দরসে কোরআন -অধ্যক্ষ হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
وَأُخْرَى تُحِبُّوْنَهَا نَصْرٌ مِنَ اللهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ وَبَشِّرِ الْمُؤْمِنِينَ- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا أَنْصَارَ اللهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّينَ مَنْ أَنْصَارِي إِلَى اللهِ قَالَ الْحَوَارِيُّوْنَ نَحْنُ أَنْصَارُ اللهِ فَآمَنَتْ طَائِفَةٌ مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ وَكَفَرَتْ طَائِفَةٌ فَأَيَّدْنَا الَّذِينَ آمَنُوا عَلَى عَدُوِّهِمْ فَأَصْبَحُوا ظَاهِرِينَ-
আল্লাহর নামে আরম্ভ যিনি পরম করুণাময়, দয়ালু
তরজমা: (মহান আল্লাহ্ এরশাদ করেছেন) এবং আরো একটা অনুগ্রহ তোমাদেরকে দেবেন, যা তোমরা পছন্দ কর আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং শিগ্গিরই আগমনকারী বিজয়। (এবং (হে নবী) আপনি মুমিনদের সুসংবাদ দান করুন। হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী হও যেমন মারয়াম তনয় ঈসা হাওয়ারীদেরকে বলেছিলেন কারা আছে, যারা আল্লাহর পথে আমায় সাহায্য করবে? হাওয়ারীগণ বলল, আমরা হলাম আল্লাহর পথে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী। অতঃপর বনী ঈসরাঈলের একদল ঈমান আনয়ন করেছে এবং একদল কুফরি করেছে। সুতরাং আমি (আল্লাহ) মুমিনদেরকে তাদের শত্রুদের মোকাবেলায় সাহায্য করেছি। ফলে তারা বিজয়ী হয়েছে।
[সূরা আস-সফ, আয়াত- ১৩ ও ১৪]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
وَأُخْرَى تُحِبُّونَهَا نَصْرٌ مِنَ اللَّهِ وَفَتْحٌ قَرِيبٌ
উদ্ধৃত আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন اخرى শব্দটি উহ্য نِعمة এর বিশেষণ। অর্থাৎ পূর্বোক্ত আয়াতে উল্লেখিত অনুগ্রহরাজি ছাড়াও মহান আল্লাহ তোমাদেরকে আরো একটি অনুগ্রহ দান করবেন, যা তোমরা পছন্দ করো। আর তা হলো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে সাহায্য এবং শিগগিরিই বিজয়। আলোচ্য আয়াতে উল্লেখিত , قَرِيب শব্দটি পরকালের বিপরীতে ব্যবহৃত হলে ইসলামের সকল বিজয়ই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আর যদি قَرِيب শব্দটি প্রচলিত অর্থে ব্যবহৃত হয়, তবে এর প্রথম অর্থ হবে খয়বর বিজয় এবং এরপর মক্কা বিজয়। তবে হাকীমুল উম্মত মুফতিয়ে আহলে সুন্নাত শাহ আহমদ ইয়ার খান নঈমী রহমাতুল্লাহি আলায়হি উদ্ধৃত আয়াতের তাফসীরে বর্ণনা করেছেন এ আয়াতে সাইয়্যেদুনা ওমর ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও সাইয়্যেদুনা হযরত ওসমান যুন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খেলাফতকালে অর্জিত পারস্য ও রোমান স¤্রাজ্য বিজয়সহ অন্যান্য বিজয়সমূহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুতরাং এ তাফসীরের আলোকে প্রমাণিত হয় সাইয়্যেদুনা আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওমর ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও সাইয়্যেদুনা হযরত ওসমান যুন্নুরাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খেলাফত বরহক ও যথার্থ। [তাফসীরে নুরুল ইরফান]
تُحِبُّونَهَا অর্থাৎ তোমরা এই নগদ নেয়ামত খুব পছন্দ কর। কারণ মানুষ স্বভাবজাতভাবে নগদকে পছন্দ করে। যেমন, কুরআনে কারীমে এরশাদ হয়েছে, وكان الانسان عجولا অর্থাৎ মানব তড়িঘড়ি পছন্দ করে। এর অর্থ এই নয় যে, পরকালীন নেয়ামত তাদের কাছে প্রিয় নয়। বরং অর্থ এই যে, পরকালের নেয়মত তো তাদের প্রিয়কাম্যই কিন্তু স্বভাবগতভাবে কিছু নগদ নেয়ামতও তারা দুনিয়াতে চায়। তাও দেয়া হবে।
প্রয়োজনীয় মূহুর্তে আল্লাহর বান্দাগণের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা নবিগণের সুন্নাত
পবিত্র কুরআনে কারীমের সূরা আস সফ এর সর্বশেষ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন শত্রুগণের মোকাবেলা, বালা-মুসিবত ও বিপদাপদের মুহুর্তে সকল প্রকার প্রয়োজনীয় মুহুর্তে আল্লাহর বান্দাগণের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা শুধু বৈধ ও শরীয়ত সম্মতই নয় বরং আল্লাহর নবি-রাসূলগণের সুন্নত। যেমন, সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বিরূদ্ধে ঈসায়ীরা যখন ষড়যন্ত্র শুরু করল তখন তিনি তাঁর অনুসারী হাওয়ারীদের উদ্দেশ্যে বলেলন مَن انصارى الى الله অর্থাৎ দ্বীনের প্রচার-প্রসারে আল্লাহর পথে কারা আমার সাহায্যকারী, হাওয়ারীগণ বললো نحن انصار الله আমরা সবাই আল্লাহর নবির সাহায্যকারী। এ আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো আল্লাহর বান্দাগণের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা কুরআনে কারীমের আলোকে প্রমাণিত সত্য। সুতরাং এটাকে শিরক-বিদআত বলে আখ্যায়িত করা মূলতঃ কুরআনের বিধানকে অস্বিকার করা। (নাউজুবিল্লাহ)
