عَنْ عبد الله بن عمر رضى الله عنهما اَنَّ رسول الله صلى الله عليه وسلم قال المسلم اخوالمسلم لايظلمه ولا يسلمة من كان فى حاجة اخيه كان الله فى حاجته ومن فرّج عن مسلم كربةً فرَّج الله عنه بها كربةً من كربات يوم القيامة ومن ستر مسلما ستره الله يوم القيامة – (رواه البخارى)
অনুবাদ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ভাইয়ের উপর জুলুম করবে না, তাকে বিপদে ফেলবে না, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে পাশে থাকবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তার প্রয়োজনে পাশে থাকবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের একটি বিপদ দূর করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার বিপদসমূহ দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ ত্র“টি গোপন রাখবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তার দোষত্র“টি গোপন রাখবে।
[সহীহ বোখারী শরীফ, হাদীস নম্বর ২৪৪২]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীস শরীফে বিশ্ব মানবতার ধর্ম, শান্তির ধর্ম ও কল্যাণের ধর্ম পবিত্র ইসলামে শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করণে আশরাফুল মাখলুকাত মানব জাতিকে সামগ্রিক কল্যাণের পন্থা অনুসরণের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এক মুসলমানকে অপর মুসলমানের ভাই হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ভাষা বর্ণ ও গোত্রের বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম উম্মাহকে এক ভ্রাতৃসংঘ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আঞ্চলিকতা বা ভৌগোলিক সীমা রেখায় আবদ্ধ চিন্তা চেতনা নয় সর্বজনীন বিশ্বজনীন কল্যাণকামীতাই ইসলামের অনুপম আদর্শ। পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের মুসলমান নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হওয়ার সংবাদ শুনে অন্য প্রান্তের মুসলমান ব্যথিত হবে তার ভাইয়ের সহযোগিতায় পাশে দাঁড়াবে, মজলুম মানবতার পাশে দাঁড়াবে, জালিম অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এটাই ইসলামের শিক্ষা, নবীজির আদর্শ। মুসলিম অর্থ শান্তিকামী, শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী। জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একজন মুসলমান নিরলসভাবে কাজ করে যাবে। অন্যের সহযোগিতায় প্রাচীরের মতো ভূমিকা পালন করবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن ابى موسى الاشعرى رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم المؤمن للمؤمن كالبنيان يشدُّ بعضه بعضا- (رواه البخارى)
হযরত আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ
করেছেন, মুমিন মুমিনদের জন্য প্রাসাদের ন্যায়, যার কিছু অংশ অপর অংশকে সুদৃঢ় করে। নির্মিত প্রাসাদ বা ভবনে ব্যবহৃত ইট এর গাঁথুনি পরপর যেভাবে সংযোগ বা স্থাপনাকে মজবুত ও শক্তিশালী করে থাকে তেমনিভাবে মুসলমানদের পারস্পরিক সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঐক্য বিশ্বের দরবারে মুসলিম উম্মাহকে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করে। মুসলমানদের আদর্শিক ঐক্যের ভিত যতই সুদৃঢ় ও শক্তিশালী হবে ইসলাম বিরোধী তাগুতি অপশক্তি গুলোর পরাজয় ততই দ্রুত ও নিশ্চিত হবে। মুসলমানদের আদর্শিক ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য প্রায়োজন পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মনোভাব।
সমাজের অসহায় দুস্থ, এতিম, নির্যাতিত নিপীড়িত সকল শ্রেণির মানুষের কল্যাণে সহযোগিতা প্রদর্শন করা একজন মুমিন মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য। বিশ্ব মানবতার কল্যাণকামী বিশ্বস্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উম্মতের কল্যাণ কামনায় এরশাদ করেছেন-
عن جرير بن عبد الله رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لايرحم الله من لايَرحَمُ الناس- (متفق عليه)
হযরত জরীর ইবনে আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ সে ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহ করেন না যে মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করে না।
[সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফ]
হাদীস বিশারদদের ব্যাখ্যা মতে সামর্থ ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কারো প্রতি দয়া অনুগ্রহ থেকে বিরত থাকে সে মহান আল্লাহর দয়া অনুগ্রহ ও রহমত বরকত থেকে বঞ্চিত হবে।
সুখে-দুঃখে আপদে সর্বদা আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা
