ইসলামে ইল্মে ফিকাহ্- অধ্যাপক মুহাম্মদ মাসুম চৌধুরী

0

ফিকাহ্ শব্দটি আরবী। এর অর্থ জানা, আত্মস্থ হওয়া। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় ক্বোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে শরিয়তের বিধি বিধান যা গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয় তা জানাকে ইল্মে ফিকাহ্ বলে। ইমাম আজম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মতে নফ্স ও আত্মার জন্য যা কল্যাণকর অথবা অকল্যাণকর সে সম্পর্কে জানাকে ইল্মে ফিকাহ্ বলা হয়। পবিত্র কোরআনে ফিকাহ্ শব্দটি বিশ জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। উনিশ স্থানেই গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞান অর্থে উল্লেখ হয়েছে। ইসলামে জ্ঞানকে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করা হয়েছে। যেমন, আকাইদ বিষয়ক জ্ঞানকে ‘ইল্মে কালাম,’ আধ্যাত্মিক বিষয়ক জ্ঞানকে ইল্মে তাসাউফ আর ইসলামী বিধিবিধান-আমলের জ্ঞানকে ‘ইল্মে ফিকাহ্’ বলা হয়।
ইল্মে ফিকাহ্’র বিষয়বস্তু হলো ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল, মুস্তাহাব, মোবাহ্, জায়েয-নাজায়েয, হারাম, মাকরূহ ইত্যাদি। এগুলো সম্পর্কে জানা ও তদানুযায়ী আমল করা অপরিহার্য।
মুসলমান ইহকাল ও পরকালের সফলতার উদ্দেশ্যেই এই জ্ঞান অর্জন করেন। ইহকালের সফলতার মধ্যে আছে, আল্লাহর হক এবং বান্দার হক সম্পর্কে অবহিত হয়ে তার উপর জীবন পরিচালনা ও মানব কল্যাণ সাধন করা। পরকালের সফলতা হলো আল্লাহর এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সাক্ষাত এবং শেষ বিচারে নাজাত তথা জান্নাত লাভ করা।
মহান আল্লাহ্ পাকের বাণী পবিত্র ক্বোরআন বুঝতে হলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র হাদিস বুঝতে হবে। হাদিস বুঝতে হলে ইল্মে ফিকাহ্ বুঝতে হবে। ইল্মে ফিকাহ্ ছাড়া ক্বোরআন এবং হাদিস বুঝা যাবে না। তাই আল্লাহ্ পাক পবিত্র ক্বোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘‘তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হয় না দ্বীনের ফিকাহ্ অর্জন করে যাতে তাদের দলকে সতর্ক করতে পারে।’’ [সূরা তাওবা: আয়াত ১২২] মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইলমে ফিকাহ্ সম্পর্কে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করেছেন। ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ পাক যার কল্যাণ চান তাকে ধর্মের ফিকাহ্ (জ্ঞান) প্রদান করেন। প্রত্যেক জিনিস মূল স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, ইসলামের স্তম্ভ হলো ফিকাহ্।
ফিকাহ্ শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন কতটা পুণ্যময় তা বর্ণনা করতে নবীজি আরো ইরশাদ করেছেন, ‘‘ফিকাহ্ শাস্ত্র আলোচনায় অল্প সময় ব্যয় করা ষাট বছর নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম।’’
ইসলামে নেতা হতে চাইলে আগে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, তারপর নেতৃত্ব দিতে পারে। যে ইসলামের বিধি জানে না সে নেতৃত্ব দিতে গেলে পথভ্রষ্টই হবে। ফিকাহ্ শাস্ত্রের জ্ঞান ব্যতীত ইসলামের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। তাই হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইরশাদ করেছেন, ‘‘নেতৃত্ব অর্জনের আগে ফিকাহ্ হাসিল কর।’’
