দরসে কোরআন-
হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী>
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
سَبَّحَ لِلّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۖ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ﴿١﴾ هُوَ الَّذِي أَخْرَجَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ مِن دِيَارِهِمْ لِأَوَّلِ الْحَشْرِ ۚ مَا ظَنَنتُمْ أَن يَخْرُجُوا ۖ وَظَنُّوا أَنَّهُم مَّانِعَتُهُمْ حُصُونُهُم مِّنَ اللهِ فَأَتَاهُمُ اللهُ مِنْ حَيْثُ لَمْ يَحْتَسِبُوا ۖ وَقَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ ۚ يُخْرِبُونَ بُيُوتَهُم بِأَيْدِيهِمْ وَأَيْدِي الْمُؤْمِنِينَ فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ ﴿٢﴾ وَلَوْلَا أَن كَتَبَ اللهُ عَلَيْهِمُ الْجَلَاءَ لَعَذَّبَهُمْ فِي الدُّنْيَا ۖ وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابُ النَّارِ ﴿٣﴾ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ شَاقُّوا اللهَ وَرَسُولَهُ ۖ وَمَن يُشَاقِّ اللهَ فَإِنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ ﴿٤﴾
আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
তরজমা ঃ আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে যা কিছু রয়েছে নভোমন্ডল এবং যা কিছু রয়েছে ভূ-মন্ডলে। এবং তিনিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। তিনিই কিতাবীদের মধ্যে যারা কাফির, তাদেরকে তাদের বাড়ি-ঘর থেকে বহিষ্কার করেছেন প্রথম সমাবেশের জন্য, তোমাদের ধারণা ছিল না যে, তারা বের হবে এবং তারা মনে করতো যে, তাদের দূর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করবে। অতঃপর আল্লাহর (শাস্তির) নির্দেশ তাদের নিকট আসল এমন দিক থেকে যার কল্পনাও তারা করেনি, এবং তিনি তাদের অন্তর গুলোতে ভয়-ভীতির সঞ্চার করলেন। তারা তাদের বাড়ী-ঘর নিজেদের হাতে এবং মুসলমানদের হাতে ধ্বংস করছিল। সুতরাং শিক্ষা গ্রহণ করো। হে দৃষ্টি শক্তি সম্পন্নরা! আর আল্লাহ যদি তাদের জন্য নির্বাসন অবধারিত না করতেন তবে পৃথিবীতেই তাদের উপর শাস্তি আপতিত করতেন। এবং তাদের জন্য রয়েছে পরকালে আগুনের শাস্তি। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহ ও র্তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে তবে নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তি দানকারী। [১-৪ নং আয়াত- সূরা হাশর]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
পবিত্র কুরআনে করীমের যে সকল সূরা سبّح অথবা يسبّح শব্দের মাধ্যমে শুরু হয়েছে মুফাসসেরীনে কেরাম সেগুলোকে مسبّحات বলে অভিহিত করেছেন। تسبيح মানে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পবিত্রতা বর্ণনা করা। সূরা “আল-হাশর” ও مسبّحات এর অন্যতম। এসব সূরায় নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর জন্য আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনার বিষয়টি বিশদভাবে প্রমাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আশরাফুল মাখলুকাত মুমিন নর-নারীগণকে যেন উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে সম্ভাব্য সব সময় মহা প্রজ্ঞাময় ¯্রষ্টা আল্লাহর পবিত্রতা, গুনগান বর্ণনায় মশগুল হতে। অবস্থার মাধ্যমে এই পবিত্রতা পাঠ সকলেরই বোধগম্য। কারণ, সৃষ্টিজগতের প্রতিটি অনু-পরমানু তার সর্বশক্তিমান ¯্রষ্টার প্রজ্ঞা ও অপার