তাছাড়া “সূরা মায়েদা”য় এরশাদ হয়েছে, وتعاونوا على البر والتقوى ولا تعاونوا على الاثم والعدوان অর্থাৎ মুমিনগণ! তোমরা পরস্পরকে সৎকর্ম ও খোদাভীরুতায় সাহায্য-সহায়তা কর এবং অসৎকর্মে ও শরীয়তের বিধি-বিধান লংঘনে একে অপরকে সাহায্য করো না। উল্লেখ থাকে যে,সাহায্য প্রার্থীকেই একমাত্র বিপদাপদের মোকাবেলায় সাহায্য করা যায়। সাহায্য প্রর্থনা ব্যতীরেকে সাহায্য করার সুযোগ নেই। তাই সাহায্য করার নির্দেশ জারির আড়ালে সাহায্য প্রার্থনা করার অনুমতি ও বৈধতা নিহিত রয়েছে।
হাদিস শরীফে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঐ বান্দাকে সাহায্য করেন যে, তার মুমিন ভাইকে সাহায্য করে। (আলহামদুলিল্লাহ) অন্য রেওয়ায়াতে এরশাদ হয়েছে যে, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা সাহাবী হযরত ইবনুল ফেরাসিয়্যাহ রা. কে সম্বোধন করে বলেন, يا ابن الفراسية ان كنت لابد فسل الصالحين ওহে ইবনুল ফেরাসিয়্যাহ রা.! যদি তুমি একান্তই অনন্যোপায় হয়ে যাও তবে তুমি (তোমার প্রত্যাশিত ও কাম্য বস্তু) প্রার্থনা করো আল্লাহর ছালেহীন-কামেলীন বান্দাগণের নিকট। [মেশকাত শরীফ, কিতাবুয যাকাত]
উপরোক্ত রেওয়ায়াতের আলোকে সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয় যে, যদি কিছু চাইতে হয় তবে আল্লাহ ওয়ালাদের নিকট চাও। কেননা, তাঁদের দান-অনুদান শুধু চাহিদা পূরণকারী হয় না, বরং তা খোদায়ী রহমত বরকতে পরিপূর্ণ হয়। যা মুমিন নর-নারীর জন্য দুনিয়া-আখেরাতের অপরিসীম কল্যাণের সহায়ক হয়। এছাড়া আরো অসংখ্য আয়াতে কুরআন ও হাদিসে রাসূলের রেওয়ায়াতে রয়েছে যা দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় নবি-অলির নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা জায়েয ও শরীয়ত সম্মত। এতদসত্ত্বেও এটাকে অস্বিকার করা কিংবা শিরক -বেদআত বলে আখ্যায়িত করা পবিত্র কুরআন-সুন্নাহকে অস্বিকার করার নামান্তর। যা কুফরী।
فَآمَنَتْ طَائِفَةٌ مِنْ بَنِي………..
উপরোক্ত আয়াতাংশের তাফসীরে প্রসিদ্ধ মুফাসসির ইমাম বাগাভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আসমানে উত্থিত হওয়ার পর খ্রীষ্টানরা তিন দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদলের বক্তব্য হলো তিনি খোদা ছিলেন এবং আসমানে চলে গেছেন। দ্বিতীয় দল বলেন, তিনি খোদা ছিলেন না বরং খোদার পুত্র ছিলেন। এখন আল্লাহ তাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং শত্রুদের শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তৃতীয় দল বিশুদ্ধ ও সত্য কথা বলল। তারা বলল, তিনি খোদাও ছিলেন না কিংবা খোদার পুত্রও ছিলেন না। বরং আল্লাহর বান্দা ও রাসূল ছিলেন মহান আল্লাহ তাকেঁ শত্রুদের কবল থেকে হেফাজত ও উচ্চ মর্যাদা দান করার জন্য আকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন। তারাই ছিল সত্যিকার ইমানদার। প্রত্যেক দলের সাথে কিছু কিছু জনসাধারণ যোগদান করে এবং পারস্পরিক কলহ বাড়তে বাড়তে যুদ্ধের উপক্রম হয়।
ঘটনা চক্রে উভয় কাফির দল মুমিনদের মোকাবেলায় প্রবল হয়ে উঠে। অবশেষে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করেন। তিনি মুমিন দলকে সমর্থন দান করেন। এভাবে মুমিন দল যুক্তি প্রমাণের নিরীখে বিজয়ী হয়ে যায়। [তাফসীরে মাযহারী শরীফ]
এ তাফসীরের আলোকে الذين امنوا বলে সাইয়্যেদুনা হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর উম্মতের মুমিনগণকেই বোঝানো হয়েছে। যারা রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহায্য ও সমর্থনে বিজয় গৌরব অর্জন করবে। [তাফসীরে মাযহারী শরীফ]
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকল মুমিন নর-নারীকে উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করে উভয় জাহানে ধন্য হওয়ার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।