মদীনা মুনাওয়ারার গুরুত্ব ও ফযীলত-
অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান>
বিশ্বে মহাপূণ্যময় বরকতমন্ডিত তিনটি স্থান মুসলিম মিল্লাতের জন্য অপরিসীম গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ। মক্কা মুয়াজ্জমা, বায়তুল মোকাদ্দাস ও মদীনা মুনাওয়ারা। বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান আল্লাহর ঘর (কা’বা শরীফ) মক্কা (বাক্কা) মুয়াজ্জমা। হজ্ব ও ওমরাহকারীদের জন্য এ ঘর তাওয়াফ করা বাধ্যতামূলক। অন্যান্য আরো বরকতময় স্থান হচ্ছে মাকামে ইব্রাহিম, সাফা-মারওয়া, হাজরে আসওয়াদ, রুকনে ইয়ামনী, আবে জমজম প্রভৃতি। ভাগ্যবান মুসলমানগণ এ সকল গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানসমূহ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান যাদের নসীবে হজ্ব করা ও এসব নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়না তাদের মনপ্রাণ দুঃখ ভারাক্রান্ত থাকে। আল্লাহ্ সকল মুসলিম নর-নারীকে হজ্ব করার তাওফিক দিন, এ প্রার্থনাই করি।
এক কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নির্দেশে প্রিয় নবী তাঁর জন্মস্থান মক্কা নগরী ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করেন। তখন মদীনার নাম ছিল ইয়াসরীব নগরী। যতো প্রকার অনাচার অত্যাচার আছে সবই ছিল তখন এ নগরীতে। অরাজকতায় ভরা নগরীতে হুজুর করীমের শুভাগমনে ন্যায় ও ইনসাফের সুবাতাস প্রবাহিত হলো চতুর্দিকে। প্রিয়নবীর পদস্পর্শে উষর মরুভূমি সুজলা সুফলায় সবুজ সজীব হয়ে উঠল। সে সময় নবীজি ইয়াসরীব নগরীর (অরাজকতা) নাম পরিবর্তন করে মদীনা রাখলেন। তখন থেকেই ওই নগরীর নাম হলো মদীনাতুন্নবী। মদীনা তৈয়্যবা অতুলনীয় মর্যাদা ও অসংখ্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নগরী। এর সবচেয়ে বড় ফজিলত ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার কারণ হুযুর পুরনুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের অবস্থান। প্রিয় নবীজি রওজা মুবারকের সবুজ গম্বুজের নিচে আরাম করছেন বিধায় আল্লাহর হাবীবের পবিত্র রওজা মুবারক ধারণ করে মদীনা আজ চিরস্মরণীয়, কোটি কোটি মুসলমানের প্রাণাধিক অমূল্য ধন। কোন সফর শেষে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার জন্য প্রিয় নবী ব্যাকুল হয়ে উঠতেন। কাছাকাছি পৌঁছলে উটের গতি বাড়িয়ে দিতেন, মদীনায় পৌঁছেই তিনি প্রশান্তি লাভ করতেন। এ পবিত্র নগরীকে আবাসস্থল বানাতে এবং এখানে মৃত্যু কামনা করতেও উৎসাহ্ দিয়েছেন প্রিয়নবী। তাজেদারে মদীনা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ফরমান, ‘যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে আমার রওজা জিয়ারত করবে কেয়ামতের দিন সে আমার সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি মদীনায় বসবাস করবে এবং তার বিপদাপদের উপর ধৈর্য ধারণ করবে, কেয়ামতের দিন তার জন্য আমি সাক্ষী ও সুপারিশকারী হবো। আর যে ব্যক্তি দুই পবিত্র নগরীর (মক্কা মদীনা) যে কোন একটিতে মৃত্যুবরণ করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে নিশ্চিন্ত করে উঠাবেন।’’ অন্য একটি হাদীসে হুযুর করীম ফরমান, তোমাদের মধ্যে যার পক্ষে সম্ভব হয় সে যেন মদীনায় মৃত্যু বরণ করে। কেননা যে ব্যক্তি মদীনায় মৃত্যু বরণ করল, আমি তার জন্য সুপারিশ করব। পবিত্র মদীনার ফলমূলেও রয়েছে রোগব্যাধি নিরাময়ের বৈশিষ্ট্য, মদীনার মাটিকে ‘খাকে শিফা’ বলা হয়। প্রখ্যাত শায়খ আবদুল হক মোহাদ্দিসে দেহলভী নিজেও মদীনার মাটি দ্বারা চিকিৎসার বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখেছেন বলে জানান, মদীনায় অবস্থানকালে একবার তাঁর পা প্রচন্ড ফুলে যায়, চিকিৎসকরা এ রোগকে দুরারোগ্য ব্যাধি ও মৃত্যুর কারণ বলে মন্তব্য করেন। এরপর তিনি পবিত্র মাটি দ্বারা চিকিৎসা করেন এবং অল্প দিনের মধ্যে তাঁর পা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে। মদীনা মুনাওয়ারায় ‘আজওয়া’ নামক এক বিশেষ খেজুর রয়েছে, এগুলো অনেক উপকারি। হাদীসে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাবে সেদিন কোন বিষ ও যাদু তার ক্ষতি করতে পারবে না। প্রিয়নবী মদীনা নগরীর বরকতের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘‘হে আল্লাহ্! আপনি মক্কায় যে বরকত দান করেছেন, তার দ্বিগুণ বরকত মদীনায় দান করুন।’’ মহানবীর রওজা মোবারক যিয়ারত করা, মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করা, বরকতময় নগরীতে অবস্থান করা অতি সওয়াবের কাজ। প্রিয় নবীর রওজার পাশে দাঁড়িয়ে যিয়ারত করার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি আর কি হতে পারে (!)