শক্তি-সামর্থ্যের সাক্ষ্যদাতা। এটাই তার তাছবিহ পাঠ। তবে যথার্থ সত্য এই যে, প্রত্যেক বস্তু তার নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গিতে আক্ষরিক অর্থে তাছবীহ পাঠ করে। কেননা, মহান আল্লাহ প্রত্যেক জড় ও অজড় পদার্থের মধ্যে তার সাধ্যানুযায়ী চেতনা ও অনুভূতি রেখেছেন। এই চেতনা ও অনুভূতির অপরিহার্য দাবী হচ্ছে পবিত্রতা বর্ননা করা। কিন্তু এসব বস্তুর তাছবীহ পাঠ মানুষ শ্রবণ করে না। যেমন, কুরআনে করীমে এরশাদ হয়েছে- وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ
তরজমা: জগতের সকল বস্তুই আল্লাহর গুনগান সহ পবিত্রতা বর্ননা করে, যদিও তোমরা তাদের তাছবীহ পাঠ অনুধাবন করতে পার না। [সূরা বনী ইসরাঈল: আয়াত-৪৪]
উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ সূরার শুরুতে অতীতকাল জ্ঞাপক পদ سبّح উল্লেখিত হয়েছে। শুধু সূরা জুমুআহ ও সূরা তাগাবুন এর শুরুতে ভবিষ্যৎকাল জ্ঞাপক পদ يسبّح ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষায় অলংকার শাস্ত্র এর মতে অতীতকাল জ্ঞাপক পদ নিশ্চয়তা বোঝায়। এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাই ব্যবহৃত হয়েছে। আর ভবিষ্যৎকাল জ্ঞাপক পদ সদা সর্বদা হওয়া যায়। তাই এ অর্থ বোঝানোর জন্য দুই সূরার প্রারম্ভে এ পদ ব্যবহার করা হয়েছে।
শানে নুযুল
সূরা আল-হাশর এর শানে নুযুল বর্ণনায় মুফাচ্ছেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-এ সূরা পবিত্র মদীনা মুনাওয়ারায় ইয়াহুদী গোত্র “বনু নুযায়র” প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। এ জন্য মুফাস্সিরকূল সরদার সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লহু আনহুমা এটাকে “সূরা বনী নুযায়র” বলে আখ্যায়িত করতেন। রাসূলে আকরম নূরে মুজাস্সাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনা শরিফে আপন শুভাগমনের আলো বিচ্ছুরিত করলেন তখন তারা আল্লাহর হাবীবের সাথে এ শর্তে সন্ধিতে উপনীত হলো যে, আমরা নিরপেক্ষ থাকবো, না আপনার বিরুদ্ধে লড়বো, না আপনার বিরুদ্ধে শত্রুদের পক্ষাবলম্বন করে তাদের কে সহযোগিতা করবো।
অতঃপর যখন “বদর” যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরিচালনায় মুসলমানরা বিজয়ী হলেন তখন বনু নুযায়র গোত্রের লোকেরা রাসূলে খোদা (দঃ) এর ভূয়সী প্রশংসা করে বলতে লাগলো “ইনি ওই রাসূলই হোন যাঁর বর্ণনা তওরাত শরীফে রয়েছে।” আবার যখন ওহুদ যুদ্ধে বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের কিছুটা বিপর্যয় ঘটলো, তখন এরা মুসলমানদের প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন করতে লাগলো। তাদের নেতা কা’ব বিন আশরাফ চল্লিশজন সঙ্গী-সহচর সহ পবিত্র মক্কায় এসে খানায়ে কা’বার গিলাফ শরীফ জড়িয়ে ধরে মক্কায় কাফেরগনের সাথে আল্লাহর হাবীবের বিরুদ্ধে অবস্থানের জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো। যার ফলশ্রুতিতে “আহযাবের যুদ্ধ” সংঘটিত হলো। এ বিশ^াস ঘাতকতার জন্য রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে হযরত মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা কা’ব বিন আশ্রাফকে হত্যা করলেন। বনু নুযায়র গোত্রকে অবরুদ্ধ করা হলো তাদের বস্তিতে। মুনাফিকগণ বাহ্যত সহানুভুতি প্রদর্শন করলেও বাস্তবে বনু নুযায়র এর সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। তারা বনু নুযায়র এর সাথে বিশ^াস ঘাতকতা প্রদর্শন করল। দীর্ঘ একুশ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর তারা পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারা ছেড়ে অন্যত্র নির্বাসিত হতে সম্মত হলো। অবশেষে বুন নুযায়র পবিত্র মদিন ছেড়ে সিরিয়া, আরিহা ও খাইবার এর দিকে চলে গেল। আর মুমিনগণ তাদের অনিষ্ট হতে নিরাপদ হলেন। [তাফসীরের খাযায়্নেুল ইরফান ও নুরুল ইরফান শরীফ]
