তাহাজ্জুদ নামাযের গুরুত্ব-
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি >
عن ابى امامة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم عليكم بقيام الليل فانه دأب الصالحين قبلكم وان قيام الليل قربة الى الله ومنهاة عن الاثم ومكفرة للسئيات ومطردة للداء عن الجسد [رواه الترمذى]
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم افضل الصيام بعد رمضان شهر الله المحرم وافضل الصلاة بعد الفريضة صلوة الليل [رواه مسلم]
অনুবাদ: হযরত আবু উমামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রাতের কিয়াম (তাহাজ্জুদের নামায) সালাত আদায় করা তোমরা আবশ্যক করে নেবে। কারণ তা তোমাদের পূর্ববর্তী নেক্কার লোকদের স্থায়ী অভ্যাস, আর রাতের কিয়াম (তাহাজ্জুদ) আল্লাহর নৈকট্য লাভের ও পাপ থেকে বিরত থাকার মাধ্যম এবং গুনাহ্ মাফের প্রতিকার এবং দেহ থেকে রোগব্যাধি বিতাড়িত করার উপকরণ। [তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং-১১৫৬]
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমজান মাসের সিয়ামের পর সর্বোত্তম সিয়াম হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররম মাসের সিয়াম, আর ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হচ্ছে রাতের সালাত, তাহাজ্জুদ নামায। [মুসলিম শরীফ] (01. Moharram সংখ্যা ডাউনলোড করুন)
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
ফরজ নামাযের পর শ্রেষ্ঠতর নামায হচ্ছে তাহাজ্জুদ নামায। বর্ণিত হাদীসসমূহে তাহাজ্জুদ নামাযের গুরুত্ব ও উপকারিতা বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে করীমা দ্বারা তাহাজ্জুদ নামাযের ফযীলত প্রমাণিত।
তাহাজ্জুদ অর্থঃ শব্দটি আরবি, পবিত্র কুরআনের সূরা বনী ইসরাঈলের ৭৯ আয়াতে শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। এর অর্থ রাত জাগা, নিদ্রা থেকে উঠা। তাহাজ্জুদ নামাযকে হাদীস শরীফে ‘‘সালাতুল লাইল’’ রাতের নামায হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে নিদ্রা ছেড়ে দেওয়ার অর্থে তাহাজ্জুদ শব্দটি ব্যবহৃত। তাহাজ্জুদ নামায যেহেতু নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয়ে আদায় করতে হয় এ কারণে তাহাজ্জুদ বলা হয়। তাহাজ্জুদ নামায আদায়ের জন্য রাতে কিছুক্ষণ ঘুমানো পূর্বশর্ত। অর্থাৎ রাতের প্রথম অংশে এশার নামায আদায়ের পর ঘুমোতে হয়। মধ্যরাত থেকে আরম্ভ করে সুবহে সাদিক পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করার সময়।
পবিত্র কুরআনে তাহাজ্জুদের বর্ণনা
মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল করীমের বিভিন্ন সূরায় অনেকগুলো আয়াতে তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও তাহাজ্জুদ আদায়কারী বান্দার প্রশংসা করা হয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন-ومن الليل فتهجد به نافلة لك عسى ان يبعثك ربك مقاما محمودًا অর্থঃ আপনি রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়–ন, এটা আপনার জন্য অতিরিক্ত দায়িত্ব। আশা করা যায় আপনার প্রভু আপনাকে প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন। [পারা-১৫, সূরা বনী ইসরাঈল, আয়াত-৭৯]