ইল্মে ফিকাহ্ চর্চা প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সময়কাল হতে শুরু হয়। কিন্তু তখন এ শাস্ত্র নিয়ে বিতর্ক ছিল না, কারণ যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য মুসলমানগণ প্রিয় নবীজীর দরবারে হাজির হতো। তাঁর কাছ হতে সমাধান নিত এবং তাঁকেই অনুসরণ করতো। অনেক সমস্যা সমাধান আল্লাহ্ পাক পবিত্র ক্বোরআন পাকের আয়াত নাজিলের মাধ্যমে সমাধান করেছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র ওফাতের পর ইসলাম ধর্ম আরো ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে থাকে। দেশ-বিদেশের বহু জাতি গোষ্ঠীর কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছতে থাকে। ফলে সৃষ্টি হতে থাকে নতুন নতুন সমস্যা। এসব নতুন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ক্বোরআন-হাদিসের আলোকে গবেষণা করে ফিকহী সমাধান প্রদান করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ ক্বোরআন-হাদিসে ইসলামের মূলনীতিগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আছে, কিন্তু বিস্তারিত ব্যাপক বিশ্লেষণ নেই। তাই তাবেঈনের যুগে কিছু জ্ঞানী ইসলামের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা পবিত্র ক্বোরআনের আলোকে এবং হাদিসের অনুসরণে ইসলামী আইন শাস্ত্র প্রণয়নে হাত দেন। এ শাস্ত্রের মূলনীতিকে বলা হয় ‘উসূলে ফিকাহ্’ এবং ‘উসূলে ফিকাহ্’র যে আইন শাস্ত্র প্রণীত তাকে বলে ‘ফিকাহ্’। ইমাম আজম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ইমাম মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এবং ইমাম আবু ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি
সর্বপ্রথম ‘উসূলে ফিকাহ্’ গ্রন্থ রচনা করেন। যদিও গ্রন্থটি কোন এক কালে অজানা কারণে হারিয়ে যায়। হযরত ইমাম শাফেঈ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি উসূলে ফিকাহ্’র বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিসালায়ে উসূলে ফিকাহ্’ লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
ইমাম গায্যালী রাহমাতুল্লাহ্ িআলায়হি’র মতে ফিকাহ্ শব্দের অর্থ হলো শরিয়তের গভীর জ্ঞান অর্জন করা। তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এহইয়াউল উলুমুদ্দীন’-এ ফিকাহ্ শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জনকারীদের জন্য সাতটি বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন। তা হলো ১. দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্ত না হওয়া, ২. পরকালের সঞ্চয়ে আসক্ত হওয়া, ৩. ইসলামের গভীর জ্ঞানী হওয়া, ৪. তাক্ওয়াবান হওয়া, ৫. মুসলমানের অধিকার ও মান সম্মান সম্পর্কে সচেতন হওয়া, ৬. ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে জাতির কল্যাণে ব্রত হওয়া, ৭. সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত লালসা না করা। হযরত শাহ্ ওয়ালি উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর রচিত বিখ্যাত কিতাব ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’য় লিখেছেন, ‘মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র জামানায় ‘ফিকহ্’ শাস্ত্র সংকলিত হয়নি। কারণ সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে যেভাবে দেখতেন সেভাবে অনুসরণ করা গৌরবের মনে করতেন। সাহাবায়ে কেরাম নবীজির কোন কাজটি মর্যাদার এবং কোন কাজ তাঁর স্বভাব তা কোন দিন জানতে চাইতেন না। ইবাদতের উদ্দেশ্যে তিনি কোন কাজ সম্পাদন করেছেন তাও কোন দিন প্রশ্ন করতেন না। নবীজিকে যে কাজ করতে দেখতেন, তাঁরাও তা অনুসরণ করতেন। হযরতের অনুসরণই ছিল তাঁদের কাছে প্রাণের চেয়ে প্রিয়।
তখন কোন বিষয়ে ক্বোরনান-হাদিসের ফয়সালা না পেলে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে যিনি অধিক জ্ঞানী তাঁর কাছেই জানতে চাইতেন। কারণ পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেছেন, ‘‘যদি তোমরা না জান তাহলে জ্ঞানীদের নিকট হতে জেনে নাও।’’
সাহাবায়ে কেরামের পর তাবিঈনের যুগে ক্বোরআন-হাদিসের জ্ঞান সরাসরি সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণীয় বিষয় থেকে গ্রহণ করা হয়। তাবিঈনের যুগে এসে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবী এবং তাবিঈনের জীবন দর্শন, বাণী গবেষণা অনুসন্ধানের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে তখন থেকে মূলত ফিকাহ্ শাস্ত্রের সংকলন শুরু হয়।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •