[ মহাপরিচালক- আনজুমান রিসার্চ সেন্টার
আলমগীর খানক্বাহ্ শরীফ, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।]
মানুষের মধ্যে দু’টি শক্তি আছে- আক্বল (যুক্তি-বিবেক) এবং ইশ্ক্ব। কখনো কখনো মানুষের সামনে এমন এমন বিষয়ও উপস্থিত হয়, যা নিয়ে আক্বল ও ইশ্ক্বের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আক্বল বা বিবেক ওই বিষয়ে তার এমন যুক্তি পেশ করে যাতেও তার উপকার আছে বৈ-কি! কিন্তু তখন ইশ্ক্ব এমন সিদ্ধান্ত নেয়, যার সামনে বিবেক হতভম্ব হয়ে ইশ্ক্বের শুভ পরিণামের মহিমা দেখতে থাকে। বিশেষত বিষয়টি যখন আল্লাহ্ ও রসূলের ভালবাসা সম্পর্কিত হয় আর তখন নিজের প্রাণ, সন্তান-সন্তুতি ও ধনসম্পদ ইত্যাদির রক্ষা কিংবা ওইগুলো পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়ার প্রশ্ন জড়িত হয়। এমন মুহূর্তে বিবেক (আক্বল/যুক্তি) চূড়ান্তভাবে চেষ্টা চালায় যেন প্রাণ, সন্তান ও সম্পদ রক্ষা পেয়ে যায়। আর ইশ্ক্ব তখন আক্বল বা বিবেক/যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে সবকিছু বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনা এবং সামান্যটুকুও কালক্ষেপন করে না। এর অনেক উদাহরণ পেশ করা যায়; তবে-
এ যিলহজ্ব মাসের ক্বোরবাণীর প্রেক্ষাপট থেকে উদাহরণ পেশ করা যেতে পারে। এ ক্বোরবাণী আল্লাহর খলীল হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর সুন্নাত। ‘সুন্নাতু আবীকুম ইব্রাহী-মা।’ হজ্বেরও অনেক বিধান হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর বরকতমন্ডিত পরিবার-পরিজনের স্মৃতি বিজড়িত। আল্লাহ্ তা‘আলা এ সুন্নাত ও বিধানগুলো তাঁর হাবীবের মাধ্যমে ক্বিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন- ‘‘ওয়া তারাক্না-হু ফিল আখিরীন।’’
মানুষের কাছে দু’টি জিনিষ সর্বাপেক্ষা প্রিয় হয়- প্রাণ ও সন্তান। আল্লাহ্ তা‘আলা এ উভয়টির ক্বোরবাণী হযরত ইব্রাহীম খলীল আলায়হিস্ সালাম থেকে তলব করেছেন। আর তিনি উভয় কঠিন পরীক্ষায় অতি উত্তমরূপে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
এখানে প্রথমোক্ত ক্বোরবাণীর কথা আলোচনা করা যাক। হযরত ইব্রাহীম খলীল আলায়হিস্ সালামকে নমরূদের খোদায়ী দাবী ও মূর্তিপূজার কঠোর সমালোচনা ও বিরোধিতা থেকে বিরত রাখতে পারলোনা। তাই চিরদিনের জন্য তার ও মূর্তি-প্রতিমার বিরোধী শক্তিকে শেষ করার জন্য বিশাল অগ্নিকুন্ড তৈরী করলো এবং ‘মিনজানীক্ব’ দিয়ে তাঁকে ওই অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা করলো। এদিকে কাফিরদের উৎসব, আনন্দ-আহলাদ চলছে, অন্যদিকে আল্লাহর খলীলকে সাহায্য করার জন্য হযরত জিব্রাঈল উপস্থিত হলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে জবাব দিয়ে দিলেন। যা এক উর্দু কবি এভাবে বর্ণনা করেছেন-
جانتاهےوه ميرا رب جليل ـ آگ ميں پڑتاهے اب اس كا خليل
(আমার মহান রব জানেন, এখন তাঁর খলীল (ঘনিষ্ট বন্ধু) আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে)।
তখন তাঁর পবিত্র আক্বল (বিবেক) ও তার যুক্তি পেশ করলো- ‘হে ইব্রাহীম খলীল (আলায়হিস্ সালাম)! প্রাণতো অত্যন্ত প্রিয় বস্তুই হয়। আপনি কি ওই প্রাণটুকু বিসর্জন দিতে যাচ্ছেন?’ এক উর্দু কবি এটা এভাবে বর্ণনা করলেন-
عقل بولى كه بڑى شئ جان هے ـ عشق بولا يار پرقربان هے
(আক্বল বা বিবেক যুক্তি দিলো- প্রাণতো অতিমাত্রায় মহান বস্তু!