আমাদের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরজ। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ছয় ওয়াক্ত নামায ফরজ ছিল, রসূলে পাকের উপর তাহাজ্জুদ নামায ফরজ ছিল। এটা নবীজির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। উম্মতের জন্য তাহাজ্জুদ নামায সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্ আলাল কিফায়াহ। মহল্লার যদি কেউ না পড়ে সবাই সুন্নত বর্জনকারী হিসেবে গুনাহ্গার হবে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো এ নামায ত্যাগ করেননি।
ব্যাথা বা অন্য কোন কারণে যদি কোন সময় রাতের তাহাজ্জুদ নামায পড়তে না পারতেন, তখন তিনি দিনে ঐ পরিমাণ বার রাকাত নামায আদায় করে দিতেন। [মুসলিম শরীফ, হাদীস নং-১৬৪০]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা তাহাজ্জুদ আদায়কারী খোদাভীরু মুমিন মুত্তাকী বান্দাদের পরিচয় এভাবে ব্যক্ত করেছেন- كانوا قليلا من الليل ما يهجعون وبالا سحارهم يستغفرون অর্থঃ তারা কম ঘুমাতো এবং রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমা প্রার্থনা করতো। [সূরা যারিয়াত, আয়াত-১৭-১৮]
বর্ণিত আয়াতের তাফসীরে হাকীমুল উম্মত আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খান নইমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কৃত তাফসীরে নুরুল ইরফানে বর্ণনা করেন, তারা রাতে তাহাজ্জুদ ও ইবাদতের জন্য জাগ্রতাবস্থায় অতিবাহিত করতঃ কম সময় শয়ন করত। কম পরিমাণ শয়ন করাকেও নিজের জন্য দোষ মনে করে ভোরে ক্ষমা প্রার্থনা করতো। প্রতীয়মান হলো সারারাত নিদ্রা যাওয়া ভাল নয়। সমগ্র রাত জেগে থাকাও ভাল নয়। বরং রাতের প্রথম ভাগে নিদ্রা যাওয়া রাতের শেষ ভাগে তাহাজ্জুদের জন্য জেগে ওঠা, তারপর আরো কিছুক্ষণ শয়ন করা ওটাই সুন্নাত। তবে সতর্ক থাকতে হবে তাহাজ্জুদ নামায আদায়ের পর ঘুমানোর সুন্নাত আদায় করতে গিয়ে ফজরের নামায কাযা হয়ে যাওয়ার আশংকা হলে তাহাজ্জুদের পর নিদ্রামগ্ন না হয়ে ফজরের নামায আদায় করে নেয়াটাই উত্তম। কারণ তাহাজ্জুদের পর নিদ্রার কারণে ফজর নামায কাযা হয়ে গেলে তাহাজ্জুদের ফযীলত ও ফায়েদা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাবে।
সম্মানিত মদিনাবাসী আনসার সাহাবাগণ এশার নামায মসজিদে নবভী শরীফে আদায় করে নিজ নিজ ঘরে চলে যেতেন। অতঃপর সামান্য শয়ন করার পর জেগে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন। তারপর ফজর নামায মসজিদে নবভী শরীফে এসে জামাত সহকারে সম্পন্ন করতেন, তাঁদের এ আসা যাওয়াও ইবাদত ছিল।
বর্ণিত আয়াত থেকে আরো প্রতীয়মান হলো, রাতের শেষাংশে ইস্তিগফার ও দুআ প্রার্থনা করা অতীব ফলপ্রসু ও উপকারী। ফজরের সুন্নাত নামাযের পর সত্তরবার ইস্তিগফার ও পূর্বাপর দরুদ শরীফ পাঠ করা সর্বপ্রকার বিপদাপদ মুসীবত থেকে পরিত্রাণের রক্ষাকবচ। রিযকে বরকত লাভের উত্তম উপায়। তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের ফযীলত বর্ণনায় মহান আল্লাহ্ তা‘আলা আরো এরশাদ করেছেন- واللذين يبيتون لربهم سجد اوقيامًا
অর্থঃ এবং ওইসব লোক যারা রাত অতিবাহিত করে আপন রবের জন্য সিজদা ও কিয়ামের মাধ্যমে। [সূরা আল ফোরকান, পারা-১নং আয়াত-৬৪]
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে নুরুল ইরফানে উল্লেখ রয়েছে তাহাজ্জুদ নামায একটি উচ্চ পর্যায়ের ইবাদত। তাহাজ্জুদ নামাযে সিজদা ও কিয়াম অতি উত্তম রুকন। তাহাজ্জুদ নামায আদায় করলে সারা রাতের ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়।
রাতের সালাতে অধিক ফযীলত
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রকাশ্য দানের চেয়ে গোপন দানের মর্যাদা ও ফযীলত অধিক। তদ্রুপ দিবাকালীন (নফল) নামাযের তুলনায় রাতের সালাতের ফযীলত অধিক। [তাবরানী শরীফ, ফিকহুস্ সুনানি ওয়াল আসার]
