আমাদের সমাজে বাল্যবিবাহ অত্যন্ত ভয়াবহ সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থা, কুসংস্কার ও অজ্ঞতার কারণে এ সমস্যা ছড়িয়ে পড়েছে। ১৮ বছরের কম বয়সের মেয়ে অথবা ২১ বছরের কম বয়সের ছেলেদের বিবাহকে বাল্যবিবাহ বলে। ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ বলতে বাল্যকালে বা নাবালক বয়সে ছেলে-মেয়েদের বিবাহকে বোঝায়।
এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাল্যবিবাহের কারণে বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মেয়ে ১৫ বছরের আগে গর্ভবতী হয়। ফলে মা ও শিশু মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয়। নির্দিষ্ট সময়ের আগে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া ও কম ওজনের সন্তান জন্মদান ইত্যাদি সমস্যার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় মা ও সন্তান দুজনের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে।
বিবাহের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষকে বালেগ, প্রাপ্তবয়স্ক ও পরিপক্ক হওয়া আবশ্যক বলে ইসলামে বলা হয়েছে। তাই শরিয়তের দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু অভিভাবক বা সামাজিক ও ধর্মীয় নেতারা বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন না হয় তাহলে এর অনুশীলন চলতে থাকবে। যে বাল্যবিবাহ ভগ্নস্বাস্থ্য, অপরিকল্পিত পরিবার, দাম্পত্য কলহ, প্রসবকালীন মৃত্যু এবং নবজাতকের মৃত্যুসহ অনেক বিপদ ডেকে আনে সে বিবাহ কখনো ইসলামে অনুমোদিত হতে পারে না।
গতবছর (২০১৬) ২৪ নভেম্বর বিয়ের জন্য মেয়েদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের জন্য ২১ বছর বয়সের শর্ত রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন’ অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ৮ ডিসেম্বর বিল হিসেবে সংসদে আইনটি উত্থাপন করা হয়েছে।
আমাদের দেশে এখনো প্রায় ৬৬ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। আর পরিণতি হচ্ছে মেয়েদের অকাল মাতৃত্ব এবং একইসাথে মা ও নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা।
শারীরিক গঠন পূর্ণাঙ্গ হওয়ার আগেই, অতঃপর সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে পুষ্টিহীনতায় ভোগে বাল্যবধূরা। তাছাড়া গর্ভধারণের বয়সে উন্নীত হওয়ার আগেই অল্পবয়সী বালিকাদের বিয়ে দিলে পরবর্তী সময়ে যে গর্ভধারণ হয় তা নবজাত শিশু ও মা উভয়ের জন্য বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক হতে পারে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বাল্যবিয়ের কারণে জরায়ুর ক্যান্সার হওয়ারও ঝুঁকি থাকে।
গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেশি । শুধু চট্টগ্রামে গত তিনমাসে প্রশাসন অথবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে ৪/৫টি বাল্যবিবাহ ভেঙে দেয়া হয়েছে। উত্তর বঙ্গে বাল্যবিবাহের হার এখনো বেশি। তবে সরকারের প্রচারণা ও উদ্যোগের কারণে বাল্যবিবাহের হার কমে আসছে।
মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এতে কিছুটা সফলতাও এসেছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নবজাতকের মৃত্যু প্রতি হাজারে ৪২ থেকে কমে ২৩ হয়েছে।
একটি মেয়ে তার স্কুলজীবন পেরোনোর আগেই বউ হচ্ছে, মা হচ্ছে। জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার পূর্বেই সংসার জীবনে প্রবেশ করছে। অথচ অন্য মেয়েদের মতো শিক্ষিত স্বাবলম্বী ও সুন্দর জীবনযাপনের ধারণার অধিকারী হতে পারত। বাল্যবিবাহের অবশ্যাম্ভাবী পরিণতি হলো অপরিণত গর্ভধারণ ও মাতৃত্ব। প্রতিবছর গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসবকালীন সমস্যার কারণে কমপক্ষে ৬০ হাজার বাল্যবধূ মারা যায়। বাল্যবিবাহের পরিণতিতে শুধু শিশু, অল্প বয়সী নারী বা তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এতে দেশও হয় অপুষ্টি ও দুর্বল প্রজম্মের উত্তরাধিকারী। পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা সামাজিক নেতারা যদি বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন না হয়, তাহলে এটা রোধ করা কঠিন হবে। সামাজিক সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কেবল বাল্যবিয়ে রোধ করতে পারে। আর নারী নিজেই সচেতন হয়ে উঠলে এ ঘৃণ্য অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে। মসজিদের খতিব-ইমামরাও ধর্মীর দৃষ্টিতে বাল্যবিবাহের কুফল বর্ণনা করে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারেন। এ বিষয়ে যদি সবাই একযোগে কাজ করে তবে বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে বালিকা, অভিভাবক, সমাজ ও রাষ্ট্র।