করলাম। একগুলিতে দুই শিকার হল। এ ঘটনা দ্বারা নিশ্চিত হওয়া গেল যে, তাঁর মধ্যে হযরত খিজির আলায়হিস্ সালাম’র উদ্দীপনা ও কর্মক্ষমতা বিদ্যমান ছিল। তিনি যখন যে ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে যে অবস্থারই প্রতিফলন ঘটাতে ইচ্ছে করতেন অতি সামান্য নেক নজরে তা সম্পন্ন করতেন এবং ‘কামালিয়াতের ওপর পরিপূর্ণ ক্ষমতা ও আধিপত্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁর রচিত অবিস্মরণীয় দুরূদ শরীফের অমূল্য কিতাব মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রত্যেকটি ছত্রে প্রিয় নবীজির কোন না কোন বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলীর বর্ণনা করা হয়েছে। সমগ্র কিতাবে চারিত্রিক সৌন্দর্য, মাধূর্য ও বৈশিষ্ট্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।
এ গ্রন্থ সম্পর্কে তার প্রধান খলীফা গাউসে জমান হযরত মাওলানা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মূল্যায়ন
এ গ্রন্থ হুজুর চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির ইলম ও মা’রিফাত সমুদ্রের একটি বিন্দুমাত্র; যা তাঁর ইনতিকালের পর বিশ্ববাসীর সামনে মহান আল্লাহর রহমত ও করুণার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে এবং উত্তম হচ্ছে পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফ। এ গ্রন্থের আওরাদ ওজিফাগুলো প্রায় ১০০টি নির্ভরযোগ্য কিতাব হতে সংকলিত। দুরূদ শরীফ রচনার এ অভিনব পদ্ধতি তাঁর নিজস্ব আবিস্কার। অদ্যাবধি কোন দুরূদ শরীফ রচয়িতার মধ্যে এমন রচনাশৈলী বিরল। এটা অধ্যয়নে তাফসীর, উসুলে তাফসির, হাদীস ও উসুলে হাদীস, ফিকহ্, উসুলে ফিকহ্, মানতেক, দর্শন প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞান অধ্যয়ন ও বুঝার সক্ষমতা সৃষ্টি হয়। এখানে এমন কিছু বিষয় আছে যা শুধু হুজুর চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সাথেই সম্পৃক্ত ও নির্দিষ্ট। এ মহান মুর্শিদের জ্ঞান ‘কামালিয়াতের স্তর ও কারামতের বর্ণনা দেয়া দুঃসাধ্য। কেননা যুগশ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন গাউসে জমান আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কবির ভাষায় ব্যক্ত করেছেন-
মানছে গোয়াম শরহে ওয়াছফে আঁ জনাব
আফতাবস্ত, আফতাবস্ত, আফতাব।
আমি সে সম্মানিত ব্যক্তির গুণাবলীর কি ব্যাখ্যা দেব, তিনিই সূর্য, সূর্যই সুর্য।
এ মহান পথ প্রদর্শক, নুরে মুজাচ্ছম প্রিয় নবীর প্রতিচ্ছবি উলুমে এলাহিয়ার ধনভান্ডার, মা‘আরেফে লুদুন্নিয়ার প্রস্রবণ খাজায়ে খাজেগান হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী ১ জিলহজ্ব ১৩৪২ হিজরি রোজ শনিবার বাদ নামাজে মাগরিব ইন্তেকাল করেন। এরই ধারাবাহিকতায় কুতবুল এরশাদ হযরত হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি, কতুবুল এরশাদ হযরত হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ ও জিনতে কাদেরিয়াত হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল আলীর মতো আওলাদে রসূল, গাউসে জমানদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দ্বীন মাযহাব-মিল্লাত, নবী-ওলী প্রেমিকদের দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’র ঝান্ডা বিশ্বে সমুন্নত ও সমাদৃত হচ্ছে। আমরা নবী-ওলী প্রেমিকগণ যেন এ সকল মহাপুরুষের ফয়ূজাত লাভে ধন্য হতে পারি এ কামনা করি। এদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জীবন অতিবাহিত করার শক্তি ও সাহস যেন আল্লাহ্ পাক আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করেন।