তাহাজ্জুদ আদায়কারীর জন্য বেহেশতে বিশেষ মর্যাদা
হযরত আবু মালিক আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
ان فى الجنة غرفًا ترى ظاهرها من باطنها وباطنها من ظاهرها اعد الله لمن الان الكلام واطعم الطعام وتابع الصيام وصلى لليل والناس نيام [البيهقى]
অর্থঃ বেহেশতে এমন একটি উন্নত মানের কক্ষ রয়েছে, যার ভেতর থেকে বাইরে এবং বাহির থেকে ভেতরে দেখা যায়। আল্লাহ্ তা‘আলা তা নির্মাণ করেছেন ঐ ব্যক্তির জন্য যে ন¤্র কথা বলে মানুষকে খাবার খাওয়ায়। নিয়মিত রোজা রাখে। রাতের (তাহাজ্জুদ) নামায পড়ে যখন মানুষ নিদ্রামগ্ন থাকে। [বায়হাকী শরীফ, হাদীস নং-১১৬১]
তাহাজ্জুদের রাকাত সংখ্যা
ফিক্বহ্ শাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দুররুল মোখতার ফতোয়ায়ে শামী, আলমগীরি, ফতহুল কদীর প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহে তাহাজ্জুদ নামায কমপক্ষে দু’ রাকাত, চার রাকাত, আট রাকাত ও ঊর্ধে বার রাকাত পড়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে আট রাকাতের বর্ণনাটাই অধিক গ্রহণযোগ্যরূপে ফক্বীহগণের অভিমত প্রমাণিত। ফতওয়ায়ে শামীতে উল্লেখ রয়েছে- اقل التهجد ركعتان واوسطه اربع ركعات واكثره ثمان [شامى]
তাহাজ্জুদের সময়
অর্ধ রাতে ঘুম থেকে উঠার পর হতে সুবহে সাদিক তথা ফজরের নামাযের ওয়াক্ত শুরু হওয়া পর্যন্ত। রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ পড়া উত্তম। তাহাজ্জুদ নামাযে কেরাত বেশী পড়া উত্তম। মুখস্থ থাকলে বড় সুরা পড়া উত্তম। অন্যথায় যে কোন সুরা দিয়ে আদায় করা যাবে। সহজ পদ্ধতিতে দুই, দুই রাকাত করে নিয়ত বেঁধে প্রত্যেক রাকাতে একবার সূরা ফাতিহা আলহামদু শরীফ ও তিনবার সূরা এখলাস বা অন্য যে কোন সুরা দিয়ে এ নামায পড়া যাবে। এরপর তাসবীহ্ তাহলীল, দুআ, দুরুদ, যিকর আযকার সহকারে মুনাজাতের মাধ্যমে নামায সম্পন্ন করা অধিক ফলপ্রসূ ও কল্যাণকর।
শেষ রাতের দুআ বেশী কবুল হয়
হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন-
قيل لرسول الله صلى الله عليه وسلم اى الدعاء اسمع قال جوف الليل الاخر ودبر الصلواة المكتوبات [رواه الترمذي]
কোন দুআ বেশী কবুল হয়? নবীজি এরশাদ করেছেন শেষ রাতের মুনাজাত ও ফরজ নামাযের শেষের মুনাজাত। [তিরমিযী ২/১৮৮]
হযরত মুআয বিন জাবল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বললেন, হে মুআয, আমি তোমাকে ওসীয়ত করছি, প্রত্যেক নামাযের পর এ দু‘আ পড়াকে তুমি কখনো ছাড়বে না। হে আল্লাহ্, আমাকে তোমার যিকর, শোকর এবং উত্তম ইবাদত করার সাহায্য কর। [নাসাঈ ও আবু দাঊদ শরীফ]
রাতের নামাযে অধিক খোদাভীতি থাকে। লৌকিকতা বা লোক দেখানো থাকেনা। নিষ্ঠা ও একাগ্রতা বেশী থাকে। আরামের নিদ্রা ত্যাগ করে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করার কারণে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অধিক পরিমাণ অর্জিত হয়। তাহাজ্জুদ নামায নফল ইবাদতসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম ইবাদত। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রসূলের উম্মতদেরকে দয়া করে কতগুলো ঐচ্ছিক নফল ইবাদত দান করেছেন। যা নিয়মিত আদায় করলে আল্লাহ্ তা‘আলা বান্দাকে স্বীয় সন্তুষ্টি ও নৈকট্য দান করে থাকেন। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে তাহাজ্জুদ নামাযের ফযীলত বুঝা ও আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।