মদীনাবাসী আনসার সাহাবীদের সম্পর্কে আল্লাহ্ ইরশাদ করেন, যারা মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে মদীনায় বসবাস করেছিল এবং বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তারা মুহাজিরদের ভালবাসে, মুহাজিরদের যা দেয়া হয়েছে, তজ্জন্য তারা অন্তরে ঈর্ষা পোষণ করে না এবং নিজেরা অভাবগ্রস্থ হলেও তাদের অগ্রাধিকার দান করেন, যারা মনের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম।
এই পূণ্যভূমিতেই সবুজ গম্বুজের ছায়ায় রওজা পাকে আছেন সৃষ্টির সেরা আল্লাহর হাবীব রহমাতুললিল আলামিন। এই রওজা মুবারক যিয়ারত করা একজন মুমিনের জন্য সারা জীবনের লালিত প্রত্যাশা। রওজা মুবারকে প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর রহমত ও বরকত নিয়ে ফেরেশতারা নাজিল হন। এ প্রসঙ্গে হযরত কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এমন কোনো ফজর পৃথিবীতে উদিত হয় না, যে ফজরে ৭০ হাজার ফেরেশতা রসূলের রওজা মুবারকে আসেন না। এরা এসে নবীর রওজা মুবারককে ঘিরে ফেলেন এবং তাদের পাখাগুলো বিছিয়ে নবীর উপর দুরূদ শরীফ পড়তে থাকেন সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যা হওয়া মাত্রই তারা চলে যান। আরো ৭০ হাজার ফেরেশতা অবতরণ করেন। পরে রওজা মুবারক ঘিরে পাখা বিছিয়ে নবীর ওপর দুরূদ শরীফ পড়তে থাকেন। এভাবে ৭০ হাজার রাতে ও ৭০ হাজার দিনে নবী পাকের রওজায় দরুদ শরীফ পড়তে থাকেন। এমনকি যেদিন কেয়ামত হয়ে যাবে সেদিন মাটি ফেটে রাস্তা হয়ে যাবে। এবং নবী রাহমাতুল্লিল আলামিন ৭০ হাজার ফেরেশতার মধ্য থেকে বের হবেন। প্রিয়নবী বলেন, আমাদের এমন এক নগরীতে বসবাসের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা মর্যাদায় সব শহরকে ছাড়িয়ে যাবে। মানুষ তাকে ইয়াসরীব বলে। তা মন্দ লোকদের এমনভাবে দূর করে দেবে যেমন কামারের ভাটি লোহার ময়লা দূর করে। প্রিয় নবী আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি মদিনার অধিবাসিদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে চায়, আল্লাহ্ তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, যেভাবে লবণ পানির মধ্যে মিশে যায়। মদীনা থেকেই ঈমানের আলো সারা বিশ্বে বিচ্ছুরিত হয়েছিল। শেষ যুগে মানুষ যখন ঈমান থেকে বিচ্যুত হতে থাকবে, তখন ঈমান তার গৃহে তথা মদীনার দিকে ফিরে আসবে। যেভাবে সাপ গর্তের দিকে ফিরে আসে। দাজ্জালের আবির্ভাবের ফিতনা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়লে মানুষ ভীত সন্ত্রস্থ হবে। বিশ্বের সর্বত্র বিচরণ করতে সক্ষম হলেও তখন দাজ্জাল পবিত্র মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। মক্কা-মদীনার প্রতিটি প্রবেশপথ ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে পাহারা দেবেন। তখন মদীনা তার অধিবাসীসহ তিনবার কেঁপে উঠবে। আর সব কাফির ও মুনাফিক মদীনা ছেড়ে চলে যাবে। মক্কার মতো মদীনায়ও হারাম শরীফ আছে। এ ব্যাপারে আল্লাহর নবী বলেন, ‘ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম মক্কাকে সম্মানিত করে একে হারাম করেছেন, আর আমি মদীনাকে এর দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানকে যথাযোগ্যভাবে সম্মানিত করে হারাম ঘোষনা করলাম।’ হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী করিম বলেছেন, ‘হে আল্লাহ্! তুমি মদিনাকে আমাদের কাছে এমনই প্রিয় করে দাও যেমনি প্রিয় করেছ মক্কাকে। বরং তার চেয়েও বেশি প্রিয় করে দাও। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, মসজিদে নববীতে যদি কেউ এক ওয়াক্ত নামায আদায় করেন তবে ৫০ হাজার ওয়াক্ত নামাজের সওয়াব পাবেন। মসজিদে নববীতে একাধিক্রমে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়ার ফযিলত সম্পর্কে নবী করীম বলেন, যে ব্যক্তি আমার মসজিদে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে আর কোনো নামাজ ক্বাযা করেনি সে নিফাক আর দোযখের আজাব থেকে নাজাত পাবে, মদিনা মুনাওয়ারা যিয়ারত করা ও প্রিয়নবীর ওসীলা নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করার জন্য পবিত্র কুরআনপাকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে।
পবিত্র কুরআন মজিদে এরশাদ হচ্ছে, যখন তারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করবে, তারা আপনার নিকট আসবে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নিকট মাগফিরাত তলব করবে, এবং রসূলুল্লাহ্ও তাদের জন্য মাগফিরাত তলব করবেন, তখন নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের তাওবা কবুল করবেন। করুণা প্রদর্শন করবেন, যদি মহান রসূলও তার জন্য ক্ষমা চান। এতে বুঝা যায়, মহানবী জিয়ারতকারিকে দেখেন, শোনেন, জানেন এবং তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান, তার জন্য দোয়া করেন। এজন্য তাঁকে ‘হায়াতুন্নবী’ বলা হয়। অপর এক হাদীসে আরো স্পষ্টভাবে আছে, নবীজি বলেন, আমার দুনিয়ার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং আমার ওফাতও তোমাদের জন্য কল্যাণকর। মদীনায় যাওয়া নিছক কোন ভ্রমণ নয়। বরং তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আর তা হতে হবে রওজা পাকের যিয়ারতের উদ্দেশ্যেই। দুনিয়ার রওজাসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশি যিয়ারতের উপযুক্ত স্থান হলো রসূলে পাকের রওজা। এ কথায় পূর্বাপর সব ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্য রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, হাদীসে আছে নবী পাক বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর হজ্ব করবে অতঃপর আমার কবর জিয়ারত করবে, সে যেন জীবিত অবস্থায় আমার সঙ্গে সাক্ষাত করল। যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আমার যিয়ারত করবে সে কেয়ামতের দিন আমার প্রতিবেশি হিসেবে থাকবে। আর সেদিন আমি তার জন্য শাফায়াত করব। যে ব্যক্তি মক্কায় হজ্ব করল অতঃপর আমার মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল তার আমলনামায় দু’টি মকবুল হজ্ব লেখা হবে। মদীনা শরীফের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে সে যেন মৃত্যু পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করে, যে ব্যক্তি মদীনায় মারা যাবে তার জন্য আমি নিশ্চয়ই সুপারিশ করব।’ এজন্য নবী প্রেমিকগণ মদীনায় মৃত্যুবরণের জন্য দোয়া করতেন। হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দোয়া করেছিলেন, হে আল্লাহ্ আমাকে তোমার হাবীবের শহর মদীনায় মৃত্যুমুখে পতিত কর, [বুখারী]। আল্লাহ্ পাক তাঁর দোয়া কবুল করেছেন। ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সারা জীবনই মদীনায় অতিবাহিত করেছেন। কেবলমাত্র ফরজ হজ্ব করার জন্য এক বছর মক্কায় গিয়েছিলেন। প্রিয়নবীর মহব্বতে তিনি কখনো মদীনা ত্যাগ করেননি। মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা নববী লিখেছেন, হজ্ব এবং ওমরাহকারীগণ মক্কা শরীফ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে রওজা পাকের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা শরীফও সফর করবেন। [সূত্র. মহানবীর স্মৃতি বিজড়িত মদীনা, লেখক, মোস্তফা কাজল]