তার জবাবে ইশ্ক্ব বললো- ওই মহান বস্তুটিই আমার বন্ধুর জন্য ক্বোরবান করলাম।)
এদিকে আক্বল (বিবেক) তার যুক্তিগুলো পেশ করছিলো; ইত্যবসরে আল্লাহর ইশক্বের বলে বলীয়ান, হযরত খলীল অনায়াসে আগুনের জ্বলন্ত কুন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আল্লামা ইক্ববাল একটি পংক্তিতে অতি সুন্দরই বলেছেন-
بے خطر كود پڑا آتش نمرود ميں عشق ـ عقل تھى محوتماشاۓ لب بام ابھى
(নিদ্বির্ধায় নমরূদের অগ্নিকুন্ডে লাফ ছিলো ইশক্ব। আর আক্বল তখন অগ্নিকুন্ডের তীরে দাঁড়িয়ে ইশক্বের তামাশা (মহিমা) দেখছে।)
মা’শূক্বে হাক্বীক্বী আল্লাহ্ তা‘আলাও বললেন, হে আমার আশিক্ব, আমার খলীল, তুমি যখন আমার ইশক্বে আগুনে ঝাঁপ দিলে, আমিও আগুনকে নির্দেশ দিচ্ছি-
يَانَارُ كُوْنِىْ بَرْدًا وَسَلاَمًا عَلٰى اِبْرَاهِيْمَ
(হে আগুন, আমার ইব্রাহীমের জন্য শীতল হয়ে যা এবং শান্তি বিশিষ্ট মনোরম হয় যা)! সুবহানাল্লাহ!
দ্বিতীয়ত,
হযরত ইব্রাহীম আল্লাহর নির্দেশে আপন সন্তানকে হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালামকে ক্বোরবানী দিতে প্রস্তুতি নিলেন। শয়তান তাঁকে, হযরত হাজেরাকে এবং হযরত ইসমাঈলকে (আলায়হিমুস্ সালাম) তা থেকে বিরত রাখার জন্য অনেক যুক্তি দিলো; কিন্তু হযরত খলীলের ইশক্বে ইলাহীর সামনে কোনটাই কার্যকর হয়নি। অনুরূপ, হযরত হাজেরা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকেও এবং হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালামকেও বিন্দুমাত্র দ্বিাধাগ্রস্ত করতে পারেনি বরং হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম হযরত ইসমাঈলকে ক্বোরবাণীর প্রস্তাব দেওয়ার সাথে সাথে তিনি যে জবাব দিয়েছিলেন তা তো স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করার মতোই। তিনি বলেছিলেন- ‘‘ইয়া আবাতিফ্‘আল মা-তু’মারু সাতাজিদুনী ইনশা-আল্লাহু মিনাস্ সোয়া-বিরী-ন।’’ (হে আমার আব্বাজান, আপনি পালন করুন যার নির্দেশ আপনাকে দেওয়া হয়েছে, আমাকে আপনি ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।) সুবহা-নাল্লাহ্! আল্লামা ইকবাল বলে ওঠলেন-
يه فيضان نظر تها كه مكتب كى كرامت تهى
سكھاۓكس نے اسماعيل كو آداب فرزندى
এটা কি (হযরত ইব্রাহীম খলীলুল্লাহর) কৃপাদৃষ্টির প্রভাব ছিলো, না তাঁর মকতবের কারামত ছিলো? হযরত ইসমাঈলকে একজন অতি সুপুত্র সুলভ আদাব বা নিয়মাবালীকে শিক্ষা দিলো?
বলাবাহুল্য, হযরত ইসমাঈলতো ছিলেন তখন অল্পবয়স্ক কিশোর; অন্য কোন পার্থিব, উস্তাদের কাছেও কিছু পড়েননি? আর এমন কঠিন মুহূর্তে এমন দ্বিধাহীন ও সুন্দর জবাব দিলেন! তদুপরি, যেমন কথা তেমন কাজ।
আর আল্লাহ্ তা‘আলাও বলে দিলেন- ‘‘ক্বাদ সোয়াদ্দাক্বতার রু’ইয়া।’’ (হে ইব্রাহীম, তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করলে!) সুতরাং আল্লাহ্ বেহেশত থেকে দুম্বা পাঠিয়ে হযরত ইসমাঈলের পরিবর্তে সেটাকেই যবেহ করালেন। আর ক্বিয়ামত পর্যন্তের জন্য এ প্রিয় সুন্নাতকে স্মৃতি হিসেবে স্থায়ী করে দিলেন।
এখানে আরো একটি কথা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, হযরত খলীলুল্লাহ্র ক্বোরবানীর চেয়ে আমাদের প্রিয় নবী হাবীবুল্লাহ্ (আলায়হিমাস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম)-এর ক্বোরবানী অনেকগুণ বেশী উত্তম। তিনি আপন-দৌহিত্র হযরত হোসাঈনের প্রত্যক্ষ ক্বোরবাণীর ব্যবস্থা করেছেন। ঐতিহাসিক খায়বারে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিলো। ইত্যাদি।
পরিশেষে, আবারো বলা যাক-ইশক্ব ও বিবেকের দ্বন্দ্বে ইশক্বের চূড়ান্ত জয় হয়েছে। আল্লাহ্ আমাদেরকে প্রকৃত ইশ্ক্বে ইলাহী ও ইশ্ক্বে নবী দান করুন! আ-মী-ন।