سَبَّحَ لِلَّـهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ الخ
আল্লাহর পবিত্র বাণী “নভোমন্ড ও ভু-মন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করে। ” এর মর্ম বাণীর আলোকে প্রমাণিত হয় যে, “জিন ও ইনসান” ব্যতীত অন্য কোন সৃষ্টির মধ্যে কাফির-মুশরিক তথা মহান আল্লাহর অবাধ্য ও অস্বীকারকারী কেউ নেই। বরং দৃশ্যমান ও অদৃশ্য, জীব-জড়, ক্ষুদ্র-বৃহৎ,অনু-পরমানু নির্বিশেষে সকল সৃষ্টিই মহা প্রজ্ঞাময় আল্লাহ রব্বুল আলামীনের অনুগত-বাধ্যগত। সর্বক্ষণ আল্লাহর পবিত্রতা-মহিমা বর্ণনায় নিয়োজিত। কুরআনে হাকিমে অসংখ্যবার এ বিষয়টি উল্লেখ করে মহান আল্লাহ মুমিনগণকে তাগিদ দিয়েছেন তারাও যেন অন্যান্য সৃষ্টির ন্যায় ¯্রষ্টার অনুগত-বাধ্যগত হয়। সম্ভাব্য সবসময় মহান আল্লাহর তাছবীহ-তাহলীল পাঠের মধ্যে দিয়ে নিজের ভিতরগত সত্ত্বাকে যেন আলোকিত করে।
هُوَ الَّذِي أَخْرَجَ الَّذِينَ كَفَرُوا
আল্লাহর পবিত্র বাণী “তিনিই, যিনি কিতাবী কাফিরগণকে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন প্রথম সমাবেশের জন্য”এর ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-মদীনা মুনাওয়ারায় বসবাসরত ইয়াহুদীগোত্র বনু নুযায়র কর্তৃক রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে আল্লাহর নবীকে গোপনে হত্যার ষড়যন্ত্র করা, ইসলাম আর মুসলমানদের মোকাবেলায় মক্কায় কাফের-মুশরেকদের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হওয়া এবং আহযাবের যুদ্ধে মক্কায় কাফের-মুশরেকদেরকে সাহায্য করা ইত্যাদি কারণে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে পবিত্র মদীনার পুণ্যভূমি থেকে চিরতরে বহিষ্কার করলেন। তারা একুশদিন যাবত তাদের দূর্গে অবরুদ্ধ থাকার পর অবশেষে মদীনা মুনাওয়ারা ত্যাগ করতে বাধ্য হলো। এখানে দৃশ্যতঃ আল্লাহর হাবীবই তাদেরকে মদীনা মুনাওয়ারা হতে নির্বাসিত করলেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন “সূরা হাশর” এর আলোচ্য দ্বিতীয় আয়াত هُوَ الَّذِي أَخْرَجَ الَّذِينَ كَفَرُوا অবতীর্ণ করে বিশ্ববাসীর সামনে ঘোষণা করলেন-আমি আল্লাহই ইয়াহুদী গোত্র “বনু নুযায়র” কে তাদের বাড়ী-ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। এহেন ঘোষণার মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে জানিয়ে দিলেন-হাবীবে খোদা আশরাফে আম্বিয়া মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম মহান আল্লাহর নিবিড়তম, ঘনিষ্টতম ও পরম প্রিয়তম সুহৃদ। তাঁর প্রতিটি মহিমান্বিত কথা, কর্ম ও সিদ্ধান্ত যেন স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মহিমান্বিত কথা, কর্ম ও সিদ্ধান্ত। এ ক্ষেত্রে কোনরূপ পার্থক্য কিংবা তফাৎ-তারতম্যের দেয়াল নির্মাণের সুযোগ নেই ঈমানদারের জন্য। এ বিষয়ের উপর কুরআনে করীমে অসংখ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। মহান আল্লাহ সকল কে উপরোক্ত সত্য হৃদয়ঙ্গম করার তৌফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক: অধ্যক্ষ কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর, এফ ব্লক, ঢাকা।