দুঃখ-কষ্ট, ব্যাথা-বেদনা-যন্ত্রণা, সুস্থতা, অসুস্থতা, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, ভাল-মন্দ, সর্বাবস্থায় সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ফায়সালা ও তাকদিরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা সুখ শান্তি স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দের মুহূর্তে আল্লাহর দয়া অনুগ্রহ কৃপা ও মেহেরবানীর শুকরিয়া আদায় করা, আপদ-বিপদ-মুসিবত ও অশান্তির সময়ে ধৈর্য ধারণ করা কষ্ট সহ্য করা সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট।
মুমিনের প্রতিটি অবস্থায় কল্যাণ নিহিত রয়েছে
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে –
عن صهيب رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله وسلم عَجبًا لامر المؤمن اِنَّ امرَهُ كله خير وليس ذاك لاحد اِلَّا للمؤمن ان اصابته سراءُ شَكَرَ فكان خيرًا له- وان اصابته ضرّاء فكان خيرا له- (رواه مسلم)
অর্থ: হযরত সুহাইব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মুমিনের অবস্থা হলো আশ্চর্যজনক। নিশ্চয়ই মুমিনের প্রতিটি পর্যায়ে কল্যাণ নিহিত রয়েছে- যা মুমিন ব্যতীত অন্য কারো জন্য নেই। তাকে যদি কোন সুখ সাচ্ছন্দ্য পেয়ে বসে তখন সে শুকরিয়া আদায় করে তা তার জন্য কল্যাণ আনে। আর যদি দুঃখ দুর্শদশার শিকার হয় তখন ধৈর্য ধারণ করে তা তার জন্য কল্যাণ নিয়ে আসে। [মুসলিম শরীফ, হাদীস নম্বর ২৯৯৯]
মুসলিম ভাইয়ের সহযোগিতা করা
বর্ণিত হাদীসে মুসলিম ভাইয়ের সহযোগিতায় এগিয়ে আসার শিক্ষা রয়েছে, সহজ পন্থা অবলম্বনে অবস্থাভেদে সফলতা রয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
عن انس رضى الله عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم يسروا ولاتعسروا وبشرا ولاتنفروا- (رواه البخارى)
অর্থ: হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা সহজ করো, কঠোরতা অবলম্বন করো না। মানুষকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান করবে, জাহান্নামের ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবে না।
[সহীহ বুখারী শরীফ]
গোপনীয়তা রক্ষা করা
প্রতিটি বিষয় প্রকাশযোগ্য নয়, সমাজের এক শ্রেণির মানুষের অপরের দোষত্র“টি খুঁজে বেড়ায় তা অন্যের নিকট প্রচার ও প্রকাশ করে। এ ধরনের কাজ নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত। কোন অন্যায় অপকর্ম ও অপরাধ প্রত্যক্ষ করলে প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে অন্যায়কারী বা অপরাধীকে সতর্ক করবে। ভয়-ভীতি দেখাবে। সংশোধনের সুযোগ দেবে। একাধিক বার সতর্ক করার পরও সতর্ক ও সংশোধনের লক্ষণ দেখা না গেলে যথাযথ কতৃপক্ষ বরাবর যথানিয়মে অভিযোগ জানাবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে প্রতিকারের ব্যবস্থা করবে। কারো ব্যক্তিগত বিষয় বা কথা গোপন রাখা- এটা আমানত। হাদীস শরীফে গোপন কথা প্রকাশ না করে তা সংরক্ষণের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
عن انس بن مالك رضى الله عنه اسر الى النبى صلى الله عليه وسلم سرًّا فما اخبرت به احدًا بعده ولقد سالقنى ام سليم فما احبرتها به- (رواه البخارى)
অর্থ: হযরত আনাস ইবন মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট কিছু গোপন কথা বলেছিলেন। তারপর এ বিষয়ে আমি কাউকে অবহিত করিনি। উম্মে সুলাইম (আনাস রাদ্বি.এর মাতা) আমার কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন আমি তাকেও এ বিষয়ে অবহিত করিনি। [বুখারী শরীফ, হাদীস নম্বর ৬২৮৯]
সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
لا يستر عبدٌ عبدًا فى الدنيا الا ستره الله يوم القيامة-
অর্থ: দুনিয়াতে যে বান্দা অন্য বান্দার দোষত্র“টি গোপন রাখবে পরকালে আল্লাহ্ অবশ্যই সেই বান্দার পাপরাশিকে গোপন করে রাখবেন। মুসলমানদের ব্যক্তিগত দোষত্র“টি ও গুণাহের কাজসমূহ গোপন রাখা একটি সওয়াবের কাজ। এটি প্রকাশ করা গুনাহ তবে কোন ব্যক্তি যদি পাপকর্ম নিয়মিত করতে থাকে তবে উত্তম পন্থায় তা বাধা প্রদান করা ওয়াজিব। নিজে গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়ে তা অন্যের নিকট প্রকাশ করা মাকরূহ বরং নিজে তা থেকে বিরত থাকবে। এবং পুনরায় এ ধরনের অপরাধ না করার দৃঢ় সংকল্প করবে।
হিকমতপূর্ণ পন্থায় পাপাচার অন্যায় ও অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জড়িত ব্যক্তিকে সংশোধন করার প্রত্যয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। উগ্রপন্থায় ফিতনা ফ্যাসাদের পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নয়, শান্তিপূর্ণ পন্থায় সতর্কতা মূলক কৌশলে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাতে হবে। অসংখ্য হাদীস শরীফ দোষত্র“টির গোপনীয়তা রক্ষা করার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের উত্তম আদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক নসিব করুন। আ-মী-ন।